শ্রদ্ধাঞ্জলি-স্যারের ফোন বেজে চলেছে... by অজয় দাশগুপ্ত
পান্না স্যার বাসায় ছাত্র পড়াতেন। অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী তার বাসায় প্রতিদিন আসত। কোচিং সেন্টার বলতে যা বোঝায় তা তিনি অনুসরণ করতেন না। পড়াতেন যত্ন করে। প্রত্যুষে কিংবা সন্ধ্যার পরও মেয়েদের তার বাসায় পাঠাতে অভিভাবকদের বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা হতো না। শুধু গৈলা নয়, আশপাশের অনেক স্কুল থেকে তার কাছে পড়তে আসত ছাত্রছাত্রী। যার পরিবারে অসচ্ছলতা তার কাছ থেকে কম অর্থ নিতেন।
তার আন্তরিকতার পরশ মিলত পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারেও। রোদে পুড়ে বা বৃষ্টিতে ভিজে আসা ছাত্রছাত্রীদের মিলত সেবাযত্ন, তারপরে পাঠাতেন পড়ার টেবিলে। ধর্মে ভেদাভেদ নেই, ধনী-দরিদ্রে পার্থক্য নেই। কখনও মারধর করতেন না। এ যেন এক ভিন্ন জগৎ
বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার নিভৃত এক গ্রাম ভদ্রপাড়ায় মারুফ-শারমিন স্মৃতি পাঠাগারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা ছিল তার। কিন্তু মৃত্যু এসে এমন অলঙ্ঘনীয় দেয়াল তুলল, যা কেউ ভেদ করতে পারে না। এ পাঠাগারের উদ্যোক্তা মেজর শামসুল আলম স্মৃতিচারণ করলেন তার প্রিয় শিক্ষক পান্নালাল কর্মকারের এভাবে : 'স্কুলে পড়ার সময় জীবনের লক্ষ্য কী_ জানতে চেয়েছিলেন তিনি। আমি জানালাম, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাই। স্যার বলেন, কাল সকাল ৯টায় দেখা করিস। আমার তখন ঘড়ি ছিল না। বাড়ি থেকে সূর্য দেখে রওনা হয়ে স্যারের বাসায় হাজির হলে নিজের ঘড়ি দেখে বলেন, সময়মতো এসেছিস। সেনাবাহিনীতে সময়ানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা থাকতেই হবে।'
পান্নালাল কর্মকার ২৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। বাড়ির পাশেই স্কুল। পড়াতেন ইংরেজি। অঙ্কেও পারদর্শী ছিলেন এবং অনেকের কাছে জটিল হিসেবে বিবেচিত এ বিষয়টিও বুঝিয়ে দিতেন সহজ করে। শিক্ষকতার দীর্ঘ সময়ে কোনোদিন স্কুল কামাই হয়নি। বড় অসুখে পড়েননি কোনোদিন। আর ছোটখাটো সমস্যা গায়ে মাখেননি। ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বাড়ির লাগোয়া বাজারে গেলেন, এই আসছি বলে। কিন্তু অলক্ষ্যে মৃত্যু এলো, ঘরে ফিরতে হলো পরের কাঁধে চেপে_ যা ৭২ বছরের জীবনে কখনও চাননি। ১৮৯৩ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত গৈলা স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক কৈলাশ চন্দ্র সেনের সমাধিসৌধে লেখা রয়েছে : 'ডেথ ডিভাইডস, মেমরি লিঙ্গারস।' মৃত্যুর প্রায় আট দশক পরও গৈলা এবং আশপাশ এলাকার মানুষ তাকে স্মরণ রেখেছে। তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরির মোহ ত্যাগ করে প্রত্যন্ত গ্রামে চলে এসেছিলেন জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে। প্রায় সাড়ে তিন দশক কাজ করেছেন স্কুলে। একই সঙ্গে পার্শ্ববর্তী আগৈলঝাড়ায় ভৈগাই হালদার পাবলিক স্কুল গড়ে তুলতে সক্রিয় সহায়তা দিয়েছেন। দায়িত্ব নিয়েছেন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির। দশকের পর দশক ধরে তিনি হয়ে আছেন নমস্য। পান্নালাল কর্মকারের মতো আরও অনেকের আদর্শ তিনি।
পান্না স্যার অবসর নিয়েছেন কয়েক বছর আগে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা তাকে স্মরণে রেখেছে। মৃত্যুসংবাদ মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের গণ্ডি ছাড়িয়ে বরিশাল, ঢাকা ও অন্য শহরে এবং দেশের বাইরে। তার টেলিফোন নম্বর জানা ছিল অনেকের। সেই নম্বরেই অনবরত ফোন আসতে থাকে। স্বদেশ-বিদেশ হাহাকারে একাকার হয়ে যায়_ নেই, তিনি নেই। কাছের ও দূরের ছাত্রছাত্রীরা ছুটে এসেছে মা-বাবাকে নিয়ে। পর্দানশিন নারী রাতের আঁধার উপেক্ষা করেছেন, কারও সঙ্গী কিশোরী কন্যা। কেউবা এসেছেন বালক পুত্রের কান্না সামলাতে না পেরে। প্রিয় শিক্ষকের জন্য ১৮৫ সদস্যের কর্মকার বাড়ির উঠানে উঠানে জটলা, শোক-আবেগ কেউ সামলাতে পারছে না। এ বাড়িরই অভিভাবক ফণিভূষণ কর্মকার_ পান্নালাল কর্মকারের অগ্রজ। সত্তর বছরেরও বেশি সময়ের জুটি ছিন্ন হয়ে গেল। এক সঙ্গে স্কুলে পড়েছেন। ফুটবল ও ক্রিকেট মাঠে নেমেছেন এক সঙ্গে। পরিবার ও সমাজের সব কাজে দু'জনে সিদ্ধান্ত নিতেন পরামর্শ করে। কর্মজীবনে একজন ছিলেন স্কুলে, আরেকজন কলেজে। ফণিভূষণ বরিশালে একাধিক বড় দলে ফুটবল লীগে পেশাদার হিসেবে খেলেছেন, আর অনুজ পান্না খেলাধুলায় উৎসাহী থাকলেও বেশি আগ্রহ ছিল শিক্ষায়। এভাবেই সর্বমহলে হয়ে উঠেছিলেন জনপ্রিয়। স্কুল ও গ্রামের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছিল দারুণ উৎসাহ। ভালো তবলা বাজাতেন, অন্যদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন।
পান্না স্যার বাসায় ছাত্র পড়াতেন। অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী তার বাসায় প্রতিদিন আসত। কোচিং সেন্টার বলতে যা বোঝায় তা তিনি অনুসরণ করতেন না। পড়াতেন যত্ন করে। প্রত্যুষে কিংবা সন্ধ্যার পরও মেয়েদের তার বাসায় পাঠাতে অভিভাবকদের বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা হতো না। শুধু গৈলা নয়, আশপাশের অনেক স্কুল থেকে তার কাছে পড়তে আসত ছাত্রছাত্রী। যার পরিবারে অসচ্ছলতা তার কাছ থেকে কম অর্থ নিতেন। তার আন্তরিকতার পরশ মিলত পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারেও। রোদে পুড়ে বা বৃষ্টিতে ভিজে আসা ছাত্রছাত্রীদের মিলত সেবাযত্ন, তারপরে পাঠাতেন পড়ার টেবিলে। ধর্মে ভেদাভেদ নেই, ধনী-দরিদ্রে পার্থক্য নেই। কখনও মারধর করতেন না। এ যেন এক ভিন্ন জগৎ!
শিক্ষার মান বাড়াতে তাগিদ ক্রমেই বাড়ছে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে চাই অনেক অনেক কারিগর। পান্নালাল কর্মকার ছিলেন এ কাজের উপযুক্ত ব্যক্তি, যার অভাব বরিশালের এ অঞ্চলে অনেক সময় অনুভূত হবে।
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার নিভৃত এক গ্রাম ভদ্রপাড়ায় মারুফ-শারমিন স্মৃতি পাঠাগারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা ছিল তার। কিন্তু মৃত্যু এসে এমন অলঙ্ঘনীয় দেয়াল তুলল, যা কেউ ভেদ করতে পারে না। এ পাঠাগারের উদ্যোক্তা মেজর শামসুল আলম স্মৃতিচারণ করলেন তার প্রিয় শিক্ষক পান্নালাল কর্মকারের এভাবে : 'স্কুলে পড়ার সময় জীবনের লক্ষ্য কী_ জানতে চেয়েছিলেন তিনি। আমি জানালাম, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাই। স্যার বলেন, কাল সকাল ৯টায় দেখা করিস। আমার তখন ঘড়ি ছিল না। বাড়ি থেকে সূর্য দেখে রওনা হয়ে স্যারের বাসায় হাজির হলে নিজের ঘড়ি দেখে বলেন, সময়মতো এসেছিস। সেনাবাহিনীতে সময়ানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা থাকতেই হবে।'
পান্নালাল কর্মকার ২৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। বাড়ির পাশেই স্কুল। পড়াতেন ইংরেজি। অঙ্কেও পারদর্শী ছিলেন এবং অনেকের কাছে জটিল হিসেবে বিবেচিত এ বিষয়টিও বুঝিয়ে দিতেন সহজ করে। শিক্ষকতার দীর্ঘ সময়ে কোনোদিন স্কুল কামাই হয়নি। বড় অসুখে পড়েননি কোনোদিন। আর ছোটখাটো সমস্যা গায়ে মাখেননি। ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বাড়ির লাগোয়া বাজারে গেলেন, এই আসছি বলে। কিন্তু অলক্ষ্যে মৃত্যু এলো, ঘরে ফিরতে হলো পরের কাঁধে চেপে_ যা ৭২ বছরের জীবনে কখনও চাননি। ১৮৯৩ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত গৈলা স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক কৈলাশ চন্দ্র সেনের সমাধিসৌধে লেখা রয়েছে : 'ডেথ ডিভাইডস, মেমরি লিঙ্গারস।' মৃত্যুর প্রায় আট দশক পরও গৈলা এবং আশপাশ এলাকার মানুষ তাকে স্মরণ রেখেছে। তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরির মোহ ত্যাগ করে প্রত্যন্ত গ্রামে চলে এসেছিলেন জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে। প্রায় সাড়ে তিন দশক কাজ করেছেন স্কুলে। একই সঙ্গে পার্শ্ববর্তী আগৈলঝাড়ায় ভৈগাই হালদার পাবলিক স্কুল গড়ে তুলতে সক্রিয় সহায়তা দিয়েছেন। দায়িত্ব নিয়েছেন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতির। দশকের পর দশক ধরে তিনি হয়ে আছেন নমস্য। পান্নালাল কর্মকারের মতো আরও অনেকের আদর্শ তিনি।
পান্না স্যার অবসর নিয়েছেন কয়েক বছর আগে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা তাকে স্মরণে রেখেছে। মৃত্যুসংবাদ মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের গণ্ডি ছাড়িয়ে বরিশাল, ঢাকা ও অন্য শহরে এবং দেশের বাইরে। তার টেলিফোন নম্বর জানা ছিল অনেকের। সেই নম্বরেই অনবরত ফোন আসতে থাকে। স্বদেশ-বিদেশ হাহাকারে একাকার হয়ে যায়_ নেই, তিনি নেই। কাছের ও দূরের ছাত্রছাত্রীরা ছুটে এসেছে মা-বাবাকে নিয়ে। পর্দানশিন নারী রাতের আঁধার উপেক্ষা করেছেন, কারও সঙ্গী কিশোরী কন্যা। কেউবা এসেছেন বালক পুত্রের কান্না সামলাতে না পেরে। প্রিয় শিক্ষকের জন্য ১৮৫ সদস্যের কর্মকার বাড়ির উঠানে উঠানে জটলা, শোক-আবেগ কেউ সামলাতে পারছে না। এ বাড়িরই অভিভাবক ফণিভূষণ কর্মকার_ পান্নালাল কর্মকারের অগ্রজ। সত্তর বছরেরও বেশি সময়ের জুটি ছিন্ন হয়ে গেল। এক সঙ্গে স্কুলে পড়েছেন। ফুটবল ও ক্রিকেট মাঠে নেমেছেন এক সঙ্গে। পরিবার ও সমাজের সব কাজে দু'জনে সিদ্ধান্ত নিতেন পরামর্শ করে। কর্মজীবনে একজন ছিলেন স্কুলে, আরেকজন কলেজে। ফণিভূষণ বরিশালে একাধিক বড় দলে ফুটবল লীগে পেশাদার হিসেবে খেলেছেন, আর অনুজ পান্না খেলাধুলায় উৎসাহী থাকলেও বেশি আগ্রহ ছিল শিক্ষায়। এভাবেই সর্বমহলে হয়ে উঠেছিলেন জনপ্রিয়। স্কুল ও গ্রামের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছিল দারুণ উৎসাহ। ভালো তবলা বাজাতেন, অন্যদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন।
পান্না স্যার বাসায় ছাত্র পড়াতেন। অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী তার বাসায় প্রতিদিন আসত। কোচিং সেন্টার বলতে যা বোঝায় তা তিনি অনুসরণ করতেন না। পড়াতেন যত্ন করে। প্রত্যুষে কিংবা সন্ধ্যার পরও মেয়েদের তার বাসায় পাঠাতে অভিভাবকদের বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা হতো না। শুধু গৈলা নয়, আশপাশের অনেক স্কুল থেকে তার কাছে পড়তে আসত ছাত্রছাত্রী। যার পরিবারে অসচ্ছলতা তার কাছ থেকে কম অর্থ নিতেন। তার আন্তরিকতার পরশ মিলত পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারেও। রোদে পুড়ে বা বৃষ্টিতে ভিজে আসা ছাত্রছাত্রীদের মিলত সেবাযত্ন, তারপরে পাঠাতেন পড়ার টেবিলে। ধর্মে ভেদাভেদ নেই, ধনী-দরিদ্রে পার্থক্য নেই। কখনও মারধর করতেন না। এ যেন এক ভিন্ন জগৎ!
শিক্ষার মান বাড়াতে তাগিদ ক্রমেই বাড়ছে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে চাই অনেক অনেক কারিগর। পান্নালাল কর্মকার ছিলেন এ কাজের উপযুক্ত ব্যক্তি, যার অভাব বরিশালের এ অঞ্চলে অনেক সময় অনুভূত হবে।
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments