শিক্ষাই জীবনে চলার পথে হাতিয়ার by ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

র্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর যে কয়টি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে 'জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০' তৈরি করা। এই জাতীয় শিক্ষানীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে_সাধারণ, মাদ্রাসা এবং কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য একই হওয়া, পাঁচ বছরের নিচে প্রি-প্রাইমারি শিক্ষা; অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাকে একীভূত করা; সেকেন্ডারি লেভেলে শিক্ষা হচ্ছে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত; তিন বছরের ডিগ্রি কোর্সের মেয়াদ চার


বছর রাখা; প্রতিটি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা, একীভূত শিক্ষানীতি প্রস্তুত করা এবং স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করা। সরকারের এই শুভ উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রয়াস চালানো হচ্ছে। মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষায় কিছুটা সামঞ্জস্য বিধান করা গেলেও ইংরেজি মাধ্যমে অ্যাডেঙ্লে ও ক্যামব্রিজের আওতায় 'ও' এবং 'এ' লেভেল করা ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে আরো সুচিন্তিত মতামত থাকার প্রয়োজন ছিল।
দেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কিন্তু পর্যাপ্ত নয়। দেশে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হচ্ছে ৯৫টি। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে ৩১টি। দুটি বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। একটি হচ্ছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং অন্যটি বাংলাদেশ ওপেন ইউনিভার্সিটি। বাকিগুলো হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়াও দেশে দুটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এশিয়া ইউনিভার্সিটি ফর ওমেন এবং ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি। জনসংখ্যা এবং শিক্ষার হার অনুপাতে এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম। ২৪টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। পাশাপাশি দেশে প্রায় ৫০টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ আছে। বস্তুত যে হারে প্রতিবছর উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা পাস করে বেরোচ্ছে, সে হারে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা রয়েছে। দেশে উন্নতমানের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা স্বল্প। ফলে বিদেশের অখ্যাত-অজ্ঞাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দ্বারস্থ হচ্ছেন অনেকেই। এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ ও ইনস্টিটিউটগুলোর বেশির ভাগের মান নিম্ন। ওপেন ইউনিভার্সিটির অবস্থাও লেজেগোবরে। সরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় যেগুলো ইদানীং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোর মানও তেমন উন্নত নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ পাস করায় ভালো হয়েছে। কিন্তু এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা আছে।
আবার দেশে ভালো স্কুল-কলেজের সংখ্যাও কম। অথচ উন্নতমানের শিক্ষা ছাড়া আমাদের পক্ষে বিশ্বায়নের এ যুগে প্রতিষ্ঠা লাভ সম্ভব নয়। অনেকেই বিদেশি ডিগ্রিধারী দেখলেই মনে করে, শিক্ষার ধাপ অনেক ওপরে উঠে গেছে। একজন ছাত্রছাত্রীর কাছে রোল মডেল হবেন শিক্ষক-শিক্ষিকা। জ্ঞানের ক্ষেত্রে যে অবাধ বিচরণ তথ্যপ্রবাহমুক্ত হওয়া, তার সুষ্ঠু প্রায়োগিক কৌশল দরকার। ভোকেশনাল এবং কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা যাচ্ছেতাই। বিদেশে আমরা যাদের পাঠাচ্ছি, তাদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। দরকার ছিল বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর বিদেশের বাজারে কী ধরনের শ্রমিক প্রয়োজন, তা যাচাই-বাছাই করে দেশে জানানো। তার ভিত্তিতে প্ল্যান করে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে মানবসম্পদ প্রেরণ করা। আবার ওই দেশের বাজারে কী ধরনের কাজের সুযোগ রয়েছে, তা যাচাই-চাছাই করে তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিদেশে প্রেরণ করতে হবে। তাদের আচার-ব্যবহার, সে দেশের ভাষা ও চালচলন সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বস্তুত এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নানামুখী সমস্যায় আক্রান্ত। বর্তমান সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় চেষ্টা করলেও তা দূর করতে সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত কর্মসূচির সুষ্ঠু প্রয়োগ দরকার। কেননা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে হলে কেবল মুষ্টিময়ের মধ্যে শিক্ষা সীমিত রাখা উচিত নয়, আলো ছড়িয়ে দিতে হবে সবার মধ্যে। অবশ্য শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। আর এটি হচ্ছে জমি দিয়ে শিক্ষার গুণগত মান বিচার করা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় বলুন, অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বলুন_এক দিনে কিন্তু তৈরি হয়নি। দীর্ঘ সময় ও ব্যাপ্তি লেগেছে। তার পরও বাংলাদেশে বর্তমানে বিশ্বমানের বেশ কয়েকটি ভালো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তবে বিদেশের মতো তাদেরও উচিত দেশের স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে কেবল এমপিএইচ প্রোগ্রামের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ না রেখে এমবিবিএস, ডেন্টিস্ট বা নার্সিংসহ নানাবিধ মেডিক্যাল শিক্ষায় অগ্রসর হওয়া। এ ক্ষেত্রে কেবল গণস্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় একমাত্র ভূমিকা রাখছে। যদিও সেগুলোর গুণগত মান উপযুক্ত কর্তৃপক্ষই বলতে পারবে। ইউজিসির পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে অধিকতর তৎপর হতে হবে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অজ্ঞাত কারণে দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা স্বল্প হওয়া সত্ত্বেও তা বাড়তে দিচ্ছে না। আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিমাণ ও পরিধি বেশ সীমিত। এটি শিক্ষাক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করে থাকে। এদিকে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যয় হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে স্বল্প। এই স্বল্প ব্যয়ে আসলে সরকারের কিছুই করার নেই। বর্তমান জনকল্যাণমূলক সরকার চেষ্টা করছে, কিন্তু সামাজিক কল্যাণের যত খাত রয়েছে এবং সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কারণে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যতটুকু ব্যয় হয়, তার যথাযথ ব্যবহার ঘটানো যায় না। অথচ বর্তমান শিক্ষানীতিতে মানুষের জন্য সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং শিক্ষাক্ষেত্রকে একমুখী করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। তাদের এই সাধু উদ্দেশ্য পূরণ করতে হলে বেসরকারি বিনিয়োগ আরো সম্প্রসারিত হওয়া উচিত। দেশে যাতে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি না হয়, সে জন্য অ্যাক্রেডেনশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা উচিত। বিজয়ের ৪০ বছর পূর্তির মাসে স্মরণ করি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর প্রয়াসেই উচ্চশিক্ষা বিস্তার লাভ করেছে। বর্তমানে দেশের সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোর মান অত্যন্ত নিম্ন। সরকার এ ক্ষেত্রে চেষ্টা করলেও অনেক শিক্ষিকাই আছেন, যাঁরা তাঁদের কাজে গাফিলতি করেন। আবার কিন্ডারগার্টেনও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে যথাযথ তদারকির অভাব অত্যন্ত প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়েও পড়ার মান তেমন উন্নত নয়। অথচ বর্তমান সরকার চেষ্টা চালিয়েছিল কোচিং বন্ধ করার জন্য। সরকারের এই সাধু প্রয়াসও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। অথচ কোচিংয়ের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের সুকুমার প্রবৃত্তি ও মৌলিকত্ব নষ্ট হচ্ছে। বস্তুত দেশে জ্ঞানের প্রসারে নিম্ন পর্যায় থেকে আরম্ভ করে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা দরকার। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর বেশির ভাগের মান যাচ্ছেতাই। এই মান উন্নয়নের কোনো প্রয়াস নেই। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে গুণগত মানসম্পন্ন ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৈরি করা সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ইউজিসি কর্তৃক যাচাই করা উচিত। কেননা এগুলোর বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ আছে। আসলে শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে মানুষের আয়প্রবাহ। এ ব্যাপারে সবাইকে আরো বেশি যত্নবান হতে হবে। আর তাই নিম্ন পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা সবার জন্য সুন্দরভাবে বিশ্বমানের করতে প্রয়াস গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা হয়ে উঠুক জীবনের চলার পথে হাতিয়ার। বর্তমানে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী অত্যন্ত দক্ষ। কিন্তু তাঁর একক দক্ষতা দিয়ে তো তেমন কিছু করা সম্ভব নয়। এটি একটি টিমওয়ার্ক। প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরও তৎপর হতে হবে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্তদের ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে হবে। আদম ব্যাপারিদের হাতে পড়ে এ দেশের ছাত্রছাত্রীরা বিদেশে গিয়ে যাতে সর্বস্বান্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিক্ষা মানুষের জীবনকে আলোকিত করুক, সুন্দর করুক, মহৎ করুক।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, এমএইচ স্কুল অব বিজনেস, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়


No comments

Powered by Blogger.