'এমন মানব জনম আর কি হবে' by তানজিনা হক বিয়াস

মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হয়েই চিৎকার করে জানিয়ে দেয় তার আগমনী বার্তা। আর তখন থেকেই চলে তার অধিকার প্রতিষ্ঠার যাত্রা। পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতিভেদে মানবশিশু পায় তার অধিকার। লালন বলেন, 'অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই, শুনি মানব রূপের উত্তম কিছুই নাই। দেব-দেবতাগণ, করে আরাধন জনম নিতে মানবে।' তবু সৃষ্টির এত উত্তম রূপ এই মানবই বঞ্চিত করে আরেক মানবসন্তানকে তার অধিকার থেকে।


মানবাধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এই দুটি শব্দ জায়গা করে নেয় মানবের অভিধানে, জায়গা করে নেয় পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতিভেদে মানবজীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় গঠিত হয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮। এই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে রাষ্ট্রগুলো স্বাক্ষর করে এই সনদে। তবু অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় না, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৭৯ সালে নারী সমাজের বিরুদ্ধে সবধরনের বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত কনভেনশন বা সনদ গ্রহণ করে। বাংলাদেশসহ এখন বিশ্বের ১৬০টিরও বেশি দেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষর দান করেছে। রাষ্ট্র তার সংবিধানে আইন ও নীতিমালা তৈরি করেছে, তবুও সমাজে নারীরা অবহেলিত, বঞ্চিত ও নির্যাতিত। তাদের সঙ্গে শিশুরা, প্রবীণরা, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীরাও সমাজে হচ্ছে মৌলিক অধিকার থেকে সুবিধাবঞ্চিত, হচ্ছে অত্যাচার, বঞ্চনা আর অবহেলার শিকার। এই অবহেলার প্রবৃত্তিরও সামাজিকরণ হয়েছে যুগ যুগ ধরে দেশ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে। তাই মানবাধিকার সনদ বা রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও পদে পদে লঙ্ঘিত হয় এসব অভাজনের অধিকার, শোষিত হয় তারা ক্ষমতাবানদের হাতে। তবু আশার কথা এই যে, সমাজের বিবেকবান একাংশ, কিছু বেসরকারি সাহায্য সংস্থা আজ সোচ্চার হয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালার আলোকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে এবং শিক্ষার মাধ্যমে নারী, শিশু, দরিদ্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়।
যদি মন খুলে, চোখ মেলে দেখি, তাহলে দেখতে পাই আমাদের আশপাশে রয়েছে কিছু মানুষ, জন্মই যেন তাদের আজন্ম পাপ, তেমন মানুষরা হচ্ছেন মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী, না পুরুষ না নারী এমনই এক মানব জনম (হিজড়া), যৌনকর্মী, সামাজিকভাবে চিহ্নিত নিম্ন সম্প্রদায় যেমন দলিত সম্প্রদায়, ঋষি সম্প্রদায় এবং আরও অনেকে; তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা খুব কমই উচ্চারিত হয়, খুব কমই অন্তর্ভুক্ত হয় তারা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। আবার আরেকদিকে শোনা যায় পাহাড়ের কান্না, অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা আজ চরম বিতর্কে উঠেছে 'আদিবাসী' আর 'উপজাতি' দুটি শব্দ নিয়ে হচ্ছে উন্নয়ন ব্যাহত।
অনেক রক্তের বিনিময়ে, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি মানচিত্র , বাংলাদেশ যার নাম, যাদের কথা এখন বলেছি তারা এই বাংলাদেশেরই নাগরিক, বিজয়ের চার দশক পরে যদি অর্জনের কথা ভাবি কী করতে পেরেছি আমরা! এই মানুষদের অবহেলিত রেখে, বঞ্চিত করে, তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা না করে কোনোভাবেই দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রয়োজন তাদের উন্নয়নে সরকারের উপযোগী নীতিমালা গ্রহণ করা, প্রয়োজন আইন ও নীতিমালার যথার্থ প্রয়োগ। আরও প্রয়োজন আমরা যারা সুবিধাভোগী আছি, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা, সবাইকে সচেতন করা তোলা, সরকারকে সহযোগিতা করা এবং যার যার অবস্থান থেকে এসব মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উন্নয়নের মূলধারায়। তবেই সম্ভব দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়ন।
আজ আবার এসেছে ১০ ডিসেম্বর। যেন লালনের মতো বলতে পারি, 'এমন মানব জনম আর কী হবে। মন যা কর, ত্বরায় কর এই ভবে।'
tanzinahq@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.