স্মরণ-প্রচলিত ধারা তাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে by বদিউল আলম মজুমদার
শুধু প্রগতিশীল চিন্তা লালনকারীই নয়, মঞ্জু ছিলেন অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী। একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও মঞ্জুকে আমি কোনোদিন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে দেখিনি। বস্তুত তিনি যে বিখ্যাত আজিজ মিঞার ছেলে অতি ঘনিষ্ঠরা ছাড়া কেউ তা জানতও না। এক কথায়, মঞ্জু একজন অতি সহজ-সরল ও নিরীহ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন\\ গত ২৫ অক্টোবর আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অতি ঘনিষ্ঠ নূরুদ্দিন জাহিদ মঞ্জু
পরলোকগমন করেন। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমি তখন দেশের বাইরে এবং সেখান থেকেই আমি তার অকালমৃত্যুর কথা সংবাদপত্রে পড়ে অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত হয়েছি। মৃত্যুকালে মঞ্জুর বয়স হয়েছিল প্রায় ৬৪ বছর। তবুও আমি তার মৃত্যুকে অকালমৃত্যু বলছি। কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলে ৬০-৬৫ বছর বয়স্ক ব্যক্তিকে এখন আর বৃদ্ধ বলে মনে করা হয় না। মানুষের গড় আয়ু এখন অনেক বেড়েছে, এমনকি বাংলাদেশেও। যেমন, গত তিন দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯০ বা তার বেশি বয়সের জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিনগুণ।
এ ছাড়াও ৫০-৬০ বছর বয়সেই মানুষের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার শ্রেষ্ঠ সময়। লেখাপড়া শেখা, জীবন-জীবিকার সন্ধান এবং পারিবারিক দায়দায়িত্ব পালনের পর ষাটের দিকেই মানুষের সত্যিকারের নতুন জীবন শুরু হয়। সঞ্চিত অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে তখনই সমাজের জন্য মানুষের অবদান রাখার সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর জীবনের এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মঞ্জু আমাদের থেকে চিরবিদায় নেন।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মঞ্জুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আমি তখন বাণিজ্য বিভাগে অনার্সের ছাত্র। তখনও বাণিজ্য অনুষদ সৃষ্টি হয়নি। মঞ্জু আমার এক বছরের জুনিয়র ছিলেন, তবুও আমাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। কিন্তু পাস করার পর লেকচারার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের কারণে আমি তার শিক্ষক হয়ে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা সচরাচরই ঘটে। আমার মনে আছে, মঞ্জুসহ একদল ছাত্রকে, বাণিজ্য বিভাগে তখন ছাত্রী ছিল না, আমি শিক্ষা সফরে খুলনা নিয়ে গিয়েছিলাম। সে সময়ও শিক্ষক-ছাত্রের সঙ্গত দূরত্ব রেখেই আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অব্যাহত থাকে।
মঞ্জু আর আমি একই হলে থাকতাম। সে সুযোগে আমাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক। বস্তুত মঞ্জু ছিল আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠদের মধ্যে একজন। ক্যান্টিন ও ডাইনিং হলে দেখা ছাড়াও আমাদের মধ্যে মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হতো। হতো গুরুগম্ভীর বিষয় থেকে শুরু করে সমসাময়িক বিষয় নিয়েও মতবিনিময়। আমাদের মধ্যে গল্প হতো। আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার একটি বড় কারণ ছিল যে, অনেক বিষয়েই আমাদের মতামত প্রায় অভিন্ন ছিল।
আমার যতটুকু মনে পড়ে, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসার পর মঞ্জু বেশ কিছুদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় ছিলেন। বস্তুত বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার স্থানীয় অভিভাবক।
ষাটের দশকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মঞ্জুর বাবা এমএ আজিজ (আজিজ মিঞা) ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা। তিনি ও তার পরিবার ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের অতি নিকটের, আর সে কারণেই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে মঞ্জুর থাকা। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু যে এক বিরাট মাপের মানুষ ছিলেন সে সম্পর্কে মঞ্জু থেকে জেনেছি। ছাত্রজীবনের শেষ দিকে অবশ্য বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আমারও কিছুটা সুযোগ ঘটে।
ষাটের দশকের মাঝ থেকে শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানের জহুরুল হক হল) ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্রস্থল ছিল। সেখান থেকেই ছাত্র তথা বহুলাংশে জাতীয় রাজনীতির কলকাঠি নাড়ানো হতো। এগার দফা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন মূলত ইকবাল হল থেকেই পরিচালিত হয়েছিল। মঞ্জু এবং আমি নিজেও ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলাম। কিন্তু আমরা উভয়েই একটু ভিন্ন প্রকৃতির ছিলাম। আমরা প্রগতিশীল মনা এবং লেখাপড়ার প্রতি অপেক্ষাকৃত বেশি মনোযোগী ছিলাম। আমি প্রথমে ইকবাল হল ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক এবং ১৯৬৭-৬৮ সালে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হই। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির অনেক জাঁদরেল নেতাই তখন আমাদের রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলাম। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে এবং সাংগঠনিক কাজে মঞ্জু সে সময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
শুধু প্রগতিশীল চিন্তা লালনকারীই নয়, মঞ্জু ছিলেন অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী। একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও মঞ্জুকে আমি কোনোদিন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে দেখিনি। বস্তুত তিনি যে বিখ্যাত আজিজ মিঞার ছেলে অতি ঘনিষ্ঠরা ছাড়া কেউ তা জানতও না। এক কথায়, মঞ্জু একজন অতি সহজ-সরল ও নিরীহ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন।
সত্তরের প্রথম দিকে আমি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাই। এরপর থেকে মঞ্জুর সঙ্গে আমার অনেকদিন আর যোগাযোগ ছিল না। তিনি ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ উপেক্ষা করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি জাসদে যোগদান করেন এবং ১৯৭৩ সালে জাসদের পক্ষে চট্টগ্রাম থেকে সংসদ নির্বাচন করেন। শুনেছি, তিনি নির্বাচনে জয়ীও হয়েছিলেন, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। সে সময় দীর্ঘ আলাপকালে আমি মঞ্জুর মধ্যে বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে এক ধরনের হতাশা লক্ষ্য করেছি।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে ফেরত আসার পর মঞ্জুর সঙ্গে আমার একাধিকবার সাক্ষাৎ হয়। আমাদের কয়েকজনের প্রচেষ্টায় একটি নাগরিক সংগঠন হিসেবে 'সুজন, সুশাসনের জন্য নাগরিক' সৃষ্টির পর গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি তাকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাই। তিনি তখন অসুস্থ এবং সে কারণে তিনি আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেননি। কিন্তু 'সুজন'-এর পতাকাতলে উদ্বিগ্ন নাগরিকদের সংগঠিত করতে তিনি আমাকে প্রবলভাবে উৎসাহিত করেন। তিনি আমাকে সর্বতোভাবে সহায়তারও আশ্বাস দেন।
এরপরও একাধিকবার মঞ্জুর সঙ্গে আমার দেখা হয়। প্রত্যেকবারই আমি তাকে দেখেছি আমাদের কলুষিত রাজনীতি সম্পর্কে বিতৃষ্ণা প্রকাশ করতে; আমাদের রাজনীতিকদের কঠোর সমালোচনা করতে; তাদের স্বার্থপরতা সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করতে। আলাপকালে জেনেছি যে, তার সবচেয়ে অপছন্দের ব্যক্তি ছিলেন সেসব রাজনীতিবিদ যারা প্রবঞ্চক, যারা জনকল্যাণের নামে রাজনীতিতে নেমে ব্যক্তি ও কোটারি স্বার্থে পরিচালিত হন এবং জনগণের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করেন।
প্রচলিত অর্থে মঞ্জু একজন 'ব্যর্থ' রাজনীতিবিদ হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুকালে তিনি টাকার পাহাড় রেখে যাননি। একদল ক্যাডার বাহিনীও তার ছিল না। রাজনীতিতে তিনি উত্তরাধিকারও সৃষ্টি করেননি। আসলে মঞ্জু নয়, আমাদের রাজনীতিই ব্যর্থ হয়েছে মঞ্জুর মতো সৎ, মেধাবী_ সর্বোপরি জনকল্যাণে নিবেদিত একজন রাজনীতিবিদকে ধারণ এবং অবদান রাখার সুযোগ করে দিতে; তাকে নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করতে।
দুর্ভাগ্যবশত শুধু মঞ্জুই নন, বাস্তবতা হলো, তার মতো অগণিত নিবেদিতপ্রাণ সজ্জন আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে প্রতিনিয়ত বিতাড়িত হন। বস্তুত আমাদের রাজনীতিতে এখন যেন এক ধরনের 'গ্রেসামস ল' কাজ করে। ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে টমাস গ্রাহাম পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, 'গুড মানি ড্রাইভস ব্যাড মানি আউট অব সার্কুলেশন'_ ভালো টাকা খারাপ টাকার প্রচলনকে রুদ্ধ করে। তেমনিভাবে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে যেন সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণমুখী রাজনীতিবিদরা নিয়মিতভাবে বিতাড়িত হন এবং হচ্ছেন। অর্থাৎ তারা রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারছেন না। এর মূল কারণ হলো রাজনীতির নামে অপরাজনীতির চর্চা। আর এ অপরাজনীতি তথা অপসংস্কৃতির অদূর ভবিষ্যতে অবসান না ঘটলে জাতি হিসেবে আমাদের জন্য ভবিষ্যতে আরও অনেক দুঃখ-কষ্ট অপেক্ষা করছে। এটাই হোক মঞ্জুর জীবন থেকে আমাদের কঠিন শিক্ষা।
ড. বদিউল আলম মজুমদার :সম্পাদক
'সুজন, সুশাসনের জন্য নাগরিক'
এ ছাড়াও ৫০-৬০ বছর বয়সেই মানুষের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার শ্রেষ্ঠ সময়। লেখাপড়া শেখা, জীবন-জীবিকার সন্ধান এবং পারিবারিক দায়দায়িত্ব পালনের পর ষাটের দিকেই মানুষের সত্যিকারের নতুন জীবন শুরু হয়। সঞ্চিত অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে তখনই সমাজের জন্য মানুষের অবদান রাখার সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর জীবনের এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মঞ্জু আমাদের থেকে চিরবিদায় নেন।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মঞ্জুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আমি তখন বাণিজ্য বিভাগে অনার্সের ছাত্র। তখনও বাণিজ্য অনুষদ সৃষ্টি হয়নি। মঞ্জু আমার এক বছরের জুনিয়র ছিলেন, তবুও আমাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। কিন্তু পাস করার পর লেকচারার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের কারণে আমি তার শিক্ষক হয়ে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা সচরাচরই ঘটে। আমার মনে আছে, মঞ্জুসহ একদল ছাত্রকে, বাণিজ্য বিভাগে তখন ছাত্রী ছিল না, আমি শিক্ষা সফরে খুলনা নিয়ে গিয়েছিলাম। সে সময়ও শিক্ষক-ছাত্রের সঙ্গত দূরত্ব রেখেই আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অব্যাহত থাকে।
মঞ্জু আর আমি একই হলে থাকতাম। সে সুযোগে আমাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক। বস্তুত মঞ্জু ছিল আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠদের মধ্যে একজন। ক্যান্টিন ও ডাইনিং হলে দেখা ছাড়াও আমাদের মধ্যে মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হতো। হতো গুরুগম্ভীর বিষয় থেকে শুরু করে সমসাময়িক বিষয় নিয়েও মতবিনিময়। আমাদের মধ্যে গল্প হতো। আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার একটি বড় কারণ ছিল যে, অনেক বিষয়েই আমাদের মতামত প্রায় অভিন্ন ছিল।
আমার যতটুকু মনে পড়ে, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসার পর মঞ্জু বেশ কিছুদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় ছিলেন। বস্তুত বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার স্থানীয় অভিভাবক।
ষাটের দশকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মঞ্জুর বাবা এমএ আজিজ (আজিজ মিঞা) ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা। তিনি ও তার পরিবার ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের অতি নিকটের, আর সে কারণেই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে মঞ্জুর থাকা। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু যে এক বিরাট মাপের মানুষ ছিলেন সে সম্পর্কে মঞ্জু থেকে জেনেছি। ছাত্রজীবনের শেষ দিকে অবশ্য বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আমারও কিছুটা সুযোগ ঘটে।
ষাটের দশকের মাঝ থেকে শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানের জহুরুল হক হল) ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্রস্থল ছিল। সেখান থেকেই ছাত্র তথা বহুলাংশে জাতীয় রাজনীতির কলকাঠি নাড়ানো হতো। এগার দফা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন মূলত ইকবাল হল থেকেই পরিচালিত হয়েছিল। মঞ্জু এবং আমি নিজেও ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলাম। কিন্তু আমরা উভয়েই একটু ভিন্ন প্রকৃতির ছিলাম। আমরা প্রগতিশীল মনা এবং লেখাপড়ার প্রতি অপেক্ষাকৃত বেশি মনোযোগী ছিলাম। আমি প্রথমে ইকবাল হল ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক এবং ১৯৬৭-৬৮ সালে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হই। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির অনেক জাঁদরেল নেতাই তখন আমাদের রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলাম। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে এবং সাংগঠনিক কাজে মঞ্জু সে সময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
শুধু প্রগতিশীল চিন্তা লালনকারীই নয়, মঞ্জু ছিলেন অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী। একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও মঞ্জুকে আমি কোনোদিন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে দেখিনি। বস্তুত তিনি যে বিখ্যাত আজিজ মিঞার ছেলে অতি ঘনিষ্ঠরা ছাড়া কেউ তা জানতও না। এক কথায়, মঞ্জু একজন অতি সহজ-সরল ও নিরীহ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন।
সত্তরের প্রথম দিকে আমি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাই। এরপর থেকে মঞ্জুর সঙ্গে আমার অনেকদিন আর যোগাযোগ ছিল না। তিনি ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ উপেক্ষা করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি জাসদে যোগদান করেন এবং ১৯৭৩ সালে জাসদের পক্ষে চট্টগ্রাম থেকে সংসদ নির্বাচন করেন। শুনেছি, তিনি নির্বাচনে জয়ীও হয়েছিলেন, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। সে সময় দীর্ঘ আলাপকালে আমি মঞ্জুর মধ্যে বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে এক ধরনের হতাশা লক্ষ্য করেছি।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে ফেরত আসার পর মঞ্জুর সঙ্গে আমার একাধিকবার সাক্ষাৎ হয়। আমাদের কয়েকজনের প্রচেষ্টায় একটি নাগরিক সংগঠন হিসেবে 'সুজন, সুশাসনের জন্য নাগরিক' সৃষ্টির পর গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি তাকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাই। তিনি তখন অসুস্থ এবং সে কারণে তিনি আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেননি। কিন্তু 'সুজন'-এর পতাকাতলে উদ্বিগ্ন নাগরিকদের সংগঠিত করতে তিনি আমাকে প্রবলভাবে উৎসাহিত করেন। তিনি আমাকে সর্বতোভাবে সহায়তারও আশ্বাস দেন।
এরপরও একাধিকবার মঞ্জুর সঙ্গে আমার দেখা হয়। প্রত্যেকবারই আমি তাকে দেখেছি আমাদের কলুষিত রাজনীতি সম্পর্কে বিতৃষ্ণা প্রকাশ করতে; আমাদের রাজনীতিকদের কঠোর সমালোচনা করতে; তাদের স্বার্থপরতা সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করতে। আলাপকালে জেনেছি যে, তার সবচেয়ে অপছন্দের ব্যক্তি ছিলেন সেসব রাজনীতিবিদ যারা প্রবঞ্চক, যারা জনকল্যাণের নামে রাজনীতিতে নেমে ব্যক্তি ও কোটারি স্বার্থে পরিচালিত হন এবং জনগণের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করেন।
প্রচলিত অর্থে মঞ্জু একজন 'ব্যর্থ' রাজনীতিবিদ হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুকালে তিনি টাকার পাহাড় রেখে যাননি। একদল ক্যাডার বাহিনীও তার ছিল না। রাজনীতিতে তিনি উত্তরাধিকারও সৃষ্টি করেননি। আসলে মঞ্জু নয়, আমাদের রাজনীতিই ব্যর্থ হয়েছে মঞ্জুর মতো সৎ, মেধাবী_ সর্বোপরি জনকল্যাণে নিবেদিত একজন রাজনীতিবিদকে ধারণ এবং অবদান রাখার সুযোগ করে দিতে; তাকে নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করতে।
দুর্ভাগ্যবশত শুধু মঞ্জুই নন, বাস্তবতা হলো, তার মতো অগণিত নিবেদিতপ্রাণ সজ্জন আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে প্রতিনিয়ত বিতাড়িত হন। বস্তুত আমাদের রাজনীতিতে এখন যেন এক ধরনের 'গ্রেসামস ল' কাজ করে। ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে টমাস গ্রাহাম পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, 'গুড মানি ড্রাইভস ব্যাড মানি আউট অব সার্কুলেশন'_ ভালো টাকা খারাপ টাকার প্রচলনকে রুদ্ধ করে। তেমনিভাবে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে যেন সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণমুখী রাজনীতিবিদরা নিয়মিতভাবে বিতাড়িত হন এবং হচ্ছেন। অর্থাৎ তারা রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারছেন না। এর মূল কারণ হলো রাজনীতির নামে অপরাজনীতির চর্চা। আর এ অপরাজনীতি তথা অপসংস্কৃতির অদূর ভবিষ্যতে অবসান না ঘটলে জাতি হিসেবে আমাদের জন্য ভবিষ্যতে আরও অনেক দুঃখ-কষ্ট অপেক্ষা করছে। এটাই হোক মঞ্জুর জীবন থেকে আমাদের কঠিন শিক্ষা।
ড. বদিউল আলম মজুমদার :সম্পাদক
'সুজন, সুশাসনের জন্য নাগরিক'
No comments