ইশারার ইস্কুল by মুকিত রহমানী
মেয়ে নিপার বয়স এখন ২০ বছর। ১৯৯৪ সালে তিন বছর বয়সী এই নিপাকে নিয়েই আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন বাবা জহির আলম। টাইফয়েডে আক্রান্ত নিপাকে নিয়ে আর গ্গ্নানি সহ্য হচ্ছিল না তার। বাক ও শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলা মেয়ে নিপাকে নিয়ে তাই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন জহির। কিন্তু একটি পা ভাঙা শালিক পাখি তাকে নতুন করে বাঁচতে শেখায়। জহির ভাবেন, আহত পা নিয়ে পাখিটি বাঁচতে পারলে তিনি তার অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে
বাঁচতে পারবেন না কেন? সেই থেকে শুরু মূক ও বধির শিশুদের নিয়ে জহির আলমের ইশারার\ ইস্কুল। তার বোবা মেয়েটির জন্য আজ তাকে চেনে দেশের মানুষ। চেনে ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত 'শাহজালাল মূক ও বধির প্রতিবন্ধী স্কুলটি'। আজ শুধু জহির একা নন, সঙ্গে আছে স্কুল, প্রতিবন্ধী দেড়শ' শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সম্মান আর খ্যাতি। এরই মধ্যে 'সাদা মনের মানুষ'সহ পেয়েছেন বহু সম্মাননা ও দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের 'থ্যাঙ্কস লেটার'; কিন্তু জহির আলমের আনন্দ-বেদনা যেমন আছে, আছে স্বপ্নও। মূক ও বধিরদের জন্য কলেজ করার স্বপ্ন তাকে তাড়া করে। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ইজারা চেয়েছিলেন একখণ্ড সরকারি জমি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকার পরও ওই জমিটুকু ইজারা পাননি। প্রভাব না থাকায় তা পেয়ে যায় একটি এনজিও।
জহির আলমের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের টেংরাটিলা গ্রামে। বাবা কালা মিয়া সওদাগরের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। জীবিকার তাগিদে ১৯৯০ সালে সিলেট নগরীতে আসেন। বড় ভাই নুরুল আমিনের সানি্নধ্যে শেখেন ড্রাইভিং। পরবর্তী সময়ে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন শাহজালাল ড্রাইভিং স্কুল। ১৯৯২ সালে জহির আলম ও তার স্ত্রী আম্বিয়া বেগমের কোলে আসে প্রথম সন্তান। নাম রাখেন আজিজা আলম নিপা। সবকিছু ঠিকই চলছিল। নিপার তিন বছর বয়স হলে জহির আলমের জীবনে ঘটে ছন্দপতন। টাইফয়েড জ্বর কেড়ে নেয় নিপার বাক ও শ্রবণশক্তি। সিলেট ও ঢাকায় ডাক্তার-কবিরাজের পেছনে দৌড়েও মেয়েকে সুস্থ করতে ব্যর্থ হন জহির। '৯৪ সালে রাজধানীর আল ফারুক হোটেলে মেয়েকে নিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। বিধাতা তার এমন সিদ্ধান্ত সফল হতে দেননি। পা ভাঙা শালিক তাকে নতুন করে বাঁচতে শেখায়। জহির নতুন করে শুরু করেন সংগ্রাম। ইশারা ভাষা (সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ) রপ্ত করার জন্য নিজেই ভর্তি হন ধানম ির একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে। নিজে শেখার পর স্ত্রী ও মেয়ে নিপাকেও সেখানে ভর্তি করান। সিলেটে ফিরে ১৯৯৫ সালে প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে শুরু করেন 'শাহজালাল মূক-বধির প্রতিবন্ধী স্কুল'। শুরুতে শিক্ষার্থী ছিল সাতজন। আজ শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫০-এ। ভাড়া করা বাড়িতে চলছে স্কুলের কার্যক্রম।
শহরে স্কুল করেই থেমে থাকেননি জহির। ২০০৫ সালে গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের টেংরাটিলায়ও গড়ে তোলেন 'টেংরাটিলা মূক-বধির সংঘ' নামে আরেকটি স্কুল। সেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা এখন ৯২। এ দুটি স্কুল করতে গিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয় জহির আলমকে।
১৫ বছর ধরে নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকার অনামিকায় ৬৯ নম্বর বাসার দোতলায় পরিচালনা করছেন স্কুলের কার্যক্রম। ভাড়া ওই বাসার পাঁচ রুমের মধ্যে দুই রুমে স্ত্রী, তিন মেয়ে ও শিশুপুত্রকে নিয়ে তার সংসার। বাকি রুমগুলো ছেড়ে দিয়েছেন স্কুলের জন্য। বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত প্রথম হতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী শিশুদের ফ্রি পড়ানো হয়। বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। বর্তমানে এ স্কুলে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৫০। এর মধ্যে ৬০ জন ছাত্র ও ৯০ জন ছাত্রী। পড়াশোনা করানোর দায়িত্ব নিয়েছেন জহির আলমের দুই মেয়ে। এ ছাড়া নামমাত্র সম্মানীতে শিক্ষকতা করছেন নগরীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের আরও পাঁচ শিক্ষার্থী।
জহির আলম সমকালকে জানান, স্কুল প্রতিষ্ঠার পর পদে পদে প্রভাবশালীদের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন এনজিও স্কুলটি কেড়ে নিতে চেয়েছিল। তিনি জানান, কারিগরি শিক্ষা_ সেলাই প্রশিক্ষণ, গাড়ির পেইন্টিং, ড্রাইভিং শিখে অনেক অসহায় প্রতিবন্ধী হয়ে উঠেছে স্বাবলম্বী। বর্তমানে গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন গার্মেন্টে তার প্রশিক্ষিত আড়াইশ' প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ে কাজ করছে। তাদের কাজ দেখে তিনি আনন্দ পান, উৎসাহ পান।
তিনি ও তার স্ত্রী আম্বিয়া বেগম নিজেদের ড্রাইভিং স্কুলে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। স্বামী-স্ত্রী দু'জন মিলে মাসে যা আয় করেন তার বড় অংশই খরচ করেন স্কুলের পেছনে।
জহির আলমকে ২০০৮ সালে ইউনিলিভার-এটিএন বাংলা 'সাদা মনের মানুষ' সম্মাননা দেয়। পরের বছর বাংলালিংক তাকে মনোনীত করে 'দিনবদলের মানুষ' হিসেবে। এ ছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন সম্মাননাসহ দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ধন্যবাদপত্র পেয়েছেন। স্কুলের আদ্যপান্ত ও বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে সম্প্রতি একটি ওয়েবসাইটও (িি.িংফফংনফ.হবঃ) খুলেছেন জহির আলম।
এসব স্বীকৃতি পেয়ে যেমন আনন্দিত জহির আলম, তেমনি হতাশাও। তার স্বপ্ন বৃহৎ আকারে প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে স্থায়ী কিছু করার। সে জন্য কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে ২০০৯ সালে জেলা প্রশাসক বরাবরে সরকারি ১২ শতক জায়গা ইজারা নেওয়ার জন্য আবেদন করেন। সবকিছু ঠিক থাকার পরও পূর্ব শাহী ঈদগাহ এলাকায় অবস্থিত ওই জায়গাটুকু ইজারা পাননি। তদবিরের অভাবে সে জায়গা ইজারা পায় একটি এনজিও। তারপরও আশা ছাড়েননি জহির আলম। তিনি বলেন, 'প্রতিবন্ধীদের নিয়েই আমার পথচলা। অভীষ্ট লক্ষ্যে না পেঁৗছা পর্যন্ত আমার সংগ্রাম চলবে।'
জহির আলমের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের টেংরাটিলা গ্রামে। বাবা কালা মিয়া সওদাগরের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। জীবিকার তাগিদে ১৯৯০ সালে সিলেট নগরীতে আসেন। বড় ভাই নুরুল আমিনের সানি্নধ্যে শেখেন ড্রাইভিং। পরবর্তী সময়ে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন শাহজালাল ড্রাইভিং স্কুল। ১৯৯২ সালে জহির আলম ও তার স্ত্রী আম্বিয়া বেগমের কোলে আসে প্রথম সন্তান। নাম রাখেন আজিজা আলম নিপা। সবকিছু ঠিকই চলছিল। নিপার তিন বছর বয়স হলে জহির আলমের জীবনে ঘটে ছন্দপতন। টাইফয়েড জ্বর কেড়ে নেয় নিপার বাক ও শ্রবণশক্তি। সিলেট ও ঢাকায় ডাক্তার-কবিরাজের পেছনে দৌড়েও মেয়েকে সুস্থ করতে ব্যর্থ হন জহির। '৯৪ সালে রাজধানীর আল ফারুক হোটেলে মেয়েকে নিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। বিধাতা তার এমন সিদ্ধান্ত সফল হতে দেননি। পা ভাঙা শালিক তাকে নতুন করে বাঁচতে শেখায়। জহির নতুন করে শুরু করেন সংগ্রাম। ইশারা ভাষা (সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ) রপ্ত করার জন্য নিজেই ভর্তি হন ধানম ির একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে। নিজে শেখার পর স্ত্রী ও মেয়ে নিপাকেও সেখানে ভর্তি করান। সিলেটে ফিরে ১৯৯৫ সালে প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে শুরু করেন 'শাহজালাল মূক-বধির প্রতিবন্ধী স্কুল'। শুরুতে শিক্ষার্থী ছিল সাতজন। আজ শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫০-এ। ভাড়া করা বাড়িতে চলছে স্কুলের কার্যক্রম।
শহরে স্কুল করেই থেমে থাকেননি জহির। ২০০৫ সালে গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের টেংরাটিলায়ও গড়ে তোলেন 'টেংরাটিলা মূক-বধির সংঘ' নামে আরেকটি স্কুল। সেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা এখন ৯২। এ দুটি স্কুল করতে গিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয় জহির আলমকে।
১৫ বছর ধরে নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকার অনামিকায় ৬৯ নম্বর বাসার দোতলায় পরিচালনা করছেন স্কুলের কার্যক্রম। ভাড়া ওই বাসার পাঁচ রুমের মধ্যে দুই রুমে স্ত্রী, তিন মেয়ে ও শিশুপুত্রকে নিয়ে তার সংসার। বাকি রুমগুলো ছেড়ে দিয়েছেন স্কুলের জন্য। বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত প্রথম হতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী শিশুদের ফ্রি পড়ানো হয়। বিভিন্ন ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। বর্তমানে এ স্কুলে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৫০। এর মধ্যে ৬০ জন ছাত্র ও ৯০ জন ছাত্রী। পড়াশোনা করানোর দায়িত্ব নিয়েছেন জহির আলমের দুই মেয়ে। এ ছাড়া নামমাত্র সম্মানীতে শিক্ষকতা করছেন নগরীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের আরও পাঁচ শিক্ষার্থী।
জহির আলম সমকালকে জানান, স্কুল প্রতিষ্ঠার পর পদে পদে প্রভাবশালীদের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন এনজিও স্কুলটি কেড়ে নিতে চেয়েছিল। তিনি জানান, কারিগরি শিক্ষা_ সেলাই প্রশিক্ষণ, গাড়ির পেইন্টিং, ড্রাইভিং শিখে অনেক অসহায় প্রতিবন্ধী হয়ে উঠেছে স্বাবলম্বী। বর্তমানে গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন গার্মেন্টে তার প্রশিক্ষিত আড়াইশ' প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ে কাজ করছে। তাদের কাজ দেখে তিনি আনন্দ পান, উৎসাহ পান।
তিনি ও তার স্ত্রী আম্বিয়া বেগম নিজেদের ড্রাইভিং স্কুলে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। স্বামী-স্ত্রী দু'জন মিলে মাসে যা আয় করেন তার বড় অংশই খরচ করেন স্কুলের পেছনে।
জহির আলমকে ২০০৮ সালে ইউনিলিভার-এটিএন বাংলা 'সাদা মনের মানুষ' সম্মাননা দেয়। পরের বছর বাংলালিংক তাকে মনোনীত করে 'দিনবদলের মানুষ' হিসেবে। এ ছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন সম্মাননাসহ দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ধন্যবাদপত্র পেয়েছেন। স্কুলের আদ্যপান্ত ও বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে সম্প্রতি একটি ওয়েবসাইটও (িি.িংফফংনফ.হবঃ) খুলেছেন জহির আলম।
এসব স্বীকৃতি পেয়ে যেমন আনন্দিত জহির আলম, তেমনি হতাশাও। তার স্বপ্ন বৃহৎ আকারে প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে স্থায়ী কিছু করার। সে জন্য কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে ২০০৯ সালে জেলা প্রশাসক বরাবরে সরকারি ১২ শতক জায়গা ইজারা নেওয়ার জন্য আবেদন করেন। সবকিছু ঠিক থাকার পরও পূর্ব শাহী ঈদগাহ এলাকায় অবস্থিত ওই জায়গাটুকু ইজারা পাননি। তদবিরের অভাবে সে জায়গা ইজারা পায় একটি এনজিও। তারপরও আশা ছাড়েননি জহির আলম। তিনি বলেন, 'প্রতিবন্ধীদের নিয়েই আমার পথচলা। অভীষ্ট লক্ষ্যে না পেঁৗছা পর্যন্ত আমার সংগ্রাম চলবে।'
No comments