বিদেশি নাগরিক ও সংগঠনকে সম্মাননা-বিতর্কিত সংস্থা আইসিজের নাম তালিকা থেকে বাদ
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বিদেশি ব্যক্তি ও সংগঠনকে সম্মাননা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, দার্শনিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠন মিলিয়ে ১২৪ জনের নামের তালিকা করা হয়েছে। এ তালিকায় জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কমিশন ফর জুরিস্ট (আইসিজে)-এর নামও ছিল। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিতর্কিত ভূমিকা রাখার প্রমাণ পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত এর নাম বাদ
দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, জেনেভাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিজের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতা করার দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। ১৯৭২ সালে 'দি ইভেন্টস ইন ইস্ট পাকিস্তান ১৯৭১ : এ লিগ্যাল স্টাডি' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষ এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে অবৈধ দাবি করা হয়। এ দেশের লাখো শহীদের আত্মত্যাগ নিয়েও তির্যক মন্তব্য করা হয়।
দি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ) নামে আইন বিশেষজ্ঞদের একটি সংস্থা গত ১৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার কাছে মুক্তিযুদ্ধে আইসিজের ভূমিকা নিয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠায়। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারীদের তালিকায় আইসিজেকে রাখা উচিত কি না, তা পর্যালোচনার অনুরোধ জানায় সংগঠনটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সম্মাননা প্রদানবিষয়ক জাতীয় কমিটি সংক্ষিপ্ত তালিকা পর্যালোচনা করে বিতর্কিত আইসিজের নাম সর্বসম্মতিক্রমে বাদ দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বিদেশিদের সম্মাননা প্রদান কমিটির গত ২২ মার্চের সভায় সবাই আইসিজের নাম বাদ দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হন। চলতি বছরের শুরুর দিকে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সম্মাননা দেওয়া হবে এমন ব্যক্তি ও সংস্থার নামের তালিকায় আইসিজের নাম দেখে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে।
আইসিজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছিল, ১৯৭১ সালে লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে স্বীকৃত নয়। আইসিজের দাবি, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল অবৈধ। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে 'গৃহযুদ্ধ' এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের 'বিদ্রোহী' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
আইসিজের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা বাঙালিদের ওপর যে নির্বিচার গণহত্যা চালায়, তা যেমন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী 'অপরাধ' তেমনি বিহারিদের ওপর বাঙালি 'বিদ্রোহীদের' (মুক্তিযোদ্ধাদের) আক্রমণও একই রকম 'অপরাধ'।
এ মাসেই ঘোষণা করা হতে পারে ১২৪ বিদেশির নাম : গত ১ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে সম্মাননা প্রদানসংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সম্মাননা প্রদানের জন্য ১২৪ জন বিদেশির নামের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভা ওই তালিকা অনুমোদন করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ কথা জানা গেছে।
আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে তালিকা প্রকাশ করা হতে পারে বলে জানা গেছে। আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আগেই ওই ব্যক্তিদের সম্মাননা দেওয়া হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত ৩১ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতীয় কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান, এবারের বিজয় দিবসে সম্মাননা প্রদানের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হচ্ছে না। কারণ ওই দিন অন্যান্য অনুষ্ঠান থাকে। তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতার ৪০তম বার্ষিকী উপলক্ষে বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত জুলাই মাসে ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সম্মাননা দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ এ প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সম্মাননার জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা জীবিত নেই তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ঢাকায় আনা হবে। কেউ আসতে না পারলে তাঁর নিজ দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে বলে জানান।
উল্লেখ্য, গত জুলাই মাসে ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে মুক্তিযুদ্ধে বিদেশিদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রদান করে বাংলাদেশ। সম্মাননার জন্য মনোনীত বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা' এবং অন্যদের 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা' প্রদান করা হবে বলে জানা গেছে।
No comments