আলোকের এই ঝরনাধারায় পর্ব - ৫০-রাজনীতি সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণী কখনোই গড়ে ওঠেনি by আলী যাকের

জাহাঙ্গীর রোডের সরকারি কোয়ার্টার্সে বেশির ভাগ অধিবাসী ছিলেন বিভিন্ন সরকারি বিভাগে কর্মরত বাঙালি করণিক। একটি মেসে চার সিটের একটি ঘরে আমার জায়গা হলো। এবার ভাবলাম, এত দিন তো বিনা পয়সার সরাইখানায় থেকেছি মহা-আনন্দে; এখন থাকা-খাওয়ার খরচটি অন্তত আমাকেই জোগাড় করতে হবে। আমাদের পৈতৃক সম্পত্তির আয় থেকে তখন আমার জন্য বরাদ্দ ছিল মাসে ২০০ টাকা।


এই অর্থটি ভাইয়া আমাকে নিয়মিত মনি অর্ডার করে পাঠাতেন। কিন্তু তাতে খাওয়া-থাকা এবং হাতখরচ দেওয়া সম্ভব ছিল না। এদিকে তখনো করাচির আপাত চাকচিক্য আমায় টানছে। অতএব চাকরির খোঁজে নামতে হলো। এখানে আমি স্বীকার করতে বাধ্য, করাচির এসব মধ্যবিত্ত বাঙালি সেই সময় একজন অপরিচিত বাঙালি তরুণের জন্য যথেষ্ট করেছেন। জাহাঙ্গীর রোড কোয়ার্টার্স ছাড়াও নাজিমাবাদে ফেডারেল ক্যাপিটাল এলাকায় এ ধরনের মধ্যবিত্ত অনেক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে আমার সখ্য হয়েছিল। তাঁদের বিত্ত ছিল না, কিন্তু বাৎসল্যের অভাব ছিল না। আমার তখন যে মানসিক অবস্থা, তাতে এই স্নেহ না পেলে সত্যিই উদ্ভ্রান্ত হয়ে যেতাম।
যখন পাকিস্তানের জন্ম হলো, তখন বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে অধিকাংশই ছিল কৃষক শ্রেণীর। যেমন_আগেই বলেছি, হাতের আঙুলে গোনা যায়, কিছু উচ্চ শ্রেণীর মানুষ পাকিস্তান আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন। তা ছাড়া অবশিষ্ট জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন প্রথাসিদ্ধ শিক্ষার সুযোগ পায়নি। ফলে নগরায়ণ যখন শুরু হলো এবং কিছু কিছু জায়গায় শুরু হলো শিল্পায়ন, তখন সেখানকার শ্রমিকরা বেশির ভাগই কৃষি সম্প্রদায় থেকে আসতেন। তাঁরা ছিলেন অদক্ষ শ্রমিক। হাতে-কলমে কাজ করতে করতে তাঁদের কেউ কেউ দক্ষ শ্রমিক হয়ে ওঠেন। কেউ বা প্রশিক্ষণ পেয়ে আধিকারিকের পদে উন্নীত হন। পরবর্তীকালে তাঁদেরই সন্তানরা স্কুল-কলেজে গিয়ে মোটামুটি শিক্ষিত হয়ে ওঠে। তবে তাঁদের জন্মগত অবস্থান থেকে তাঁরা মানসিকভাবে বেরিয়ে আসতে পারেননি। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন হয় বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলন। পাকিস্তানে বাঙালি মুসলমানদের এই বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কেউ ছিলেন না। দু-চারজন নমস্য নেতা, যাঁরা বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। এবং তাঁরা পাকিস্তানি অভিজাত গোষ্ঠীভুক্ত মুসলমানদের দ্বারা ক্রমাগত অত্যাচারিত হয়েছিলেন। এ কারণেই আমাদের দেশে মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন, ঋজু মনোভাবের, রাজনীতি সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণী কখনোই গড়ে ওঠেনি, যাঁরা যুক্তির মাধ্যমে কোনো মতবাদ গ্রহণ কিংবা বর্জন করবেন। তাই এখনো আমরা সম্পূর্ণ মুক্তবুদ্ধির জনগোষ্ঠী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলাম না।
আজ জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ পার করে এসে মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমার দেশে কিছু উচ্চাভিলাষী অর্থগৃধ্নু আর অবশিষ্ট হতদরিদ্র ছাপোষা মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনাকারী একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের অভাব সব সময় অনুভব করেছি। এমন একটি সচেতন, সুশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যারা সমাজের শিক্ষা-সংস্কৃতি-শিল্পকলার চালিকাশক্তি হবে। আমরা যখন পরাধীন ছিলাম, পাকিস্তানিদের দ্বারা নিরন্তর অত্যাচারিত ছিলাম, তখন এ ধরনের একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী আমাদের অলক্ষ্যেই সৃষ্টি হয়েছিল। এই শ্রেণীই আমাদের আমাদের অলক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। একটি চেতনা, একটি মূল্যবোধ, একটি আদর্শের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর আমরা আবার দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েছি যেন। বিশ্বের প্রায় সব সমাজেই শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা তাদের কষ্টার্জিত বিদ্যা, মনন এবং যুক্তি দ্বারা চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়ে সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাই আমরা দেখতে পাই, প্রায় সব সমাজেই, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশেও, দেশের রাজনীতি-অর্থনীতিতে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা বিত্তবান না হওয়ায় শিক্ষার প্রতি তাদের বিশেষ দৃষ্টি দিতে হয়। ক্রমাগত তারা পয়সার পেছনে দৌড়ায় না। এই শিক্ষার প্রতি আনুগত্য তাদের আরো গভীর, আরো জীবনমুখী চিন্তায় ব্রতী করে। সেখান থেকেই আসে অনিয়মকে চ্যালেঞ্জ করার দীক্ষা।
আমাদের ঊনচলি্লশতম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে বসে আমি যখন কয়েক যুগ আগের স্মৃতিকথা সম্পর্কে ভাবছি, তখন এ কথাগুলো বারবার মনে আসছে। আমরা বলি, একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন হয়েছি। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে মুক্ত হওয়ার মানসে আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধ। আমরা মূলত সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। এই 'সংস্কৃতি' শব্দটির মধ্যে অঙ্গীভূত ছিল আমাদের জীবনের সব উপাদান। যেমন_আমাদের ভাষা, আমাদের ধর্ম, লোকাচার, খাদ্য, পরিচ্ছদ, প্রায়োগিক শিল্পকলা এবং একটি জীবনে যা যা প্রয়োজন সব কিছুই। আজ একে কেবল স্বাধীনতাযুদ্ধ বললে আমাদের জীবনপণ করা এই সংগ্রামকে অসম্মান করা হয়।
ফিরে যাই করাচিতে। করাচিতে থাকাকালে মেসের জীবনে অনভ্যস্ত আমি যখনই স্নেহের অভাব বোধ করেছি, তখনই আমার কোনো না কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাসায় গিয়েছি; এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের স্নেহময় আচরণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। এ রকম একজন ছিলেন আমার দূরসম্পর্কের খালাতো ভাই, যিনি একজন উচ্চপদস্থ আমলা ছিলেন এবং করাচির গার্ডেন রোড কোয়ার্টার্সে থাকতেন। তিনি, মোহাম্মদ মহসীন (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত) ও তাঁর স্ত্রী আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং আমি তাঁদের বাড়িতে অনেক রাত কাটিয়েছি। তাঁদের দ্বিতীয় কোনো শোয়ার ঘর ছিল না। খাওয়ার ঘরের একপাশে মহসীন ভাই ও ভাবি একটি লোহার খাট জুড়ে দিতেন এবং সত্যিকার অর্থেই একজন খুবই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতো আমার দেখভাল করতেন। তাঁদের একমাত্র মেয়ে মিন্নাত আমার খুব নেওটা ছিল। বাচ্চাদের নিয়ে একটি খেলা আমার খুব পছন্দ। আমি তাদের ওপরদিকে ছুড়ে দিই, আবার ধরে ফেলি। প্রতিবার ওরা যখন আমার হাতে ধরা দেয়, বুকের কাছে এনে একটা আদর করে জিজ্ঞেস করি, 'আকাশ কেমন দেখলে?' এই খেলাটি, আমি দেখেছি, প্রায় সব বাচ্চাই ভীষণ পছন্দ করে। মিন্নাতও করত। এ রকম দু-চারটি ভালোবাসার স্থান না থাকলে আমার করাচি বাস সত্যিকার অর্থেই দুর্বিষহ হয়ে উঠত।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.