বাংলাদেশও মহাকাশে যাবে

সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের কার্যক্রমের উৎসাহ জোগাতে জাতিসংঘের খ্যাতনামা দুই মহাকাশ বিজ্ঞানী বাংলাদেশে এসেছিলেন। তারা হলেন যুক্তরাজ্যের নর্থ আয়ারল্যান্ড স্পেস অফিসের পরিচালক ড. রবার্ট হিল এবং ফক্স টেলিস্কোপ প্রজেক্টের শিক্ষাবিষয়ক পরিচালক ড. সারাহ রবার্ট। ডিসকাশন প্রজেক্টের বিজ্ঞানকর্মী শামসুদ্দিন আহমেদ, আজাদ, টাঙ্গাইলের কালিহাতীর কলেজ শিক্ষক মোঃ আলী হাসান, বুয়েটের শিক্ষক ফারসীম মান্নান মোহম্মদী, বিজ্ঞান বক্তা


আসিফের সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ আলাপে ড. রবার্ট হিল মহাকাশ বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে অনেক কথা বলেছেন। কালস্রোতের পক্ষ থেকে তারই সারাংশ তুলে ধরেছেন মোঃ আলী হাসান ও শামসুদ্দিন আহমেদ


গোধূলির ঘনায়মান আঁধারে ফয়জুর রহমানের ত্রিতল আবাস 'মহাকাশ ভবন'। এর সুপরিসর লনে গা এলিয়ে দিয়ে আকাশের লালিমা মরে গিয়ে কৃষ্ণতর হতে দেখছিলাম আমরা কজনা। কথা হচ্ছিল আইরিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. রবার্ট হিলসের সঙ্গে_ যিনি ছয় হাজার মাইল উড়ে এসে একটানে নীল আকাশের চাঁদোয়াটা আমাদের হাতে এনে দিয়েছেন, কথা হচ্ছিল তরুণ প্রজন্মের বিজ্ঞান ভাবনা নিয়ে -
কালস্রোত :ড. রবার্ট হিল। স্বাগতম আপনাকে। কেমন বোধ করছেন
ড. রবার্ট হিল : প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসে আমি খুবই উপভোগ করছি। ২৪ ঘণ্টার লম্বা ভ্রমণ ছিল। তারপরও সবার মধ্যে মহাকাশ বিষয়ক উৎসাহ দেখে আবেগ অনুভব করছি।
কালস্রোত : অনেক কষ্ট স্বীকার করে আপনি এবং ড. সারাহ রবার্ট সুদূর আয়ারল্যান্ড থেকে সুদূরতর এনায়েতপুর এসেছেন। এ আগমন কতটুকু সার্থক মনে হচ্ছে?
ড. হিলস : তরুণ প্রজন্মের বিজ্ঞানবিমুখতা আজ বিশ্বজুড়ে এক সমস্যা। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকরা বিজ্ঞানকে সঠিকভাবে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করতে পারেন না বলে এমনটা ঘটছে, তা নয়। বরং কারিকুলামে বিজ্ঞান ও তৎসংলগ্ন বিষয়গুলোর ত্রুটিপূর্ণ অন্তর্ভুক্তি। এরা বিজ্ঞান শিখতে চায়, কিন্তু পাঠ্যসূচিতে যেভাবে একে সৃষ্টিছাড়াভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার ফলে সৃষ্টিশীলতা বিলুপ্ত হয়েছে।
এ ব্যাপারে আপনাদের নতুন কোনো পদক্ষেপ আছে?
হ্যাঁ আমরা যে অ্যাপ্রোচে যাচ্ছি তাতে ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে কিছু সাফল্য দেখা গেছে। সনাতন পদ্ধতিতে পাঠ্যসূচি সাজানোর কারণে ছাত্ররা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও গণিতকে বিশুদ্ধ, ধারণাতীত বিষয় বলে ভাবতে শুরু করেছে।

একটু উদাহরণ দিয়ে বলা যায়
যেমন ধরুন, বিশ্ব পরিচয়ে আমরা মহাকর্ষ ব্যাখ্যা শুরু না করে যদি এই মহাবিশ্ব কত বড়, কতগুলো নক্ষত্র আছে_ এখানে এই জাতীয় প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি তাহলে পুরো শিক্ষাটাই হয়ে পড়ে আনন্দদায়ক, আকর্ষণীয়। কারণ শিশুরা গণিত বা পদার্থবিজ্ঞান বোঝে না, প্রকৃতিকে বুঝতে চায়, জানতে চায় নিজের পরিপার্শ্বকে।
এ ব্যাপারে অন্য কারও কথা বলা যায়_
ডেভিড এটেনবরাহের সেই বিখ্যাত টিভি সিরিয়াল লাইফ অন আর্থ এর কথাই ধরুন না কেন। সেখানে গণিত বা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে তো কোনো আলাপ শুরু হয়নি। তিনি প্রকৃতি থেকে পাঠ নিচ্ছিলেন এবং তা করতে গিয়ে আলোচনার সুবিধার্থে বোঝার স্বার্থেই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই ওই ডিসিপ্লিনগুলো এসে পড়ে। তখন তা দুরূহ না হয়ে চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে।
জ্যোতির্বিজ্ঞান অধ্যয়নের ক্ষেত্রে আপনি একজন ব্রিটিশ ও একজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে কি ব্যবধান খুঁজে পান?
আমি বরং মিলই খুঁজে পাই। যেমন ধরুন, তারা একই আকাশ শেয়ার করছে। শেয়ারের তালিকা দীর্ঘতর করার জন্য চাঁদ, তারা, সূর্য কোনোটাই পিছিয়ে নেই। তারপরও যদি বলেন আমি বলব ব্রিটেনের রয়েছে নিউটন... এদের ঐতিহ্য আর বাঙালির আছে বিজ্ঞান শেখার ঐকান্তিকতা_ কোনোটাই ফেলনা নয়।
বাংলাদেশের পাঠসূচিতে আমূল কোনো পরিবর্তনের কি প্রয়োজন
(বিনয়ীভাবে) আমরা বাংলাদেশের পাঠ্যসূচিতে আমূল কোনো পরিবর্তনের কথা বলব না, কেননা এ দেশের প্রয়োজনকে সামনে রেখেই নির্মিত। শুধু বলি জ্যোতির্বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা হলে মহাশূন্যকে বুঝতে গিয়েও তো শিক্ষার্থীরা গণিতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে_ এও তো এক পরম পাওয়া। হাজার বছর ধরে নীলনদ ভরা ভাদরে দু'কূল ছাপিয়ে দাপিয়ে যেত আর দূর আকাশের তারারা তখন মুছে যাওয়া জমির হদিস বলে দিত!
ফয়জুর রহমানের বাড়ির সীমানা প্রাচীরের ভেতরের দেয়াল ৫ ফুট বাই ৬ ফুট অনূ্যন ৩০টি পোস্টারের আড়ালে হারিয়ে গেছে। যার প্রতিটিতেই গ্রহপুঞ্জ, সূর্যের ক্লোজআপ, চন্দ্রগ্রহণ, মহাকাশযান, খেয়াতরীর ছবি মূর্ত। তেমনই একটি পোস্টারে এফআর সরকারকে দেখা যাচ্ছে শূন্য মাধ্যাকর্ষণে ভাসমান অবস্থায় একটি জিও স্টেশনারি কৃত্রিম উপগ্রহে। এ ব্যাপারে...
এই দুর্লভ পোস্টারগুলো ইঙ্গিত করে আমি মানুষকে প্রশ্ন করেছি এগুলো কী। তাদের উত্তরের গভীরতা আমাকে ভাবিয়েছে।
আপনার বক্তব্যের এক জায়গায় আমাদের মনে হয়েছে আপনি সাগানের সেই বিখ্যাত গ্রন্থ কসমস দিয়ে দারুণভাবে প্রভাবিত। পশ্চিমে তো বইটি বহুল পঠিত। অনেক শিশুর মহাশূন্যচারী স্বপ্নই তো বইটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সাগানের বহুলশ্রুত একটি উক্তিই হলো যে তুমি, আমি, আমরা আমাদের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছি নক্ষত্রের গর্ভে। কীভাবে? নিউক্লীয় সংশ্লেষণে জন্ম নেয় ভারী পরমাণুগুলো। কার্বনের মতো অনেকগুলো ভারী পরমাণু ও আরও কিছু পরমাণু মিলে জটিল জৈব যৌগ গঠনের মধ্য দিয়ে অ্যামিনো এসিড তৈরি হয়_ অতি সরলপ্রাণ।
আমার শেষ প্রশ্ন, আবার কবে, কীভাবে আমাদের দেখা হবে?
ড. হিলস : আবার নিশ্চয়ই এই সুন্দর অতিথিপরায়ণ দেশটিতে আমরা আসব। তবে কী এবং কীভাবে শিক্ষা দিতে হয়_ শিক্ষকদের তা শেখাতে নয়, তারা এটা খুব ভালো জানেন। যারা এই সেমিনারে এসেছেন তারা সবাই ভালো শিক্ষক। তাদের উপদেশ দিতে যাওয়া হবে মূর্খতা। আমরা কেবল আমাদের বেস্ট প্র্যাকটিস শেয়ার করতে পারি। ব্রিটিশ কাউন্সিল একটা ভালো রিপোজিটরি হতে পারে। আমরা ভাবতে পারি, ছাত্র-শিক্ষকও এই ধরনের আরও তথ্যকেন্দ্রকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় এনে মহাজাগতিক জ্ঞানকে কীভাবে আরও আন্তর্জাতিক করা যায়। আমার ধারণা ৩০ বছরের মধ্যে মহাকাশে বাংলাদেশ পতাকা ওড়াবে।

No comments

Powered by Blogger.