কলকাতায় হাসপাতালে আগুন বাংলাদেশিসহ মৃত ৮৯ by সুব্রত আচার্য্য

লকাতায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় কমপক্ষে ৮৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন বাংলাদেশিও রয়েছেন। তার নাম গৌরাঙ্গ মণ্ডল। দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায় অ্যাডভান্সড মেডিকেয়ার রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এএমআরআই বা আমরি) হাসপাতালে গতকাল শুক্রবার এ আগুনের ঘটনা ঘটে। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন ওই হাসপাতালের কর্মী, অন্য সবাই চিকিৎসাধীন রোগী।


বেশির ভাগ রোগীর মৃত্যু হয়েছে জরুরি অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ কিংবা ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ভেন্টিলেশনের যন্ত্র বন্ধ হয়েও অনেকে মারা গেছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৮৯ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে প্রশাসন।
এদিকে যথাযথ অগ্নিনিরোধক ও জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থা না থাকার অভিযোগে হাসপাতালটির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে হাসপাতালের ছয় পরিচালককে।
বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখানের খাসরু গ্রামের প্রবীণ কৃষক গৌরাঙ্গ মণ্ডলের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন কলকাতার বাংলাদেশ উপদূতাবাসের প্রেসসচিব কাজি মোস্তাক জহির। ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণ নিয়েগত ৭ ডিসেম্বর এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন গৌরাঙ্গ।
জানা যায়, রাত সাড়ে ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে চার তলার এই হাসপাতালে আগুনের সূত্রপাত হলেও সকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস বিভাগকে খবর দেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমনকি নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও কাজে লাগায়নি। আগুনের তথ্য গোপন রেখেই সেখানে কর্মরত নিরাপত্তারক্ষীরাও হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকালে হাঁটতে গিয়েই প্রথম তারা চারতলা থেকে কালো ধোঁয়া বেরুতে দেখে। তখন স্থানীয়
লোকজন খবর দেয় ফায়ার সার্ভিসকে। শুধু তাই নয়, এলাকার মানুষই প্রথম হাসপাতালে ঢুকে উদ্ধার কাজ শুরু করে। কিন্তু ওই সময় হাসপাতালের ভেতরে ঢুকতে বাধা দেন নিরাপত্তারক্ষীরা। বাধা অগ্রাহ্য করেই স্থানীয় লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধারকাজে।
পুলিশ জানায়, রাত ৪টা নাগাদ আগুন লাগে হাসপাতালের বেসমেন্টে। সেখানে প্রচুর চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ ও কাগজপত্র জমা থাকায় প্রচুর ধোঁয়া সৃষ্টি হয়। হাসপাতালটি পুরো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় আগুন লাগার পরই ঘন কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় গোটা চত্বর। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট। তাদের সঙ্গে ছিল দুটি বিশাল মই। দমকলের পাশাপাশি ঘটনাস্থলে পৌঁছায় বিপর্যয় মোকাবিলা টিম। পরিস্থিতি মোকাবিলায় হাসপাতালের জানালার কাচ ভেঙে রোগীদের বের করে আনার মরিয়া চেষ্টা চালানো হয়।
জানা যায়, আগুনের খবর ছড়িয়ে পড়তেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে রোগীরা। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে অপেক্ষমাণ লোকজন। সে সময় অনেকেই নিজ উদ্যোগে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলেও চিকিৎসারত অনেকেই বেরিয়ে আসতে পারেনি। ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়েই বেশির ভাগ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। রোগীদের পাশাপাশি আটকে পড়েন চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতালের কর্মীরাও। রোগীদের এসএসকেএম, শম্ভুনাথ পণ্ডিত এবং এমআরআইর সল্টলেক ও মুকুন্দপুর শাখায় সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপরই একে একে মৃত্যুর খবর আসতে থাকে।
দুর্ঘটনার পরই ঘটনাস্থলে পৌঁছান ফায়ার সার্ভিস-মন্ত্রী জাভেদ খান, পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্য কান্ত মিশ্র ও কলকাতার পুলিশ কমিশনার। সকাল ১০টা নাগাদ এএমআরআই হাসপাতালে পৌঁছান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী পৌঁছানো মাত্রই রোগীর আত্মীয়রা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। একসময় বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে তারা। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের হঠাতে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে। পরে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে অবস্থা কিছুটা শান্ত হয়। দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তিদের পরিবারকে দুই লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ এবং অসচ্ছল প্রতি পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী।
এদিকে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে কলকাতায় অবস্থিত এএমআরআই হাসপাতালের সব শাখার লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে হাসপাতালের প্রতিটি শাখা।
এদিকে দুর্ঘটনার পরই হাসপাতালের বিরুদ্ধে উঠে আসছে একের পর এক অভিযোগ। ঘটনার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকেই দায়ী করা হচ্ছে। হাসপাতালের ওই বেসমেন্টে গাড়ি পার্কিংয়ের অনুমতি থাকলেও সেখানে কেবল তার, পেট্রলসহ দাহ্য পদার্থ মজুদ ছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
দুর্ঘটনার পর হাসপাতালের কোনো কর্মকর্তাকেই পাওয়া যায়নি। সবাই পালিয়ে যান বলে খবর পাওয়া গেছে।
এস এম কৃষ্ণ ও মমতাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শোকবার্তা : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গতকাল বিকেলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কলকাতার হাসপাতালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে জানমালের ক্ষয়ক্ষতিতে শোকবার্তা পাঠিয়েছেন।
এস এম কৃষ্ণকে পাঠানো বার্তায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, 'কলকাতার ঢাকুরিয়ার এএমআরআই হাসপাতালে ভয়াবহ আগুনে প্রাণহানির ঘটনায় আমরা শোকাহত ও আতঙ্কিত। আমি নিজে ও বাংলাদেশের জনগণ এবং সরকারের পক্ষে ওই মর্মান্তিক ঘটনায় ভারতের জনগণ ও সরকারের প্রতি গভীর শোক ও সমাবেদনা জানাই।
ডা. দীপু মনি আরো বলেন, 'বিশেষ করে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাওয়া অনেক রোগী হতাহত হওয়ার খবরে আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি। নিহতদের আত্মার চিরশান্তি এবং নিহতদের স্বজনরা যাতে শোক সামলে ওঠতে পারেন, সে জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে আমরা প্রার্থনা করছি।'
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পাঠানো পৃথক বার্তায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শোক প্রকাশ করেছেন এবং আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.