চরাচর-শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট এবং আমার বাবা

খন আমি ১৩-১৪ বছরের। বাবা মো. আবদুল কাদের মিয়া দেবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ইন্সপেক্টর হওয়ার পথে)। বাবা যখন এ পদের দায়িত্বভার পালন করছিলেন, তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রাক্ষুসে কালো থাবায় জর্জরিত পুরো বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের তুমুল সংঘর্ষ সর্বত্র। দেবীগঞ্জ ও দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত দেবীগঞ্জ একটি থানা (বর্তমানে পঞ্চগড় জেলা)। মুক্তিযুদ্ধের আলোড়ন সেখানেও। আমার দেশপ্রেমিক বাবা কি তখন চুপ করে থাকতে


পারেন? তিনি মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই সর্বপ্রথম ২৭ মার্চ ১৯৭১ দেবীগঞ্জ থানার সামনে 'স্যালুটিং বেজ'-এ বাংলাদেশের ম্যাপ সংবলিত প্রথম পতাকা উত্তোলন করান তাঁর ছেলে নুরুল ফেরদৌস এবং রেজু নামে আরেকটি ছোট ছেলেকে দিয়ে। দ্বিতীয় পতাকা উত্তোলন করান আনসার ক্লাবের সামনে। আমার বাবা সেখানে ছিলেন সাহসের প্রতীক হয়ে। তাঁর অন্তরে তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে দেশপ্রেমের সুউজ্জ্বল বহ্নিশিখা। তাঁর দেহের শিরা-উপশিরায় মুক্তিযুদ্ধের তপ্ত রক্তকণিকা তখন সতত প্রবহমান। আর এই কাজ করতে গিয়ে কখনো তিনি ছুটে গেছেন সীমান্তের ওপারে হলদিবাড়ী। সংগ্রহ করে এনেছেন অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ। তুলে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সেগুলো। এমনিভাবে বাবা গোপনে অতি সন্তর্পণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কাজ করে গেছেন। দেশের মুক্তিই ছিল তখন তাঁর একমাত্র ধ্যান-ধারণা। তাই তাঁর ওপর অর্পিত সরকারি দায়িত্ব সম্পন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দিতে লাগলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পরিচিত পরিজনদের উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন এবং থানার অন্য পুলিশ অফিসার ও জওয়ানদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেন। খুব সম্ভব এপ্রিল মাসের কোনো এক দিনে। এ সময় বাবা ইপিআর পুলিশবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে বেশ কয়েকটি অপারেশন চালিয়েছেন। আমরা বাড়িতে বসেই লোকমুখে এ সংবাদ পেতাম। মে মাসের শেষের দিকে আমরা খবর পেলাম, বাবা ৩১ মে আমাদের কাছে আসবেন। হানাদার বাহিনীর চর ও সহযোগীরা এ খবর যথাসময় পেয়েছিল এবং বাবার আসার পথটিও জানতে পেরেছিল। ৩১ মে রাতে আমাদের বাড়িতে আসার পথে বাবা ও তাঁর সহযোগী মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনী কর্তৃক এক অতর্কিত হামলার মুখোমুখি হন। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। সে যুদ্ধে তাৎক্ষণিক দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং আমার বাবা গুরুতর আহত হন। এদিকে আমাদের বাসায় হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা এসে সব কিছু তছনছ ও জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে ওরা বাবার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকে। ১ জুন, মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টা-৪টার দিকে ওরা আমার বাবার ইউনিফর্ম নেওয়ার জন্য একজন রাজাকারকে আমাদের বাসায় পাঠায়। বাবাকে দেবীগঞ্জ থানায় নিয়ে আসে। এনে পুলিশের ইউনিফর্ম পরায় এবং আমার বাবার মাথা থেকে ক্যাপ খুলে নিয়ে ওই থানার সেকেন্ড অফিসার সামাদ দারোগার মাথায় পরিয়ে দেয়। এরপর আর্মিদের জিপে তুলে দেবীগঞ্জ থেকে ব্রুজের ডাঙ্গায় (ভুসির বন্দর) নিয়ে যাওয়ার পথে আনসার ক্যাম্পের নিকটবর্তী স্থানে চলন্ত জিপের সামনে আমার দুর্জয় সাহসিনী মা দুই হাত তুলে দাঁড়িয়ে যান। ওরা জিপটি থামিয়ে দেয়। আমার মা জিপের দরজার কাছে চলে আসেন। জিপের সামনের সিটে দুই হাত বাঁধা অবস্থায় আমার বাবা বসা ছিলেন। বাবা আবেগাপ্লুত কণ্ঠে মাকে কিছু বলতে চেষ্টা করেন। তখন আমার বাবার চুলগুলো এলোমেলো অবস্থায় কপালের ওপর এসে পড়েছিল। মা হাত দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার দুই চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মা তখন স্পষ্টই দেখতে পেলেন, বাবার কপালে রাইফেলের বাঁটের নিচের চিহ্নটি (বাঁট ট্রিপ) লাল হয়ে ফুটে উঠেছে। মা খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করেন। বাবা মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, 'তুমি বাসায় গিয়ে নামাজ পড়ে আমার জন্য দোয়া করো, আমার মা এবং আমার ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে রেখো।' বাবার সঙ্গে মায়ের সেই শেষ কথা। মা বাবার দিকে তাকিয়ে বহু কষ্টে বলেছিলেন, 'ফি আমানিল্লাহ!' তারপর বাবাকে জিপে করে ব্রুজের ডাঙ্গা নামক স্থানে নিয়ে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরদিন রাজাকাররা স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় বাবাকে তাড়াহুড়ো করে মাটিচাপা দেয়।
বাবার কবরটি যাঁরা সযত্নে পরিচর্যা করে এমন উজ্জ্বল করে রেখেছেন, তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। কবরের ওপর শ্যামল দূর্বাদল সতত বায়ুভরে আলোড়িত। বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগ ১৯৯৯ সালে শহীদ আবদুল কাদের মিয়া স্মরণে 'শহীদ বুদ্ধিজীবী' স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম সাহেব শহীদের নিজ এলাকা সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলাধীন ডায়া থেকে জামিরতা পর্যন্ত সড়কটি শহীদ আবদুল কাদের মিয়ার নামে নামকরণ করেন। শহীদ পরিবার এ জন্য চিরকৃতজ্ঞ। আমার সেই বাবা দেশের জন্য যিনি প্রাণ দিলেন তাঁর প্রাণদান সার্থক হয়েছে। আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম স্বদেশ পেয়েছি। এর চেয়ে বড় সম্পদ, বড় গৌরব আর কী
হতে পারে?
নূরজাহান কিরণ

No comments

Powered by Blogger.