কলকাতায় হাসপাতালে আগুন, নিহত ৮৯
পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার ঢাকুরিয়া এলাকার বেসরকারি আমরি (এএমআরআই) হাসপাতালে শুক্রবার ভোরে এক ভয়াবহ অগি্নকাণ্ডে ৮৯ জনের করুণ মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে গৌরাঙ্গ মণ্ডল নামে এক বাংলাদেশি রয়েছেন। তার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলার খারশুর গ্রামে। অগি্নকাণ্ডের এ মর্মান্তিক ঘটনার পর হাসপাতালে যথাযথ অগি্ননিরোধক ও জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থা না থাকায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দমকল
দফতরের অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা করেছে পুলিশ। এরই মধ্যে হাসপাতালের ছয় পরিচালক থানায় আত্মসমর্পণ করেছেন। তাদের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যথাযথ তদন্তের পর
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, এটা অমার্জনীয় অপরাধ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মর্মান্তিক এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া এ ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
অগি্নকাণ্ডের ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করেছেন সিপিআই সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্ত। অন্যদিকে বামেদের দুষছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, সিপিএমের আমলে তৈরি এ হাসপাতাল বাম ঘনিষ্ঠদের। অবশ্য রাজ্য সরকারের গাফিলতির দিকে আঙুল তুলেছেন সিপিএমের বাসুদেব আচারিয়া।
দমকল দফতরের কর্মকর্তারা জানান, বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটায় হাসপাতালের এনেক্স ভবনের বেজমেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত। এরপর পুরো হাসপাতাল ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। হাসপাতালের আইসিসিইউ ও আইটিইউতে রোগীদের অধিকাংশই আগুনের ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। ঘটনার পর রোগীদের স্বজনরা হাসপাতালে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত রোগীদের পরিবারকে ৫ লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
উদ্ধারকর্মীরা জানান, নিহতদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের নগর উন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের চাচা ও হাসপাতালের তিনজন কর্মী রয়েছেন। দমকল দফতর আমরি হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগে বলেছে, হাসপাতালে যথাযথ অগি্ননিরোধক ও জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থা ছিল না। আগুন লাগার পরপর হাসপাতালের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী পালিয়ে যান। কর্মকর্তারা জানান, দমকল বাহিনীর ২৫টি দল আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। স্থানীয় কাউন্সিলর চৈতালি চ্যাটার্জি বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও কিছু মানুষ ভেতরে আটকে পড়েন।
এদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাসপাতাল এলাকায় পেঁৗছলে নিরাপত্তার জন্য উদ্ধার তৎপরতা কিছুটা ব্যাহত হয়। এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ মানুষের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। শুক্রবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা হাসপাতালের পাশের ছোট গলি দিয়ে হাসপাতাল এলাকায় পেঁৗছলে সাধারণ মানুষ এবং গণমাধ্যমকর্মীরা সেখানে ভিড় করেন। এরপর শুরু হয় হট্টগোল। রোগীদের স্বজনদের অভিযোগ, বিশৃঙ্খলার কারণে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সও তখন পেঁৗছতে পারছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাইক হাতে নিয়ে পুলিশকে লাঠিপেটা করতে বারণ করেন। এ সময় পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে মমতা রোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। ভিড় ঠেলে এক রোগীর স্বজন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে বলেন, তিনি এখানে আসায় অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালের বর্ধিত ভবন পর্যন্ত আসতে পারছে না। মুখ্যমন্ত্রী তখন অ্যাম্বুলেন্স পেঁৗছার ব্যবস্থা করে দেন। আরেক রোগীর স্বজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার বাবা হাসপাতালের ভেতরে, আমি এখন পর্যন্ত তার কোনো খবর পাইনি। অথচ সাংবাদিকরা মুখ্যমন্ত্রীর ছবি তুলতেই ব্যস্ত। সেখানে উত্তেজিত জনতা একজন ফটোসাংবাদিককে মারধর ও অন্য সাংবাদিকদের ক্যামেরা ভাংচুর করে।
কীভাবে অগি্নকাণ্ড
হাসপাতালের বেজমেন্টে দাহ্য পদার্থ মজুদ ছিল। কর্তৃপক্ষ বেজমেন্টকে স্টোর হিসেবে ব্যবহার করছিল। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের ফলে সেখানে আগুন লাগে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে কিছুই জানাতে পারেনি। হাসপাতাল সূত্র জানায়, অগি্নকা ের সময় হাসপাতালে প্রায় ১৬০ রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে ৮৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি অনেককে বাঙ্গুর ও মুকুন্দপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সময় রাত ১১টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দফতরের কর্মীরা হাসপাতালের ভেতরে আটকেপড়া রোগী, চিকিৎসক ও নার্সদের উদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন। উদ্ধারকর্মীরা জানান, আগুনে গুরুতর আহতদের অন্যান্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রোগীদের উদ্বিগ্ন স্বজনদের কারণে উদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
পুলিশ বলছে, বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটায় হাসপাতালের এনেক্স ভবনের বেজমেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত। পরে তা দ্রুত চারটি তলায় ছড়িয়ে পড়ে। পুরো হাসপাতালে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লে রোগীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক।
রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান ও কলকাতার পুলিশ কমিশনার আরকে পচানন্দ সকালেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান। দমকলের ২৫টি ইউনিট ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ আনে। হাসপাতালে ঢোকার পথ সংকীর্ণ হওয়ায় অসুবিধার মুখে পড়তে হয় তাদের।
বেজমেন্টে আগুন লাগার পর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে ধোঁয়া অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের ১৬০টি শয্যাতে তখন রোগী ভর্তি ছিল। খবর পেয়ে দমকলকর্মীরা মই বেয়ে উঠে ভবনের বাইরের কাচ ভেঙে কপিকলের সাহায্যে রোগীদের নিচে নামিয়ে আনতে শুরু করেন। কলকাতা দমকল বিভাগের প্রধান গোপাল ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের জানান, তারা ৮৫ রোগীকে অন্য হাসপাতালে সরিয়ে নিয়েছেন।
উদ্ধার তৎপরতা
কলকাতার একটি টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে দেখা যায়, কয়েকজন রোগী হাসপাতাল ভবনের জানালা দিয়ে সাদা পতাকা উড়িয়ে সাহায্য চাইছেন। আরেকটি জানালা বেয়ে এক রোগীকে নেমে আসার চেষ্টা করতে দেখা যায়, যার হাতের সঙ্গে তখনও স্যালাইনের বোতল বাঁধা ছিল। দমকল কর্তৃপক্ষ আগুন লাগার কারণ জানাতে না পারলেও ফিরহাদ হাকিম ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালের বেজমেন্টে অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ ছিল। গ্যারেজের সঙ্গেই এসব রাখা হয়েছিল। ফলে শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে।
আগুন লাগার খবর ছড়িয়ে পড়লে ভোরেই হাসপাতাল এলাকায় বহু মানুষের ভিড় জমে যায়। রোগীদের স্বজনরা অগি্নকা ের জন্য কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকে দায়ী করে অভ্যর্থনা কক্ষে ভাংচুর চালায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সকাল পৌনে ১০টায় ঘটনাস্থলে পেঁৗছলে গণমাধ্যমকর্মীসহ ব্যাপক লোক সমাগম হয়। এতে দমকল বাহিনীর উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হয়। রোগীর আত্মীয়স্বজন মমতা এবং গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এর আগে ২০০৮ সালেও একবার বড় ধরনের অগি্নকা ঘটেছিল দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ার এ হাসপাতালে। ওই অগি্নকা ের কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
পশ্চিমবঙ্গের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় হাসপাতাল পরিদর্শন করে বলেন, উদ্ধার কাজ শেষের পর এএমআরআই গ্রুপের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে রাজ্য সরকার। তিনি বলেন, এত রোগী আটকা পড়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি_ এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আগুন লাগার পর হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পালিয়ে যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর কর্তৃপক্ষের কর্মকা ে বিশৃঙ্খলা ও অদক্ষতা দেখা গেছে। তাদের তাৎক্ষণিক কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। রোগী ও তাদের পরিবারের লোকজনকে এ ব্যাপারে কোনো কিছু জানানোও হয়নি। অগি্নকা ের সময় ঘটনাস্থলের এক নারী জানান, 'আমরা ঘুমিয়েছিলাম, লোকজনের চিৎকারে জানতে পারি আগুন লেগেছে। হাসপাতালের কর্মীরা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বলেছে, শান্ত থাকুন, কিছু হবে না।'
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা অমার্জনীয় অপরাধ। তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে একটি প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে মামলা করা হয়েছে।
পুরো ভবনে কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকায় সেটি পুরোপুরি কাচ দিয়ে ঘেরা ছিল। ফলে ভেতরে ধোঁয়া ঢুকে দমবন্ধ করা পরিবেশ তৈরি হয়। রোগীরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। ল্যাডারের সাহায্যে দমকল ও ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের কর্মীরা ওপরে উঠে কাচ ভেঙে অনেক রোগীকে বাইরে বের করে আনতে সমর্থ হন।
আমরি কর্তৃপক্ষ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এনেক্স বিল্ডিংয়ে চিকিৎসারত রোগীদের প্রায় ৭০ শতাংশকে দ্রুত মূল ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাদের সাহায্য করেছেন ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের কর্মীরাও। দুটি ল্যাডারের সাহায্যে আটকে থাকা রোগীদের নামিয়ে আনা হয়। এ পর্যন্ত যে দেহগুলো উদ্ধার হয়েছে তাদের মধ্যে কয়েকজন আগুনে ঝলসে মারা গেলেও বাকি সবারই মৃত্যু হয়েছে শ্বাসরোধ হয়ে। মৃতদের মধ্যে রোগী ছাড়াও কয়েকজন নার্স রয়েছেন। মৃতদেহগুলো উদ্ধার করে হাসপাতালের মূল ভবনের একতলা ও দোতলায় দীর্ঘক্ষণ রাখা হয়। পরে সেগুলো ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। আত্মীয়দের অনুরোধ করা হয়েছে সেখানে গিয়ে মৃতদেহগুলো শনাক্ত করতে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও বিধানসভার বিরোধীদলীয় নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, পুর ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান, জনস্বাস্থ্য ও কারিগরিমন্ত্রী সুব্রত মুখার্জি এবং মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় ঘটনাস্থলে যান। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘক্ষণ ঘটনাস্থলে থেকে রোগীদের উদ্ধারকাজ তদারক করেন। পরে তিনি এসএসকেএম হাসপাতালেও যান।
সরকারের অভিযোগ
পশ্চিমবঙ্গের জনস্বাস্থ্যমন্ত্রী সুব্রত মুখার্জি হাসপাতাল পরিদর্শনের পর গণমাধ্যমকে বলেন, আগুন লাগার পর আমরি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আটক রোগীদের উদ্ধারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ ঘটনা সত্যি অত্যন্ত মর্মান্তিক। তিনি বলেন, ঘটনার পর উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করার পরিবর্তে হাসপাতালের সিনিয়র কর্মকর্তারা পালিয়ে যান। উদ্ধার কাজ শেষ হওয়ার পর আমরি গ্রুপের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি হুশিয়ার করেন।
'বাবাকে বাঁচানোর
অনুমতিও পাইনি'
দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়াকে রাজা গাঙ্গুলী নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী আগুন লাগার ঘটনার মর্মস্পর্শী বিবরণ দেন। তিনি জানান, রাত আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে অনেকের মতো আমিও হাসপাতালের বেজমেন্ট থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখি। আমার বাবা হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আমি দৌড়ে আইসিইউতে যাই। এটি হাসপাতালের ওপরের তলায় ছিল। আমি গিয়ে ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য প্রশাসনিক স্টাফকে সতর্ক করে দিই যে, ভবনের বেজমেন্টে আগুন লেগেছে এবং সেখান থেকে প্রচুর ধোঁয়া বের হচ্ছে। এখনই রোগীদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া উচিত; কিন্তু কেউ আমার কথায় গুরুত্ব দেননি। তারা জানান, সামান্য আগুনে সুরক্ষিত আইসিইউর কোনো ক্ষতি হবে না। তখন পরিস্থিতি বুঝে আমি কাচের এ পাশ থেকে আমার বাবাকে শেষবারের মতো একনজর দেখে দ্রুত ভবনের নিচতলায় নেমে আসি। এখানে রোগীর স্বজনদের থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। কিছু সময়ের মধ্যে পুরো ভবনে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। এক সময় চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পাই। সবাই প্রচণ্ড ধোঁয়ায় কাশতে থাকে। আমি ধোঁয়ায় সামনের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার অন্তরাত্মা বলল, সবশেষ! আমি তখন দেরি না করে অন্যদের সঙ্গে ভবনের বাইরে খোলা জায়গায় বেরিয়ে যাই। চারদিকে তখন আর্তচিৎকার, হৈচৈ। এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। আমি সবাইকে চিৎকার করে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছিলাম। ফোন করে ফায়ার ব্রিগেডকে জরুরি সাহায্যের আবেদন জানাই। এর পরপরই দমকল বাহিনীর গাড়ি হাসপাতালে পেঁৗছে যায়।
প্রায় ছয় ঘণ্টা পার হওয়ার পর মৃত ব্যক্তিদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেখানে আমার বাবার নাম ছিল না। আমার মনে আশার ক্ষীণ আলো জ্বলে উঠেছিল। হয়তো আমার বাবা অলৌকিকভাবে বেঁচে আছেন। তার কিছুই হয়নি। আমি দমকল বাহিনীর কর্মীদের সঙ্গে আইসিইউতে গেলাম বাবার খোঁজে। গিয়ে দেখি বাবা অপর এক রোগীর সঙ্গে মৃত পড়ে আছেন।
ময়নাতদন্ত শেষে বাবার লাশ নেওয়ার জন্য এখন আমি মর্গের বাইরে অপেক্ষা করছি।
শেখ হাসিনার শোক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগি্নকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের কাছে পাঠানো শোকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, 'এ ঘটনায় আমি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি।'
প্রেস সচিব জানান, শেখ হাসিনা বিশেষভাবে দুঃখিত হয়েছেন এই কারণে যে, এখানে তারা রোগমুক্তির আশায় আশ্রয় নিয়ে এ পরিণতির শিকার হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দোনেশিয়ায় তার সরকারি সফর শেষে দেশে ফিরেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো শোকবার্তায় হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান এবং নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। তিনি আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের শোকবার্তা
বাংলাদেশিসহ প্রায় ১০০ মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে খালেদা জিয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠানো শোকবার্তায় ভয়াবহ অগি্নকাণ্ডের ঘটনায় গভীর সমবেদনা জানান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণা ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পাঠানো পৃথক শোকবার্তায় এ অগি্নকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন। এসএম কৃষ্ণার কাছে পাঠানো বার্তায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'আমরা এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় হতাহতের খবরে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি।' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পাঠানো বার্তায় দীপু মনি বলেন, 'সরকার, বাংলাদেশের জনগণ ও আমার নিজের পক্ষ থেকে আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করছি।'
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, এটা অমার্জনীয় অপরাধ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মর্মান্তিক এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া এ ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
অগি্নকাণ্ডের ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করেছেন সিপিআই সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্ত। অন্যদিকে বামেদের দুষছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, সিপিএমের আমলে তৈরি এ হাসপাতাল বাম ঘনিষ্ঠদের। অবশ্য রাজ্য সরকারের গাফিলতির দিকে আঙুল তুলেছেন সিপিএমের বাসুদেব আচারিয়া।
দমকল দফতরের কর্মকর্তারা জানান, বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটায় হাসপাতালের এনেক্স ভবনের বেজমেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত। এরপর পুরো হাসপাতাল ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। হাসপাতালের আইসিসিইউ ও আইটিইউতে রোগীদের অধিকাংশই আগুনের ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। ঘটনার পর রোগীদের স্বজনরা হাসপাতালে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত রোগীদের পরিবারকে ৫ লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
উদ্ধারকর্মীরা জানান, নিহতদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের নগর উন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের চাচা ও হাসপাতালের তিনজন কর্মী রয়েছেন। দমকল দফতর আমরি হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগে বলেছে, হাসপাতালে যথাযথ অগি্ননিরোধক ও জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থা ছিল না। আগুন লাগার পরপর হাসপাতালের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী পালিয়ে যান। কর্মকর্তারা জানান, দমকল বাহিনীর ২৫টি দল আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। স্থানীয় কাউন্সিলর চৈতালি চ্যাটার্জি বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও কিছু মানুষ ভেতরে আটকে পড়েন।
এদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাসপাতাল এলাকায় পেঁৗছলে নিরাপত্তার জন্য উদ্ধার তৎপরতা কিছুটা ব্যাহত হয়। এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ মানুষের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। শুক্রবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা হাসপাতালের পাশের ছোট গলি দিয়ে হাসপাতাল এলাকায় পেঁৗছলে সাধারণ মানুষ এবং গণমাধ্যমকর্মীরা সেখানে ভিড় করেন। এরপর শুরু হয় হট্টগোল। রোগীদের স্বজনদের অভিযোগ, বিশৃঙ্খলার কারণে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সও তখন পেঁৗছতে পারছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাইক হাতে নিয়ে পুলিশকে লাঠিপেটা করতে বারণ করেন। এ সময় পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে মমতা রোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। ভিড় ঠেলে এক রোগীর স্বজন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে বলেন, তিনি এখানে আসায় অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালের বর্ধিত ভবন পর্যন্ত আসতে পারছে না। মুখ্যমন্ত্রী তখন অ্যাম্বুলেন্স পেঁৗছার ব্যবস্থা করে দেন। আরেক রোগীর স্বজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার বাবা হাসপাতালের ভেতরে, আমি এখন পর্যন্ত তার কোনো খবর পাইনি। অথচ সাংবাদিকরা মুখ্যমন্ত্রীর ছবি তুলতেই ব্যস্ত। সেখানে উত্তেজিত জনতা একজন ফটোসাংবাদিককে মারধর ও অন্য সাংবাদিকদের ক্যামেরা ভাংচুর করে।
কীভাবে অগি্নকাণ্ড
হাসপাতালের বেজমেন্টে দাহ্য পদার্থ মজুদ ছিল। কর্তৃপক্ষ বেজমেন্টকে স্টোর হিসেবে ব্যবহার করছিল। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের ফলে সেখানে আগুন লাগে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে কিছুই জানাতে পারেনি। হাসপাতাল সূত্র জানায়, অগি্নকা ের সময় হাসপাতালে প্রায় ১৬০ রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে ৮৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি অনেককে বাঙ্গুর ও মুকুন্দপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
স্থানীয় সময় রাত ১১টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দফতরের কর্মীরা হাসপাতালের ভেতরে আটকেপড়া রোগী, চিকিৎসক ও নার্সদের উদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন। উদ্ধারকর্মীরা জানান, আগুনে গুরুতর আহতদের অন্যান্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রোগীদের উদ্বিগ্ন স্বজনদের কারণে উদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
পুলিশ বলছে, বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটায় হাসপাতালের এনেক্স ভবনের বেজমেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত। পরে তা দ্রুত চারটি তলায় ছড়িয়ে পড়ে। পুরো হাসপাতালে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লে রোগীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় আতঙ্ক।
রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান ও কলকাতার পুলিশ কমিশনার আরকে পচানন্দ সকালেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান। দমকলের ২৫টি ইউনিট ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ আনে। হাসপাতালে ঢোকার পথ সংকীর্ণ হওয়ায় অসুবিধার মুখে পড়তে হয় তাদের।
বেজমেন্টে আগুন লাগার পর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে ধোঁয়া অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের ১৬০টি শয্যাতে তখন রোগী ভর্তি ছিল। খবর পেয়ে দমকলকর্মীরা মই বেয়ে উঠে ভবনের বাইরের কাচ ভেঙে কপিকলের সাহায্যে রোগীদের নিচে নামিয়ে আনতে শুরু করেন। কলকাতা দমকল বিভাগের প্রধান গোপাল ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের জানান, তারা ৮৫ রোগীকে অন্য হাসপাতালে সরিয়ে নিয়েছেন।
উদ্ধার তৎপরতা
কলকাতার একটি টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে দেখা যায়, কয়েকজন রোগী হাসপাতাল ভবনের জানালা দিয়ে সাদা পতাকা উড়িয়ে সাহায্য চাইছেন। আরেকটি জানালা বেয়ে এক রোগীকে নেমে আসার চেষ্টা করতে দেখা যায়, যার হাতের সঙ্গে তখনও স্যালাইনের বোতল বাঁধা ছিল। দমকল কর্তৃপক্ষ আগুন লাগার কারণ জানাতে না পারলেও ফিরহাদ হাকিম ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালের বেজমেন্টে অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ ছিল। গ্যারেজের সঙ্গেই এসব রাখা হয়েছিল। ফলে শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে।
আগুন লাগার খবর ছড়িয়ে পড়লে ভোরেই হাসপাতাল এলাকায় বহু মানুষের ভিড় জমে যায়। রোগীদের স্বজনরা অগি্নকা ের জন্য কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকে দায়ী করে অভ্যর্থনা কক্ষে ভাংচুর চালায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সকাল পৌনে ১০টায় ঘটনাস্থলে পেঁৗছলে গণমাধ্যমকর্মীসহ ব্যাপক লোক সমাগম হয়। এতে দমকল বাহিনীর উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হয়। রোগীর আত্মীয়স্বজন মমতা এবং গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এর আগে ২০০৮ সালেও একবার বড় ধরনের অগি্নকা ঘটেছিল দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ার এ হাসপাতালে। ওই অগি্নকা ের কারণ এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
পশ্চিমবঙ্গের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় হাসপাতাল পরিদর্শন করে বলেন, উদ্ধার কাজ শেষের পর এএমআরআই গ্রুপের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে রাজ্য সরকার। তিনি বলেন, এত রোগী আটকা পড়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি_ এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আগুন লাগার পর হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পালিয়ে যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর কর্তৃপক্ষের কর্মকা ে বিশৃঙ্খলা ও অদক্ষতা দেখা গেছে। তাদের তাৎক্ষণিক কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। রোগী ও তাদের পরিবারের লোকজনকে এ ব্যাপারে কোনো কিছু জানানোও হয়নি। অগি্নকা ের সময় ঘটনাস্থলের এক নারী জানান, 'আমরা ঘুমিয়েছিলাম, লোকজনের চিৎকারে জানতে পারি আগুন লেগেছে। হাসপাতালের কর্মীরা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বলেছে, শান্ত থাকুন, কিছু হবে না।'
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা অমার্জনীয় অপরাধ। তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে একটি প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে মামলা করা হয়েছে।
পুরো ভবনে কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকায় সেটি পুরোপুরি কাচ দিয়ে ঘেরা ছিল। ফলে ভেতরে ধোঁয়া ঢুকে দমবন্ধ করা পরিবেশ তৈরি হয়। রোগীরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। ল্যাডারের সাহায্যে দমকল ও ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের কর্মীরা ওপরে উঠে কাচ ভেঙে অনেক রোগীকে বাইরে বের করে আনতে সমর্থ হন।
আমরি কর্তৃপক্ষ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এনেক্স বিল্ডিংয়ে চিকিৎসারত রোগীদের প্রায় ৭০ শতাংশকে দ্রুত মূল ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাদের সাহায্য করেছেন ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের কর্মীরাও। দুটি ল্যাডারের সাহায্যে আটকে থাকা রোগীদের নামিয়ে আনা হয়। এ পর্যন্ত যে দেহগুলো উদ্ধার হয়েছে তাদের মধ্যে কয়েকজন আগুনে ঝলসে মারা গেলেও বাকি সবারই মৃত্যু হয়েছে শ্বাসরোধ হয়ে। মৃতদের মধ্যে রোগী ছাড়াও কয়েকজন নার্স রয়েছেন। মৃতদেহগুলো উদ্ধার করে হাসপাতালের মূল ভবনের একতলা ও দোতলায় দীর্ঘক্ষণ রাখা হয়। পরে সেগুলো ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। আত্মীয়দের অনুরোধ করা হয়েছে সেখানে গিয়ে মৃতদেহগুলো শনাক্ত করতে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও বিধানসভার বিরোধীদলীয় নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, পুর ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান, জনস্বাস্থ্য ও কারিগরিমন্ত্রী সুব্রত মুখার্জি এবং মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় ঘটনাস্থলে যান। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘক্ষণ ঘটনাস্থলে থেকে রোগীদের উদ্ধারকাজ তদারক করেন। পরে তিনি এসএসকেএম হাসপাতালেও যান।
সরকারের অভিযোগ
পশ্চিমবঙ্গের জনস্বাস্থ্যমন্ত্রী সুব্রত মুখার্জি হাসপাতাল পরিদর্শনের পর গণমাধ্যমকে বলেন, আগুন লাগার পর আমরি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আটক রোগীদের উদ্ধারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ ঘটনা সত্যি অত্যন্ত মর্মান্তিক। তিনি বলেন, ঘটনার পর উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করার পরিবর্তে হাসপাতালের সিনিয়র কর্মকর্তারা পালিয়ে যান। উদ্ধার কাজ শেষ হওয়ার পর আমরি গ্রুপের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি হুশিয়ার করেন।
'বাবাকে বাঁচানোর
অনুমতিও পাইনি'
দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়াকে রাজা গাঙ্গুলী নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী আগুন লাগার ঘটনার মর্মস্পর্শী বিবরণ দেন। তিনি জানান, রাত আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে অনেকের মতো আমিও হাসপাতালের বেজমেন্ট থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখি। আমার বাবা হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আমি দৌড়ে আইসিইউতে যাই। এটি হাসপাতালের ওপরের তলায় ছিল। আমি গিয়ে ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য প্রশাসনিক স্টাফকে সতর্ক করে দিই যে, ভবনের বেজমেন্টে আগুন লেগেছে এবং সেখান থেকে প্রচুর ধোঁয়া বের হচ্ছে। এখনই রোগীদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া উচিত; কিন্তু কেউ আমার কথায় গুরুত্ব দেননি। তারা জানান, সামান্য আগুনে সুরক্ষিত আইসিইউর কোনো ক্ষতি হবে না। তখন পরিস্থিতি বুঝে আমি কাচের এ পাশ থেকে আমার বাবাকে শেষবারের মতো একনজর দেখে দ্রুত ভবনের নিচতলায় নেমে আসি। এখানে রোগীর স্বজনদের থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। কিছু সময়ের মধ্যে পুরো ভবনে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। এক সময় চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পাই। সবাই প্রচণ্ড ধোঁয়ায় কাশতে থাকে। আমি ধোঁয়ায় সামনের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার অন্তরাত্মা বলল, সবশেষ! আমি তখন দেরি না করে অন্যদের সঙ্গে ভবনের বাইরে খোলা জায়গায় বেরিয়ে যাই। চারদিকে তখন আর্তচিৎকার, হৈচৈ। এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। আমি সবাইকে চিৎকার করে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছিলাম। ফোন করে ফায়ার ব্রিগেডকে জরুরি সাহায্যের আবেদন জানাই। এর পরপরই দমকল বাহিনীর গাড়ি হাসপাতালে পেঁৗছে যায়।
প্রায় ছয় ঘণ্টা পার হওয়ার পর মৃত ব্যক্তিদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেখানে আমার বাবার নাম ছিল না। আমার মনে আশার ক্ষীণ আলো জ্বলে উঠেছিল। হয়তো আমার বাবা অলৌকিকভাবে বেঁচে আছেন। তার কিছুই হয়নি। আমি দমকল বাহিনীর কর্মীদের সঙ্গে আইসিইউতে গেলাম বাবার খোঁজে। গিয়ে দেখি বাবা অপর এক রোগীর সঙ্গে মৃত পড়ে আছেন।
ময়নাতদন্ত শেষে বাবার লাশ নেওয়ার জন্য এখন আমি মর্গের বাইরে অপেক্ষা করছি।
শেখ হাসিনার শোক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগি্নকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের কাছে পাঠানো শোকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, 'এ ঘটনায় আমি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি।'
প্রেস সচিব জানান, শেখ হাসিনা বিশেষভাবে দুঃখিত হয়েছেন এই কারণে যে, এখানে তারা রোগমুক্তির আশায় আশ্রয় নিয়ে এ পরিণতির শিকার হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দোনেশিয়ায় তার সরকারি সফর শেষে দেশে ফিরেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো শোকবার্তায় হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান এবং নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। তিনি আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের শোকবার্তা
বাংলাদেশিসহ প্রায় ১০০ মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে খালেদা জিয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠানো শোকবার্তায় ভয়াবহ অগি্নকাণ্ডের ঘটনায় গভীর সমবেদনা জানান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণা ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পাঠানো পৃথক শোকবার্তায় এ অগি্নকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন। এসএম কৃষ্ণার কাছে পাঠানো বার্তায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'আমরা এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় হতাহতের খবরে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছি।' মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পাঠানো বার্তায় দীপু মনি বলেন, 'সরকার, বাংলাদেশের জনগণ ও আমার নিজের পক্ষ থেকে আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করছি।'
No comments