উৎপাদন বাড়লেও ভর্তুকির চাপে বিদ্যুৎ খাত by নাজমুল ইমাম

 উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ ভর্তুকির চাপে পড়েছে বিদ্যুৎ খাত। বেশি দামে বেসরকারি বিদ্যুৎ কিনে কম দামে তা সাধারণ গ্রাহকের কাছে বিক্রির ফলে চলতি অর্থবছরে পিডিবিকে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনতে হবে। বেসরকারি খাত থেকে চলতি বছর আরও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। সে বিদ্যুৎও সরকারকে কিনতে হবে। পিডিবি আশঙ্কা করছে, ভবিষ্যতে পর্যায়ক্রমে বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে ভর্তুকির পরিমাণ ১০ হাজার


কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যা সরকারের সার্বিক আর্থিক শৃঙ্খলা বিনষ্ট করতে পারে। বর্তমান সরকারের আমলে আড়াই হাজার মেগাওয়াটের বেশি নতুন উৎপাদন বেড়েছে। এতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সহনীয় করা সম্ভব হয়েছে; কিন্তু বেশি দামে কেনা বিদ্যুৎ কম দামে বিক্রি করতে গিয়ে ব্যাপক আর্থিক সংকটে পড়েছে সরকার।
সূত্র জানায়, বছর বছর পিডিবির কাঁধে এ লোকসানের বোঝা বাড়ছে। সরকারের কাছ থেকে ধারে টাকা নিয়ে এ লোকসান সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা পিডিবি। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী পিডিবি সবসময় ধারেও টাকা পাচ্ছে না। এতে সংস্থাটি আর্থিকভাবে চরম সংকটের মুখে পড়েছে বলে পিডিবি দাবি করেছে। চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে ৭ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ রয়েছে। এর বাইরে ভর্তুকি
মোকাবেলায় সরকারের আরও ৭ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা ব্যয় হবে। সবমিলিয়ে বিদ্যুৎ খাতের জন্য এ অর্থবছরে খরচ হবে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়ন বাজেটের অর্থ জোগান দেওয়ার পাশাপাশি বিপুল অঙ্কের ঋণের টাকা জোগাড় করা সরকারের জন্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হবে। ভর্তুকির টাকা জোগান দিতে গিয়ে উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দেও টান পড়তে পারে। এতে এ অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন ব্যাহত হতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা। বিশেষ করে সরকারি খাতে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদনের টার্গেট রয়েছে সেগুলোর উন্নয়ন ব্যাহত হতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা সমালোচনা করে বলেছেন, একসঙ্গে বেসরকারি খাত থেকে এত বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার দরকার ছিল না। সরকারের পক্ষে বলা হচ্ছে, রেন্টাল (ভাড়াভিত্তিক) বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া উপায় ছিল না। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ বিষয়ে বলেন, রেন্টালসহ বেসরকারি বিদ্যুৎ না কিনলে এখন সারাদিন চার ঘণ্টাও বিদ্যুৎ পাওয়া যেত না। অন্ধকারে ডুবে থাকতে হতো। তখনও আবার সমালোচনা হতো। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সরকারি খাতে কোনো কেন্দ্র নির্মাণ করতে গেলে অনেকে বেশি সময় লাগে। এ কারণে বিদেশ থেকে ভাড়া করা কেন্দ্র আনা হয়েছে। বেসরকারি খাতে ছাড়া এটা আনাও সম্ভব হতো না। তারা আরও বলেছেন, সরকারি খাতের কেন্দ্রগুলো চালু হলে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ কমে আসবে। তখন লোকসানের পরিমাণও কমে আসবে।
যত লোকসান : বেসরকারি খাতের ২ হাজার ৩৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২৮টি কেন্দ্র থেকে সরকার বর্তমানে বিদ্যুৎ কিনছে। গত অর্থবছর পিডিবি লোকসান দিয়েছে ৪ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু পাঁচটি কুইক রেন্টাল কেন্দ্রেই ১ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। চলতি অর্থবছর জ্বালানি তেলনির্ভর কেন্দ্র থেকে আরও প্রায় ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। এর ফলে পিডিবির আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও বেড়ে দাঁড়াচ্ছে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা।
গ্যাসনির্ভর সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘোড়াশাল পাওয়ার স্টেশনে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেখানে ব্যয় হচ্ছে ১ টাকা ৯০ পয়সা, সেখানে বেসরকারি কোম্পানি ম্যাক্স পাওয়ার লিমিটেডের কেন্দ্রে খরচ পড়ছে ৮ টাকা ৭৫ পয়সা। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কুইক রেন্টাল সামিটের নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ৭৯ পয়সা, হরিপুরের এনইপিসির আইপিপিতে ১২ টাকা ৫৭ পয়সা এবং ডিজেলচালিত ঠাকুরগাঁওয়ের রেন্টাল আরজেড কেন্দ্রে ১৭ টাকা ২৬ পয়সা ও এগ্রিকোর খুলনা কেন্দ্র থেকে ১৫ টাকা ৯৯ পয়সা দরে বিদ্যুৎ কিনছে পিডিবি।
নিজস্ব তেলনির্ভর কেন্দ্র পরিচালনা ছাড়াও বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলো থেকে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে গত অর্থবছর পিডিবির ক্ষতি হয়েছে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের কেন্দ্রেই লোকসান হয়েছে ৪ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে ফার্নেস অয়েলের মূল্য ১৯ ও ডিজেল ৩১ এবং চলতি নভেম্বর ১১ ও ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে দুই টাকা এক পয়সা। এর ফলে চলতি অর্থবছরের বাকি আট মাসে পিডিবির অতিরিক্ত ১ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা ব্যয় হবে। সবমিলিয়ে চলতি অর্থবছর শেষে রাষ্ট্রীয় সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াত ৯ হাজার ৯২ কোটি টাকা। তবে সম্প্রতি বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য বৃদ্ধির ফলে এর পরিমাণ বেশ কিছুটা কমবে। এবার ৭ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা লোকসান হতে পারে। অস্বাভাবিক লোকসানের কারণে পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ধার নিয়েও এ সংকট মোকাবিলা করতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পিডিবি বিইআরসিতে চলতি মাসসহ চার দফায় বিদ্যুতের পাইকারি দাম ৭৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। শিগগির কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে।
লোকসান কমাতেই দাম বৃদ্ধি : ক্রমবর্ধমান লোকসান কমাতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়িয়েছে। এখন গ্রাহক (ভোক্তা) পর্যায়ে মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টিও বিইআরসিতে প্রক্রিয়াধীন। সংকট মোকাবেলায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ এবং পাইকারি মূল্যের মধ্যে আরও ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ ব্যাপারে পিডিবির চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবির সমকালকে বলেন, সেপ্টেম্বরের পর নতুন করে আরেক দফা তেলের দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আরও বেড়ে গেছে। এতে বেড়েছে পিডিবির লোকসানও। এ অবস্থা থেকে সংস্থাটিকে রক্ষায় বিইআরসি বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য বৃদ্ধি করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পিডিবি সরকারের কাছে ভর্তুকি চেয়েও পাচ্ছে না। ভর্তুকির পরিবর্তে তাদের ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এ ঋণই এখন 'লাইফ সাপোর্ট' হিসেবে পিডিবিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। পিডিবি দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সেই অর্থে আইপিপির বিল পরিশোধ করে আসছে। এ জন্য দুই মাস অন্তর সরকার পিডিবিকে ১০০ কোটি টাকা করে ধার দিচ্ছে। বছরে যার পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা। তবে গত অর্থবছর তেলনির্ভর রেন্টাল কেন্দ্রের কারণে সংস্থাটির লোকসান বেড়ে যায়। গত অর্থবছর লোকসান বেড়ে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকায় পেঁৗছে। এ অবস্থা সামাল দেওয়া পিডিবির জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। চরম আর্থিক সংকট মোকাবেলায় সংস্থাটি সরকারের কাছে ভর্তুকি চায়; কিন্তু সরকার ভর্তুকি না দিয়ে আবারও ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। গত বছর আইপিপি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোকে বিল পরিশোধের জন্য পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়। চলতি অর্থবছর আরও বেশি ঋণ নিতে হবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, পিডিবির পক্ষে এ ঋণ পরিশোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তার ওপর নতুন ঋণের বোঝা চাপায় সংস্থাটি দেউলিয়াত্বের মুখে পড়তে পারে। এ জন্য শুধু বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য সমন্বয় না করে পিডিবিকে পর্যায়ক্রমে ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে। এ ভর্তুকি না দিয়ে বিদ্যুতের মূল্য উৎপাদন খরচের সমান করা হলে তা গ্রাহকরা দিতে পারবেন না। এতে মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। বিইআরসি বিদ্যুতের খুচরা (গ্রাহক পর্যায়) মূল্য বৃদ্ধির জন্য শিগগির যে আদেশ দিতে যাচ্ছে সেখানেও সরকারকে ভর্তুকি দিতে বলা হতে পারে। খুচরা মূল্য সীমিত হারে বাড়ানো হলে ডেসকো বাদে চারটি বিতরণ সংস্থার জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখতে হবে। তবে খুচরা মূল্য বাড়লে বিদ্যুৎ খাতে বিতরণ সংস্থাগুলোর আর্থিক ক্ষতি কিছুটা কমবে।
বিদ্যুতের আঁচ তেলে : পিডিবির সংকটের আঁচ আরেক রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকেও (বিপিসি) বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করতে গিয়ে বিপিসি চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে। গত অর্থবছর জ্বালানি তেল বিক্রি করতে গিয়ে বিপিসি ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। নতুন নতুন তেলনির্ভর কেন্দ্র গড়ে ওঠায় এক বছরের ব্যবধানে তেলের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ২০ লাখ টন। এর ফলে চলতি অর্থবছর বিপিসির লোকসানের পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকায় পেঁৗছতে পারে বলে সংস্থাটি আশঙ্কা করছে।
বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিদিন প্রায় ৫ কোটি টাকার জ্বালানি তেল ব্যবহার হয়। গত বছর যেখানে দেশে তেলের চাহিদা ছিল ৪৮ লাখ টন, সেখানে চলতি অর্থবছর সরকারি-বেসরকারি খাতের আরও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে দেশে তেলের ব্যবহার বেড়ে ৬৮ লাখ টনে পেঁৗছবে বলে বিপিসি মনে করছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের এ ভর্তুকির চাপ দেশের অর্থনীতির ওপরও পড়েছে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে পড়েছে। সম্প্রতি রিজার্ভ ৯ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন (৯৬০ কোটি) ডলারে নেমে আসে, যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোও সম্ভব নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বেশি দরে জ্বালানি তেল কিনে কম দামে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দিতে গিয়েই এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তেলের ওপর নির্ভরতা না কমালে দেশ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে তিনি মনে করেন।

No comments

Powered by Blogger.