রাজনীতিকদের হাতে পরিবহন খাত by আনোয়ার হোসেন
দেশের পরিবহন ব্যবসা পুরোপুরি রাজনীতিক ও প্রভাবশালীদের দখলে। বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-সাংসদ-রাজনীতিক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িত। কিছু রাজনীতিবিদ পরিবহন ব্যবসা না করেও মালিক সমিতি কিংবা শ্রমিক সংগঠনের নেতা বনে এই খাত নিয়ন্ত্রণ করছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি মিলে ২০-২৫ জন নেতাই ঘুরেফিরে পরিবহন খাতের নীতি ঠিক করেন। আবার তাঁরাই পরিবহন ব্যবসা করেন ও এই খাতের শ্রমিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে পরিবহন খাতে সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত সহজে বাস্তবায়িত হয় না।
কথায় কথায় ধর্মঘট, জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়। এই খাতে এখন আলোচিত-সমালোচিত চরিত্র নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। শ্রমিকনেতা হলেও তাঁর পরিবারের বাসের ব্যবসা আছে। বাসভাড়া নির্ধারণের বৈঠকে যোগাযোগমন্ত্রীর চেয়ে তাঁর কথাই বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভূমিকা কী হবে, সেটাও অনেকটা নির্ধারণ করে দেন তিনি।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নৌমন্ত্রী ও একজন পরিবহন ব্যবসায়ী নেতার কাছে মন্ত্রণালয় জিম্মি। এঁদের চাপের কারণে রাজধানীসহ সারা দেশে অনেক জায়গায় বিআরটিসির বাস বন্ধ হয়ে গেছে।
বাসমালিক, শ্রমিক ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনীতিক ও প্রভাবশালীরা পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন তিন পদ্ধতিতে। প্রথমত, সরাসরি পরিবহনের মালিক হয়ে এবং দ্বিতীয়ত মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা হয়ে। তৃতীয়ত, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারাও অনেক ক্ষেত্রে মালিক হয়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এই ধারায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একধরনের ‘সমঝোতা’ চলে আসছে।
কর্তৃত্ব যাঁদের: অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বরাবরই পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। বর্তমান সরকারের আমলেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। শাজাহান খানের ডান হাত হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। পরিবহন খাতের ভাড়া নির্ধারণ থেকে শুরু করে এই খাতের যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আইন প্রণয়ন ও সংশোধনসহ সব বৈঠকে তাঁদের উপস্থিতি দেখা যায়।
শাজাহান খান শ্রমিকদের নেতা হলেও ঢাকা-মাদারীপুর পথে চলাচলকারী ‘সার্বিক পরিবহনে’র মালিক মন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। গাবতলীতে সার্বিক পরিবহনের টিকিট বিক্রির কাউন্টারে শাজাহান খানের বাঁধানো ছবি শোভা পাচ্ছে। বর্তমান সরকারের আমলে রাজধানী ঢাকায় চালু হয় তাঁর ভাইয়ের মালিকানাধীন ‘কনক’ পরিবহন।
বিএনপি আমলে মূলত মির্জা আব্বাস, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, এস এ খালেক, জি এম সিরাজ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফর রহমান খানের বাবা হবিবুর রহমান খানকে পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে।
রাজধানী: মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাদের মালিকানাধীন বাস কোম্পানিগুলোই এখন একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছে রাজধানীতে।
সম্প্রতি কনক পরিবহনের বাসে বাড়তি ভাড়া আদায় করলেও মন্ত্রীর ভাই মালিক জেনে শুধু জরিমানা করে ছেড়ে দেয় পুলিশ। বাড়তি ভাড়া আদায়ের দায়ে কনক পরিবহনের একটি বাসের অনুমতি (রুট পারমিট) বাতিলের উদ্যোগ নিয়েও সরে আসে পুলিশ।
মিরপুর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত চলাচলকারী ‘বিহঙ্গ’ পরিবহনের চেয়ারম্যান স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ। বর্তমান সরকারের আমলে এই কোম্পানির বাস নামানোর অনুমতি দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, ওই পথে আগে থেকেই ইউনাইটেড কোম্পানির বাস চলাচল করত। রীতি অনুযায়ী একই যাত্রা ও গন্তব্যে একাধিক কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়া হয় না। বিহঙ্গের ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি। বিহঙ্গের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের কোম্পানির চেয়ারম্যানের (পঙ্কজ দেবনাথ) দুটি বাস আছে। পঙ্কজসহ কয়েকজন মিলে আমরা কোম্পানিটি করেছি।’
আজিমপুর-টঙ্গী পথে চলাচলকারী ‘দুলদুল’ পরিবহনে একজন মন্ত্রীর বাস আছে বলে জানা গেছে। হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীর চাচাতো ভাই মনির চৌধুরীর বাস আছে আজিমপুর থেকে আবদুল্লাহপুর পথে চলাচলকারী ‘সূচনা বিআরএফ’ পরিবহনে। সূচনা বিআরএফ একটি কোম্পানি এবং এতে অন্য আরও অনেক মালিকের বাস আছে।
বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাসের বাস ছিল ঢাকা পরিবহনে। এ সরকারের আমলে অবশ্য মির্জা আব্বাসের বাস চলে না।
মির্জা আব্বাস প্রথম আলোকে বলেন, এই খাতে নোংরামি ঢুকে গেছে। তাই তিনি ১০ বছর আগেই সরে এসেছেন। তাঁর দাবি, তিনি পরিবহন নেতা থাকা অবস্থায় এত চাঁদাবাজি-বিশৃঙ্খলা ছিল না।
দূরপাল্লার পথ: শাজাহান খানের ‘সার্বিক পরিবহনে’র বাইরে অনেক নেতা দূরপাল্লার পথে বাস পরিচালনা করছেন। বিএনপির সাবেক সাংসদ জি এম সিরাজের এস আর পরিবহন ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় চলে।
বিএনপির সাবেক সাংসদ এস এ খালেকের পরিবহনের নাম খালেক এন্টারপ্রাইজ। দ্রুতি পরিবহনের অন্যতম স্বত্বাধিকারী আলী কবির চাঁন। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হেলালের ভগ্নিপতি। ঢাকা থেকে বরিশাল পথে চলে দ্রুতি পরিবহন। ঢাকা-ফেনী পথে চলাচলকারী স্টারলাইন পরিবহনের স্বত্বাধিকারী আলাউদ্দিন জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
এর বাইরে অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিক বা তাঁদের আত্মীয়স্বজন পরিবহন ব্যবসায় জড়িত। এঁরা নিজেরা এক বা একাধিক বাস কিনে প্রভাব খাটিয়ে নামি কোম্পানির অধীনে চালান। আওয়ামী লীগের সাবেক এক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাস শ্যামলী পরিবহনে চালানো হয় বলে জানা গেছে। এমন অনেক কোম্পানিতে মন্ত্রী-সাংসদদের বাস চলাচল করে।
মালিক সমিতি: সারা দেশে বাসমালিকদের সমিতি আছে চারটি। এগুলো হচ্ছে—বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি, ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং ঢাকা বাস-ট্রাক ওনার্স গ্রুপ।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি ও ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির যথাক্রমে মহাসচিব ও সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তাঁর মালিকানাধীন ‘এনা পরিবহন’ রাজধানীর মিরপুর থেকে মতিঝিল পথে চলে। দূরপাল্লার পথে এনা পরিবহন চলে মহাখালী থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় তিনি আওয়ামী লীগের লোক এবং এক-এগারোর আগে আওয়ামী লীগের আন্দোলন-সংগ্রামে বিপুল লোকসমাগমের ব্যবস্থা করতেন। শাজাহান খানের ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে পরিবহন খাতের চাঁদার নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতেই অর্পণ করা হয়েছে। এই চাঁদার একটা অংশ আওয়ামী লীগের অনেক নেতার পকেটে যায় বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির অন্যতম প্রভাবশালী নেতা মশিউর রহমান জাতীয় পার্টির নেতা। উত্তরবঙ্গে তাঁর মালিকানাধীন বাসও চলে।
বিএনপি আমলে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির নেতৃত্বে ছিলেন মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সাইফুল আলম ও আবদুল বাতেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সাইফুল-বাতেনের সৌখিন পরিবহনেও মির্জা আব্বাসের অংশীদারি ছিল। রাজধানীতে বাস চলাচলের অনুমতি দেয় যে কমিটি (মেট্রো-আরটিসি), সেই কমিটির সদস্যও ছিলেন সাইফুল।
গাবতলী টার্মিনালভিত্তিক বাসের নিয়ন্ত্রণ করে বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। এই সমিতির সভাপতি আলী কবির চাঁন। সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ। বিএনপি সরকারের আমলে অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে ছিলেন জি এম সিরাজ ও কফিল উদ্দিন।
বাস-ট্রাক ওনার্স গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে গাবতলী টার্মিনাল থেকে মানিকগঞ্জ, সাভার, ধামরাইসহ ঢাকার আশপাশে চলাচলকারী বাস। বিএনপি আমলে এই গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন এস এ খালেক। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে আওয়ামী লীগের সাংসদ আসলামুল হকের কাছে।
আসলামুল হক বলেন, তিনি পরিবহন খাতের সঙ্গে জড়িত নন। তবে গাবতলী টার্মিনালে যাতে চাঁদাবাজি ও বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে তিনি দিকনির্দেশনা দেন।
খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের সমর্থক। রাজনীতিকেরা পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করে, এটা ঠিক নয়। প্রকৃত মালিক-শ্রমিকেরাই নিয়ন্ত্রণ করছে।’
শ্রমিক ইউনিয়ন: শ্রমিক ইউনিয়নগুলো নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বিএনপির নেতা লুৎফর রহমান খানের বাবা হবিবুর রহমান খান। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে তিনি নিষ্ক্রিয়। তাঁকে সরিয়ে এখন সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী।
বিআরটিসি বন্ধ: মিরপুর-১১ নম্বর থেকে আবদুল্লাহপুর পথে বিআরটিসির প্রায় ২৫টি বাস চলত গত এপ্রিল মাস থেকে। বেশ জনপ্রিয়ও ছিল এই পথটি। কিন্তু হঠাৎ গত ১৭ অক্টোবর এটি বন্ধ হয়ে যায়। মিরপুরে বিআরটিসির কাউন্টারে একটি বিজ্ঞপ্তি দেখা যায়। এতে বলা হয়, ‘অনিবার্য কারণবশত কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে মিরপুর-আবদুল্লাহপুর পথে বাস চলাচল বন্ধ আছে।’
বিআরটিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, একই পথে নৌমন্ত্রীর ভাই আজিজুর রহমান খানের কোম্পানি ‘কনক পরিবহনের’ বাস চলাচল করে। আজিজুর রহমান খান এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। শাজাহান খান মন্ত্রী হওয়ার পর এই পরিবহন কোম্পানিটি চালু হয়।
অভিযোগ রয়েছে, শাজাহান খানের চাপেই বিআরটিসি এই পথে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ বিআরটিসির বাস চালু হওয়ার পর এই কনক পরিবহনে যাত্রী কমে যায়। চালুর পর থেকেই তাই কনক পরিবহনের পক্ষ থেকে পথটি বন্ধ করার চাপ ছিল।
বিআরটিসির বাসে চলাচল করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আফজাল হোসেন। গত সোমবার তিনি জানান, উত্তরা থেকে তিনি বিআরটিসির বাসে ২০ টাকায় আগারগাঁও আসতেন। এখন কনক পরিবহনের বাসে এই পথে তাঁকে ৩০ টাকা গুনতে হচ্ছে।
বিআরটিসির মিরপুর ডিপোর ব্যবস্থাপক মো. গোলাম ফারুক দাবি করেন, বেসরকারি কোনো কোম্পানির চাপে বাসপথটি বন্ধ করা হয়নি। লোকসানের কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত বাস পাওয়া গেলে আবার চালু করা যাবে। অন্য কোম্পানির বাস লোকসান না দিলে বিআরটিসির কেন লোকসান হয়—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক যাত্রী বিআরটিসির বাসে ভাড়া দিতে চান না।
জানতে চাইলে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান তাঁর দপ্তরে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা না থাকলে এই খাত ধ্বংস হয়ে যেত।’ পরিবহন শ্রমিকনেতা হয়ে বাসমালিক হওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, এটা তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা। তিনি মন্ত্রী হওয়ার কারণে এই ব্যবসায় আলাদা কোনো সুবিধা নিচ্ছেন না বলে দাবি তাঁর। বিআরটিসির বাস বন্ধের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি এই রুটটি সম্পর্কে জানিই না। কাউকে বিআরটিসির বাস বন্ধ করতেও বলিনি।’
নৌমন্ত্রী হয়ে পরিবহন খাতে খবরদারির বিষয়ে শাজাহান খান বলেন, ‘আমি তো ওয়াসার খাল উদ্ধার ও শ্রম আইন নিয়েও কাজ করি। এতে কথা ওঠে না, পরিবহনে এলে ওঠে কেন?’
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নৌমন্ত্রী ও একজন পরিবহন ব্যবসায়ী নেতার কাছে মন্ত্রণালয় জিম্মি। এঁদের চাপের কারণে রাজধানীসহ সারা দেশে অনেক জায়গায় বিআরটিসির বাস বন্ধ হয়ে গেছে।
বাসমালিক, শ্রমিক ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনীতিক ও প্রভাবশালীরা পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন তিন পদ্ধতিতে। প্রথমত, সরাসরি পরিবহনের মালিক হয়ে এবং দ্বিতীয়ত মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা হয়ে। তৃতীয়ত, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারাও অনেক ক্ষেত্রে মালিক হয়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এই ধারায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একধরনের ‘সমঝোতা’ চলে আসছে।
কর্তৃত্ব যাঁদের: অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বরাবরই পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। বর্তমান সরকারের আমলেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। শাজাহান খানের ডান হাত হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। পরিবহন খাতের ভাড়া নির্ধারণ থেকে শুরু করে এই খাতের যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আইন প্রণয়ন ও সংশোধনসহ সব বৈঠকে তাঁদের উপস্থিতি দেখা যায়।
শাজাহান খান শ্রমিকদের নেতা হলেও ঢাকা-মাদারীপুর পথে চলাচলকারী ‘সার্বিক পরিবহনে’র মালিক মন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। গাবতলীতে সার্বিক পরিবহনের টিকিট বিক্রির কাউন্টারে শাজাহান খানের বাঁধানো ছবি শোভা পাচ্ছে। বর্তমান সরকারের আমলে রাজধানী ঢাকায় চালু হয় তাঁর ভাইয়ের মালিকানাধীন ‘কনক’ পরিবহন।
বিএনপি আমলে মূলত মির্জা আব্বাস, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, এস এ খালেক, জি এম সিরাজ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফর রহমান খানের বাবা হবিবুর রহমান খানকে পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে।
রাজধানী: মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাদের মালিকানাধীন বাস কোম্পানিগুলোই এখন একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছে রাজধানীতে।
সম্প্রতি কনক পরিবহনের বাসে বাড়তি ভাড়া আদায় করলেও মন্ত্রীর ভাই মালিক জেনে শুধু জরিমানা করে ছেড়ে দেয় পুলিশ। বাড়তি ভাড়া আদায়ের দায়ে কনক পরিবহনের একটি বাসের অনুমতি (রুট পারমিট) বাতিলের উদ্যোগ নিয়েও সরে আসে পুলিশ।
মিরপুর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত চলাচলকারী ‘বিহঙ্গ’ পরিবহনের চেয়ারম্যান স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ। বর্তমান সরকারের আমলে এই কোম্পানির বাস নামানোর অনুমতি দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, ওই পথে আগে থেকেই ইউনাইটেড কোম্পানির বাস চলাচল করত। রীতি অনুযায়ী একই যাত্রা ও গন্তব্যে একাধিক কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়া হয় না। বিহঙ্গের ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি। বিহঙ্গের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের কোম্পানির চেয়ারম্যানের (পঙ্কজ দেবনাথ) দুটি বাস আছে। পঙ্কজসহ কয়েকজন মিলে আমরা কোম্পানিটি করেছি।’
আজিমপুর-টঙ্গী পথে চলাচলকারী ‘দুলদুল’ পরিবহনে একজন মন্ত্রীর বাস আছে বলে জানা গেছে। হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীর চাচাতো ভাই মনির চৌধুরীর বাস আছে আজিমপুর থেকে আবদুল্লাহপুর পথে চলাচলকারী ‘সূচনা বিআরএফ’ পরিবহনে। সূচনা বিআরএফ একটি কোম্পানি এবং এতে অন্য আরও অনেক মালিকের বাস আছে।
বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাসের বাস ছিল ঢাকা পরিবহনে। এ সরকারের আমলে অবশ্য মির্জা আব্বাসের বাস চলে না।
মির্জা আব্বাস প্রথম আলোকে বলেন, এই খাতে নোংরামি ঢুকে গেছে। তাই তিনি ১০ বছর আগেই সরে এসেছেন। তাঁর দাবি, তিনি পরিবহন নেতা থাকা অবস্থায় এত চাঁদাবাজি-বিশৃঙ্খলা ছিল না।
দূরপাল্লার পথ: শাজাহান খানের ‘সার্বিক পরিবহনে’র বাইরে অনেক নেতা দূরপাল্লার পথে বাস পরিচালনা করছেন। বিএনপির সাবেক সাংসদ জি এম সিরাজের এস আর পরিবহন ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় চলে।
বিএনপির সাবেক সাংসদ এস এ খালেকের পরিবহনের নাম খালেক এন্টারপ্রাইজ। দ্রুতি পরিবহনের অন্যতম স্বত্বাধিকারী আলী কবির চাঁন। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হেলালের ভগ্নিপতি। ঢাকা থেকে বরিশাল পথে চলে দ্রুতি পরিবহন। ঢাকা-ফেনী পথে চলাচলকারী স্টারলাইন পরিবহনের স্বত্বাধিকারী আলাউদ্দিন জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
এর বাইরে অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিক বা তাঁদের আত্মীয়স্বজন পরিবহন ব্যবসায় জড়িত। এঁরা নিজেরা এক বা একাধিক বাস কিনে প্রভাব খাটিয়ে নামি কোম্পানির অধীনে চালান। আওয়ামী লীগের সাবেক এক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাস শ্যামলী পরিবহনে চালানো হয় বলে জানা গেছে। এমন অনেক কোম্পানিতে মন্ত্রী-সাংসদদের বাস চলাচল করে।
মালিক সমিতি: সারা দেশে বাসমালিকদের সমিতি আছে চারটি। এগুলো হচ্ছে—বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি, ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি, বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং ঢাকা বাস-ট্রাক ওনার্স গ্রুপ।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি ও ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির যথাক্রমে মহাসচিব ও সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তাঁর মালিকানাধীন ‘এনা পরিবহন’ রাজধানীর মিরপুর থেকে মতিঝিল পথে চলে। দূরপাল্লার পথে এনা পরিবহন চলে মহাখালী থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় তিনি আওয়ামী লীগের লোক এবং এক-এগারোর আগে আওয়ামী লীগের আন্দোলন-সংগ্রামে বিপুল লোকসমাগমের ব্যবস্থা করতেন। শাজাহান খানের ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে পরিবহন খাতের চাঁদার নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতেই অর্পণ করা হয়েছে। এই চাঁদার একটা অংশ আওয়ামী লীগের অনেক নেতার পকেটে যায় বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির অন্যতম প্রভাবশালী নেতা মশিউর রহমান জাতীয় পার্টির নেতা। উত্তরবঙ্গে তাঁর মালিকানাধীন বাসও চলে।
বিএনপি আমলে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির নেতৃত্বে ছিলেন মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সাইফুল আলম ও আবদুল বাতেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সাইফুল-বাতেনের সৌখিন পরিবহনেও মির্জা আব্বাসের অংশীদারি ছিল। রাজধানীতে বাস চলাচলের অনুমতি দেয় যে কমিটি (মেট্রো-আরটিসি), সেই কমিটির সদস্যও ছিলেন সাইফুল।
গাবতলী টার্মিনালভিত্তিক বাসের নিয়ন্ত্রণ করে বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। এই সমিতির সভাপতি আলী কবির চাঁন। সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ। বিএনপি সরকারের আমলে অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে ছিলেন জি এম সিরাজ ও কফিল উদ্দিন।
বাস-ট্রাক ওনার্স গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে গাবতলী টার্মিনাল থেকে মানিকগঞ্জ, সাভার, ধামরাইসহ ঢাকার আশপাশে চলাচলকারী বাস। বিএনপি আমলে এই গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন এস এ খালেক। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে আওয়ামী লীগের সাংসদ আসলামুল হকের কাছে।
আসলামুল হক বলেন, তিনি পরিবহন খাতের সঙ্গে জড়িত নন। তবে গাবতলী টার্মিনালে যাতে চাঁদাবাজি ও বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে তিনি দিকনির্দেশনা দেন।
খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের সমর্থক। রাজনীতিকেরা পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করে, এটা ঠিক নয়। প্রকৃত মালিক-শ্রমিকেরাই নিয়ন্ত্রণ করছে।’
শ্রমিক ইউনিয়ন: শ্রমিক ইউনিয়নগুলো নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বিএনপির নেতা লুৎফর রহমান খানের বাবা হবিবুর রহমান খান। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে তিনি নিষ্ক্রিয়। তাঁকে সরিয়ে এখন সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী।
বিআরটিসি বন্ধ: মিরপুর-১১ নম্বর থেকে আবদুল্লাহপুর পথে বিআরটিসির প্রায় ২৫টি বাস চলত গত এপ্রিল মাস থেকে। বেশ জনপ্রিয়ও ছিল এই পথটি। কিন্তু হঠাৎ গত ১৭ অক্টোবর এটি বন্ধ হয়ে যায়। মিরপুরে বিআরটিসির কাউন্টারে একটি বিজ্ঞপ্তি দেখা যায়। এতে বলা হয়, ‘অনিবার্য কারণবশত কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে মিরপুর-আবদুল্লাহপুর পথে বাস চলাচল বন্ধ আছে।’
বিআরটিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, একই পথে নৌমন্ত্রীর ভাই আজিজুর রহমান খানের কোম্পানি ‘কনক পরিবহনের’ বাস চলাচল করে। আজিজুর রহমান খান এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। শাজাহান খান মন্ত্রী হওয়ার পর এই পরিবহন কোম্পানিটি চালু হয়।
অভিযোগ রয়েছে, শাজাহান খানের চাপেই বিআরটিসি এই পথে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ বিআরটিসির বাস চালু হওয়ার পর এই কনক পরিবহনে যাত্রী কমে যায়। চালুর পর থেকেই তাই কনক পরিবহনের পক্ষ থেকে পথটি বন্ধ করার চাপ ছিল।
বিআরটিসির বাসে চলাচল করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আফজাল হোসেন। গত সোমবার তিনি জানান, উত্তরা থেকে তিনি বিআরটিসির বাসে ২০ টাকায় আগারগাঁও আসতেন। এখন কনক পরিবহনের বাসে এই পথে তাঁকে ৩০ টাকা গুনতে হচ্ছে।
বিআরটিসির মিরপুর ডিপোর ব্যবস্থাপক মো. গোলাম ফারুক দাবি করেন, বেসরকারি কোনো কোম্পানির চাপে বাসপথটি বন্ধ করা হয়নি। লোকসানের কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত বাস পাওয়া গেলে আবার চালু করা যাবে। অন্য কোম্পানির বাস লোকসান না দিলে বিআরটিসির কেন লোকসান হয়—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক যাত্রী বিআরটিসির বাসে ভাড়া দিতে চান না।
জানতে চাইলে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান তাঁর দপ্তরে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা না থাকলে এই খাত ধ্বংস হয়ে যেত।’ পরিবহন শ্রমিকনেতা হয়ে বাসমালিক হওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, এটা তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা। তিনি মন্ত্রী হওয়ার কারণে এই ব্যবসায় আলাদা কোনো সুবিধা নিচ্ছেন না বলে দাবি তাঁর। বিআরটিসির বাস বন্ধের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি এই রুটটি সম্পর্কে জানিই না। কাউকে বিআরটিসির বাস বন্ধ করতেও বলিনি।’
নৌমন্ত্রী হয়ে পরিবহন খাতে খবরদারির বিষয়ে শাজাহান খান বলেন, ‘আমি তো ওয়াসার খাল উদ্ধার ও শ্রম আইন নিয়েও কাজ করি। এতে কথা ওঠে না, পরিবহনে এলে ওঠে কেন?’
No comments