সিপিডির আলোচনা সভায় বক্তারা-পুঁজিবাজারে আস্থা ছাড়া তারল্য বাড়িয়ে সংকটের সমাধান হবে না

কেবল তারল্য সংকট দূর করার মাধ্যমে শেয়ারবাজারের সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা ভুল। তারপরও এ পথেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করায় বাজারে তার কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। মূল সমস্যা হলো আস্থার সংকট। গতকাল সোমবার গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত 'শেয়ারবাজার এবং সাম্প্রতিক নীতি উদ্যোগ' শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপকে 'লজ্জাকর'


আখ্যায়িত করে খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে শেয়ারবাজার সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান চার ঘণ্টা বৈঠক করেছেন বলে আমার জানা নেই। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসিকে স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এর আগে সংঘটিত সব অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শও দেন। বক্তারা বলেন, হস্তক্ষেপ না করলে বাজার নিজে থেকেই স্থিতিশীল হবে। রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে আয়োজিত এ আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক
উপদেষ্টা ও এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, সরকার গঠিত শেয়ারবাজার বিষয়ক তদন্ত কমিটির প্রধান ও কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন আহমেদ, এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাংসদ ফজলুল আজীম, সাংসদ ও পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাফিজ মজুমদার, অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান বজলুল হক খোন্দকার, এবিবি সভাপতি কে মাহমুদ সাত্তার, সিএসই সভাপতি আল মারুফ খান, ডিএসই জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আহসানুল ইসলাম প্রমুখ। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক ফেলো ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'এক বছর ধরে কেবল তহবিল জোগান সম্পর্কিত নীতি গ্রহণ দিয়ে বাজারের স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু বাজারের প্রধান সংকট আস্থাহীনতা। এটা দূর করার জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।' তিনি জানান, শেয়ার কারসাজির মূল ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার মানসিকতা এখনও সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে বিদ্যমান। শেয়ারবাজার বিষয়ে সরকারকে সুপরামর্শ প্রদানের জন্য পরামর্শক কমিটিতে বাজার সংশ্লিষ্টদের না রেখে অভিজ্ঞদের দ্বারা গঠনেরও পরামর্শ দেন তিনি।
শেয়ারবাজার সমস্যার মূল কারণ হিসেবে আস্থার সংকটকে প্রধান বলে দায়ী করেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। শেয়ার কারসাজির তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা না নেওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'সরকার কিছু আড়াল করতে চাইছে। ছিয়ানব্বইয়ে এমনটি হয়েছে, এবারও হলো।' একে সরকারের পলিটিক্যাল গেম (রাজনৈতিক খেলা) আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে শেয়ারবাজারে কারসাজি বারবারই হতে থাকবে। শেয়ারবাজারকে সুষ্ঠু ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সরকারকে এ ধরনের 'গেম' থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দেন তিনি।
এসইসি স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত না হলে বাজার সুষ্ঠুভাবে চলবে না। কারসাজির আশঙ্কা সব সময়ই থাকবে_ এমন মন্তব্য করেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। বাজারের ভবিষ্যৎ বিষয়ে তিনি বলেন, 'সব বাজারেরই বটম লাইন (সর্বনিম্ন স্তর) থাকে। বর্তমান বাজার বটম লাইনের কাছাকাছি রয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু লেনদেন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা গেলে শিগগিরই বাজার স্থিতিশীল হবে।'
বারবার প্রণোদনা ঘোষণার সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, 'বাজারকে জোর করে তোলার চেষ্টার ফল ভালো হয় না। সব ক্ষেত্রে বাজারে আইন পরিপালন নিশ্চিত হলে, অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে বাজার এমনিতেই স্থিতিশীল হবে।' স্বচ্ছতার জন্য তালিকাভুক্ত কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা কমিটির প্রধান হিসেবে উদ্যোক্তা ভিন্ন একজন স্বতন্ত্র পরিচালকের বিধান প্রবর্তনের পরামর্শ দেন তিনি। ঘোষিত প্রণোদনাগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়া এবং বাজারের সমস্যা অনুধাবন না করে প্রণোদনা দেওয়ায় উল্টো অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী।
শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত বিনিয়োগ করেছিল_ এ দায় স্বীকার করে বিএবি সভাপতি ও সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, 'ব্যাংকগুলোর কাছে তারল্য বেশি ছিল বলেই তারা বিনিয়োগ করেছিল। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো আইন ভঙ্গ করলেও সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের দোষ ছিল না।' শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সিএলআর ও এসআরআর হার কমানোর দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'সিএলআর/এসআরআর হার কমানো হলে ব্যাংকগুলোর তারল্য জোগান হবে।'
শেয়ারবাজার সমস্যা সমাধানে সমস্যা চিহ্নিত করা ও শেয়ার লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন ডিএসইর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আহসানুল ইসলাম। বাজারের স্বচ্ছতার জন্য অমনিবাস হিসাব বন্ধ ও মার্জিন ঋণ নিয়ন্ত্রণ করার দাবি জানান তিনি। সিএসই সভাপতি আল মারুফ খান বলেন, দেশের শেয়ারবাজারকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যবহার করার বিষয়ে কোনো রাষ্ট্রীয় নীতি নেই। সংকট উত্তরণে প্রণোদনা প্যাকেজ কাজ না করার বিষয়ে তিনি বলেন, স্বল্পমেয়াদি প্রণোদনা স্বল্পমেয়াদি ফল দেয়।

No comments

Powered by Blogger.