মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-গোলাম আযমকে গ্রেপ্তারে আবেদন

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমকে গ্রেপ্তারের জন্য আবেদন জানানো হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। গতকাল সোমবার প্রসিকিউশনের মাধ্যমে তদন্ত সংস্থার এ আবেদন ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন এবং রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে দাখিল করা হয়েছে। তবে ট্রাইব্যুনাল এ বিষয়ে কোনো আদেশ দেননি। এদিকে একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ, এক কোটি মানুষকে


দেশান্তরিত করা, হিন্দু সম্প্রদায়কে ধর্মান্তরিত করাসহ মানবতাবিরোধী ৫২টি ঘটনায় শতাধিক অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। ১০০ পৃষ্ঠার ফরমাল চার্জের সঙ্গে ত্রিশ খণ্ডে কয়েক শ দলিল (ডকুমেন্ট) দাখিল করা হয়েছে। এই ফরমাল চার্জে বলা হয়েছে, গোলাম আযম ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ৩(২) ধারার অপরাধ করেছেন।
বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গতকাল ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয় এবং গোলাম আযমকে গ্রেপ্তারের আবেদন জানানো হয়। গতকাল সকালে গোলাম আযমকে গ্রেপ্তারের আবেদন ও ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর (প্রধান কৌঁসুলি) অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু। তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে তিনি বলেন, 'গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ প্রস্তুত করা হয়েছে। এর সঙ্গে আমরা তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য পৃথক একটি আবেদন দিয়েছি।'
জবাবে বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, 'আপনারা এ সব কিছু রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে দাখিল করুন। ফরমাল চার্জ আমলে নেওয়ার পর আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'
এরপর দুপুরে প্রসিকিউশন টিম গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ, প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট এবং গ্রেপ্তারের আবেদন ট্রাইব্যুনালের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মেজবাহউদ্দিন আহমেদের কাছে দাখিল করে।
এসব আবেদন করার পর গতকাল দুপুরে চিফ প্রসিকিউটর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৫২টি ঘটনায় শতাধিক অপরাধের বিচারের জন্য ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে গোলাম আযমকে গ্রেপ্তারের আবেদনসহ আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করার আবেদন জানানো হয়েছে।
প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা, সারা দেশে হত্যা, গণহত্যা, লুট, ধর্ষণ, হিন্দু সম্প্রদায়কে ধর্মান্তরিত করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন গোলাম আযম। তাঁর নির্দেশেই সারা দেশে রাজাকার, আলশামস, আলবদর, মুজাহিদ বাহিনী গঠন করা হয়। এসব বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় মানবতাবিরোধী অপরাধ করে।
গতকাল দুপুরে প্রসিকিউশন কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, জেয়াদ আল মালুম, মোখলেসুর রহমান বাদল, আবদুর রহমান হাওলাদার, সাহিদুর রহমান ও তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, তদন্ত সংস্থার দেওয়া প্রতিবেদন ও ডকুমেন্টের ওপর ভিত্তি করে ফরমাল চার্জ তৈরি করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর মাধ্যমে যেসব অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে, এর সব ঘটনার জন্য গোলাম আযম দায়ী।
জানা গেছে, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যে মানবিক বিপর্যয় ঘটে এর সব দায় গোলাম আযমের। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে থেকেই পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সঙ্গে গোলাম আযমের যোগাযোগ ছিল। নির্বাচনের পরও এই যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। ওই অবস্থায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এ অভিযানের মাধ্যমে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলা চালাতে থাকে। এর কয়েক দিন পর ৪ এপ্রিল গোলাম আযমসহ কয়েকটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও 'খ' অঞ্চলের সামরিক অইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তাঁরা অপারেশন সার্চলাইটের নামে সেনা অভিযানের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, এ অভিযান পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য। ওই বৈঠকেই পাকিস্তানি বাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তাঁরা অঙ্গীকার করেন। এ অভিযানের প্রতি জনমত গঠন করতে একটি নাগরিক কমিটি গঠন করারও প্রস্তাব করেন তাঁরা।
অভিযোগে আরো বলা হয়, ৬ এপ্রিল গোলাম আযম সাবেক মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীকে নিয়ে টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে শান্তি কমিটি গঠন করা নিয়ে আলোচনা হয়। এর কয়েক দিন পর খাজা খায়ের উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ১৪০ সদস্যের শান্তি কমিটি হয়। এই কমিটির দৈনন্দিন কাজ তদারক করতে ছয় সদস্যের একটি উপকমিটি করা হয়। এই উপকমিটিতে ২ নম্বরে ছিল গোলাম আযমের নাম।
অভিযোগে বলা হয়, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগসাজশে এবং চক্রান্তে সারা দেশে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস, পাইওনিয়ার ফোর্স ও মুজাহিদ বাহিনী গঠন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির হওয়ার কারণে এসব বাহিনী গঠনে মূল ভূমিকা ছিল গোলাম আযমের। এসব সংগঠনকে অস্ত্র সরবরাহ করা এবং এ বিষয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে সুপারিশ করার দায়িত্ব গোলাম আযমই পালন করতেন। জামায়াতে ইসলামী, তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ এবং জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার মাধ্যমে এসব বাহিনীতে লোক নিয়োগ করা হতো। তিনি সারা দেশ ঘুরে এসব বাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ ও কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করে সালাম নিয়েছেন। রাজাকার বাহিনীতে সদস্য ও অস্ত্র সরবরাহ বাড়ানোর আবেদন করেন গোলাম আযম।
অভিযোগে আরো বলা হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঈদের দিন গভীর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগার থেকে মুক্তিযোদ্ধা শিরু মিয়া, তাঁর ছেলেসহ ৩৮ জনকে বের করে নিয়ে কৈরতলা এলাকায় হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় গোলাম আযম সম্পৃক্ত ছিলেন।
অভিযোগে বলা হয়, একটি দলের প্রধান হয়ে তাঁর উচিত ছিল ওই সব অপরাধের সঙ্গে সস্পৃক্ত না হওয়া এবং তাঁর দলের লোকদের বিরত রাখা। তা না করে উল্টো তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অপরাধের সঙ্গে জড়িত থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
গত বছরের ২৩ আগস্ট থেকে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে তদন্ত সংস্থা। তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন মতিউর রহমান। গত ৪ ও ৫ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর ও আখাউড়া সফর করে এ সংস্থা। তদন্ত সংস্থা গত ৩১ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলন করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পন্ন করার ঘোষণা দেয়। এরপর ১ নভেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করা হয় ট্রাইব্যুনালে। ৩৬০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে ১০ হাজার পৃষ্ঠার নথি সংযুক্ত রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালের তথ্য ও চিত্রসংবলিত সিডি, ডিভিডি, গণহত্যাসংক্রান্ত ভিডিও ফুটেজ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আলবদর বাহিনীর অনাচারের প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, তখনকার এনবিসি, সিবিএস এবং দৈনিক সংগ্রাম, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান ও পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার প্রতিবেদনও দেওয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.