‘সিএসআর’ মানে শুধু মানবিকতা নয় by আব্দুল কাইয়ুম
এশিয়া ও ইউরোপের ১১টি দেশের ১২ জন সাংবাদিক কিছুটা অবাক হয়ে শুনছি লিসা সেনসনের কথা। চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরের সাংবাদিক যেমন আছেন, তেমনি আছেন ইতালি, পর্তুগাল, চেক প্রজাতন্ত্রের সাংবাদিকেরাও। লিসা অর্থনীতিতে পিএইচডি করেছেন। তিনি সুইডিশ সিএসআর অ্যাম্বাসেডর। সিএসআর মানে করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি, এর আসল তাৎপর্যটা আমরা সাধারণত গভীরে ভেবে দেখি না।
মনে করি, বন্যা-ঝড়ে সাহায্য বা দুর্গত অঞ্চলে একটা স্কুল করে দিলে তো কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কিছুটা সারা হলো। হলো, তাতে সন্দেহ নেই। এটা তো করতেই হবে। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো, কোম্পানিগুলো নিজেদের শ্রমিক ও কর্মীদের জন্য কাজের সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে কি না? বেতন যা দেয়, তা কি ন্যায্য? শ্রমিকেরা কি নিয়মিত ছুটি-ছাটা পায়? তাদের প্রতি মানবিক আচরণ করা হয় কি না? তার প্রতিষ্ঠান পরিবেশদূষণ করছে কি?
স্টকহোমের ইন্টারন্যাশনাল প্রেস সেন্টারে আলোচনা হচ্ছে। লিসা বললেন, সিএসআরের প্রকৃত তাৎপর্য হলো, অন্তত চারটি বিষয় সব কোম্পানিকে নিশ্চিত করতে হবে—দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান, মানবাধিকার, শ্রমিকদের ন্যায্য স্বার্থ নিশ্চিত ও পরিবেশদূষণ না করা। তালিকাটা আরও বড়। সদস্যদেশগুলোকে তা মেনে চলতে হয়। সুইডেন তাদের অন্যতম।
তবে সুইডেনেও ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন—বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয় সুইডেনে ব্ল্যাকবেরি, ব্লুবেরি প্রভৃতি ফল আহরণের জন্য। এখন শীত এসে গেছে। মাঝেমধ্যে অভিযোগ পাওয়া যায়, ওই শ্রমিকদের জন্য হয়তো ভালো থাকার ব্যবস্থা করা হয়নি। তাদের গায়ে শীতের উপযুক্ত পোশাক নেই। বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য ও বিনিয়োগবিষয়ক পরিচালক ল্যার্্স অ্যান্ডিয়েসন বললেন, এ ধরনের অভিযোগের প্রতিকার তাঁরা করেন। এ বছর অবশ্য তেমন কোনো অভিযোগ আসেনি।
কোনো কোম্পানির সিইও সাহেবের সন্তানের স্কুলে বিরাট অনুদান দিয়ে উপকার করা যায়। এ ধরনের সামাজিক কার্যক্রমের প্রয়োজনও আছে। কিন্তু একদিকে স্কুলে অনুদান দিয়ে যদি তার কারখানার বর্জ্য নদীদূষণ করতে থাকে, তাহলে লাভ কী? সামগ্রিকতায় দেখলে বলতে হয়, শুধু সামাজিক কার্যক্রম দিয়ে টেকসই ব্যবসা চলে না।
বিকেলে গেছি সুইডেনের স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেসে। সেখানে অধ্যাপিকা সুসেইন সুইটও সে কথাটাই ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বললেন, সিএসআর মানে নিছক মানবিকতা নয়। এটা একটা সমন্বিত ও উদ্ভাবনী কার্যক্রম। অধ্যাপিকা মিজ লিন আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করে বোঝালেন। যুগ বদলাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় আমাদের জীবনে কালো ছায়া ফেলছে। আর এ সময় বিশ্বের ৬০০ কোটির মধ্যে প্রায় ৪০০ কোটি লোকই দিনে মাত্র দু-তিন ডলার আয়ের ওপর চলে। অথচ বিশ্বের সব বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির উৎপাদিত পণ্যের মূল ক্রেতা হলো ওপরের দিকের বাকি ২০০ কোটি মানুষ। এভাবে চললে তো কোম্পানিগুলো টেকসই হবে না। তাই সিএসআর হতে হবে কোম্পানিগুলোর উৎপাদন-প্রক্রিয়ারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোম্পানি অবশ্যই মুনাফা করবে। কিন্তু তাৎক্ষণিক অতিরিক্ত মুনাফার জন্য যেন কোম্পানির আয়ু দ্রুত ফুরিয়ে না যায়, সেটা দেখাও ব্যবসারই অঙ্গীভূত বিষয়।
ইউরোপে সিএসআর নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়েও বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী সিএসআরের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করছেন।
সন্ধ্যায় কনফেডারেশন অব সুইডিশ এন্টারপ্রাইজের শিল্পনীতি ও বহিঃসম্পর্কের প্রধান গোয়েরান নরিয়েনের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, বাংলাদেশে কোনো সুইডিশ কোম্পানি যদি সিএসআরের নীতিমালা মেনে না চলে, সেটা কে তদারকি করবে? তাঁর উত্তরটা ছিল বেশ সোজা। প্রতিটি কোম্পানির নিজস্ব তদারকি ব্যবস্থা রয়েছে। তারা বিনা নোটিশেও কারখানায় গিয়ে হাজির হয়, সরেজমিনে তদারকি করে। তা ছাড়া আছে বিভিন্ন এনজিও। তারা ভালোই পাহারা দেয়!
No comments