সময় এখন স্পিনারদের

রফরাজ নেওয়াজ, ইমরান খান, ওয়াকার ইউনুস, ওয়াসিম আকরাম, শোয়েব আখতারদের বোলিংয়ে বুকে কাঁপন উঠত না এমন ব্যাটসম্যান কমই ছিলেন। তাঁদের পেস-ঝড়ে ১৫০ থেকে ১৮০ রানের পুঁজি নিয়েও অনেকবার ম্যাচ জিতেছে পাকিস্তান। যুগে যুগে এ ধরনের ফাস্ট বোলার উপহার দিয়ে এসেছে যারা সেই পাকিস্তানেরই এখন অন্য রূপ! মিসবাহ-উল হকের দলটা এখন পেসের চেয়ে বেশি স্পিননির্ভর। সাঈদ আজমল, মোহাম্মদ হাফিজ, শহীদ আফ্রিদির
কাঁধে ভর করে চলছে তারা। শুধু পাকিস্তানই কেন, বিশ্বক্রিকেটই যেন হয়ে পড়ছে স্পিননির্ভর। সময়, পরিস্থিতি বদলানোয় আর উইকেটগুলো গতি হারানোয় বাড়ছে স্পিনারদের দাপট। আইসিসির ওয়ানডে বোলিং র‌্যাংকিংয়ের দিকে তাকানো যাক। সেরা পাঁচজনের চারজনই স্পিনার! পাকিস্তানি স্পিনার সাঈদ আজমল শীর্ষে আর দুই নম্বরে আছেন মোহাম্মদ হাফিজ। নিউজিল্যান্ডের ড্যানিয়েল ভেট্টোরি তিন ও ইংল্যান্ডের অফস্পিনার গ্রায়েম সোয়ান রয়েছেন চারে। সেরা পাঁচের একমাত্র ফাস্ট বোলার অস্ট্রেলিয়ার মিচেল জনসন। তাহলেই বুঝুন ওয়ানডেতে স্পিনারদের দাপট কতটা।
আজমল এ বছর মাত্র ১৭.০৮ গড় ও ৩.৪৮ ইকোনমি রেটে নিয়েছেন ৩৪ উইকেট আর হাফিজ ২৫.৩৪ গড়ে ৩২ উইকেট। ৩২ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ১০৭৫ রান করেছেনও হাফিজ। ওয়ানডেতে তাঁর আগে এক বছরে আর মাত্র তিনজনই ৩০ উইকেটের পাশাপাশি করতে পেরেছিলেন এক হাজার রান। লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের তিন ম্যাচেই বোলিংয়ের শুরুটা করেছিলেন মোহাম্মদ হাফিজ। তা ছাড়া এ বছর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৫ উইকেট পাওয়া বোলারও পাকিস্তানের শহীদ আফ্রিদি (সর্বোচ্চ ৪৮ উইকেট শ্রীলঙ্কার লাসিথ মালিঙ্গার)। হঠাৎ অবসর না নিলে নিশ্চিতভাবেই উইকেটের হাফ সেঞ্চুরিও হয়ে যেত সাবেক এ অধিনায়কের। তবে এই সুযোগেই আফ্রিদি গড়েছেন চার চারবার ৫ উইকেট নিয়ে এক বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তিও। তাঁর আগে ১৯৯০ সালে এক বছরে সর্বোচ্চ পাঁচবার ৫ উইকেট নিয়েছিলেন পাকিস্তানেরই পেসার ওয়াকার ইউনুস।
গত ৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে অদ্ভুত এক কীর্তি গড়ে বসেছিল স্পিনাররা। বাংলাদেশ-পাকিস্তানের তৃতীয় ওয়ানডেতে ৪৬.১ ওভারে মিসবাহর দল অল আউট হয়েছিল ১৭৭ রানে। জবাবে ১৯.৩ ওভারে ১ উইকেটে ৬৯ করে জয়ের পথেই ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু হাফিজ, আজমল, মালিকদের ঘূর্ণিতে মুশফিকুর রহিমের দল অল আউট হয়ে যায় ১১৯-এ। ম্যাচটিতে ৮৪.১ ওভারের মধ্যে স্পিনাররাই করেছেন ৭৩.১ ওভার। অর্থাৎ ৫০৫ বলের মধ্যে স্পিনাররা করেছিলেন ৪৩৯টি, যা এক ম্যাচে স্পিনারদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বল করার রেকর্ড!
স্পিননির্ভরতাটা সবচেয়ে বেশি উপমহাদেশের দলগুলোর মধ্যেই। ২০১০ সালের জানুয়ারির পর থেকে স্পিননির্ভর সেরা পাঁচ দলের চারটিই উপমহাদেশের। সবচেয়ে বেশি স্পিননির্ভর আবার বাংলাদেশ। এ সময়ে দেশের ২০৫০.৫ ওভারের মধ্যে স্পিনাররাই করেছেন ১২৯১.৫ ওভার। হারটা ৬২.৯৯ শতাংশ। ৩৫.০১ গড় ও ৪.৭৬ ইকোনমি রেটে ২৮৭ উইকেটের ১৭৬টিই নিয়েছেন সাকিব, রাজ্জাক, মাহমুদ উল্লাহরা। স্পিনার হয়েও সবচেয়ে বেশি ১৬ বার ইনিংস বোলিং ওপেন করার রেকর্ডটা বাংলাদেশের রাজ্জাকেরই। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫ বার ইনিংস ওপেন করেছেন জিম্বাবুয়ের রে প্রাইস। সাকিবদের জন্য বাংলাদেশের উইকেটগুলো তৈরি করা হয় ধীরগতির ও নিচু বাউন্সের। বল সেভাবে টার্ন না করলেও এই নিচু বাউন্স আর ধীরগতির কারণে মোটেও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকেন না ব্যাটসম্যানরা। বাংলাদেশের মাটিতে তাই ১৭৭ করেও স্পিনারদের দাপটে ৫৮ রানের বড় জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পেরেছে পাকিস্তান।
২০১০ সালের জানুয়ারির পর স্পিননির্ভরতায় বাংলাদেশের ঠিক পরের অবস্থান জিম্বাবুয়ের। এ সময় জিম্বাবুয়ের ১৬৩৭.৪ ওভারের মধ্যে স্পিনাররা করেছেন ৬১.৬০ হারে ১০০৮.৫ ওভার। পাকিস্তানি স্পিনারদের বেলায় এ হারটা ৫০.৯২, ভারতের ৫০.২৮ আর শ্রীলঙ্কার ৪৩.৩১। সবচেয়ে কম স্পিননির্ভর দল অস্ট্রেলিয়া। ২০১০-এর জানুয়ারি থেকে ২১৯৪.২ ওভারের মধ্যে তাদের স্পিনাররা মাত্র ২৬.৬১ শতাংশ হারে করেছে ৫৮৪ ওভার।
আসলে ২০০৪ সালের পর ধীরে ধীরে স্পিনারদের রাজত্বটা বেড়েই চলেছে ওয়ানডেতে। ২০০৪ সালে ওয়ানডেতে ১০৯৪৫.২ ওভারের মধ্যে স্পিনাররা করেছিল ৩৩৭৯.১ ওভার। স্পিনারদের করা ওভারের হারটা ৩০.৮৭ শতাংশ। বাড়তে বাড়তে সেটা ২০১০ সালে এসে দাঁড়ায় ৪১.১০ শতাংশে! গত বছর ১২৬১১.২ ওভারের মধ্যে স্পিনাররা করেছিলেন ৫১৮৩ ওভার। গত বছরের এ হারটাও ছাড়িয়ে গেছে ২০১১ সালে। ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজের পঞ্চম ম্যাচ শেষে ২০১১ সালে ওয়ানডেতে হয়েছে মোট ১২৫৪৪.৪ ওভার। এর মধ্যে স্পিনাররাই করেছেন ৫২২৯.২ ওভার, যার হার ৪১.৬৪ শতাংশ। যেভাবে দিন দিন দাপট বাড়ছে তাতে হয়তো খুব বেশি দেরি নেই যখন ৫০ শতাংশ ওভারই করবেন স্পিনাররা।
শুধু আগের চেয়ে বেশি হারে বল করাতেই নয়, তাঁরা সফল উইকেট নেওয়ার বেলাতেও। এ বছর ১৯৩০টি ওয়ানডে উইকেটের ৭৩৮টি পেয়েছেন স্পিনাররা, যার গড় ৩২.৭২। ইকোনমি রেটটাও শ্রদ্ধা করার মতো ৪.৬২। গত বছর ১৯১১টি উইকেটের মধ্যে স্পিনাররা ৬৬১টি উইকেট পেয়েছিলেন ৩৬.১১ গড়ে আর ইকোনমি রেট ছিল ৪.৬০। অর্থাৎ সাফল্যের হারেও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে স্পিনারদের।
বাংলাদেশের বিপক্ষে কদিন আগে শেষ হওয়া ওয়ানডে সিরিজে তামিম ইকবালকে দুবার আউট করেছিলেন মোহাম্মদ হাফিজ। তামিমের বিপক্ষে দুই ম্যাচে ৮ বলে দিয়েছিলেন মাত্র ১ রান। ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ওয়ানডের প্রথম ১৫ ওভারে বল করা স্পিনারদের মধ্যে কিন্তু দারুণ সফল হাফিজ। এ সময়ে ৩০ গজের বৃত্তের বাইরে মাত্র দুজন ফিল্ডার থাকতেন বলে ব্যাটসম্যানদের বেঁধে রাখা খুবই কঠিন (নিয়মটার পরিবর্তন হয়েছে ১ অক্টোবর থেকে, এখন প্রথম ১০ ওভার বাধ্যতামূলক পাওয়ার প্লে আর ১৫ ওভারের পর বোলিং সাইড নিতে পারবে দ্বিতীয় পাওয়ার প্লে)। সেই কাজটাই ধারাবাহিকভাবে করেছেন হাফিজ। প্রথম ১৫ ওভারে ৪৪৪ বলে ২১৭ রান দিয়ে নিয়েছেন ১৪ উইকেট। এর গড় ১৫.৫০ আর ইকোনমি রেট ২.৯৩। গড়ে স্পিনারদের মধ্যে শীর্ষে থাকলেও ইকোনমি রেটে তাঁর চেয়ে এগিয়ে জিম্বাবুয়ের রে প্রাইস। ৬৪২ বলে ৩০৯ রান দিয়ে তিনি ৯ উইকেট নিয়েছেন ৩৪.৩৩ গড় ও ২.৮৮ ইকোনমি রেটে।
ইকোনমি রেটের বিচারে তৃতীয় স্থানে আছেন নিউজিল্যান্ডের ড্যানিয়েল ভেট্টোরি আর চতুর্থ স্থানে বাংলাদেশের নাঈম ইসলাম। ভেট্টোরি ২৫৮ বলে ১৬৮ রান দিয়ে ৭ উইকেট নিয়েছেন ২৪.০০ গড় ও ৩.৯০ ইকোনমি রেটে। আর নাঈম ইসলাম ২২৮ বলে ১৫১ রান দিয়ে ৩ উইকেট নিয়েছেন ৫০.৩৩ গড় ও ৩.৯৭ রেটে। বাংলাদেশের বাকি স্পিনারদের মধ্যে ২০১০ সালের জানুয়ারির পর প্রথম ১৫ ওভারে আবদুর রাজ্জাকের ইকোনমি রেট ৪.১৯ আর সাকিব আল হাসানের ৪.২৪। এ সময়ে ৬০২ বলে ৪২৬ রান দিয়ে সবচেয়ে বেশি ২১ উইকেট পেয়েছেন সাকিবই। উইকেট পাওয়ার দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে বাংলাদেশেরই আবদুর রাজ্জাক। ৮১০ বলে ৫৬৬ রানে ২৮.৩০ গড়ে রাজ্জাকের উইকেট ২০টি। এ ছাড়া ২০১০-এর জানুয়ারি থেকে প্রথম ১৫ ওভারে সাঈদ আজমলের উইকেট ৫টি, শহীদ আফ্রিদির ৪, গ্রায়েম সোয়ানের ৫ আর হরভজন সিংয়ের ২টি।
ব্যাটসম্যানদের বেঁধে রাখতে পারার কারণেও প্রথম ১৫ ওভারে স্পিননির্ভরতা বাড়ছে। ২০০৪ সালে স্পিনাররা যেখানে প্রথম ১৫ ওভারে করেছিলেন ১৪৯.৫ ওভার সেখানে ২০১১ সালে ৮৯১.২ ওভার! প্রায় ৬ গুণ বেশি। সাফল্যের হারটাও বেড়েছে একইভাবে। ২০০৪ সালে প্রথম ১৫ ওভারে স্পিনারদের মাত্র ৭ উইকেটের বিপরীতে এ বছর সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৭-তে। ওভার আর সাফল্যের হার বাড়ার চিত্রটা তুলে ধরা যাক। ২০০৫ সালে প্রথম ১৫ ওভারে ১০০.৫ ওভার বল করে স্পিনাররা পেয়েছিলেন ১২ উইকেট। ২০০৬ সালে ১৭৩.৫ ওভারে ২০, ২০০৭ সালে ২০৯.২ ওভারে ২৪, ২০০৮ সালে ২৫৬.০ ওভারে ৩৮, ২০০৯ সালে ৩৭১.৫ ওভারে ৫২, ২০১০ সালে ৫৯৫.০ ওভারে ৮৫ আর ২০১১ সালে ৮৯১.২ ওভারে স্পিনাররা নিয়েছেন ১১৭ উইকেট। ক্রিকইনফো
২০১০ সাল থেকে ওয়ানডেতে স্পিননির্ভরতা

No comments

Powered by Blogger.