জাহাজভাঙা বিধিমালা চূড়ান্ত-আজ গেজেট প্রকাশ by ফারজানা লাবনী

তকাল সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাহাজভাঙা বিধিমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার এই বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা যায়। জাহাজভাঙা বিধিমালা প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ বি এম খোরশেদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ সংশোধিত ২০১০, শ্রম আইন ২০০৬ সহ সব জনকল্যাণমূলক আইনের আলোকে জাহাজভাঙা বিধিমালা চূড়ান্ত


করা হয়েছে। দুই বছর আগে থেকে জাহাজভাঙা ব্যবসায় অস্থিরতা তৈরি হয়। পরিত্যক্ত জাহাজের দূষিত তেল ও বর্জ্যের ফলে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ জানিয়ে বেলাসহ পরিবেশবাদী একাধিক সংগঠন এই ব্যবসা বন্ধের দাবি জানায়। তারা আদালতের আশ্রয়ও নেয়। আদালতের আদেশে সাময়িকভাবে পুরনো জাহাজ আমদানি বন্ধ করা হয়। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে হালকা প্রকৌশল শিল্প, আবাসন ও নির্মাণসহ একাধিক শিল্প খাতে। অস্থিরতা তৈরি হয় পুরো অর্থনীতিতে। এ পরিস্থিতিতে জাহাজভাঙা ব্যবসাকে প্রধানমন্ত্রী ১৩ ফেব্রুয়ারি শিল্প হিসেবে ঘোষণা দেন। ২১ এপ্রিল তা প্রকাশ হয় গেজেট আকারে। একই সঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত খাত হিসেবে কর্মকাণ্ড পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়। শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে জাহাজভাঙা বিধিমালা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে আদালত থেকে জানানো হয়, বিধিমালা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত জাহাজভাঙা ব্যবসা পরিচালনা করা যাবে। তবে পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর ৫ মে আদালত দুই মাসের মধ্যে (৪ জুলাই) জাহাজভাঙা বিষয়ে চূড়ান্ত বিধিমালা তৈরির সময় বেঁধে দেয়, কিন্তু নির্ধারিত সময়ে শিল্প মন্ত্রণালয় তা সম্পন্ন করতে না পারায় আদালত থেকে ১২ অক্টোবর নতুন সময় দেওয়া হয়। সে সময়ের মধ্যেও বিধিমালা তৈরি না হওয়ায় শিল্প মন্ত্রণালয় আবারও সময় চেয়ে আদালতে আবেদন জানায়। আদালত থেকে ১২ নভেম্বর আদেশ দেওয়া হয়, বিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত জাহাজভাঙা ব্যবসা বন্ধ থাকবে। আরো বলা হয়, আগামী ১৪ ডিসেম্বর শিল্পসচিব মাসুদ সিদ্দিকীকে চূড়ান্ত বিধিমালাসহ আদালতে উপস্থিত হতে হবে। এ কাজে ব্যর্থ হলে জাহাজভাঙা বিধিমালা তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ প্রেক্ষাপটে গত সাত মাসে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে জাহাজভাঙা বিধিমালা চূড়ান্ত হয়।
গতকাল শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ভবিষ্যতে যাতে এ শিল্পে আর কোনো অস্থিরতা তৈরি না হয় সে জন্য সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মতামতের ভিত্তিতে এ বিধিমালা তৈরি করা হয়েছে।
শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, চূড়ান্ত বিধিমালায় ৫২টি ধারা রয়েছে। বিধিমালায় আছে, জাহাজ কাটার পর বর্জ্য বা দূষিত তেল মাটিতে বা পানিতে পড়লে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। ক্ষেত্রবিশেষে ইয়ার্ডের মালিকদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে এবং ভবিষ্যতে ইয়ার্ড পরিচালনায় পুনরায় লাইসেন্স সরবরাহ করা হবে না। বিনা প্রশিক্ষণে কাউকে কাজ দেওয়া যাবে না। ইয়ার্ডে কর্মরত অবস্থায় শ্রমিককে অবশ্যই হেলমেট ও বিশেষ পোশাক ব্যবহার করতে হবে। কর্মরত অবস্থায় শ্রমিক মারা গেলে তাঁর পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এ ছাড়া ইয়ার্ডের মালিকদের নিয়ম ভঙ্গের গুরুত্ব অনুসারে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ১০ হাজার টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ধার্য করা হয়েছে। শ্রমিকের পরিচয়পত্র, পৃথক মজুরি, প্রশিক্ষণ এবং শ্রম আইন বাধ্যতামূলক করার জন্য বিধিমালায় নির্দেশনা রয়েছে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, কর্মপরিবেশ, আর্থিক নিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকছে এখানে। এ ছাড়া ইয়ার্ডে কর্মরত অবস্থায় কোনো শ্রমিক মারা গেলে মালিকপক্ষ যাতে সে ঘটনা অস্বীকার বা নায্য পাওনা থেকে তাকে বঞ্চিত করতে না পারে সেজন্য বিধিমালায় স্পষ্ট ধারা রয়েছে। বিধিমালায় উল্লেখ আছে, জাহাজভাঙা ব্যবসায়ীরা বিধিমালা মেনে ব্যবসা করছেন কি না, তা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণে এবং দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডে অনুমতি দানে একাধিক বোর্ড গঠন করা হবে। বিধিমালায় প্রি-ক্লিনিং ও জাহাজ কাটার আগে বিশেষজ্ঞের ছাড়পত্র আনার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে জানা যায়।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিধিমালা চূড়ান্ত হওয়ায় জাহাজভাঙা ব্যবসায় স্থিতি ফিরে আসবে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা আরো প্রতিযোগী হতে পারব।' অ্যাসোসিয়েশন থেকে জানা যায়, এ দেশে জাহাজভাঙা শিল্পে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিক এতে কর্মরত রয়েছে। এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয় প্রায় ৭০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকা। পুরনো জাহাজ থেকে প্রায় ৫০০ রি-রোলিং মিলে প্রতিবছর ২৫ লাখ টন রড তৈরির কাঁচামাল সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া এ খাত থেকে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টন কাঠের ফার্নিচার সরবরাহ করা হয়। দেশে ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ১২০টি ইয়ার্ড রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.