গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল গ্রেফতারের আবেদন-গণহত্যা ধর্ষণ অগি্নসংযোগসহ ৫২টি ঘটনার শতাধিক অভিযোগ
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সুনির্দিষ্ট ৫২টি ঘটনায় শতাধিক মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করার আবেদন করা হয়েছে। গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চে এ আবেদন দাখিল করা হয়।
তবে আদালত যথাযথ নিয়মে চার্জশিট ও গ্রেফতারের আবেদন ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কাছে দাখিলের নির্দেশ দেন।
ট্রাইব্যুনালের প্রধান কেঁৗসুলি গোলাম আরিফ টিপু সাংবাদিকদের বলেন, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৫২টি ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এ অবস্থায় আইন অনুযায়ী তদন্ত সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ট্রাইব্যুনালে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার এ বিষয়ে শুনানি হতে পারে। তিনি আরও বলেন, দেশবাসীর দীর্ঘদিনের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে
অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা বা সমনসহ সব আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করার আবেদন জানানো হয়েছে। এ সময় তদন্তকারী কর্মকর্তা মতিউর রহমান, প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্তসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রেস ব্রিফিংয়ে তারা বলেন, স্বাধীনতার সময় গোলাম আযমের নেতৃত্বে সারাদেশে আলবদর, আল শামস, রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠিত হয়। ১৯৭০ সালে নির্বাচনের আগ থেকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরই মধ্যে ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলা চালায়। এর কয়েক দিন পর গোলাম আযম ও রাজনৈতিক দলের নেতারা অবরুদ্ধ বাংলাদেশের গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে নাগরিক কমিটি গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়। মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা খবিরউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ১৪০ সদস্যবিশিষ্ট শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। দৈনন্দিন দায়িত্ব ৬ সদস্যের কমিটির ওপর ন্যস্ত করা হয়। এই কমিটিতে ২ নম্বর দায়িত্ব দেওয়া হয় গোলাম আযমকে। তার নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও মুজাহিদ বাহিনী গঠন করা হয়। এসব কমিটি গঠনের পর গোলাম আযম বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন এবং কুচকাওয়াজের সালাম গ্রহণ করেন।
প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়, এরপর এসব ক্যাম্পে কার কী পরিমাণ অস্ত্র দরকার তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে তালিকা পাঠিয়ে সুপারিশ করেছিলেন গোলাম আযম। জামায়াতে ইসলামী, তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘ এবং জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার মাধ্যমে এসব বাহিনীতে লোক নিয়োগ করা হতো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত এ ঘটনা ঘটতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর মাধ্যমে যা কিছু পরিচালিত হয়েছে, তার সব কিছুই হয়েছে গোলাম আযমের মূল নেতৃত্বে। সব ঘটনার জন্য মূলত তিনিই দায়ী। অভিযোগ গঠনের এই উপাদানগুলো আমরা তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন থেকে পেয়েছি।
প্রেস বিফিংয়ে আরও বলা হয়, গোলাম আযমের নেতৃত্বে ১৪ ডিসেম্বর শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়। বাংলাদেশে যে সব ওয়ারক্রাইম ঘটনা ঘটেছে তার জন্য গোলাম আযম দায়ী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলা নামক স্থানে সিরু মিয়াসহ ৩৮ জনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার সঙ্গেও গোলাম আযম জড়িত।
তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বলেন, ৪০ বছর আগের ঘটনা হওয়ায় প্রতিবেদনে ব্যক্তি সাক্ষীর পাশাপাশি তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন নথিপত্রকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৩৬০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে ৪শ'টি নথি ও ৪০ জন সাক্ষী আছে। তিনি বলেন, গোলাম আযম দেশের দু'ভাগে ক্ষতি করেছেন। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজে শান্তি কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছেন, দ্বিতীয়ত, যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছেন।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৩৬০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের পাশাপাশি ১০ হাজার পৃষ্ঠার নথি সংযুক্ত রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালের তথ্য ও চিত্রসংবলিত সিডি, ডিভিডি, গণহত্যা সংক্রান্ত ভিডিও, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আলবদর বাহিনীর অনাচারের প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য ও তখনকার এনবিসি, সিবিএস এবং দৈনিক সংগ্রাম, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান ও পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার প্রতিবেদনও রয়েছে।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ : সূত্র জানায়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাঙালি হত্যার অভিযান শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর প্রকৃত উদ্দেশ্য উন্মোচিত হয়েছিল। ৪ এপ্রিল প্রথম সুযোগেই ঘাতক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গোলাম আযম 'পাকিস্তান রক্ষার প্রচেষ্টায় পূর্ণ সহযোগিতা প্রদানের' কথা ঘোষণা করেছিলেন।
৬ এপ্রিল দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের পর তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে 'ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও অনুপ্রবেশ' আখ্যায়িত করে বলেন, 'ভারতের এই অভিসন্ধি নস্যাৎ করার জন্য প্রদেশের জনগণ ও তার দল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে সাহায্য করবে।'
রাজাকার ও বদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠা : স্বাধীনতা যুদ্ধকে নস্যাতের চেষ্টায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণের উদ্দেশ্যে জামায়াতে ইসলামী 'রাজাকার' ও 'আলবদর' বাহিনী গড়ে তুলেছিল। খুলনায় ৯৬ সদস্যের সমন্বয়ে মে মাসে 'রাজাকার' বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ, অন্যদিকে শিক্ষিত রুকন এবং ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মীরা ছিল 'বদর বাহিনী'র সদস্য। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযান এবং অগি্নসংযোগসহ নির্যাতনের ক্ষেত্রে রাজাকাররা নিয়েছিল প্রধান ভূমিকা। বদর বাহিনীর কার্যক্রমের মধ্যে ছিল স্বাধীনতাকামীদের খুঁজে বের করে হত্যা করা, সেমিনার আয়োজন ও প্রচারপত্র বিতরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাঙালিদের পাকিস্তানি ও ইসলামী জীবন দর্শনে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীতে পরিণত করার চেষ্টা চালানো এবং প্রয়োজনে সশস্ত্রভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবেলা করা। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে বিশেষ করে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা বদর বাহিনীর নির্মম হত্যাকা ের শিকার হয়েছিলেন। রাজাকারদের পাক সেনা কর্তৃপক্ষ আধা-সামরিক বাহিনীতে রূপান্তরিত করে।
রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইউসুফ এক রাজাকার সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে ১১ অক্টোবর খুলনায় বলেছিলেন, 'দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের দমন এবং দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলার যে কোনো অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য আমাদের সাহসী জনগণ সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের পেছনে থাকবে।'
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর। তিনি এখন কারাবন্দি। একই অপরাধে জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা বিচারের মুখোমুখি। এ চারজন কারাবন্দি। কাদের মোল্লা ছাড়া অন্য তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে চার্জশিট ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা।
এ ছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমও একই অপরাধে বিচারের মুখোমুখি। উভয়কে গ্রেফতার করা হলেও ট্রাইব্যুনাল আবদুল আলীমকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দিয়েছেন। সাকা চৌধুরী কারাবন্দি।
ট্রাইব্যুনালের প্রধান কেঁৗসুলি গোলাম আরিফ টিপু সাংবাদিকদের বলেন, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৫২টি ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এ অবস্থায় আইন অনুযায়ী তদন্ত সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ট্রাইব্যুনালে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার এ বিষয়ে শুনানি হতে পারে। তিনি আরও বলেন, দেশবাসীর দীর্ঘদিনের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে
অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা বা সমনসহ সব আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করার আবেদন জানানো হয়েছে। এ সময় তদন্তকারী কর্মকর্তা মতিউর রহমান, প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্তসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রেস ব্রিফিংয়ে তারা বলেন, স্বাধীনতার সময় গোলাম আযমের নেতৃত্বে সারাদেশে আলবদর, আল শামস, রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠিত হয়। ১৯৭০ সালে নির্বাচনের আগ থেকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরই মধ্যে ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলা চালায়। এর কয়েক দিন পর গোলাম আযম ও রাজনৈতিক দলের নেতারা অবরুদ্ধ বাংলাদেশের গভর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে নাগরিক কমিটি গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়। মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা খবিরউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ১৪০ সদস্যবিশিষ্ট শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। দৈনন্দিন দায়িত্ব ৬ সদস্যের কমিটির ওপর ন্যস্ত করা হয়। এই কমিটিতে ২ নম্বর দায়িত্ব দেওয়া হয় গোলাম আযমকে। তার নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও মুজাহিদ বাহিনী গঠন করা হয়। এসব কমিটি গঠনের পর গোলাম আযম বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন এবং কুচকাওয়াজের সালাম গ্রহণ করেন।
প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়, এরপর এসব ক্যাম্পে কার কী পরিমাণ অস্ত্র দরকার তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে তালিকা পাঠিয়ে সুপারিশ করেছিলেন গোলাম আযম। জামায়াতে ইসলামী, তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘ এবং জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার মাধ্যমে এসব বাহিনীতে লোক নিয়োগ করা হতো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত এ ঘটনা ঘটতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর মাধ্যমে যা কিছু পরিচালিত হয়েছে, তার সব কিছুই হয়েছে গোলাম আযমের মূল নেতৃত্বে। সব ঘটনার জন্য মূলত তিনিই দায়ী। অভিযোগ গঠনের এই উপাদানগুলো আমরা তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন থেকে পেয়েছি।
প্রেস বিফিংয়ে আরও বলা হয়, গোলাম আযমের নেতৃত্বে ১৪ ডিসেম্বর শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়। বাংলাদেশে যে সব ওয়ারক্রাইম ঘটনা ঘটেছে তার জন্য গোলাম আযম দায়ী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলা নামক স্থানে সিরু মিয়াসহ ৩৮ জনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার সঙ্গেও গোলাম আযম জড়িত।
তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বলেন, ৪০ বছর আগের ঘটনা হওয়ায় প্রতিবেদনে ব্যক্তি সাক্ষীর পাশাপাশি তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন নথিপত্রকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৩৬০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে ৪শ'টি নথি ও ৪০ জন সাক্ষী আছে। তিনি বলেন, গোলাম আযম দেশের দু'ভাগে ক্ষতি করেছেন। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজে শান্তি কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছেন, দ্বিতীয়ত, যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছেন।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৩৬০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের পাশাপাশি ১০ হাজার পৃষ্ঠার নথি সংযুক্ত রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালের তথ্য ও চিত্রসংবলিত সিডি, ডিভিডি, গণহত্যা সংক্রান্ত ভিডিও, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আলবদর বাহিনীর অনাচারের প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য ও তখনকার এনবিসি, সিবিএস এবং দৈনিক সংগ্রাম, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান ও পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার প্রতিবেদনও রয়েছে।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ : সূত্র জানায়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাঙালি হত্যার অভিযান শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর প্রকৃত উদ্দেশ্য উন্মোচিত হয়েছিল। ৪ এপ্রিল প্রথম সুযোগেই ঘাতক জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গোলাম আযম 'পাকিস্তান রক্ষার প্রচেষ্টায় পূর্ণ সহযোগিতা প্রদানের' কথা ঘোষণা করেছিলেন।
৬ এপ্রিল দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের পর তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে 'ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও অনুপ্রবেশ' আখ্যায়িত করে বলেন, 'ভারতের এই অভিসন্ধি নস্যাৎ করার জন্য প্রদেশের জনগণ ও তার দল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে সাহায্য করবে।'
রাজাকার ও বদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠা : স্বাধীনতা যুদ্ধকে নস্যাতের চেষ্টায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণের উদ্দেশ্যে জামায়াতে ইসলামী 'রাজাকার' ও 'আলবদর' বাহিনী গড়ে তুলেছিল। খুলনায় ৯৬ সদস্যের সমন্বয়ে মে মাসে 'রাজাকার' বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ, অন্যদিকে শিক্ষিত রুকন এবং ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মীরা ছিল 'বদর বাহিনী'র সদস্য। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযান এবং অগি্নসংযোগসহ নির্যাতনের ক্ষেত্রে রাজাকাররা নিয়েছিল প্রধান ভূমিকা। বদর বাহিনীর কার্যক্রমের মধ্যে ছিল স্বাধীনতাকামীদের খুঁজে বের করে হত্যা করা, সেমিনার আয়োজন ও প্রচারপত্র বিতরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে বাঙালিদের পাকিস্তানি ও ইসলামী জীবন দর্শনে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীতে পরিণত করার চেষ্টা চালানো এবং প্রয়োজনে সশস্ত্রভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবেলা করা। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে বিশেষ করে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা বদর বাহিনীর নির্মম হত্যাকা ের শিকার হয়েছিলেন। রাজাকারদের পাক সেনা কর্তৃপক্ষ আধা-সামরিক বাহিনীতে রূপান্তরিত করে।
রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইউসুফ এক রাজাকার সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে ১১ অক্টোবর খুলনায় বলেছিলেন, 'দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের দমন এবং দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলার যে কোনো অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য আমাদের সাহসী জনগণ সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের পেছনে থাকবে।'
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর। তিনি এখন কারাবন্দি। একই অপরাধে জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা বিচারের মুখোমুখি। এ চারজন কারাবন্দি। কাদের মোল্লা ছাড়া অন্য তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে চার্জশিট ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা।
এ ছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমও একই অপরাধে বিচারের মুখোমুখি। উভয়কে গ্রেফতার করা হলেও ট্রাইব্যুনাল আবদুল আলীমকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দিয়েছেন। সাকা চৌধুরী কারাবন্দি।
No comments