সমাজ-ভিক্ষুক ও ভবঘুরে সমস্যা by এহতেশামুল হক

বঘুরেদের পুনর্বাসন ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত নারীদের জন্য সরকারের যথাক্রমে ৬টি পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং ৬টি প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র আছে। এগুলোতে মোট দুই হাজার চারশ' ব্যক্তিকে স্থান দেওয়া সম্ভব। তবে এসব ক্ষেত্রে খাবার এবং থাকার মান যেমন নিম্ন, তেমনি মহিলাদের ওপর শারীরিক, মানসিক ও যৌন হয়রানিও নিত্যদিনের ঘটনা বলে অভিযোগ রয়েছে\\ সম্প্রতি ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তিদের জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃৃৃক্ত করার


লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে 'ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) বিল-২০১১' পাস হয়েছে। পাস হওয়া বিলটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে 'বেঙ্গল ভ্যাগরেন্সি অ্যাক্ট-১৯৪৩' যথাযথভাবে প্রয়োগযোগ্য হচ্ছিল না। এ জন্য আইনটি যুগোপযোগী করতেই বিলটি আনা হয়েছে। বিলে বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধগুলোর বিচার হবে 'মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯' অনুযায়ী। এই বিলের ৯ ধারা অনুসারে পুলিশের এসআই পদমর্যাদার নিচে নন এমন কর্মকর্তা অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা কোনো ব্যক্তিকে ভবঘুরে বলে গণ্য করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে মর্মে নিশ্চিত হলে তিনি ওই ব্যক্তিকে যে কোনো স্থান থেকে যে কোনো সময় আটক করতে পারবেন। এই আইনে সন্দেহের ভিত্তিতে যে কোনো ব্যক্তিকে আটক করা যাবে বলে এর অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ ছাড়া এ আইনের কয়েকটি সংজ্ঞা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে অনেকেই মনে করেন। যেমন এতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তির বসবাসের বা রাতযাপনের সুনির্দিষ্ট কোনো স্থান নেই অথবা যিনি উদ্দেশ্যহীনভাবে অথবা রাস্তায় ঘোরাফেরা করে জনসাধারণকে বিরক্ত করবেন অথবা যিনি নিজে কারও প্ররোচনায় ভিক্ষাবৃত্তিতে লিপ্ত হবেন তিনি ভবঘুরে বা ভ্যাগাবন্ড বলে গণ্য হবেন। আভিধানিক বা আক্ষরিক অর্থে ভ্যাগাবন্ড বা ভবঘুরে হচ্ছে তারা, যারা কিনা শারীরিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কাজ না করে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায়। যাদের সুনির্দিষ্ট কোনো থাকার জায়গা নেই তারাও এ সংজ্ঞার আওতায় পড়ে। কিন্তু এই সব সংজ্ঞা আমাদের সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে সাংঘর্ষিক। এ ছাড়া সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের অনুচ্ছেদ ১৫তে উলি্লখিত মৌলিক প্রয়োজন (অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও চিকিৎসা) নিশ্চিতকল্পে আমাদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো এই চলি্লশ বছরে কতটুকু সচেষ্ট ছিল_ সেই প্রশ্নেরও উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে না।
ভবঘুরে আইন অসহায় নাগরিক বা মানুষের জীবন এবং চলাচলের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করে। এ আইনে ভিক্ষাবৃত্তিকে ভবঘুরের সমতুল্য গণ্য করা হয়েছে, যদিও তাদের অনেকের নিজস্ব আবাসন এবং পারিবারিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। ফলে আইনটি দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষত নারী, পথশিশু, ভিক্ষুক ও নিরাশ্রয় ব্যক্তিদের জীবনধারণের স্বাধীনতাকে ব্যাহত করবে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য, কোনো ব্যক্তি দাতব্য, ধর্মীয় বা জনহিতকর কাজের উদ্দেশ্যে অর্থ, খাদ্য বা অন্য কোনো প্রকার দান সংগ্রহ করলে এবং উক্ত উদ্দেশ্যে বা কাজে তা ব্যবহার করলে তিনি ভবঘুরের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।
ঢাকা শহরে এই ভবঘুরেদের সংখ্যা কত? এর সঠিক উত্তর হয়তো পাওয়া কঠিন। একটি সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কেবল রাজধানীতেই ২০০৪ সালে মোট টোকাইর সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারাদেশে ভিক্ষুকের মোট সংখ্যা ৯ লাখ। এদের মধ্যে এক লাখের বাস ঢাকায় এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৪ থেকে ৬ হাজার। ভবঘুরেদের পুনর্বাসন ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত নারীদের জন্য সরকারের যথাক্রমে ৬টি পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং ৬টি প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র আছে। এগুলোতে মোট দুই হাজার চারশ' ব্যক্তিকে স্থান দেওয়া সম্ভব। তবে এসব ক্ষেত্রে খাবার এবং থাকার মান যেমন নিম্ন, তেমনি মহিলাদের ওপর শারীরিক, মানসিক ও যৌন হয়রানিও নিত্যদিনের ঘটনা বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা বাইরের গুণ্ডা-পাণ্ডাদের সহায়তায় এসব আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ও নির্যাতন চালায়।
ভবঘুরে সমস্যার সমাধান আইন প্রণয়নে নয়, বাস্তবায়নের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। সুতরাং আইনের বাস্তবায়ন যদি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা না যায় তাহলে ১৯৪৩ সালে প্রণীত বেঙ্গল ভ্যাগরেন্সি অ্যাক্ট, আর ২০১১ সালে প্রণীত 'ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) বিলের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। এ জন্য ভবঘুরের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি আশ্রয়স্থলে রাখা প্রয়োজন।

এহতেশামুল হক : শিক্ষক
enoman@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.