ধর নির্ভয় গান-এই বন্ধুর পথে বড্ড একা হয়ে যাচ্ছি আমরা by আলী যাকের
এ ধরনের একটা স্বপ্ন আমার সব সময়ই ছিল যে, পুকুরের ঢালে গণমানুষের নাটক করব আমরা আর তা দেখবে আমাদেরই গ্রামগঞ্জের মানুষ। তবে এর আয়োজন করতে ইমদাদ ভাইয়ের মতো একজন সংগঠক, একজন অসম সাহসী মানুষ, একজন অতি দক্ষ শিল্পীর প্রয়োজন হয়। শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আমি আরও ভাবছিলাম, তারা যে একে একে চলে যাচ্ছেন, আমাদের এক ভীষণ অবক্ষয়ী সমাজে ফেলে রেখে, এরপর প্রয়োজনে কার কাছে গিয়ে দাঁড়াব আমরা?
সম্প্রতি ইমদাদ ভাই চলে গেলেন। শিল্পী ইমদাদ হোসেন। তার দীর্ঘ দেহটি শায়িত ছিল কফিনের ভেতরে। সবার পেছনে পেছনে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে একটি ফুলের তোড়া নিয়ে সেই কফিনের ওপর রাখার সঙ্গে সঙ্গেই তার শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখটি দেখতে পেলাম। তিনি কখনও দাড়ি রাখেননি। এই দাড়ি বোধহয় সম্প্রতি তিনি যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী ছিলেন, তখনকার। তার বেশ পুরুষ্ট পৌরুষদীপ্ত একজোড়া গোঁফ ছিল। তিনি মাঝে মধ্যে মশকরা করে বলতেন, 'গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, গোঁফ দিয়ে যায় চেনা।' অবশ্য তখন আমারও একজোড়া গোঁফ ছিল। দাড়ি রাখিনি তখন। ইমদাদ ভাই আর আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন প্রয়াত ওয়াহিদ ভাই, ওয়াহিদুল হকের মধ্যে সখ্য ছিল। আমার এখনও মনে পড়ে আমরা যখন ওয়াহিদ ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ কন্যা অপালার আমন্ত্রণে তার গ্রাম কেরানীগঞ্জের আটিভাওয়ালে গেলাম, তখন ইমদাদ ভাই তার গ্রাম রোহিতপুর থেকে এসে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তার পরনে ছিল একটি ফুলশার্ট এবং ট্রাউজার্স, কোমর থেকে কাঁধ অবধি সাসপেন্ডার আঁটা। হাতে একটা লাঠি। তারা দুজন ছিলেন পরম সখা। বিভিন্ন সময় তাদের দু'জনকে একসঙ্গে দেখেছি। যেমন বন্ধু ছিলেন তেমনি দু'জনের মধ্যে তর্কও হতো প্রচণ্ড। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। তবে প্রধানত রাজনীতি নিয়ে। ইমদাদ ভাইয়ের অনেক বন্ধু ছিল। মিনু আপা, সন্্জীদা খাতুন তাদের অন্যতম। শহীদ মিনারে মিনু আপার একেবারে ভেঙে পড়া চেহারা দেখে আমার এতই খারাপ লেগেছিল যে, কাছে গিয়ে যে তার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাব সে ইচ্ছাও হয়নি। আমার এখনও মনে পড়ে, ইমদাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার সেই শেষ দেখা আটিভাওয়ালের মাঠের ধারে। মলিন চেহারা তার। মাথা নাড়ছেন আর বলছেন, 'ওয়াহিদুল তো আমার ছোট ছিল, আগেই চলে গেল?'
ইমদাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ সন্্জীদা আপা, ওয়াহিদ ভাই এবং ছায়ানট সূত্রে। তখন সন্্জীদা আপা, ওয়াহিদ ভাইরা হাতিরপুলের কাছে মোতালিব কলোনির একটি বাড়ির দোতলায় থাকতেন। আমার বয়স তখন ২৩-২৪ বছর। প্রচণ্ড আড্ডা জমত ওই বাড়িতে। ওয়াহিদ ভাইয়ের মা খুব ভালো রান্না করতেন। অতি সাধারণ বাঙালি রান্না যে এত উপাদেয় হতে পারে, তা তার হাতের রান্না যারা খেয়েছে, সবাই জানে। রাতের খাওয়ার পরেই রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং সঙ্গীত নিয়ে দারুণ আড্ডা জমে উঠত ওয়াহিদ ভাইদের বসার ঘরের মাটিতে পাতা ফরাশে বসে। মাঝে মধ্যেই ওয়াহিদ ভাই রবীন্দ্রনাথের একটি গানের চরণ গেয়ে উঠতেন। তারপর সেই চরণটির সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথের গানের কথা, সুর এবং দর্শন নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হতো। এই সময় ইমদাদ ভাই মাঝে মধ্যেই উপস্থিত থাকতেন। ভারি মিষ্টি একটা হাসি তার ঠোঁটে লেগেই থাকত। মাঝে মধ্যে টিপ্পনী কাটতেন, আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠতাম। এই হাসিটা ইমদাদ ভাইয়ের স্বভাবসুলভ হাসি। অনেক সময় দেখেছি, তাবৎ বৈরী শক্তিকে চরম গালাগাল দেওয়ার সময়ও তার মুখে হাসি লেগেই থাকত।
ইমদাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখাশোনা কালেভদ্রে হতো। কিন্তু যখনই দেখা হতো, আলাপের বিষয়বস্তু খুঁজে বের করতে হতো না। যেমন দীর্ঘদেহী শালপ্রাংশু চেহারা তার ছিল, তেমনি বিশাল ছিল তার হৃদয়। সেই হৃদয় ছিল নির্ভীক, ভয়শূন্য। কিন্তু প্রচণ্ড দয়ার আধার। আমাদের যখন তরুণ বয়স আর তিনি প্রৌঢ়ত্বের দিকে এগোচ্ছেন, তখনও যেমন দেখেছি, তেমনি তিনি যখন অতি প্রবীণ, তখনও তার চালচলন কী কথাবার্তায় যে দ্যুতি আমি দেখেছি, তা আজকালকার দিনে অতি তরুণদের চেহারায়ও সচরাচর দেখা যায় না। আটিভাওয়ালে ওয়াহিদ ভাইয়ের স্মরণসভায়ও দীর্ঘক্ষণ তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তিনি একটি লাঠিতে ভর করেছিলেন বটে। তবে তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি ছিল ঋজু। ওই মানুষটিকে বয়সের ভারে ন্যুব্জ কখনোই বলা যাবে না।
এ রকম কিছু মানুষ, যেমন_ প্রয়াত কামরুল হাসান, ওয়াহিদুল হক, ইমদাদ হোসেন এবং অকালে ঝরে যাওয়া চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের মতো আমাদের কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ ছিলেন বলে আমাদের সাহসের সীমা-পরিসীমা ছিল না। একটু প্রসঙ্গান্তরে যাই। কামরুল ভাইয়ের মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে থেকে তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। তার অপত্য স্নেহ এবং অসীম সাহস আমায় সর্বদাই তার কাছে টানত। কামরুল ভাইয়ের বাড়িতে অধিকাংশ সময় আমি গিয়েছি প্রয়াত ড. নওয়াজিশ আহমেদ এবং প্রয়াত লেখক মিজানুর রহমানের (মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা খ্যাত) সঙ্গে। তার অসংখ্য খেরো খাতায় লেখা রোজনামচা কিছু কিছু পড়ার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। পরে অবশ্য দৈনিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ওগুলো ছাপা হয়েছিল। আমার জানা মতে কামরুল ভাইয়ের মতো সাহসী মানুষ, এই বাংলাদেশে, খুব অল্পই দেখেছি আমি। মনে পড়ে তার মৃত্যুর কেবল কয়েকদিন আগে আমি একাই গিয়েছিলাম তার কাছে। সঙ্গে আমার ক্যামেরাটা ছিল। উদ্দেশ্য, তার কিছু ছবি তুলব। আমাকে তার বাড়ির কাজের লোকটি একেবারে সোজা ওই বাড়ির ছাদে নিয়ে গেল। গিয়ে দেখি ওই ছাদের চিলেকোঠার ধারে একটি ছোট্ট ঘরের সামনে লেখা রয়েছে পটুয়া বাড়ি। বুঝলাম এটিই তার ছবি আঁকার ঘর। কামরুল ভাই সহাস্যে বেরিয়ে এলেন। পরনে তার সাদা শর্টস আর হাতকাটা গেঞ্জি। তখনও তার বাহুতে এবং হাতের তালুতে তিনি সরষের তেল মাখছিলেন। আমাকে দেখেই সহাস্যে বললেন, 'দেখ তো আমার মাস্ল এখনও কেমন খেলে?' এই সময় মাথার ওপর দিয়ে দুটি যুদ্ধ জাহাজ উড়ে গেল। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, 'আমি সারাদিন এখানে বসে বসে ছবি আঁকি আর এই দু'জন, জগাই-মাধাই আছে আমি হেন এক নিরীহ শিল্পীকে ভয় দেখানোর চেষ্টায়।' বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন। কী নির্ভীক এক মানুষ ছিলেন। সামরিক শাসনের জাঁতাকল যখন বাংলাদেশের সবাইকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে চাইছে তখন তিনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলতেন, 'আরে, কত আইয়ুব এলো, আইয়ুব গেল, ইয়াহিয়া এলো, ইয়াহিয়া গেল। আর এ তো হচ্ছে তুচ্ছ বাঙালি পুঙ্গব, ভয় দেখাতে চাইছে আমাদের? তোরা আসবি আর যাবি। কামরুল হাসানরা আমরণ বুক ফুলিয়েই চলবে।'
শ্রদ্ধেয় আলমগীর কবিরও এ রকমই একজন সাহসী মানুষ ছিলেন। আমার মনে পড়ে ১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমীর তখনকার অস্থায়ী মঞ্চে বিজয় দিবস উপলক্ষে সকালবেলায় এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। তখন সদ্যই বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে জেলে বন্দি চার জাতীয় নেতাকে এবং অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সেনাধ্যক্ষ ও সৈনিকদের। আমরা সবাই সাবধানে কথা বলছি। তবে সবারই মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। মাঝে মধ্যে বাঁধভাঙা বন্যার মতো সব ভাসিয়ে নিতে চায়। কিন্তু সাবধানতার আগল সেই ইচ্ছাকে অবদমিত করে রাখে। কবির ভাইয়ের আলোচনা শুরু হলো। তিনি শুরুই করলেন প্রায় বিদ্রোহের একটি আহ্বান দিয়ে। বললেন, 'আজ বিজয় দিবস। আমাদের বিজয় দিবস। এই দিনটির কথা মনে করুন সবাই। একাত্তরের এই দিনে আমরা চারদিকে দেয়াল তোলা এরকম ঘরে বসে কেবল আলাপ-আলোচনা করলে দেশটি কখনোই স্বাধীন হতো না। আজ আবার আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধতে চাইছে যারা, তাদের বিরুদ্ধে যদি কিছু করতে চান, তবে যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রাস্তায় নেমে আসুন। চলুন এখন থেকেই আরও একটি যুদ্ধ শুরু করা যাক।'
এরকম সাহসী মানুষেরা ছিলেন বলেই আমরা জীবনের একটা অর্থ খুঁজে পেতাম তখন। পেতাম বক্ষে পরম সাহস নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত। আমরা আরও নিবিষ্ট মনে আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে একাত্ম হতাম। কত শক্ত কথা বলার সাহস তারা পেয়েছেন তখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে অবলীলায়! সেই সাহসেরই উত্তরসূরি আজকের তরুণরা। তাদের মধ্যে এমন অনেকে আছে যারা অসীম সাহস ধরে বক্ষে। তবে বেশিরভাগ তরুণ আজকে আপাতরম্যে বসবাস করছে। জীবনের গভীর থেকে তারা নির্বাসিত। আমি তাদের দোষ দিই না। দোষ দিই তাদের অগ্রজদের, তাদের অভিভাবকদের। একাত্তরের সেই পরম বিক্রম, সেই অসীম সাহস, সেই উন্মাদনা কোথায় হারিয়ে গেল আমাদেরই প্রজন্মের পিতৃপুরুষদের আপসকামিতার জন্য? ইমদাদ ভাইয়ের মরদেহকে সামনে রেখে চকিতে মনে পড়ে যায় এত সব বিচিত্র কথা। মনে পড়ে যায়, অবলীলায় হাসতে হাসতে তিনি কেমন করে এক জঙ্গিবাজ রাষ্ট্রপতির মুখের ওপরে বলেছিলেন, 'মহামহিম, আপনি আমার বা আমাদের কথা বুঝবেন না। আপনার বোঝার কথাও নয়। পৃথিবীতে অনেক ধরনের মানুষ আছে। এক ধরনের মানুষ করোটির ভেতরে রক্ষিত বস্তুটি ব্যবহার করে কাজ করে, আরেক ধরনের মানুষের তো মাথাই নেই, মাথাব্যথা থাকবে কী করে?'
আজ সকালে ইমদাদ ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে পড়ল কয়েক বছর আগের কথা। তিনি আমাদের নাটক 'নুরলদীনের সারাজীবন' দেখে খুবই পছন্দ করেছিলেন এবং আমাকে বলেছিলেন এই নাটকটি গ্রামের গণমানুষের মধ্যে অভিনয় করতে। আমি তাকে বলেছিলাম নানা রকম অসুবিধার কথা। তিনি আর কিছু না বলে মহিলা সমিতি থেকে বাড়ি গিয়েছিলেন। এরপর হঠাৎ একদিন যোগাযোগ করে বললেন, আমরা তার গ্রাম রোহিতপুরে গিয়ে নাটকটি করতে রাজি আছি কি-না। নির্ধারিত দিন সকালবেলা আমরা সবাই হৈ হৈ করে পেঁৗছে গেলাম রোহিতপুর। আমরা ভেবেছিলাম, গ্রামে সাধারণত নাটক যেভাবে হয় সেই রকম ব্যবস্থাই করা হয়েছে এখানেও। অর্থাৎ উন্মুক্ত কোনো স্থানে কাঠের পাটাতন দিয়ে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে তার ওপরে অভিনীত হবে নাটক। গিয়ে দেখি এক অভিনব ব্যবস্থা করেছেন ইমদাদ ভাই। একটি পুকুরপাড়ে নাটকাভিনয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। বাঁশের খাঁচা তৈরি করে সেখান থেকে ঝুলছে মাইক। আমরা পুকুরপাড়ে নাটক করব আর পুকুরের ঢালে বসে গ্রামবাসী নাটক দেখবে। ঢাল থেকে শুরু করে আরও অনেক দূরে খালি জায়গায় লোকে বসে নাটক দেখবে। একটু দূরে দূরে একটি করে বাঁশ পুঁতে তাতে লাউডস্পিকার ঝোলানো হয়েছে। মনে মনে ভাবলাম, এই না হলে ইমদাদ ভাইয়ের মতো অত বড়মাপের একজন শিল্পী কি হতে পারতেন তিনি?
এ ধরনের একটা স্বপ্ন আমার সবসময়ই ছিল যে, পুকুরের ঢালে গণমানুষের নাটক করব আমরা আর তা দেখবে আমাদেরই গ্রামগঞ্জের মানুষ। তবে এর আয়োজন করতে ইমদাদ ভাইয়ের মতো একজন সংগঠক, একজন অসম সাহসী মানুষ, একজন অতি দক্ষ শিল্পীর প্রয়োজন হয়। শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আমি আরও ভাবছিলাম, তারা যে একে একে চলে যাচ্ছেন, আমাদের এক ভীষণ অবক্ষয়ী সমাজে ফেলে রেখে, এরপর প্রয়োজনে কার কাছে গিয়ে দাঁড়াব আমরা? কে আমাদের পথ দেখাবে? একে একে বন্ধুহীন হতে হতে এই বন্ধুর পথে বড্ড একা হয়ে যাচ্ছি আমরা।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
ইমদাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ সন্্জীদা আপা, ওয়াহিদ ভাই এবং ছায়ানট সূত্রে। তখন সন্্জীদা আপা, ওয়াহিদ ভাইরা হাতিরপুলের কাছে মোতালিব কলোনির একটি বাড়ির দোতলায় থাকতেন। আমার বয়স তখন ২৩-২৪ বছর। প্রচণ্ড আড্ডা জমত ওই বাড়িতে। ওয়াহিদ ভাইয়ের মা খুব ভালো রান্না করতেন। অতি সাধারণ বাঙালি রান্না যে এত উপাদেয় হতে পারে, তা তার হাতের রান্না যারা খেয়েছে, সবাই জানে। রাতের খাওয়ার পরেই রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং সঙ্গীত নিয়ে দারুণ আড্ডা জমে উঠত ওয়াহিদ ভাইদের বসার ঘরের মাটিতে পাতা ফরাশে বসে। মাঝে মধ্যেই ওয়াহিদ ভাই রবীন্দ্রনাথের একটি গানের চরণ গেয়ে উঠতেন। তারপর সেই চরণটির সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথের গানের কথা, সুর এবং দর্শন নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হতো। এই সময় ইমদাদ ভাই মাঝে মধ্যেই উপস্থিত থাকতেন। ভারি মিষ্টি একটা হাসি তার ঠোঁটে লেগেই থাকত। মাঝে মধ্যে টিপ্পনী কাটতেন, আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠতাম। এই হাসিটা ইমদাদ ভাইয়ের স্বভাবসুলভ হাসি। অনেক সময় দেখেছি, তাবৎ বৈরী শক্তিকে চরম গালাগাল দেওয়ার সময়ও তার মুখে হাসি লেগেই থাকত।
ইমদাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখাশোনা কালেভদ্রে হতো। কিন্তু যখনই দেখা হতো, আলাপের বিষয়বস্তু খুঁজে বের করতে হতো না। যেমন দীর্ঘদেহী শালপ্রাংশু চেহারা তার ছিল, তেমনি বিশাল ছিল তার হৃদয়। সেই হৃদয় ছিল নির্ভীক, ভয়শূন্য। কিন্তু প্রচণ্ড দয়ার আধার। আমাদের যখন তরুণ বয়স আর তিনি প্রৌঢ়ত্বের দিকে এগোচ্ছেন, তখনও যেমন দেখেছি, তেমনি তিনি যখন অতি প্রবীণ, তখনও তার চালচলন কী কথাবার্তায় যে দ্যুতি আমি দেখেছি, তা আজকালকার দিনে অতি তরুণদের চেহারায়ও সচরাচর দেখা যায় না। আটিভাওয়ালে ওয়াহিদ ভাইয়ের স্মরণসভায়ও দীর্ঘক্ষণ তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তিনি একটি লাঠিতে ভর করেছিলেন বটে। তবে তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি ছিল ঋজু। ওই মানুষটিকে বয়সের ভারে ন্যুব্জ কখনোই বলা যাবে না।
এ রকম কিছু মানুষ, যেমন_ প্রয়াত কামরুল হাসান, ওয়াহিদুল হক, ইমদাদ হোসেন এবং অকালে ঝরে যাওয়া চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের মতো আমাদের কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ ছিলেন বলে আমাদের সাহসের সীমা-পরিসীমা ছিল না। একটু প্রসঙ্গান্তরে যাই। কামরুল ভাইয়ের মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে থেকে তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। তার অপত্য স্নেহ এবং অসীম সাহস আমায় সর্বদাই তার কাছে টানত। কামরুল ভাইয়ের বাড়িতে অধিকাংশ সময় আমি গিয়েছি প্রয়াত ড. নওয়াজিশ আহমেদ এবং প্রয়াত লেখক মিজানুর রহমানের (মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা খ্যাত) সঙ্গে। তার অসংখ্য খেরো খাতায় লেখা রোজনামচা কিছু কিছু পড়ার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। পরে অবশ্য দৈনিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ওগুলো ছাপা হয়েছিল। আমার জানা মতে কামরুল ভাইয়ের মতো সাহসী মানুষ, এই বাংলাদেশে, খুব অল্পই দেখেছি আমি। মনে পড়ে তার মৃত্যুর কেবল কয়েকদিন আগে আমি একাই গিয়েছিলাম তার কাছে। সঙ্গে আমার ক্যামেরাটা ছিল। উদ্দেশ্য, তার কিছু ছবি তুলব। আমাকে তার বাড়ির কাজের লোকটি একেবারে সোজা ওই বাড়ির ছাদে নিয়ে গেল। গিয়ে দেখি ওই ছাদের চিলেকোঠার ধারে একটি ছোট্ট ঘরের সামনে লেখা রয়েছে পটুয়া বাড়ি। বুঝলাম এটিই তার ছবি আঁকার ঘর। কামরুল ভাই সহাস্যে বেরিয়ে এলেন। পরনে তার সাদা শর্টস আর হাতকাটা গেঞ্জি। তখনও তার বাহুতে এবং হাতের তালুতে তিনি সরষের তেল মাখছিলেন। আমাকে দেখেই সহাস্যে বললেন, 'দেখ তো আমার মাস্ল এখনও কেমন খেলে?' এই সময় মাথার ওপর দিয়ে দুটি যুদ্ধ জাহাজ উড়ে গেল। তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, 'আমি সারাদিন এখানে বসে বসে ছবি আঁকি আর এই দু'জন, জগাই-মাধাই আছে আমি হেন এক নিরীহ শিল্পীকে ভয় দেখানোর চেষ্টায়।' বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন। কী নির্ভীক এক মানুষ ছিলেন। সামরিক শাসনের জাঁতাকল যখন বাংলাদেশের সবাইকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে চাইছে তখন তিনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলতেন, 'আরে, কত আইয়ুব এলো, আইয়ুব গেল, ইয়াহিয়া এলো, ইয়াহিয়া গেল। আর এ তো হচ্ছে তুচ্ছ বাঙালি পুঙ্গব, ভয় দেখাতে চাইছে আমাদের? তোরা আসবি আর যাবি। কামরুল হাসানরা আমরণ বুক ফুলিয়েই চলবে।'
শ্রদ্ধেয় আলমগীর কবিরও এ রকমই একজন সাহসী মানুষ ছিলেন। আমার মনে পড়ে ১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমীর তখনকার অস্থায়ী মঞ্চে বিজয় দিবস উপলক্ষে সকালবেলায় এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। তখন সদ্যই বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে জেলে বন্দি চার জাতীয় নেতাকে এবং অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সেনাধ্যক্ষ ও সৈনিকদের। আমরা সবাই সাবধানে কথা বলছি। তবে সবারই মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। মাঝে মধ্যে বাঁধভাঙা বন্যার মতো সব ভাসিয়ে নিতে চায়। কিন্তু সাবধানতার আগল সেই ইচ্ছাকে অবদমিত করে রাখে। কবির ভাইয়ের আলোচনা শুরু হলো। তিনি শুরুই করলেন প্রায় বিদ্রোহের একটি আহ্বান দিয়ে। বললেন, 'আজ বিজয় দিবস। আমাদের বিজয় দিবস। এই দিনটির কথা মনে করুন সবাই। একাত্তরের এই দিনে আমরা চারদিকে দেয়াল তোলা এরকম ঘরে বসে কেবল আলাপ-আলোচনা করলে দেশটি কখনোই স্বাধীন হতো না। আজ আবার আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধতে চাইছে যারা, তাদের বিরুদ্ধে যদি কিছু করতে চান, তবে যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রাস্তায় নেমে আসুন। চলুন এখন থেকেই আরও একটি যুদ্ধ শুরু করা যাক।'
এরকম সাহসী মানুষেরা ছিলেন বলেই আমরা জীবনের একটা অর্থ খুঁজে পেতাম তখন। পেতাম বক্ষে পরম সাহস নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত। আমরা আরও নিবিষ্ট মনে আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে একাত্ম হতাম। কত শক্ত কথা বলার সাহস তারা পেয়েছেন তখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে অবলীলায়! সেই সাহসেরই উত্তরসূরি আজকের তরুণরা। তাদের মধ্যে এমন অনেকে আছে যারা অসীম সাহস ধরে বক্ষে। তবে বেশিরভাগ তরুণ আজকে আপাতরম্যে বসবাস করছে। জীবনের গভীর থেকে তারা নির্বাসিত। আমি তাদের দোষ দিই না। দোষ দিই তাদের অগ্রজদের, তাদের অভিভাবকদের। একাত্তরের সেই পরম বিক্রম, সেই অসীম সাহস, সেই উন্মাদনা কোথায় হারিয়ে গেল আমাদেরই প্রজন্মের পিতৃপুরুষদের আপসকামিতার জন্য? ইমদাদ ভাইয়ের মরদেহকে সামনে রেখে চকিতে মনে পড়ে যায় এত সব বিচিত্র কথা। মনে পড়ে যায়, অবলীলায় হাসতে হাসতে তিনি কেমন করে এক জঙ্গিবাজ রাষ্ট্রপতির মুখের ওপরে বলেছিলেন, 'মহামহিম, আপনি আমার বা আমাদের কথা বুঝবেন না। আপনার বোঝার কথাও নয়। পৃথিবীতে অনেক ধরনের মানুষ আছে। এক ধরনের মানুষ করোটির ভেতরে রক্ষিত বস্তুটি ব্যবহার করে কাজ করে, আরেক ধরনের মানুষের তো মাথাই নেই, মাথাব্যথা থাকবে কী করে?'
আজ সকালে ইমদাদ ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে পড়ল কয়েক বছর আগের কথা। তিনি আমাদের নাটক 'নুরলদীনের সারাজীবন' দেখে খুবই পছন্দ করেছিলেন এবং আমাকে বলেছিলেন এই নাটকটি গ্রামের গণমানুষের মধ্যে অভিনয় করতে। আমি তাকে বলেছিলাম নানা রকম অসুবিধার কথা। তিনি আর কিছু না বলে মহিলা সমিতি থেকে বাড়ি গিয়েছিলেন। এরপর হঠাৎ একদিন যোগাযোগ করে বললেন, আমরা তার গ্রাম রোহিতপুরে গিয়ে নাটকটি করতে রাজি আছি কি-না। নির্ধারিত দিন সকালবেলা আমরা সবাই হৈ হৈ করে পেঁৗছে গেলাম রোহিতপুর। আমরা ভেবেছিলাম, গ্রামে সাধারণত নাটক যেভাবে হয় সেই রকম ব্যবস্থাই করা হয়েছে এখানেও। অর্থাৎ উন্মুক্ত কোনো স্থানে কাঠের পাটাতন দিয়ে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে তার ওপরে অভিনীত হবে নাটক। গিয়ে দেখি এক অভিনব ব্যবস্থা করেছেন ইমদাদ ভাই। একটি পুকুরপাড়ে নাটকাভিনয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। বাঁশের খাঁচা তৈরি করে সেখান থেকে ঝুলছে মাইক। আমরা পুকুরপাড়ে নাটক করব আর পুকুরের ঢালে বসে গ্রামবাসী নাটক দেখবে। ঢাল থেকে শুরু করে আরও অনেক দূরে খালি জায়গায় লোকে বসে নাটক দেখবে। একটু দূরে দূরে একটি করে বাঁশ পুঁতে তাতে লাউডস্পিকার ঝোলানো হয়েছে। মনে মনে ভাবলাম, এই না হলে ইমদাদ ভাইয়ের মতো অত বড়মাপের একজন শিল্পী কি হতে পারতেন তিনি?
এ ধরনের একটা স্বপ্ন আমার সবসময়ই ছিল যে, পুকুরের ঢালে গণমানুষের নাটক করব আমরা আর তা দেখবে আমাদেরই গ্রামগঞ্জের মানুষ। তবে এর আয়োজন করতে ইমদাদ ভাইয়ের মতো একজন সংগঠক, একজন অসম সাহসী মানুষ, একজন অতি দক্ষ শিল্পীর প্রয়োজন হয়। শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আমি আরও ভাবছিলাম, তারা যে একে একে চলে যাচ্ছেন, আমাদের এক ভীষণ অবক্ষয়ী সমাজে ফেলে রেখে, এরপর প্রয়োজনে কার কাছে গিয়ে দাঁড়াব আমরা? কে আমাদের পথ দেখাবে? একে একে বন্ধুহীন হতে হতে এই বন্ধুর পথে বড্ড একা হয়ে যাচ্ছি আমরা।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments