সব অপরাধের দায় তাঁর by আজাদুর রহমান চন্দন
বাঙালি নির্মূল 'অভিযানে পাকিস্তানিদের সাফল্য ছিল সামান্যই। কারণ পাকিস্তানি সৈন্যরা সন্দেহভাজন বাঙালিদের চেহারা যেমন চিনত না, তেমনি পড়তে পারত না বাংলায় লেখা অলিগলির নম্বরও। এ জন্য তাদের নির্ভর করতে হতো স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতার ওপর। সামগ্রিকভাবে বাঙালিরা তখনো ছিল মুজিবের ফিরে আসার ব্যাপারে আশাবাদী। পাকিস্তানিদের প্রতি তারা ছিল নিস্পৃহ। ওই সময় যাঁরা এগিয়ে আসেন তাঁরা হলেন কাউন্সিল মুসলিম
লীগের খাজা খয়ের উদ্দিন, কনভেনশন মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরী, কাইয়ুম মুসলিম লীগের খান এ সবুর খান, জামায়াতে ইসলামীর অধ্যাপক গোলাম আযম ও নেজামে ইসলাম পার্টির মৌলভী ফরিদ আহমদের মতো মুষ্টিমেয় কিছু ডানপন্থী।' পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের তখনকার জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তাঁর উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে এসব কথা লিখেছেন।
গোলাম আযমদের এই এগিয়ে আসাটা নিছক গণহত্যার জন্য বাঙালিদের চিনিয়ে দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং রাজাকার-আলবদরের মতো বিভিন্ন সহযোগী বাহিনী গঠন করে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন।
গোলাম আযম ছিলেন তখন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির। তিনি তাঁর পুরো দলকেই সহযোগী বাহিনীতে রূপান্তরিত করেছিলেন। গোলাম আযম নিজেই তখন বলেছেন, 'পাকিস্তান টিকিয়ে রাখতেই জামায়াতে ইসলামী শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে।' (সূত্র : দৈনিক পাকিস্তান, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মে মাসে জামায়াতের নেতা-কর্মীরাই প্রথম খুলনায় রাজাকার বাহিনী গঠন করেছিলেন। পরে গোলাম আযমের তদবিরেই রাজকার বাহিনীকে সরাসরি সেনাবাহিনীর অধীনে নেওয়া হয়।
গোলাম আযমের নেতৃত্বাধীন শান্তি কমিটিও কোনো সাধারণ কমিটি ছিল না। একাত্তরের ২২ সেপ্টেম্বর মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'বিহারি ও উগ্র হিন্দুবিদ্বেষী কিছু বাঙালিকে নিয়ে অফিশিয়ালি (সরকারিভাবে) গঠন করা হয় শান্তি কমিটি। এরা কিছু সরকারি দায়িত্বও পালন করে।' এর আগে সেই বছরের ২৯ জুলাই ওয়াশিংটনে হেনরি কিসিঞ্জারের নেতৃত্বাধীন সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের জন্য প্রণীত একটি পেপারে শান্তি কমিটিকে সামরিক শাসনের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ জুলাই ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে সাংবাদিক পিটার আর ক্যান লিখেছিলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের ওপর সেনাবাহিনীর আস্থার ঘাটতি থাকায় তাদের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতা দিয়ে গঠন করা হয় শান্তি কমিটি। অবাঙালি বিহারি এবং মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর মতো কিছু রক্ষণশীল ধর্মভিত্তিক ছোট রাজনৈতিক দলের লোকজনকে নিয়ে এ কমিটি গঠন করে সেনাবাহিনী। সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীতে লোক রিক্রুট করার দায়িত্ব পালন করে এরা। শান্তি কমিটির সদস্যরা সেনাবাহিনীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। এরা বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু ও স্বাধীনতাপন্থী বাঙালিদের বাড়িঘর, দোকানপাট ও জমিজমা দখল করে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়।' যমদূত রাজাকার বাহিনী সাধারণভাবে শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন ছিল। প্রতিটি রাজাকার ব্যাচের ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর শান্তি কমিটির স্থানীয় প্রধান তাদের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করত। ১৯৭১-এর ২৯ অক্টোবরের দৈনিক সংগ্রামের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, 'রাজশাহী জেলা কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সম্পাদক জনাব আজিজুর রহমান আল-আমীনের সভাপতিত্বে গত সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে দুই শ রেজাকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন।' 'কুষ্টিয়ায় মুজাহিদ ও রাজাকারদের কুচকাওয়াজ' শিরোনামে ১৬ জুলাই ১৯৭১ তারিখের দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়, 'জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান জনাব সাদ আহমদ দুই হাজার রাজাকারের অভিবাদন গ্রহণ করেন।' একই পত্রিকায় ২৭ জুলাই ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনামই ছিল 'ইসলামপুর শান্তি কমিটির সভায় রাজাকার বাহিনী গঠিত'। অনেক ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণহত্যার নীলনকশা তৈরি করে তা বাস্তবায়নও করেছে শান্তি কমিটির লোকেরা। একাত্তরের ২৩ জুন রাজশাহীর পবা থানার হুজুরীপাড়া ইউনিয়ন কাউন্সিল কার্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে হামলা চালানো হয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে। দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে তাঁদের ওপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। সে বছর দৈনিক সংগ্রামে ১৫ জুলাই সাতক্ষীরা প্রতিনিধির পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'শান্তি কমিটির সদস্যরা দুষ্কৃতকারীদের আটক ও শায়েস্তা করতে তৎপর রয়েছে।' এ ছাড়া রাজাকারদের পরিচয়পত্র দিত শান্তি কমিটি। রাজাকারদের বেতন-ভাতাসংক্রান্ত সেনাবাহনীর সব চিঠিপত্রের অনুলিপি দেওয়া হতো শান্তি কমিটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। আর গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী নামে শান্তি কমিটির একটি নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনীও ছিল। এসব তথ্য ও দলিল থেকে প্রমাণ হয়, শান্তি কমিটিও ছিল সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগী বাহিনী। আর গোলাম আযম ছিলেন এই সহযোগী বাহিনীর নেতা।
এ ছাড়া গোলাম আযমের নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামীর অফিস থেকেও রাজাকারদের পরিচয়পত্র দেওয়া হতো। সারা দেশে সব থানা-জেলার জামায়াত নেতারা ছিলেন রাজাকার বাহিনীর সংগঠক। আর জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘকে রূপান্তরিত করা হয়েছিল কুখ্যাত আলবদর বাহিনীতে। জামায়তিরাই তখন বলত, 'আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল'। সাইয়েদ ওয়ালি রেজা নাসের তাঁর 'দ্য ভেনগার্ড অব দি ইসলামী রেভলিউশন' বইয়ে লিখেছেন, সরকারের অনুপ্রেরণায় ইসলামী ছাত্রসংঘ (ওঔঞ) হয়ে ওঠে জামায়াতে ইসলামীর মূল শক্তি। আর্মির সহায়তায় এরা আলবদর ও আলশামস নামের দুটি প্যারামিলিটারি ইউনিট গঠন করে বাঙালি গেরিলাদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য। পাকিস্তানি কূটনীতিক ও গবেষক হুসাইন হাক্কানি তাঁর 'পাকিস্তান : বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি' গ্রন্থে লিখেছেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত অবাঙালি ও পাকিস্তানপন্থী ইসলামী সংগঠনগুলোর কর্মীদের নিয়ে এক লাখ সদস্যের একটি রাজাকার বাহিনী গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেনাবাহিনী। দুটি আধা সামরিক কাউন্টার ইনসারজেন্সি ইউনিট গড়ার লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামী এবং বিশেষ করে এর ছাত্র সংগঠনটি ১৯৭১ সালের মে মাসে সামরিক বাহিনীর ওই উদ্যোগে শরিক হয়। জামায়াতের ছাত্র সংগঠন তাদের অনেক কর্মী-সমর্থককে এসব বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করায়। একই বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ রাজাকারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০ হাজারে।' ২০০৫ সালে প্রকাশিত এ বইয়ের ৭৯ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, 'আলবদর ও আলশামস কাজ করত সেনাবাহিনীর ডেথ স্কোয়াড হিসেবে। প্রগতিশীল অধ্যাপক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও চিকিৎসক তথা বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য এদের দায়ী করা হয়।'
এসব সহযোগী বাহিনী একাত্তরে সারা দেশে যত অপরাধ করেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী সেই সব অপরাধের দায় শীর্ষ নেতা হিসেবে গোলাম আযমের ওপরই বর্তায়। এ ছাড়া একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করার লিখিত নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন_
সেনাবাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস : একাত্তরে ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ১০ দিনের মধ্যে ৪ এপ্রিল নূরুল আমিন, গোলাম আযম, খাজা খয়ের উদ্দিন প্রমুখ ডানপন্থী রাজনীতিক পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক ও গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। দৈনিক সংগ্রাম, পাকিস্তান অবজারভার, দৈনিক পূর্বদেশসহ কয়েকটি পত্রিকায় এ-সংক্রান্ত খবর ও ছবি প্রকাশিত হয়। দুই দিন পর (৬ এপ্রিল) আরো কয়েকজনের মতো আলাদাভাবে টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন গোলাম আযম। ৭ এপ্রিল সেই খবর ছাপা হয় দৈনিক সংগ্রামে। গোলাম আযম অন্য দালালদের নিয়ে ১৬ এপ্রিল আবার টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সেনাবাহিনীকে সহায়তা দিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। পরদিন ১৭ এপ্রিল সেই খবর ছাপা হয় দৈনিক সংগ্রাম, পাকিস্তান অবজারভারসহ বিভিন্ন পত্রিকায়।
শান্তি কমিটি গঠন : গোলাম আযম অন্যদের নিয়ে গঠন করেন শান্তি কমিটি। নামে শান্তি কমিটি হলেও একাত্তরের ৯ মাস এরা অশান্তির আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে বাঙালিদের। সে বছরের ৯ এপ্রিল প্রথমে ঢাকায় খাজা খয়ের উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করা হয়, যাতে গোলাম আযম ছিলেন অন্যতম সদস্য। ১৩ এপ্রিল শান্তি কমিটির উদ্যোগে একটি মিছিল বের করা হয় ঢাকায়। ওই মিছিল শেষে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখা এবং সেনাবাহিনীর সাফল্য কামনা করে মোনাজাত করা হয়। ওই মোনাজাত অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন গোলাম আযম (দৈনিক সংগ্রাম, ১৪ এপ্রিল ১৯৭১)। পরে ১৫ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সভায় এই কমিটির নতুন নাম দেওয়া হয় পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি। ওই দিন ২১ সদস্যের একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতেও গোলাম আযম ছিলেন অন্যতম সদস্য। এ খবরও প্রকাশিত হয় দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন পত্রিকায়।
রাজাকার বাহিনী গঠনের উদ্যোগ, ভারী অস্ত্র পেতে দেনদরবার : অন্য দালালদের নিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করেই শুধু ক্ষান্ত ছিল না জামায়াতে ইসলামী ও তার নেতা গোলাম আযম। বাঙালিদের খতম করতে সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী গঠনের উদ্যোগও নিয়েছিল মূলত তারাই। যমদূত রাজাকার বাহিনী গঠনের প্রস্তাবটি গোলাম আযম দিয়েছিলেন ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে। এর আগের দিন দৈনিক পাকিস্তানের খবরে বলা হয়, গোলাম আযম লাহোরে বলেছেন, 'প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে কিছু সুপারিশ রাখবেন। তবে এগুলো আগেভাগে প্রকাশ করা ভালো হবে না।' ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের পরদিন অর্থাৎ ২০ জুন জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের খবরে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির 'দুষ্কৃতকারীদের মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে দেশের আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান'। এর পরদিনই দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, 'দেশপ্রেমিকদের অস্ত্রসজ্জিত করা হলে অল্প সময়েই দুষ্কৃতকারীদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে।' উল্লেখ্য, জামায়াতিরা তখন মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সমর্থকদের 'দুষ্কৃতকারী', 'বিচ্ছিন্নতাবাদী', 'বিদ্রোহী', 'ভারতীয় এজেন্ট' ইত্যাদি বলত। একাত্তরের ২১ জুন লাহোরে দলীয় অফিসে কর্মীদের উদ্দেশে গোলাম আযম বলেন, 'সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশকে রক্ষা করার বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না।' পরদিন দৈনিক সংগ্রামে সংবাদটি প্রকাশ করে বলা হয়, 'তিনি (গোলাম আযম) সেনাবাহিনীর প্রশংসা করেন।'
বাংলাদেশের স্থপতিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলা : তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক গোপন দলিলে [নম্বর ৪৮২/১৫৮-পল/এস (আই)] দেখা যায়, ৪ আগস্ট খুলনা জেলা জামায়াতের এক সভায় গোলাম আযম তাঁর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' আখ্যা দেন। স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল হলের ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা আবদুস সাত্তার। ২০০১ সালে বাগেরহাট-৪ আসন থেকে তিনি জামায়াতের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২৮-৭-১৯৭১ তারিখে দেওয়া ওই প্রতিবেদনে সই করেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্রসচিব এম এম কাজিম।
সাম্প্রদায়িক উসকানি : আরেকটি গোপন প্রতিবেদনে [নম্বর ৫৪৯(১৫৯) পল/এস (আই)] উল্লেখ আছে, আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কুষ্টিয়া জেলা জামায়াতের সম্মেলনে গোলাম আযম বলেন, 'হিন্দুরা মুসলমানদের শত্রু। তারা সব সময় পাকিস্তানকে ধ্বংসের চেষ্টা করছে।' ১৯ জুলাই ১৯৭১ তারিখের দৈনিক সংগ্রামের খবর অনুযায়ী, ১৬ জুলাই রাজশাহীতে শান্তি কমিটির সমাবেশে গোলাম আযম বলেন, হিন্দুরা মুসলমানের বন্ধু এমন কোনো প্রমাণ নেই। এ উসকানিরই ফল হলো ওই সময় অনেক বাঙালিকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা এবং হিন্দুদের হত্যা, তাদের বাড়িঘরে অগি্নসংযোগ, সহায়-সম্পদ লুট ইত্যাদি।
মুক্তিযোদ্ধাদের 'দুষ্কৃতকারী' আখ্যা দিয়ে তাঁদের নির্মূল করার নির্দেশ : পূর্ব পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোপন প্রতিবেদন [নম্বর ৫৪৯ (১৫৯) পল/এস (আই)] মতে, কুষ্টিয়া জেলা জামায়াতের ওই সম্মেলনে গোলাম আযম প্রতি গ্রামে শান্তি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের 'দুষ্কৃতকারী' আখ্যা দিয়ে তাঁদের নির্মূল করারও নির্দেশ দেন তিনি। গোলাম আযম বলেন, খুব শিগগিরই রাজাকার, মুজাহিদ ও পুলিশ মিলে দুষ্কৃতকারীদের মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা থেকে পিন্ডিতে মাসে দুই বার এ গোপন প্রতিবেদন (ফর্টনাইটলি সিক্রেট রিপোর্ট) পাঠানো হতো। সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধের প্রতিবেদনে [নম্বর ৬০৯(১৬৯) পল/এস(আই)] বলা হয়েছে, ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জামায়াতের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়, যাতে গোলাম আযমসহ অন্যরা বক্তব্য দেন। সভায় প্রদেশের রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয় এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে 'বিদ্রোহীদের' (মুক্তিযোদ্ধা) নির্মূল করার ওপর জোর দেওয়া হয়।
একাত্তরের ১৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে রাজাকার ক্যাম্প পরিদর্শন করেন গোলাম আযম। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক সংগ্রামের খবরে বলা হয়, প্রশিক্ষণার্থী রাজাকারদের প্রতি 'ভালোভাবে ট্রেনিং গ্রহণ করে যত শীঘ্র সম্ভব এসব অভ্যন্তরীণ শত্রুকে (মুক্তিযোদ্ধা) দমন করার জন্য গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার আহ্বান' জানান তিনি। ওই রাজাকার ক্যাম্প পরিদর্শনে গোলাম আযমের সঙ্গে ছিলেন প্রাদেশিক জামায়াতের শ্রম ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক শফিকুল্লাহ, কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সহসভাপতি ও তেজগাঁও থানা জামায়াতের সভাপতি মাহবুবুর রহমান গোরহা এবং রাজাকার বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ ইউনুস। সেখানে গোলাম আযম আরো বলেন, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা পাকিস্তানের হেফাজতের জন্য রেজাকার, মুজাহিদ ও পুলিশ বাহিনীতে ভর্তি হয়েছে। (দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)
যুদ্ধের হুংকার : একাত্তরে গোলাম আযম বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধের হুংকারও ছেড়েছেন। ২৩ নভেম্বর লাহোরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'বর্তমান মুহূর্তে আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করাই হবে দেশের জন্য আত্মরক্ষার সর্বোত্তম ব্যবস্থা।' পরদিন তাঁর এ বক্তব্য দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত হয়। ২৭ নভেম্বর গোলাম আযম পিন্ডি আইনজীবী সমিতির এক সভায় বলেন, 'দেশপ্রেমিক জনগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।' পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে ২২ নভেম্বর ঢাকা ছেড়েছিলেন গোলাম আযম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মাওলানা আবদুর রহীম ও এ কে এম ইউসুফ। সেটিই ছিল গোলাম আযমের শেষ যাওয়া। ১৯৭৮ সালের আগে আর দেশে ফেরেননি তিনি।
পাকিস্তান রক্ষার চেষ্টা : একাত্তরের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ২৫তম আজাদি দিবস উপলক্ষে এক বিবৃতিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম 'পাকিস্তান সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করার জন্য প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান' জানান। এই শিরোনামেই খবরটি তখন ছাপা হয় দৈনিক সংগ্রামে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে 'পাকিস্তানের আদর্শ' রক্ষার জন্য গোলাম আযম একটি তহবিল গঠন করেছিলেন। ওই তহবিলের জন্য গোলাম আযমের সই করা রসিদ দিয়ে চাঁদা তোলা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা সিরু মিয়াকে হত্যার নির্দেশ : কুমিল্লার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সিরু মিয়া দারোগা ও তাঁর ছেলে আনোয়ার কামালকে গোলাম আযমের লিখিত নির্দেশে হত্যা করা হয়। সিরু মিয়া দারোগা শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ট্রেনিং ও অপারেশন চালাতেন। ১৯৭১ সালের ২৭ অক্টোবর সিরু মিয়া দারোগা এবং তাঁর কিশোর ছেলে আনোয়ার কামাল ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার সময় অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। ২৯ অক্টোবর সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম তাঁর চাচা শ্বশুর আবদুল মজিদ মিয়ার কাছ থেকে খবরটি জানতে পারেন। নানা জায়গায় ধরনা দিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি ঢাকায় দূর সম্পর্কের আত্মীয় মহসীনের কাছে হাজির হন। খিলগাঁও গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের শিক্ষক মহসীন গোলাম আযমের দুই ছেলেকে প্রাইভেট পড়াতেন। তাঁর মাধ্যমেই গোলাম আযমকে ধরলেন আনোয়ারা। সব শুনে একটি চিঠি লিখলেন গোলাম আযম। খাম বন্ধ করে বললেন, কুমিল্লা ডিস্ট্রিক্ট রাজাকার কমান্ডারকে এই চিঠি দিলে সিরু মিয়াদের ছেড়ে দেওয়া হবে। আনোয়ারার ভাই ফজলু মিয়া ১ নভেম্বর কুমিল্লায় গেলেন এই চিঠি নিয়ে। স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার চিঠি পড়ে বললেন, ঈদের পরদিন কামালকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর সিরু মিয়াকে পুলিশে যোগদানের জন্য পাঠানো হবে। জেলখানায় ফজলুর সঙ্গে কামালের দেখা হয়। মামার সিগারেটের প্যাকেটের কাগজে মাকে চিঠি লেখে কামাল : 'আম্মা, সালাম নেবেন। আমরা জেলে আছি। জানি না কবে ছুটব। ভয় করবেন না। আমাদের ওপর তারা অকথ্য অত্যাচার করেছে। দোয়া করবেন। আমাদের জেলে অনেক দিন থাকতে হবে। ঈদ মোবারক। কামাল।' কামাল আরেকটি চিঠি লেখে তার নানাকে।
২৩ নভেম্বর ঈদ। পরদিন কামালের ফেরার কথা। ফেরে না কামাল। ২১ তারিখ সন্ধ্যায় তিতাসের পাড়ে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মারা হয় সিরু মিয়া ও তাঁর ছেলে কামালকে। ঈদের পরদিন ফজলু কামালকে আনতে যান কুমিল্লা জেলখানায়। সেখানে সিরু মিয়া ও কামালের জামা-কাপড় তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়। ঠিক এই নির্দেশই তাঁর লেখা চিঠিতে দিয়েছিলেন গোলাম আযম।
নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগেও এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
গোলাম আযমদের এই এগিয়ে আসাটা নিছক গণহত্যার জন্য বাঙালিদের চিনিয়ে দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং রাজাকার-আলবদরের মতো বিভিন্ন সহযোগী বাহিনী গঠন করে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন।
গোলাম আযম ছিলেন তখন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির। তিনি তাঁর পুরো দলকেই সহযোগী বাহিনীতে রূপান্তরিত করেছিলেন। গোলাম আযম নিজেই তখন বলেছেন, 'পাকিস্তান টিকিয়ে রাখতেই জামায়াতে ইসলামী শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে।' (সূত্র : দৈনিক পাকিস্তান, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মে মাসে জামায়াতের নেতা-কর্মীরাই প্রথম খুলনায় রাজাকার বাহিনী গঠন করেছিলেন। পরে গোলাম আযমের তদবিরেই রাজকার বাহিনীকে সরাসরি সেনাবাহিনীর অধীনে নেওয়া হয়।
গোলাম আযমের নেতৃত্বাধীন শান্তি কমিটিও কোনো সাধারণ কমিটি ছিল না। একাত্তরের ২২ সেপ্টেম্বর মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'বিহারি ও উগ্র হিন্দুবিদ্বেষী কিছু বাঙালিকে নিয়ে অফিশিয়ালি (সরকারিভাবে) গঠন করা হয় শান্তি কমিটি। এরা কিছু সরকারি দায়িত্বও পালন করে।' এর আগে সেই বছরের ২৯ জুলাই ওয়াশিংটনে হেনরি কিসিঞ্জারের নেতৃত্বাধীন সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের জন্য প্রণীত একটি পেপারে শান্তি কমিটিকে সামরিক শাসনের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ জুলাই ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে সাংবাদিক পিটার আর ক্যান লিখেছিলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের ওপর সেনাবাহিনীর আস্থার ঘাটতি থাকায় তাদের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতা দিয়ে গঠন করা হয় শান্তি কমিটি। অবাঙালি বিহারি এবং মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর মতো কিছু রক্ষণশীল ধর্মভিত্তিক ছোট রাজনৈতিক দলের লোকজনকে নিয়ে এ কমিটি গঠন করে সেনাবাহিনী। সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীতে লোক রিক্রুট করার দায়িত্ব পালন করে এরা। শান্তি কমিটির সদস্যরা সেনাবাহিনীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। এরা বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু ও স্বাধীনতাপন্থী বাঙালিদের বাড়িঘর, দোকানপাট ও জমিজমা দখল করে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়।' যমদূত রাজাকার বাহিনী সাধারণভাবে শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন ছিল। প্রতিটি রাজাকার ব্যাচের ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর শান্তি কমিটির স্থানীয় প্রধান তাদের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করত। ১৯৭১-এর ২৯ অক্টোবরের দৈনিক সংগ্রামের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, 'রাজশাহী জেলা কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সম্পাদক জনাব আজিজুর রহমান আল-আমীনের সভাপতিত্বে গত সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে দুই শ রেজাকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন।' 'কুষ্টিয়ায় মুজাহিদ ও রাজাকারদের কুচকাওয়াজ' শিরোনামে ১৬ জুলাই ১৯৭১ তারিখের দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়, 'জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান জনাব সাদ আহমদ দুই হাজার রাজাকারের অভিবাদন গ্রহণ করেন।' একই পত্রিকায় ২৭ জুলাই ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনামই ছিল 'ইসলামপুর শান্তি কমিটির সভায় রাজাকার বাহিনী গঠিত'। অনেক ক্ষেত্রে একই ব্যক্তি শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গণহত্যার নীলনকশা তৈরি করে তা বাস্তবায়নও করেছে শান্তি কমিটির লোকেরা। একাত্তরের ২৩ জুন রাজশাহীর পবা থানার হুজুরীপাড়া ইউনিয়ন কাউন্সিল কার্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে হামলা চালানো হয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে। দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে তাঁদের ওপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। সে বছর দৈনিক সংগ্রামে ১৫ জুলাই সাতক্ষীরা প্রতিনিধির পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'শান্তি কমিটির সদস্যরা দুষ্কৃতকারীদের আটক ও শায়েস্তা করতে তৎপর রয়েছে।' এ ছাড়া রাজাকারদের পরিচয়পত্র দিত শান্তি কমিটি। রাজাকারদের বেতন-ভাতাসংক্রান্ত সেনাবাহনীর সব চিঠিপত্রের অনুলিপি দেওয়া হতো শান্তি কমিটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। আর গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী নামে শান্তি কমিটির একটি নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনীও ছিল। এসব তথ্য ও দলিল থেকে প্রমাণ হয়, শান্তি কমিটিও ছিল সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগী বাহিনী। আর গোলাম আযম ছিলেন এই সহযোগী বাহিনীর নেতা।
এ ছাড়া গোলাম আযমের নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামীর অফিস থেকেও রাজাকারদের পরিচয়পত্র দেওয়া হতো। সারা দেশে সব থানা-জেলার জামায়াত নেতারা ছিলেন রাজাকার বাহিনীর সংগঠক। আর জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘকে রূপান্তরিত করা হয়েছিল কুখ্যাত আলবদর বাহিনীতে। জামায়তিরাই তখন বলত, 'আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল'। সাইয়েদ ওয়ালি রেজা নাসের তাঁর 'দ্য ভেনগার্ড অব দি ইসলামী রেভলিউশন' বইয়ে লিখেছেন, সরকারের অনুপ্রেরণায় ইসলামী ছাত্রসংঘ (ওঔঞ) হয়ে ওঠে জামায়াতে ইসলামীর মূল শক্তি। আর্মির সহায়তায় এরা আলবদর ও আলশামস নামের দুটি প্যারামিলিটারি ইউনিট গঠন করে বাঙালি গেরিলাদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য। পাকিস্তানি কূটনীতিক ও গবেষক হুসাইন হাক্কানি তাঁর 'পাকিস্তান : বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি' গ্রন্থে লিখেছেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত অবাঙালি ও পাকিস্তানপন্থী ইসলামী সংগঠনগুলোর কর্মীদের নিয়ে এক লাখ সদস্যের একটি রাজাকার বাহিনী গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেনাবাহিনী। দুটি আধা সামরিক কাউন্টার ইনসারজেন্সি ইউনিট গড়ার লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামী এবং বিশেষ করে এর ছাত্র সংগঠনটি ১৯৭১ সালের মে মাসে সামরিক বাহিনীর ওই উদ্যোগে শরিক হয়। জামায়াতের ছাত্র সংগঠন তাদের অনেক কর্মী-সমর্থককে এসব বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করায়। একই বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ রাজাকারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০ হাজারে।' ২০০৫ সালে প্রকাশিত এ বইয়ের ৭৯ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, 'আলবদর ও আলশামস কাজ করত সেনাবাহিনীর ডেথ স্কোয়াড হিসেবে। প্রগতিশীল অধ্যাপক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও চিকিৎসক তথা বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য এদের দায়ী করা হয়।'
এসব সহযোগী বাহিনী একাত্তরে সারা দেশে যত অপরাধ করেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী সেই সব অপরাধের দায় শীর্ষ নেতা হিসেবে গোলাম আযমের ওপরই বর্তায়। এ ছাড়া একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করার লিখিত নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন_
সেনাবাহিনীকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস : একাত্তরে ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ১০ দিনের মধ্যে ৪ এপ্রিল নূরুল আমিন, গোলাম আযম, খাজা খয়ের উদ্দিন প্রমুখ ডানপন্থী রাজনীতিক পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক ও গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। দৈনিক সংগ্রাম, পাকিস্তান অবজারভার, দৈনিক পূর্বদেশসহ কয়েকটি পত্রিকায় এ-সংক্রান্ত খবর ও ছবি প্রকাশিত হয়। দুই দিন পর (৬ এপ্রিল) আরো কয়েকজনের মতো আলাদাভাবে টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন গোলাম আযম। ৭ এপ্রিল সেই খবর ছাপা হয় দৈনিক সংগ্রামে। গোলাম আযম অন্য দালালদের নিয়ে ১৬ এপ্রিল আবার টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সেনাবাহিনীকে সহায়তা দিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। পরদিন ১৭ এপ্রিল সেই খবর ছাপা হয় দৈনিক সংগ্রাম, পাকিস্তান অবজারভারসহ বিভিন্ন পত্রিকায়।
শান্তি কমিটি গঠন : গোলাম আযম অন্যদের নিয়ে গঠন করেন শান্তি কমিটি। নামে শান্তি কমিটি হলেও একাত্তরের ৯ মাস এরা অশান্তির আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে বাঙালিদের। সে বছরের ৯ এপ্রিল প্রথমে ঢাকায় খাজা খয়ের উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করা হয়, যাতে গোলাম আযম ছিলেন অন্যতম সদস্য। ১৩ এপ্রিল শান্তি কমিটির উদ্যোগে একটি মিছিল বের করা হয় ঢাকায়। ওই মিছিল শেষে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখা এবং সেনাবাহিনীর সাফল্য কামনা করে মোনাজাত করা হয়। ওই মোনাজাত অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন গোলাম আযম (দৈনিক সংগ্রাম, ১৪ এপ্রিল ১৯৭১)। পরে ১৫ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সভায় এই কমিটির নতুন নাম দেওয়া হয় পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি। ওই দিন ২১ সদস্যের একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতেও গোলাম আযম ছিলেন অন্যতম সদস্য। এ খবরও প্রকাশিত হয় দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন পত্রিকায়।
রাজাকার বাহিনী গঠনের উদ্যোগ, ভারী অস্ত্র পেতে দেনদরবার : অন্য দালালদের নিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করেই শুধু ক্ষান্ত ছিল না জামায়াতে ইসলামী ও তার নেতা গোলাম আযম। বাঙালিদের খতম করতে সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী গঠনের উদ্যোগও নিয়েছিল মূলত তারাই। যমদূত রাজাকার বাহিনী গঠনের প্রস্তাবটি গোলাম আযম দিয়েছিলেন ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে। এর আগের দিন দৈনিক পাকিস্তানের খবরে বলা হয়, গোলাম আযম লাহোরে বলেছেন, 'প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে কিছু সুপারিশ রাখবেন। তবে এগুলো আগেভাগে প্রকাশ করা ভালো হবে না।' ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের পরদিন অর্থাৎ ২০ জুন জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের খবরে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির 'দুষ্কৃতকারীদের মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে দেশের আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান'। এর পরদিনই দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, 'দেশপ্রেমিকদের অস্ত্রসজ্জিত করা হলে অল্প সময়েই দুষ্কৃতকারীদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে।' উল্লেখ্য, জামায়াতিরা তখন মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সমর্থকদের 'দুষ্কৃতকারী', 'বিচ্ছিন্নতাবাদী', 'বিদ্রোহী', 'ভারতীয় এজেন্ট' ইত্যাদি বলত। একাত্তরের ২১ জুন লাহোরে দলীয় অফিসে কর্মীদের উদ্দেশে গোলাম আযম বলেন, 'সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশকে রক্ষা করার বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না।' পরদিন দৈনিক সংগ্রামে সংবাদটি প্রকাশ করে বলা হয়, 'তিনি (গোলাম আযম) সেনাবাহিনীর প্রশংসা করেন।'
বাংলাদেশের স্থপতিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলা : তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক গোপন দলিলে [নম্বর ৪৮২/১৫৮-পল/এস (আই)] দেখা যায়, ৪ আগস্ট খুলনা জেলা জামায়াতের এক সভায় গোলাম আযম তাঁর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' আখ্যা দেন। স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল হলের ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা আবদুস সাত্তার। ২০০১ সালে বাগেরহাট-৪ আসন থেকে তিনি জামায়াতের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২৮-৭-১৯৭১ তারিখে দেওয়া ওই প্রতিবেদনে সই করেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্রসচিব এম এম কাজিম।
সাম্প্রদায়িক উসকানি : আরেকটি গোপন প্রতিবেদনে [নম্বর ৫৪৯(১৫৯) পল/এস (আই)] উল্লেখ আছে, আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কুষ্টিয়া জেলা জামায়াতের সম্মেলনে গোলাম আযম বলেন, 'হিন্দুরা মুসলমানদের শত্রু। তারা সব সময় পাকিস্তানকে ধ্বংসের চেষ্টা করছে।' ১৯ জুলাই ১৯৭১ তারিখের দৈনিক সংগ্রামের খবর অনুযায়ী, ১৬ জুলাই রাজশাহীতে শান্তি কমিটির সমাবেশে গোলাম আযম বলেন, হিন্দুরা মুসলমানের বন্ধু এমন কোনো প্রমাণ নেই। এ উসকানিরই ফল হলো ওই সময় অনেক বাঙালিকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা এবং হিন্দুদের হত্যা, তাদের বাড়িঘরে অগি্নসংযোগ, সহায়-সম্পদ লুট ইত্যাদি।
মুক্তিযোদ্ধাদের 'দুষ্কৃতকারী' আখ্যা দিয়ে তাঁদের নির্মূল করার নির্দেশ : পূর্ব পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোপন প্রতিবেদন [নম্বর ৫৪৯ (১৫৯) পল/এস (আই)] মতে, কুষ্টিয়া জেলা জামায়াতের ওই সম্মেলনে গোলাম আযম প্রতি গ্রামে শান্তি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের 'দুষ্কৃতকারী' আখ্যা দিয়ে তাঁদের নির্মূল করারও নির্দেশ দেন তিনি। গোলাম আযম বলেন, খুব শিগগিরই রাজাকার, মুজাহিদ ও পুলিশ মিলে দুষ্কৃতকারীদের মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা থেকে পিন্ডিতে মাসে দুই বার এ গোপন প্রতিবেদন (ফর্টনাইটলি সিক্রেট রিপোর্ট) পাঠানো হতো। সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধের প্রতিবেদনে [নম্বর ৬০৯(১৬৯) পল/এস(আই)] বলা হয়েছে, ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জামায়াতের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়, যাতে গোলাম আযমসহ অন্যরা বক্তব্য দেন। সভায় প্রদেশের রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয় এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে 'বিদ্রোহীদের' (মুক্তিযোদ্ধা) নির্মূল করার ওপর জোর দেওয়া হয়।
একাত্তরের ১৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে রাজাকার ক্যাম্প পরিদর্শন করেন গোলাম আযম। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক সংগ্রামের খবরে বলা হয়, প্রশিক্ষণার্থী রাজাকারদের প্রতি 'ভালোভাবে ট্রেনিং গ্রহণ করে যত শীঘ্র সম্ভব এসব অভ্যন্তরীণ শত্রুকে (মুক্তিযোদ্ধা) দমন করার জন্য গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার আহ্বান' জানান তিনি। ওই রাজাকার ক্যাম্প পরিদর্শনে গোলাম আযমের সঙ্গে ছিলেন প্রাদেশিক জামায়াতের শ্রম ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক শফিকুল্লাহ, কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সহসভাপতি ও তেজগাঁও থানা জামায়াতের সভাপতি মাহবুবুর রহমান গোরহা এবং রাজাকার বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ ইউনুস। সেখানে গোলাম আযম আরো বলেন, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা পাকিস্তানের হেফাজতের জন্য রেজাকার, মুজাহিদ ও পুলিশ বাহিনীতে ভর্তি হয়েছে। (দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)
যুদ্ধের হুংকার : একাত্তরে গোলাম আযম বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধের হুংকারও ছেড়েছেন। ২৩ নভেম্বর লাহোরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'বর্তমান মুহূর্তে আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করাই হবে দেশের জন্য আত্মরক্ষার সর্বোত্তম ব্যবস্থা।' পরদিন তাঁর এ বক্তব্য দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত হয়। ২৭ নভেম্বর গোলাম আযম পিন্ডি আইনজীবী সমিতির এক সভায় বলেন, 'দেশপ্রেমিক জনগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।' পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে ২২ নভেম্বর ঢাকা ছেড়েছিলেন গোলাম আযম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মাওলানা আবদুর রহীম ও এ কে এম ইউসুফ। সেটিই ছিল গোলাম আযমের শেষ যাওয়া। ১৯৭৮ সালের আগে আর দেশে ফেরেননি তিনি।
পাকিস্তান রক্ষার চেষ্টা : একাত্তরের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ২৫তম আজাদি দিবস উপলক্ষে এক বিবৃতিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম 'পাকিস্তান সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করার জন্য প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান' জানান। এই শিরোনামেই খবরটি তখন ছাপা হয় দৈনিক সংগ্রামে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে 'পাকিস্তানের আদর্শ' রক্ষার জন্য গোলাম আযম একটি তহবিল গঠন করেছিলেন। ওই তহবিলের জন্য গোলাম আযমের সই করা রসিদ দিয়ে চাঁদা তোলা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা সিরু মিয়াকে হত্যার নির্দেশ : কুমিল্লার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সিরু মিয়া দারোগা ও তাঁর ছেলে আনোয়ার কামালকে গোলাম আযমের লিখিত নির্দেশে হত্যা করা হয়। সিরু মিয়া দারোগা শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ট্রেনিং ও অপারেশন চালাতেন। ১৯৭১ সালের ২৭ অক্টোবর সিরু মিয়া দারোগা এবং তাঁর কিশোর ছেলে আনোয়ার কামাল ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার সময় অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। ২৯ অক্টোবর সিরু মিয়ার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম তাঁর চাচা শ্বশুর আবদুল মজিদ মিয়ার কাছ থেকে খবরটি জানতে পারেন। নানা জায়গায় ধরনা দিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি ঢাকায় দূর সম্পর্কের আত্মীয় মহসীনের কাছে হাজির হন। খিলগাঁও গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের শিক্ষক মহসীন গোলাম আযমের দুই ছেলেকে প্রাইভেট পড়াতেন। তাঁর মাধ্যমেই গোলাম আযমকে ধরলেন আনোয়ারা। সব শুনে একটি চিঠি লিখলেন গোলাম আযম। খাম বন্ধ করে বললেন, কুমিল্লা ডিস্ট্রিক্ট রাজাকার কমান্ডারকে এই চিঠি দিলে সিরু মিয়াদের ছেড়ে দেওয়া হবে। আনোয়ারার ভাই ফজলু মিয়া ১ নভেম্বর কুমিল্লায় গেলেন এই চিঠি নিয়ে। স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার চিঠি পড়ে বললেন, ঈদের পরদিন কামালকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর সিরু মিয়াকে পুলিশে যোগদানের জন্য পাঠানো হবে। জেলখানায় ফজলুর সঙ্গে কামালের দেখা হয়। মামার সিগারেটের প্যাকেটের কাগজে মাকে চিঠি লেখে কামাল : 'আম্মা, সালাম নেবেন। আমরা জেলে আছি। জানি না কবে ছুটব। ভয় করবেন না। আমাদের ওপর তারা অকথ্য অত্যাচার করেছে। দোয়া করবেন। আমাদের জেলে অনেক দিন থাকতে হবে। ঈদ মোবারক। কামাল।' কামাল আরেকটি চিঠি লেখে তার নানাকে।
২৩ নভেম্বর ঈদ। পরদিন কামালের ফেরার কথা। ফেরে না কামাল। ২১ তারিখ সন্ধ্যায় তিতাসের পাড়ে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মারা হয় সিরু মিয়া ও তাঁর ছেলে কামালকে। ঈদের পরদিন ফজলু কামালকে আনতে যান কুমিল্লা জেলখানায়। সেখানে সিরু মিয়া ও কামালের জামা-কাপড় তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়। ঠিক এই নির্দেশই তাঁর লেখা চিঠিতে দিয়েছিলেন গোলাম আযম।
নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগেও এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
No comments