ওয়াল স্ট্রিট দখল কেন by ফারুক মঈনউদ্দীন
আমেরিকার অর্থনৈতিক রাজধানী নিউইয়র্কে হঠাৎ করে যে বিক্ষোভ সংঘটিত হয়ে গেল, সেটাকে আপাতদৃষ্টিতে মার্কিনিদের সহজাত বিচ্ছিন্ন হুজুগের মতো মনে হতে পারে অনেকের কাছে। প্রায় নেতৃত্ববিহীন স্বতঃস্ফূর্ত অর্থপূর্ণ অথচ অসংগঠিত এই বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল অনেক। তবে মূল কথাটি ছিল পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে পুঁজিপতি ও বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থলোভ, সীমাহীন দুর্নীতি, সরকারি নীতিনির্ধারণে ধনবাদী পরিবার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যায় প্রভাব এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনা। এসবের বিরুদ্ধেই ছিল বিক্ষোভকারীদের মূল প্রতিবাদ। ওয়াল স্ট্রিট দখল করার স্লোগানটি অবশ্যই প্রতীকী। কারণ, এই ওয়াল স্ট্রিটেই অবস্থিত নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ। প্রতিবাদকারীদের মতে, যখন লাখ লাখ আমেরিকান চাকরি, শিক্ষা, বেকারভাতা, গৃহঋণ ইত্যাদি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে—এমনকি সরকারও তার নাগরিকদের এসব মৌলিক সুবিধা বহাল রাখতে সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন ওয়াল স্ট্রিট তথা বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কেবল তাদের মুনাফা বাড়াতে ব্যস্ত। শুধু তা-ই নয়, শেয়ার ব্যবসায় লাখ-কোটি ডলার উৎপাদনবিহীন আয় করলেও তারা আয়কর রেয়াত পাচ্ছে।
এসবের বাইরে বিক্ষোভকারীরা আরও যেসব দাবি তুলেছে, সেগুলোর মধ্যে আছে পূর্ণ কর্মসংস্থান, ঋণাত্মক আয়কর, (যার অর্থ একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়ের নিচে হলে সরকারকে উল্টো সেই আয়কারীকে অর্থসাহায্য দিতে হবে), সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি। তবে প্রতিবাদকারীদের দাবিনামাকে সাধারণ দৃষ্টিতে অসংলগ্ন মনে হলেও, খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি দাবি সে ধারণাকে বদলে দেয়। এ নিয়ে গণমাধ্যম ও বিশ্লেষকেরা তেমন উচ্চবাচ্য না করলেও এই দাবি দুটির অর্থনৈতিক গুরুত্ব বেশ গভীর। দাবি দুটি হচ্ছে—টোবিন ট্যাক্স চালু করা এবং গ্লাস-স্টিগাল ব্যাংকিং আইনের পুনর্বহাল।
টোবিন ট্যাক্সের ধারণাটি দিয়েছিলেন আমেরিকার নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জেমস টোবিন, যার মধ্যে ছিল ফটকা উদ্দেশ্যে মুদ্রা ব্যবসার ওপর কর বসানোর পরামর্শ। আমরা জানি, শেয়ারবাজারে যেমন শেয়ার কেনা-বেচা হয়, তেমনই আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে বিভিন্ন উন্নত অর্থনীতির মুদ্রা কেনা-বেচা হয় স্বল্পমেয়াদে মুনাফা লাভের জন্য। টোবিন উপদেশিত করারোপের উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন মুদ্রারবাজার ও সুদের হারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০০ সালের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক এই ব্যবসা করতে গিয়ে শত শত কোটি টাকা লোকসান দিয়েছিল।
গ্লাস-স্টিগাল ব্যাংকিং আইনের পুনর্বহালবিষয়ক দাবিটিও অর্থবহ। ১৯২৯ সালে আমেরিকার শেয়ারবাজারের মহাধস ও অর্থনীতিতে মহামন্দার পর নীতিনির্ধারক মহল উপলব্ধি করে, এই বিপর্যয়ের মূল হোতা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কারণ, তারা মূল ব্যাংকিং কার্যক্রম উপেক্ষা করে বেশি উৎসাহী ছিল শেয়ারবাজারে লগ্নি করতে। এমনকি নিজস্ব পুঁজি বিনিয়োগের পর তারা আমানতকারীদের অর্থ শেয়ারবাজারের মতো একটা ঝুঁকিবহুল খাতে বিনিয়োগ করে নিয়েছিল সীমাহীন ঝুঁকি। এ রকম মহাবিপর্যয় সৃষ্টিকারী কার্যকলাপ থেকে ব্যাংকগুলোকে বিরত রাখতে ১৯৩৩ সালে প্রণীত হয়েছিল গ্লাস-স্টিগাল অ্যাক্ট, যেটা দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিনিয়োগ ব্যাংকের মধ্যে সুস্পষ্ট ভেদরেখা তৈরি করা হয়। আমেরিকার সাবেক ট্রেজারি সেক্রেটারি ও ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের প্রতিষ্ঠাতা কার্টার গ্লাস ছিলেন এই উদ্যোগের আবিষ্কর্তা। তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন ব্যাংকিং ও মুদ্রা কমিটির চেয়ারম্যান হেনরি স্টিগাল। তিনি মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদেরও সদস্য ছিলেন। এ আইনের আওতায় ব্যাংকগুলোকে বেছে নিতে বলা হয়েছিল, তারা কি ব্যাংকিংয়ের মূলধারায় থাকতে চায়, নাকি বিনিয়োগ ব্যাংকিংয়ে বিশেষায়িত হয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে চায়? তবে এখানে একটা ব্যতিক্রম দেওয়া হয়েছিল, অবিক্রীত সরকারি বন্ড কেনার (আন্ডার রাইটিং) ব্যাপারে এই আইন প্রযোজ্য হবে না।
সর্বকালের সব ভালো আইনের বিরুদ্ধে একটা শক্তি যে রকম সোচ্চার থাকে, এই আইনের বিপক্ষেও ছিল তেমনই শক্তি, যারা এই আইন অপসারণের জন্য সক্রিয় কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। ফলে ৬৬ বছর পর ১৯৯৯ সালে আইনটি বিলুপ্ত করা হয়, আর তার বিপরীতে চালু করা হয় নতুন আইন; যার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে আবার সক্ষম হয় নিজস্ব ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে। তবে ব্যাংকের বিশাল পুঁজি ও বৃহৎ কার্যক্রম শেয়ারবাজারে অপরিমেয় ভূমিকা রাখতে পারে বলে একটা সংবিধিবদ্ধ ভেদরেখা টানা হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিনিয়োগ ব্যাংকের মাঝখানে। ওয়াল স্ট্রিট দখলকারীদের কাছে সেই ভেদরেখা খুব কার্যকর কিছু নয় বলে তাদের একটা দাবি ছিল গ্লাস-স্টিগাল ব্যাংকিং আইনের পুনর্বহাল। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক মহাধসের পর ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী ভূমিকাও হয়ে উঠেছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তাই চলতি বছরের তারল্যসংকট ইত্যাদি কারণে বিভিন্ন ব্যাংকের মুনাফা হ্রাস পেলেও পুঁজিবাজারে অতিতৎপর ব্যাংকগুলোর মুনাফা পতনের হার সবচেয়ে বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুস্পষ্ট নীতিনির্দেশনা অনুযায়ী শেয়ারবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভূমিকা ও সংশ্লিষ্টতার প্রশ্নটি স্পষ্টতর হওয়ার পরও ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্বস্তি ও সন্তুষ্টি আসেনি।
ওয়াল স্ট্রিট দখলকারীদের অনেকগুলো দাবির মধ্যে এই দুটি দাবির গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার মুখ্য উদ্দেশ্য উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন একটা শ্রেণীর বাণিজ্য ও অপরিমেয় মুনাফা অর্জনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের একটা সুস্পষ্ট অবস্থান চিহ্নিত করা। শিল্পায়নের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহের জন্য একটা সুস্থ শেয়ারবাজার প্রয়োজন—এ কথা যেমন সত্য, তেমনই এই শেয়ারবাজারের মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ মুনাফা পেশাদার শেয়ার ব্যবসায়ীরা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তুলে নেন—সেটাও সত্য। শেয়ার ব্যবসায়ীদের এই মুনাফার সঙ্গে কিন্তু শেয়ার ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের লাভ কিংবা উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে পুরো প্রক্রিয়াটা দাঁড়ায় প্রকৃত উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন একটা মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর সম্পদ আহরণে। একইভাবে মুদ্রা ব্যবসায়েও শুধু মুনাফা সংগৃহীত হয় বিভিন্ন মুদ্রার বিনিময় মূল্যের উদ্বৃত্ত থেকে, যার সঙ্গে প্রকৃত উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক নেই। এ দুটি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উচ্চবিত্ত একটা শ্রেণী কোনো কিছু উৎপাদন না করেও বিশাল অঙ্কের মুনাফা ঘরে তুলে নিতে পারে—এমনকি কারসাজির মাধ্যমে বাজার প্রভাবিত করে কয়েক গুণ বৃদ্ধি করতে পারে এই মুনাফা। ওয়াল স্ট্রিট দখলকারীদের মূল লক্ষ্য ছিল এই শ্রেণীটি।
ওয়াল স্ট্রিটের অপরিমেয় মুনাফার বিপরীতে আমেরিকার বিশাল একটা জনসংখ্যা নিমজ্জিত হয়ে আছে দারিদ্র্যে এবং এই মুনাফার পেছনে নেই কোনো উৎপাদনপ্রক্রিয়া। তাই ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’ বিক্ষোভকারীদের এই দাবি দুটির পেছনের মূল উদ্দেশ্য ছিল উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন মুদ্রা ও শেয়ার ব্যবসা সম্পর্কিত আইনগুলো বাস্তবায়ন করা। বিক্ষোভকারীদের নেতৃত্বহীনতা, দাবির অসংলগ্নতা ইত্যাদি সত্ত্বেও এই দাবি দুটির মাধ্যমে যে বক্তব্যটি উঠে আসে, সেটি হচ্ছে—অনুৎপাদক খাতে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিশাল মুনাফার উৎস বন্ধ করা। স্পষ্টতই এসব দাবিনামার মূল প্রতিপাদ্য ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং পুঁজিবাদী শোষণ, সম্পদের পুঞ্জীভবন ও সরকার ও তার নীতির ওপর বৃহৎ করপোরেটদের অন্যায় প্রভাবের বিরুদ্ধে। তবে বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্য যত মহৎ ও বিশাল হোক না কেন, আমেরিকার বাস্তবতায় ও হুজুগে হয়তো এই আন্দোলন হালে পানি পায়নি। কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রথাগত এই প্রতিবাদের ভিন্ন মাত্রাটি প্রতিফলিত হয়েছে মুদ্রা ও শেয়ার ব্যবসা সম্পর্কিত উপরিউক্ত দুটি আইন প্রবর্তনের দাবির মাধ্যমে। আমেরিকার সচেতন মানুষের প্রতিবাদ অন্যান্য দেশের মানুষের চোখ খুলে দিয়েছে যে কেবল মুনাফাই একটা অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হতে পারে না ।
এ কথা হয়তো সত্যি অথবা সত্যি নয় যে ওয়াল স্ট্রিট দখল করো আন্দোলনের মূল প্রেরণা ছিল সাম্প্রতিক ‘আরব গণজাগরণ’। কারণ, আমেরিকায় ও ইউরোপের দেশে দেশে গণবিক্ষোভের মূল বক্তব্য মূলত অর্থনৈতিক হলেও তার কৌশলটি পথপ্রদর্শক আরব বিক্ষোভকারীদের মতো। ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু আরব গণজাগরণের উৎস ছিল তিউনিসিয়া। দেশটির পুলিশ বাহিনীর দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এক নগণ্য নাগরিকের আত্মাহুতি থেকে সৃষ্ট ব্যাপক গণজাগরণের ফলে উৎখাত হয় সরকার। তার পর মিসর, লিবিয়া, আলজেরিয়া, বাহরাইন, ওমান, কুয়েত, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, জর্ডান, মরক্কো, লেবানন, মৌরিতানিয়া, সুদান প্রভৃতি দেশেও শুরু হয় গণতন্ত্রকামী মানুষের বিক্ষোভ ও আন্দোলন। এই গণজাগরণের ফলে তিউনিসিয়া, মিসর ও লিবিয়ার সরকার উৎখাত হয়। এ ছাড়া সুদান, ইরাক, জর্ডান ও ইয়েমেনের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানেরা বিক্ষোভকারীদের দাবির প্রতি নতজানু হয়ে বিভিন্ন শর্তে এবং বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষমতা ছাড়ার মুচলেকা দিয়ে রক্ষা পেয়েছেন।
কঠোরভাবে অগণতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক আরব বিশ্বের এই গণজাগরণ ছিল অভূতপূর্ব ও অকল্পনীয়। তবুও হাজার হাজার অকুতোভয় বিক্ষোভকারী বিভিন্ন দেশের রাজপথে নেমে প্রতিবাদে মুখর হয়েছে, কোনো কোনো দেশে আদায় করে নিয়েছে তাদের দাবি। আবার কোথাও কঠোর হাতে দমন করা হয়েছে বিক্ষোভ। আরব বিশ্বের মতো চরম অগণতান্ত্রিক দেশে এ জাতীয় আন্দোলনের সফলতা বা ব্যর্থতার চেয়ে যে বিষয়টি মূল বিবেচ্য তা হচ্ছে, অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষের জেগে ওঠা। আরব গণজাগরণের দাবিগুলোর মধ্যে অর্থনীতি ও রাজনীতি দুটিই ছিল; যেমন—সরকারি দুর্নীতি, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা—এসব। ওয়াল স্ট্রিট দখলকারীদের দাবি ছিল মূলত অর্থনৈতিক। সম্পদশালী ১ শতাংশের বিরুদ্ধে বিত্তহীন ৯৯ শতাংশের এই জাগরণ অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের এত বছর পর সেই সুরে কথা বলা কিংবা অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরাসরি রাজপথে নেমে আসার বিষয়টি আর বোধ হয় উপেক্ষা করার উপায় নেই।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
এসবের বাইরে বিক্ষোভকারীরা আরও যেসব দাবি তুলেছে, সেগুলোর মধ্যে আছে পূর্ণ কর্মসংস্থান, ঋণাত্মক আয়কর, (যার অর্থ একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়ের নিচে হলে সরকারকে উল্টো সেই আয়কারীকে অর্থসাহায্য দিতে হবে), সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি। তবে প্রতিবাদকারীদের দাবিনামাকে সাধারণ দৃষ্টিতে অসংলগ্ন মনে হলেও, খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি দাবি সে ধারণাকে বদলে দেয়। এ নিয়ে গণমাধ্যম ও বিশ্লেষকেরা তেমন উচ্চবাচ্য না করলেও এই দাবি দুটির অর্থনৈতিক গুরুত্ব বেশ গভীর। দাবি দুটি হচ্ছে—টোবিন ট্যাক্স চালু করা এবং গ্লাস-স্টিগাল ব্যাংকিং আইনের পুনর্বহাল।
টোবিন ট্যাক্সের ধারণাটি দিয়েছিলেন আমেরিকার নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জেমস টোবিন, যার মধ্যে ছিল ফটকা উদ্দেশ্যে মুদ্রা ব্যবসার ওপর কর বসানোর পরামর্শ। আমরা জানি, শেয়ারবাজারে যেমন শেয়ার কেনা-বেচা হয়, তেমনই আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে বিভিন্ন উন্নত অর্থনীতির মুদ্রা কেনা-বেচা হয় স্বল্পমেয়াদে মুনাফা লাভের জন্য। টোবিন উপদেশিত করারোপের উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন মুদ্রারবাজার ও সুদের হারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০০ সালের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক এই ব্যবসা করতে গিয়ে শত শত কোটি টাকা লোকসান দিয়েছিল।
গ্লাস-স্টিগাল ব্যাংকিং আইনের পুনর্বহালবিষয়ক দাবিটিও অর্থবহ। ১৯২৯ সালে আমেরিকার শেয়ারবাজারের মহাধস ও অর্থনীতিতে মহামন্দার পর নীতিনির্ধারক মহল উপলব্ধি করে, এই বিপর্যয়ের মূল হোতা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কারণ, তারা মূল ব্যাংকিং কার্যক্রম উপেক্ষা করে বেশি উৎসাহী ছিল শেয়ারবাজারে লগ্নি করতে। এমনকি নিজস্ব পুঁজি বিনিয়োগের পর তারা আমানতকারীদের অর্থ শেয়ারবাজারের মতো একটা ঝুঁকিবহুল খাতে বিনিয়োগ করে নিয়েছিল সীমাহীন ঝুঁকি। এ রকম মহাবিপর্যয় সৃষ্টিকারী কার্যকলাপ থেকে ব্যাংকগুলোকে বিরত রাখতে ১৯৩৩ সালে প্রণীত হয়েছিল গ্লাস-স্টিগাল অ্যাক্ট, যেটা দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিনিয়োগ ব্যাংকের মধ্যে সুস্পষ্ট ভেদরেখা তৈরি করা হয়। আমেরিকার সাবেক ট্রেজারি সেক্রেটারি ও ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের প্রতিষ্ঠাতা কার্টার গ্লাস ছিলেন এই উদ্যোগের আবিষ্কর্তা। তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন ব্যাংকিং ও মুদ্রা কমিটির চেয়ারম্যান হেনরি স্টিগাল। তিনি মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদেরও সদস্য ছিলেন। এ আইনের আওতায় ব্যাংকগুলোকে বেছে নিতে বলা হয়েছিল, তারা কি ব্যাংকিংয়ের মূলধারায় থাকতে চায়, নাকি বিনিয়োগ ব্যাংকিংয়ে বিশেষায়িত হয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে চায়? তবে এখানে একটা ব্যতিক্রম দেওয়া হয়েছিল, অবিক্রীত সরকারি বন্ড কেনার (আন্ডার রাইটিং) ব্যাপারে এই আইন প্রযোজ্য হবে না।
সর্বকালের সব ভালো আইনের বিরুদ্ধে একটা শক্তি যে রকম সোচ্চার থাকে, এই আইনের বিপক্ষেও ছিল তেমনই শক্তি, যারা এই আইন অপসারণের জন্য সক্রিয় কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। ফলে ৬৬ বছর পর ১৯৯৯ সালে আইনটি বিলুপ্ত করা হয়, আর তার বিপরীতে চালু করা হয় নতুন আইন; যার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে আবার সক্ষম হয় নিজস্ব ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে। তবে ব্যাংকের বিশাল পুঁজি ও বৃহৎ কার্যক্রম শেয়ারবাজারে অপরিমেয় ভূমিকা রাখতে পারে বলে একটা সংবিধিবদ্ধ ভেদরেখা টানা হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিনিয়োগ ব্যাংকের মাঝখানে। ওয়াল স্ট্রিট দখলকারীদের কাছে সেই ভেদরেখা খুব কার্যকর কিছু নয় বলে তাদের একটা দাবি ছিল গ্লাস-স্টিগাল ব্যাংকিং আইনের পুনর্বহাল। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক মহাধসের পর ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী ভূমিকাও হয়ে উঠেছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তাই চলতি বছরের তারল্যসংকট ইত্যাদি কারণে বিভিন্ন ব্যাংকের মুনাফা হ্রাস পেলেও পুঁজিবাজারে অতিতৎপর ব্যাংকগুলোর মুনাফা পতনের হার সবচেয়ে বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুস্পষ্ট নীতিনির্দেশনা অনুযায়ী শেয়ারবাজারে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভূমিকা ও সংশ্লিষ্টতার প্রশ্নটি স্পষ্টতর হওয়ার পরও ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্বস্তি ও সন্তুষ্টি আসেনি।
ওয়াল স্ট্রিট দখলকারীদের অনেকগুলো দাবির মধ্যে এই দুটি দাবির গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার মুখ্য উদ্দেশ্য উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন একটা শ্রেণীর বাণিজ্য ও অপরিমেয় মুনাফা অর্জনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের একটা সুস্পষ্ট অবস্থান চিহ্নিত করা। শিল্পায়নের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহের জন্য একটা সুস্থ শেয়ারবাজার প্রয়োজন—এ কথা যেমন সত্য, তেমনই এই শেয়ারবাজারের মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ মুনাফা পেশাদার শেয়ার ব্যবসায়ীরা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তুলে নেন—সেটাও সত্য। শেয়ার ব্যবসায়ীদের এই মুনাফার সঙ্গে কিন্তু শেয়ার ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের লাভ কিংবা উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে পুরো প্রক্রিয়াটা দাঁড়ায় প্রকৃত উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন একটা মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর সম্পদ আহরণে। একইভাবে মুদ্রা ব্যবসায়েও শুধু মুনাফা সংগৃহীত হয় বিভিন্ন মুদ্রার বিনিময় মূল্যের উদ্বৃত্ত থেকে, যার সঙ্গে প্রকৃত উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক নেই। এ দুটি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উচ্চবিত্ত একটা শ্রেণী কোনো কিছু উৎপাদন না করেও বিশাল অঙ্কের মুনাফা ঘরে তুলে নিতে পারে—এমনকি কারসাজির মাধ্যমে বাজার প্রভাবিত করে কয়েক গুণ বৃদ্ধি করতে পারে এই মুনাফা। ওয়াল স্ট্রিট দখলকারীদের মূল লক্ষ্য ছিল এই শ্রেণীটি।
ওয়াল স্ট্রিটের অপরিমেয় মুনাফার বিপরীতে আমেরিকার বিশাল একটা জনসংখ্যা নিমজ্জিত হয়ে আছে দারিদ্র্যে এবং এই মুনাফার পেছনে নেই কোনো উৎপাদনপ্রক্রিয়া। তাই ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’ বিক্ষোভকারীদের এই দাবি দুটির পেছনের মূল উদ্দেশ্য ছিল উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন মুদ্রা ও শেয়ার ব্যবসা সম্পর্কিত আইনগুলো বাস্তবায়ন করা। বিক্ষোভকারীদের নেতৃত্বহীনতা, দাবির অসংলগ্নতা ইত্যাদি সত্ত্বেও এই দাবি দুটির মাধ্যমে যে বক্তব্যটি উঠে আসে, সেটি হচ্ছে—অনুৎপাদক খাতে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিশাল মুনাফার উৎস বন্ধ করা। স্পষ্টতই এসব দাবিনামার মূল প্রতিপাদ্য ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং পুঁজিবাদী শোষণ, সম্পদের পুঞ্জীভবন ও সরকার ও তার নীতির ওপর বৃহৎ করপোরেটদের অন্যায় প্রভাবের বিরুদ্ধে। তবে বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্য যত মহৎ ও বিশাল হোক না কেন, আমেরিকার বাস্তবতায় ও হুজুগে হয়তো এই আন্দোলন হালে পানি পায়নি। কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রথাগত এই প্রতিবাদের ভিন্ন মাত্রাটি প্রতিফলিত হয়েছে মুদ্রা ও শেয়ার ব্যবসা সম্পর্কিত উপরিউক্ত দুটি আইন প্রবর্তনের দাবির মাধ্যমে। আমেরিকার সচেতন মানুষের প্রতিবাদ অন্যান্য দেশের মানুষের চোখ খুলে দিয়েছে যে কেবল মুনাফাই একটা অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হতে পারে না ।
এ কথা হয়তো সত্যি অথবা সত্যি নয় যে ওয়াল স্ট্রিট দখল করো আন্দোলনের মূল প্রেরণা ছিল সাম্প্রতিক ‘আরব গণজাগরণ’। কারণ, আমেরিকায় ও ইউরোপের দেশে দেশে গণবিক্ষোভের মূল বক্তব্য মূলত অর্থনৈতিক হলেও তার কৌশলটি পথপ্রদর্শক আরব বিক্ষোভকারীদের মতো। ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু আরব গণজাগরণের উৎস ছিল তিউনিসিয়া। দেশটির পুলিশ বাহিনীর দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এক নগণ্য নাগরিকের আত্মাহুতি থেকে সৃষ্ট ব্যাপক গণজাগরণের ফলে উৎখাত হয় সরকার। তার পর মিসর, লিবিয়া, আলজেরিয়া, বাহরাইন, ওমান, কুয়েত, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, জর্ডান, মরক্কো, লেবানন, মৌরিতানিয়া, সুদান প্রভৃতি দেশেও শুরু হয় গণতন্ত্রকামী মানুষের বিক্ষোভ ও আন্দোলন। এই গণজাগরণের ফলে তিউনিসিয়া, মিসর ও লিবিয়ার সরকার উৎখাত হয়। এ ছাড়া সুদান, ইরাক, জর্ডান ও ইয়েমেনের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানেরা বিক্ষোভকারীদের দাবির প্রতি নতজানু হয়ে বিভিন্ন শর্তে এবং বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষমতা ছাড়ার মুচলেকা দিয়ে রক্ষা পেয়েছেন।
কঠোরভাবে অগণতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক আরব বিশ্বের এই গণজাগরণ ছিল অভূতপূর্ব ও অকল্পনীয়। তবুও হাজার হাজার অকুতোভয় বিক্ষোভকারী বিভিন্ন দেশের রাজপথে নেমে প্রতিবাদে মুখর হয়েছে, কোনো কোনো দেশে আদায় করে নিয়েছে তাদের দাবি। আবার কোথাও কঠোর হাতে দমন করা হয়েছে বিক্ষোভ। আরব বিশ্বের মতো চরম অগণতান্ত্রিক দেশে এ জাতীয় আন্দোলনের সফলতা বা ব্যর্থতার চেয়ে যে বিষয়টি মূল বিবেচ্য তা হচ্ছে, অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষের জেগে ওঠা। আরব গণজাগরণের দাবিগুলোর মধ্যে অর্থনীতি ও রাজনীতি দুটিই ছিল; যেমন—সরকারি দুর্নীতি, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা—এসব। ওয়াল স্ট্রিট দখলকারীদের দাবি ছিল মূলত অর্থনৈতিক। সম্পদশালী ১ শতাংশের বিরুদ্ধে বিত্তহীন ৯৯ শতাংশের এই জাগরণ অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের এত বছর পর সেই সুরে কথা বলা কিংবা অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরাসরি রাজপথে নেমে আসার বিষয়টি আর বোধ হয় উপেক্ষা করার উপায় নেই।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
No comments