৭ নভেম্বর-বিপ্লব ছিল অনিবার্য by আ স ম হান্নান শাহ

ছর ঘুরে আবার এসেছে ৭ নভেম্বর। জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। আজ থেকে ৩৬ বছর আগে ১৯৭৫ সালের এ দিনে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করেছিল। বাংলাদেশ রক্ষা পেয়েছিল সিকিম কিংবা হায়দরাবাদের মতো ভাগ্যবরণ থেকে। সেদিন সিপাহি-জনতা একাত্তরে ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা রক্ষা করে। রক্ষা করে গণতন্ত্র। রক্ষা পায় জাতীয় গৌরবের প্রতীক সেনাবাহিনী। পতন ঘটে একদলীয় বাকশালবাদী


অপশাসনের। নির্মূল করে দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা বিদেশি শক্তির এজেন্টদের। সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিল রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানকে। সেই দিনই সেনানায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমানের উত্থান হয়েছিল একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। তাই দিনটি বাংলাদেশের মুক্তির দিনও বটে। ইতিহাসকে বিকৃত করার অপচেষ্টায় ৭ নভেম্বরকে একটি মহল অবমূল্যায়ন করলেও, দিনটি তার স্বমহিমায় বাংলাদেশিদের হৃদয়ে স্থান করে আছে।
৩৬ বছর আগের কথা হলেও ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি আর সবার মতো এখনও স্পষ্ট স্মরণে রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তারই মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আওয়ামী লীগের এমপিদের নিয়ে দেশে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন। এর মাধ্যমে একদলীয় শাসনের অবসান হলেও দেশ পতিত হয় এক নজিরবিহীন নৈরাজ্যের মধ্যে। ছিল না কোনো শৃঙ্খলা-আইন। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গেল যখন ৩ নভেম্বর মোশতাককে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটালেন। তখনই ৭ নভেম্বর অনিবার্য হয়ে ওঠে। বিশৃঙ্খলাকারী ও কিছু সুযোগসন্ধানী সেনা কর্মকর্তা এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা টিকে থাকবে কি-না সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশের ভাগ্যে তখন করদ রাজ্য হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। সুযোগসন্ধানী সেনা কর্মকর্তারা সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে ৩ নভেম্বর তার ৬ নম্বর মইনুল হোসেন রোডের বাসভবনে গৃহবন্দি করে। জিয়াউর রহমানের বন্দিত্বের খবরে ক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষ ও সিপাহি। এতেই তার জনপ্রিয়তা প্রমাণ হয়। মুক্তিযুদ্ধে তার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। জনতা ও সিপাহিরা সেদিন কুচক্রির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করে।
৩ নভেম্বর জিয়াউর রহমানকে আটক করা হলে ৪ ও ৫ নভেম্বর দেশে এক অদ্ভুত অবস্থা বিরাজ করে। খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটালেও দেশে কার্যত কোনো শাসন ছিল না। সেনাবাহিনীতে কোনো চেইন অব কমান্ড ছিল না। এ সময় জনগণ ও সেনাবাহিনী বুঝে যায়, স্বাধীনতা বিপন্ন হতে চলেছে। বাংলাদেশ আরেকটি গোয়া কিংবা হায়দরাবাদ হতে চলেছে। সাধারণ সিপাহিরা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এর সূচনা হয় ৬ নভেম্বর রাতে। আকাশে কামানের গোলা ছুড়ে এর সূচনা করে ঢাকা সেনানিবাসের আর্টিলারি রেজিমেন্টের সদস্যরা। সাধারণ সিপাহিরা সেই রাতেই অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র সংগ্রহ করে দেশ রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা রাস্তায় নেমে আসে। তাদের সঙ্গে নিরস্ত্র জনগণও যোগ দেয়। সিপাহিদের একটি অংশ বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। ঠিক একই সময়ে বঙ্গভবনে বসে ক্ষমতাকে সুসংহত করতে পরামর্শে ছিলেন ৩ নভেম্বরের বিপ্লবের হোতা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, শাফায়েত জামিল, কর্নেল নজমুল হুদা, কর্নেল হায়দার। কর্নেল হায়দার ও কর্নেল শাফায়েত জামিল বঙ্গভবনের দেয়াল টপকে পালিয়ে যেতে পারলেও বঙ্গভবন আক্রমণকারী সিপাহিদের কাছে ধরা পড়েন খালেদ মোশাররফসহ তিন অফিসার। তাদের শেরেবাংলা নগরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যে-ই এ হত্যা করুক, এটা কারও কাছে কাম্য ছিল না।
এখন অনেক বিষয়ে কথা বললেও, সেদিন রাতে জাসদ নেতা কর্নেল তাহের, হাসানুল হক ইনুসহ আরও কয়েকজন নেতা সিপাহিদের উস্কে দিয়েছিলেন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। 'সিপাহি-সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের কল্লা চাই'_ এ স্লোগান দিয়ে অনেক সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করতে প্ররোচিত করা হয়। ধ্বংস করে দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড। অবশ্য এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ৩ নভেম্বর থেকেই। চক্রান্ত শুরু হয়েছিল আরও আগেই।
৭ নভেম্বরের প্রথম প্রহরেই জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে তাকে আর্টিলারি রেজিমেন্টের সদর দফতরে নিয়ে আসা হয়। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন বহুসংখ্যক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তারা সেখানে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব মেনে নেন। ঢাকার বাইরে অন্যান্য সেনানিবাসে অবস্থানরত কর্মকর্তারা তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। বাহিনীতে চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। সেখান থেকে জিয়াউর রহমান টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে এক মহাদুর্যোগকালে ক্ষমতা গ্রহণ করে দেশকে রক্ষা করেন। তবে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা থেকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার সব কৃতিত্ব সাধারণ সিপাহিদের।
৭ নভেম্বর ফজরের আজানের পর সাধারণ সৈন্যরা ট্যাঙ্ক, জিপগাড়িসহ যত যানবাহন ছিল সব কিছু নিয়ে ঢাকার রাস্তায় নেমে আসে। জনগণ তাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেয়। সিপাহি-জনতার সংহতির সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ঢাকার বাইরে সৈনিকরা জিয়াউর রহমানের জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। রক্ষা করেছিল দেশ ও সেনাবাহিনীকে। ৭ নভেম্বরের বিপক্ষে এখন অনেক কথা বলা হলেও ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের কারণেই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা পেয়েছিল। সেনাবাহিনী ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ এগিয়ে যাওয়ার বদলে যেভাবে পিছিয়ে যাচ্ছিল, সংঘাতে ছেয়েছিল, তার পরিত্রাণও এই সিপাহি-জনতার বিপ্লব ও সংহতি। সংঘাতময় অবস্থায় ৭ নভেম্বর ছিল অনিবার্য। যারা এর বিরুদ্ধে বলেন, তারা ৭ নভেম্বরের আগের অবস্থায় ফিরতে চান বলেই বলেন। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে সত্যিকারের স্বাধীন হওয়ার হিসেবেই লেখা থাকবে বিপ্লব ও সংহতি দিবস।

স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ : জাতীয় স্থায়ী
কমিটির সদস্য, বিএনপি

No comments

Powered by Blogger.