মৃদুকণ্ঠ-২০০১ নির্বাচনোত্তর সহিংসতা by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

পাবলিক মেমোরি বা জনস্মৃতি স্বল্পস্থায়ী। এমনটাই ধারণা করা হয়ে থাকে। সমসাময়িক সুখ-দুঃখের ক্রমাগত অভিঘাতে নিকট-অতীতের স্মৃতিও চাপা পড়ে যায় নতুন স্মৃতিপুঞ্জের কলকাকলিতে। অবশ্য আঘাতপ্রাপ্ত ভুক্তভোগীরা বেদনার স্মৃতি বহন করে চলেন দীর্ঘদিন, সারা জীবন। বেদনার উপশম হয় না। সময়ের প্রলেপে বেঁচে থাকার তাগিদে মানিয়ে নিতে হয়। পথ চলতে হয়। কখনো কোনো কারণে সমাজের কেউ ওইসব স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করলে


ভুক্তভোগীর বেদনাগুলো জেগে ওঠে। কষ্ট দেয়। তবে সামাজিক সহমর্মিতা ভুক্তভোগীকে একটুখানি সান্ত্বনাও দেয়। বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়।
২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট যে বর্বর সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছিল, তার শিকার হয়েছিল দেশের লাখ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে ছিলেন স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, অমুসলিম, বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ। অত্যাচারের ধরন ছিল হত্যা, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, বসতবাড়িতে অগি্নসংযোগ, বাড়ি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ, জমি জবরদখল, নির্যাতনের বিনিময়ে 'কাফফারা' বা 'জিজিয়া' অর্থ আদায় ইত্যাদি। অনেকেই সর্বস্ব হারিয়েছেন, দেশত্যাগ করেছেন। সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় পেটোয়া বাহিনীর নৃশংস সহিংসতার বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে 'হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ' নামক মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে একটি রিট করা হয়। শুনানি শেষে হাইকোর্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। নির্দেশনানুযায়ী সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মুহাম্মদ শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কমিটি সরেজমিন তদন্ত করে ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তাদের রিপোর্ট পেশ করে।
কমিশন ২০১০ সালে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে নির্বাচনোত্তর (১ অক্টোবর, ২০০১ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০০২) সহিংসতার বিবরণসহ অভিযোগ আহ্বান করেছিল। ৩৫৫টি রাজনৈতিক হত্যা, ৩২৭০টি ধর্ষণসহ শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাসহ মোট ৫৫৭১টি অভিযোগ তারা পেয়েছিল। এর মধ্যে ৩৬২৫টি অভিযোগের তদন্ত তারা করেছে। ১০৭৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২৫ জন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যসহ ২৬ হাজার নির্যাতনকারী সম্পৃক্ততার প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ সনি্নবেশিত হয়েছে। এ থেকেই সহিংসতার ব্যাপ্তি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। যেকোনো বিচারে এটা ছিল গণনির্যাতন।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি-জামায়াত গণনির্যাতনের পথে কেন অগ্রসর হয়েছিল? অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল কি? থাকলে সে উদ্দেশ্যই বা কী? প্রথম প্রশ্নটি বেশ কিছু ধারণা জন্ম দেয়। ২০০১ সালের নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, (ক) বিএনপি-জামায়াত জোট পেয়েছিল ৪০.৯৭ শতাংশ ভোট। বিপরীতে আওয়ামী লীগ একাই পেয়েছিল ৪০.১৩ শতাংশ ভোট। (খ) চারদলীয় জোটের ৪০.৯৭ শতাংশ ভোটের বিপরীতে আসনসংখ্যা ১৯৩টি। আওয়ামী লীগের ৪০.১৩ শতাংশ ভোটের বিপরীতে আসনসংখ্যা মাত্র ৬২টি। লক্ষণীয়, চারদলীয় জোট এবং আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোটসংখ্যা খুব কাছাকাছি। কিন্তু তাদের প্রাপ্ত আসনসংখ্যায় আকাশ-পাতাল তফাত। সংসদীয় নির্বাচনের ইতিহাসে এমনটি সচরাচর ঘটে না। তবে পরিসংখ্যানগতভাবে ঘটা সম্ভব। ৫০০-৬০০ বা আরো কম ভোটের ব্যবধানে ভোটপ্রার্থী জয়ী হয়েছেন এমন সংখ্যা অস্বাভাবিক বেশি। কমবেশি হাজার ভোটের ব্যবধানে আরো কিছু জোটপ্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এখানেই সন্দেহের উদ্রেক করে। প্রশাসনিক সহায়তায় ভোট কারচুপির মাধ্যমে এমনটা ঘটে থাকতে পারে। ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার মানসে, প্রায় সমসংখ্যক ভোট পাওয়া আওয়ামী লীগকে উৎপীড়নের মাধ্যমে দমন করার মানসিকতা কাজ করতে পারে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগকে এত বেশিসংখ্যক ভোট প্রদানের 'অপরাধে' ভোট প্রদানকারী জনগণকে শায়েস্তা করার প্রবণতা থেকেও গণনির্যাতন ঘটে থাকতে পারে। এটুকু বলাই যায় যে ভোটের বিচারে সমান জনপ্রিয় ভেবে আওয়ামী লীগ ও সমর্থকদের আঘাত করেছিল জোট সরকার।
এত গেল পরিপ্রেক্ষিতের কথা। এ রকম একটা প্রেক্ষাপটে গণনির্যাতনের সুনির্দিষ্ট ও সুপরিকল্পিত একটা লক্ষ্যও ছিল জোট সরকারের। লক্ষ্যটা অনুধাবন করতে হলে একটা সরলরেখা সম্বন্ধে ধারণা নিতে হবে, যে সরলরেখাটি সময়ের পটভূমিতে তিনটি বিন্দুর মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হয়েছে, বিন্দু তিনটিকে সংযুক্ত করেছে আরেকটি বিন্দুর দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য। বিন্দু তিনটি হলো_১৯৭১, ১৯৭৫ এবং ২০০১ সাল। ১৯৭১ সালে বিএনপি ছিল না, তবে বিএনপির পূর্বসূরিরা ছিল এবং জামায়াত ওই সময় তাদের মিত্র ছিল। ১৯৭৫ সালে বিএনপির ভ্রূণ জন্ম নেয়, যা পরে পূর্ণতা পায় এবং আওয়ামী বিরোধিতার ছদ্মাবরণে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্লাটফর্মে পরিণত হয়। সে সুবাদে জামায়াতের সঙ্গে সখ্যের ভিত্তিও রচিত হয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত একজোটে একাত্ম হওয়ার ফলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মঞ্চ পূর্ণশক্তি নিয়ে ক্ষমতারোহণ করে। তিন বিন্দুতে সন্ধানী দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে ওই শক্তিটির মানসিকতা, বিকৃতি এবং কৌশল সম্বন্ধে ধারণা মিলবে।
১৯৭১ সালে মত, পথ, চিন্তা-চেতনার নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে জনগণ একযোগে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছিল। রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ। একই সময়ে স্বাধীনতাবিরোধী, বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন পশ্চাৎগামী, ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ী স্বল্পসংখ্যক মানুষ বিপরীত অবস্থান নিয়েছিল। তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিল জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ। মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধ সংগ্রাম করেছে, খুন-রাহাজানি করেনি। বিপরীত শক্তি অর্থাৎ জামায়াত সমর্থিত রাজাকার, আলবদর, আলশামস গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগ করেছে। দুই মঞ্চের মানুষের মানসিকতা আলাদা, কৌশল ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধে যেমন অরাজনৈতিক সাধারণ মানুষের সমাহার ছিল, বিরোধী পক্ষেও অরাজনৈতিক ভাড়াটে এবং অর্থলিপ্সুরা ছিল। তবে নেতৃত্বে ছিল রাজনৈতিক দল।
রাজনৈতিক দলের চরিত্র নিয়ে কিছু কথা_মাল্টিক্লাস আমজনতার রাজনৈতিক দল জনসমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। এবারই জনপ্রিয় দল এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় যায়। আরেক ধরনের রাজনৈতিক দল রয়েছে, যেগুলো ক্যাডারভিত্তিক, কঠোর বিধিবিধানে আবদ্ধ এবং জনপ্রিয় দলের মতো খোলামেলা নয়। এরা নিজেদের আদর্শিক দল মনে করে। আগের দিনের কমিউনিস্ট পার্টি এ ধরনের দল। এদের নেতা সুপরীক্ষিত। এমনকি পার্টি ক্যাডার সুবিন্যস্ত। এমন আদর্শিক দলের অবয়ব ও পরিকাঠামো নিয়ে ধর্মান্ধ দল হিসেবে গড়ে উঠেছিল জামায়াতে ইসলামী। আদর্শিক দল বা ওই অবকাঠামোতে গড়ে ওঠা দলে অনুপ্রবেশ করা সুকঠিন। কিন্তু মাল্টিক্লাস জনপ্রিয় দলে ছদ্মবেশে যে কেউ, এমনকি শত্রুও ঢুকে পড়তে পারে এবং অনুপ্রবেশ করেও থাকে। অন্য দলে অনুপ্রবেশ ঘটানোকে ক্যাডারভিত্তিক দল রণকৌশল বলে আখ্যায়িত করে। এ কারণে জামায়াতে কোনো মুক্তিযুদ্ধপন্থী নেই। অথচ আওয়ামী লীগের মতো জনপ্রিয় দলে আদর্শবিরোধীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, নেতৃত্বেও চলে এসেছে। খন্দকার মোশতাক তেমনি উদাহরণ। জনবিরোধী ক্যাডারভিত্তিক দলের রণকৌশল হত্যা, বিভীষিকা সৃষ্টি এবং গণনির্যাতন। একাত্তরে এর রূপ ছিল গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগ। পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় জামায়াতের নেতৃত্বে রাজাকাররা এসব করেছে।
দৃষ্টি দেওয়া যাক ১৯৭৫ সালের দিকে। আওয়ামী লীগে আদর্শবিরোধী অনুপ্রবেশকারী খন্দকার মোশতাক রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে জামায়াত-মুসলিম লীগের সহযোগিতা ছিল। বাস্তবায়নে মুক্তিযুদ্ধ, সেনাবাহিনী এবং সরকারের অনুপ্রবেশকারী আদর্শবিরোধী ব্যক্তি, নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। সেনা-রাজনৈতিক জবরদখলপ্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত কৌশলগুলো ১৯৭১ সালে ব্যবহৃত পন্থার অনুরূপ। জনমনে ভীতি সঞ্চার করে প্রতিরোধ প্রচেষ্টাকে অবদমিত করার জন্য তারা হত্যা ও গণনির্যাতনের কৌশল প্রয়োগ করেছিল। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, জেলখানায় চার নেতাকে হত্যা, সেরনিয়াবাত-শেখ মনিকে সপরিবারে হত্যা, সামরিক বিচারের প্রহসনে সেনাছাউনিতে শত শত মুক্তিযোদ্ধা ও সেনা হত্যা, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কারারুদ্ধ ও নির্যাতন করা, এয়ারপোর্টে বিমানবাহিনীর সদস্যদের হত্যা, গণনির্যাতনের মাধ্যমে ভীতিপ্রদ পরিবেশ সৃষ্টি প্রভৃতি উল্লেখ করা যেতে পারে। একাত্তরের নির্যাতনের সঙ্গে কত মিল।
এবার আসা যাক তৃতীয় বিন্দু ২০০১ সালে। পাঁচমিশালি দল বিএনপির সঙ্গে একজোট হয়ে এবার প্রকাশ্য মঞ্চে আবির্ভূত হলো নিভৃতে থাকা জামায়াত। বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নিয়ে আওয়ামী লীগকে কেটেছেঁটে রাখতে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করতে এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র পাল্টে দিয়ে পাকিস্তানি মডেলের 'নতুন বাংলাদেশ' প্রতিষ্ঠা করতে। একাত্তরের জামায়াতের পাকিস্তান বজায় রাখা আর খন্দকার মোশতাকের কনফেডারেশন গঠনে গোপন প্রয়াস প্রলম্বিত হয়ে পঁচাত্তরে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে 'নতুন বাংলাদেশ' গঠিত হয়েছিল। ১৮টি ক্যু ও কাউন্টার ক্যু প্রচেষ্টার পর জেনারেল জিয়ার মৃত্যু ঘটলে 'নতুন বাংলাদেশ' অর্ধসমাপ্ত থেকে যায়। মুসলিম বাংলায় রূপান্তরের ষড়যন্ত্র নিয়ে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের মঞ্চে আরোহণ ঘটে। বিপুলসংখ্যক মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে, এ কথা স্মরণে রেখে তারা গণনির্যাতনের কৌশল প্রস্তুত করে। কৌশল মোতাবেক সরকার এবং সরকারি দল ধোয়া তুলসী পাতার মতো থেকেছে, আপেল কাটার ছুরিও যেন ব্যবহার করতে জানে না। তারা ছাতা ধরেছে, আশ্রয় দিয়েছে। হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগ, চাঁদাবাজি, হয়রানি_এসব করেছে নির্ধারিত সন্ত্রাসী ও সংস্থাগুলো। জেএমবি, হরকাতসহ বিভিন্ন সংগঠনের নামে এবং বাংলা ভাই, মুফতি হান্নান প্রমুখ ব্যক্তির নামে সশস্ত্র ক্যাডাররা গণনির্যাতন চালিয়েছে অবিরাম। সরকার চোখ বন্ধ রেখেছে। ছত্রচ্ছায়া দিয়েছে। গোপন সহায়তাও হয়তো দিয়েছে। ক্ষমতারোহণের প্রথম বছরে নির্মম গণনির্যাতন ঘটলেও নির্যাতনের সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপটি প্রকাশিত হয়নি। মিডিয়াও ভীত ছিল। এর মধ্যেও দু-চারটি পত্রিকায় প্রকাশ হয়ে পড়ল কুকীর্তির কাহিনী। মনে পড়ে কি পূর্ণিমা নামে সেই কিশোরীর কথা? দল বেঁধে ধর্ষণ করতে এসেছে। অসহায় মায়ের আকুতি_'আমার মেয়ে ছোট। বাবারা, তোমরা একসাথে ঘরে ঢুকো না। একজন করে ঢোকো।' মনে পড়ে কি উত্তরবঙ্গে বাস থেকে নামিয়ে আরেক কিশোরীকে গণধর্ষণ এবং হত্যা। মনে পড়ে, কত সংখ্যালঘু পরিবারকে নির্যাতন করে ভিটেমাটি ছাড়া করা হয়েছে। অসংখ্য কাহিনীর কিছু কিছু পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। অল্প দিনের মধ্যেই নির্যাতনের সংঘটিত রূপটি বেরিয়ে এল। একসঙ্গে ৬৪ জেলায় বোমা বিস্ফোরণ হলো। আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড বর্ষণ হলো। ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর বোমা আক্রমণ হলো। বোমা ফাটিয়ে শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হত্যা করা হলো। উত্তরবঙ্গে বাংলা ভাইয়ের ক্যাম্পে গ্রামবাসীকে হত্যা করে পা বেঁধে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হলো। পত্রিকায় সে ছবি এসেছে। মনে পড়ে, চট্টগ্রামের বাঁশখালী ট্র্যাজেডির কথা। নাগরিক সমাজ থেকে আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম। শিক্ষিত হিন্দু পরিবার দোতলা টিনের ঘরে একান্নবর্তী পরিবার হিসেবে বসবাস করে। রাতের খাবার শেষ করে শুয়ে পড়েছেন সবাই। শান্ত গ্রাম। রাত গভীর হচ্ছে। হঠাৎ কিয়ামত নেমে এল। চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা ঘরের দরজায় বাইরে থেকে তালা দিয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিল। একটি বাড়ি, অনেক মানুষ, অনেক স্বপ্ন জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেল। ঘুমন্ত শিশুদের আতঙ্কিত চিৎকার, নারী-পুরুষের হাহাকার আকাশ-বাতাস মথিত করে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। দোতলা থেকে লাফ দিয়ে গুরুতর আহত হয়েও পালিয়ে একমাত্র বেঁচে রইলেন বাড়ির জামাই ঘটনার সাক্ষী হয়ে। তাঁকে আজীবন বেঁচে থাকতে হবে দুঃসহ বেদনা নিয়ে। চারজোট আমলে বিচার হয়নি। মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর জট খুলেছে। বিচার হয়েছে। ছোট্ট নিবন্ধে কয়টা ঘটনাই বা উল্লেখ করা যায়। বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনে সাড়ে তিন হাজার ঘটনা তদন্ত হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। এর বাইরেও রয়ে গেছে অনেক ঘটনা, যা কমিটির নজরে আসেনি। এ ধরনের গণনির্যাতনে ২৬ হাজার নির্যাতনকারীর সম্পৃক্ততা থাকতেই পারে।
২০০১ নির্বাচনোত্তর প্রথম দুই বছরের সারা দেশের গ্রামগঞ্জের আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে। ঢাকায় অল্প ভাড়ার হোটেলে মাসের পর মাস থেকেছেন তাঁরা। ছোট হোটেলে তখন ১০০ শতাংশ অকুপেন্সি, যা কখনো হয় না। অনেকে আবার কয়েকজন মিলে মেস করে থেকেছেন। ঘরে ফেরার একটা 'এসকেপ রুট' তারা রেখেছিল। মোটা অঙ্কের চাঁদা (কাফফারা!) দিয়ে ঘরে ফিরতে পারত। তাও নিরাপত্তা ছিল না। মুসলিমের জন্য কাফফারা। হিন্দুর জন্য 'জিজিয়া'। কী চমৎকার বিধান!
একাত্তর, পঁচাত্তর এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং নির্যাতনের চিত্র ও কৌশল একই রকম। কারণ প্রণয়নকারী এক। লক্ষ্যও অভিন্ন। জনমনে ভীতির সঞ্চার করা, যাতে তারা সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক শক্তিকে নিষ্ফল করার জন্য আওয়ামী লীগের কর্মী নির্যাতন করার কৌশল নেওয়া হয়েছিল। আর সংখ্যালঘুদের অত্যাচার করে, বিশেষ করে হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করার কারণ দ্বিবিধ। আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক মনে করে তাদের বিতাড়ন করে ভোট কমানো। সেই সঙ্গে হিন্দুবিহীন 'মুসলিম বাংলা' প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। প্রথম দুই বছর হিন্দুরা দেশত্যাগ করলেও পরে তাঁরা মাটি আঁকড়ে রয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশেই। এমন শুদ্ধি অভিযান এবং ভয়ংকর নির্যাতনের সময় শান্তিপ্রিয় জনগণ সহিংস প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। তবে অহিংস গণতান্ত্রিকপ্রক্রিয়ায় ২০০৮ সালে ৮৭.১৬ শতাংশ ভোটার ভোটদান করে শান্তিপূর্ণ বিপ্লব সাধন করেছিল।
একাত্তরের সন্ত্রাসীদের বিচারকাজ শুরু হয়েছে, যদিও অনেক বিলম্বে। পঁচাত্তরের ঘাতকদের বিচার কিছু হয়েছে, অনেক বাকি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুলসহ চার নেতার বিচার এখনো হয়নি। কর্নেল তাহেরের ভুয়া বিচারের কলঙ্ক দূর করা হয়েছে। একাত্তর আর পঁচাত্তরের একই সূত্রে গাঁথা ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর হত্যা-নির্যাতনের বিচার সময়ের দাবি। জামায়াত-বিএনপির চারদলীয় শাসনামলে সংঘটিত গ্রেনেড হমলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র, কিবরিয়া হত্যা_এসব মামলার তদন্ত ও বিচার অগ্রসরমান। কাজেই নির্বাচনোত্তর প্রথম বছরের গণনির্যাতনের তদন্ত ও বিচার সামাজিক সংহতির জন্য অপরিহার্য। বিচার কিন্তু প্রতিশোধ নয়। বিচার একটি প্রতিকারপ্রক্রিয়া। নির্যাতিতের অধিকার।
বিএনপি ৬ ডিসেম্বর, ২০১১ তারিখে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, তারা তদন্ত রিপোর্ট মানে না। তারা তো কোনো কিছুই মানে না। তাদের মানা না-মানায় কী আসে যায়। নির্যাতিতরা মানলেই হলো। আসামি কখনো দোষ স্বীকার করে না। বিচারে দোষ প্রমাণিত হলে তাকে শাস্তি পেতেই হয়। তদন্ত বিচারপ্রক্রিয়ার প্রস্তুতিপর্ব মাত্র। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রতিটি অভিযোগে মামলার উপযোগী করে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে। তারপর বিচারের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে।
বিএনপি রিপোর্ট না মানার কারণ হিসেবে বলেছে যে তদন্ত দলের প্রধান ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করতেন। এসব কথা কি প্রাসঙ্গিক বা দায়িত্বশীল? তাহলে তো বলতে হয়, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে নিম্ন ও উচ্চ আদালতে অনেক বিচারক নিয়োগ দিয়েছে, যাঁরা ছাত্রদল করতেন বা তাঁদের সমর্থক। বিচার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। মামলা আদালতে যেতে যেতে বিএনপি আবার হয়তো ক্ষমতায় আরোহণ করবে।
সন্ত্রাস ও গণনির্যাতন গণতন্ত্র নিধনপ্রক্রিয়া। বিচার গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সাহায্য করে, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। গণতন্ত্র সহনশীল, কিন্তু দুর্বল নয়। বিচারপ্রক্রিয়ায় কেউ বাধা সৃষ্টি করলে দুর্বলতা প্রদর্শনের সুযোগ নেই। কারণ তা হবে আত্মঘাতী। ২০০১ নির্বাচনোত্তর সহিংসতার তদন্ত প্রতিবেদন যেন থেমে না থাকে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছ বিচারের মাধ্যমে নির্যাতিতরা যেন প্রতিকার পান।
লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
ও কলামিস্ট।

No comments

Powered by Blogger.