ব্যাংক খাত-শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি by মনজুর আহমেদ


ব্যাংক খাতের ওপর বিগত তিন বছরে রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক নেতৃত্ব ও গোষ্ঠীগত প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। এ সময় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনসহ সব ধরনের ব্যাংকের সুশাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়েছে। ব্যাংকগুলো অধিক মাত্রায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে ঝুঁকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা শক্ত হাতে আটকাতে পারেনি। বর্তমান সরকার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ব্যাংকিং বিভাগ তৈরি করে বিশেষত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের


সমান্তরাল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এসব ব্যাংকের পরিচালনায় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতিও গত তিন বছরে অনেকটাই নাজুক হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিকবার সরকারকে সতর্ক করলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় তা আমলে নেয়নি সরকার।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে এর আগে কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু এখন এর পুরো কর্তৃত্ব চলে গেছে সরকারের ব্যাংকিং বিভাগের হাতে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সর্বশেষ দেওয়া তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, এই ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহী নিয়োগ থেকে শুরু করে পরিচালকমণ্ডলীর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তেমন কিছু করণীয় নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বিতীয় গভর্নর এ কে এন আহমেদ তাঁর একটা প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ব্যাংকব্যবস্থায় সরকারের ঋণ কতটা আটকে রাখা যায়, তার ওপরই নির্ভর করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি।’ গত দুই বছরে বর্তমান সরকারের ঘোষিত আর্থিক কার্যক্রমের চেয়ে ব্যাংক খাতে বেশি ঋণ করার এই বিষয়টি বারবার আলোচনায় এসেছে। আর এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতিও অনেকাংশে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান দুটি মূল নীতি হচ্ছে: স্থিতিশীল মুদ্রানীতি পরিচালনা ও ব্যাংক খাতের ওপর তদারকি-নজরদারির ভিত্তিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমান সরকারের তিন বছরে এসব ক্ষেত্রে তেমন অর্জন চোখে পড়েনি। এ সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আইন ভেঙে শেয়ারবাজারে ঢুকে পড়ে। কিন্তু রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত প্রভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ কাজে ব্যাংকগুলোকে যথাসময়ে নিবৃত্ত করতে পারেনি, বরং নির্লিপ্ত থেকেছে।
তবে অর্জনও কিছু হয়েছে। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক আরও অধিক সংখ্যক মানুষকে ব্যাংকিং সেবার মধ্যে আনতে পেরেছে। ১০ টাকায় কৃষকের ব্যাংক হিসাব খোলা, কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে (এসএমই) ঋণ বৃদ্ধিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রবল উৎসাহ ছিল। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বয়ংক্রিয় নিকাশঘর (অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউস) ও ঋণ তথ্যভান্ডার (অনলাইন সিআইবি) ব্যাংকিং সেবায় এক ধাপ অগ্রগতি এনেছে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এ সময়ে ব্যাংকিং সেবা অধিক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি এনেছি। ব্যাংকগুলোর ওপর নজরদারি জোরদার করতে অনেকগুলো কাজ চলছে। সেবা গ্রহীতাদের অভিযোগ সরাসরি জানা এবং তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক তৎপরও আছে।’
সরকারের ব্যাংকঋণ ও মুদ্রানীতির অগ্রগতি নিয়ে গভর্নর বলেন, বিশ্বমন্দা ও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকে বেশি ঋণ করতে হয়েছে, এটা ঠিক। তবে মুদ্রানীতির সব লক্ষ্যমাত্রা কিন্তু সীমার মধ্যেই আছে।
শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর আইনি সীমার (আমানত ও মূলধন মিলে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ) অধিক ও ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ ছিল গত তিন বছরে আর্থিক খাতে সবচেয়ে আলোচিত-সমলোচিত বিষয়। ২০০৯ সালের মধ্যভাগে এসে ব্যাংকগুলোকে শেয়ারে বিনিয়োগ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েও এসইসি ও ডিএসইর চাপে তা কার্যকর করতে পারেনি। এ সময় শিল্পে জোগান দেওয়া ঋণ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। গত তিন বছরে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের আর্থিক মানেরও অবনতি হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ সংশোধনে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সংসদে এই আইনটি আর অনুমোদন করা হয়নি। নতুন করে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের প্রস্তাবটি এখনো চাপের মধ্যে রয়েছে। অন্যদিকে নতুন ব্যাংক স্থাপনের সম্পূর্ণ আইনি কর্তৃত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকলেও সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ একমত না হলেও সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিয়েছে।
সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলোতে সুশাসন, ব্যবস্থাপনার মান, তহবিল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে শিথিলতা লক্ষ করা গেছে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে মূল ধারার ব্যাংকিং ততটা নজরে আনেনি। বরং সাইড লাইনে চলে গেছে। কিন্তু, দুটোকেই একত্র করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.