মন্ত্রীর ভাই বাচ্চু জড়িত-জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফ by পিনাকি দাসগুপ্ত ও প্রীতিরঞ্জন সাহা

ন্ত্রীর ভাই বাচ্চুর গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পরই মেয়র লোকমানকে হত্যার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। লোকমান হত্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়া নরসিংদী শহর যুবলীগ সভাপতি আশরাফ হোসেন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য জানিয়েছেন। এদিকে লোকমান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি নরসিংদীর আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মতিন সরকার গ্রেফতার হয়েছেন।


গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ফেনী শহরের একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে নরসিংদী জেলা পুলিশ, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র‌্যাব মতিনকে গ্রেফতারের বিষয়টি এখনও স্বীকার করেনি।
নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুল মতিন সরকার লোকমান হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি। ইতিমধ্যে গ্রেফতার হওয়া শহর যুবলীগ সভাপতি আশরাফ হোসেনের বড় ভাই। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফ জানান, লোকমান হত্যার পেছনে মন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। হত্যাকাণ্ডের ২৫ দিন আগে রাজধানীর বনানী এলাকায় একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে বাচ্চু, মোবারক হোসেন মোবা, মুরাদসহ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। ১ নভেম্বর নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগ অফিসের বৈঠকও ছিল পরিকল্পিত। লোকমানকে হত্যা করার নিরাপদ স্থান হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগ অফিস বেছে নেওয়া হয়।
এদিকে মোটরসাইকেল গ্যারেজ মালিক হাজি সেলিমকে গতকাল দ্বিতীয় দফায় চারদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। বুধবার ঢাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এদিকে মামলার বাদী নিহত লোকমানের ছোট ভাই কামরুজ্জামান কামরুল সমকালকে জানান,
ফেনীতে মতিন সরকারের আত্মীয়স্বজন রয়েছেন। তাদের কাছ থেকেই মতিনের গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি তিনি জেনেছেন।
মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আশরাফ, টিপ্পন ও গ্রেফতার হওয়া কিলারকে পালাক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। লোকমান হত্যা মামলার পলাতক আসামিদের গ্রেফতারের জন্যই পুলিশকে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কারা কারা জড়িত, ভাড়াটে কিলার, অর্থ ও অস্ত্রের জোগানদাতাদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য এখন পুলিশের হাতে আছে। আশা করা যাচ্ছে, অল্প সময়ের মধ্যে লোকমান হত্যার রহস্য প্রকাশ করা হবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, আশরাফের দেওয়া তথ্যমতে তার বড় ভাই আবদুল মতিনকে ফেনী থেকে গ্রেফতার করা হয়। তবে গ্রেফতারের পর তাকে রাজধানীতে পুলিশের একটি দফতরে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, বুধবার ঢাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে আশরাফের মুখোমুখি করার পর তিনি মুখ খুলতে শুরু করেন। আশরাফ জানান, ঘটনার দিন আওয়ামী লীগ অফিসে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত। ওই বৈঠক ছিল অনির্ধারিত। লোকমানকে কৌশলে ডেকে আনা হয়েছিল। হত্যাকারীরা আশপাশেই অবস্থান করছিল। এর মধ্যে দু'জন মোটরসাইকেলে ঘটনাস্থলে পেঁৗছে। আশরাফ আরও জানান, লোকমান হত্যার বিষয় নিয়ে বাচ্চু কথা বলেছে হাতেগোনা কয়েকজনের সঙ্গে। সর্বশেষ বৈঠকে তিনি জানিয়েছিলেন, 'তোমরা ঘটনা ঘটাও, প্রশাসনিক বিষয়টি আমি দেখব।' এরপরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে পরে বাচ্চু এ নিয়ে আর কারও সঙ্গে কথা বলেননি। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন মুরাদ।
এদিকে মন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন বাচ্চুকে গ্রেফতারে ঢাকা মহানগর পুলিশের দুটি দল ঢাকার বাইরে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ১৪ নভেম্বর ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ছোট ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চু হাইকোর্ট এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর দু'দিন ঢাকায় অবস্থান করেন। পরে তিনি ঢাকা ছাড়েন।
বিমানবন্দর ও সীমান্তে আসামিদের ছবিসহ তালিকা : লোকমান হত্যা মামলার আসামিরা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন সে জন্য তিনটি বিমানবন্দর ও সীমান্তের ৩৫টি পয়েন্টে ছবিসহ তালিকা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যাওয়া আসামি মোবারক হোসেন মোবাকে দেশে ফেরত আনার ব্যাপারে গতকাল নরসিংদী জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
হাজি সেলিম ফের রিমান্ডে : লোকমান হোসেন হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত আসামি হাজি সেলিমকে আবারও চারদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। প্রথম দফায় তাকে চারদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। গতকাল পাঁচদিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে তাকে নরসিংদীর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পরিদর্শক মামুনুর রশীদ মণ্ডল।
আদালতে উপস্থাপিত পুলিশ প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ হেফাজতে রিমান্ডে থাকাকালে আসামি হাজি সেলিম অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন, যা যাচাই-বাছাইসহ আবারও নতুন তথ্য সংগ্রহের জন্য তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা একান্ত প্রয়োজন।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী এমএ আউয়াল আদালতে জামিন ও রিমান্ড বাতিলের আবেদন জানান। তিনি বলেন, হাজি সেলিমকে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ তার কাছ থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায়নি। যদি পেত তাহলে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির জন্য আদালতে আবেদন জানাত।
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে সিএসআই আনোয়ার হোসেন এবং জিআরও আশরাফুল ইসলাম বলেন, আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মোটরসাইকেলের মূল মালিকের সন্ধানসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তাকে আরও পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা একান্ত প্রয়োজন। চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিতাই চন্দ্র সাহা উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে আসামি সেলিমের দ্বিতীয় দফায় আরও চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
৯ নভেম্বর সেলিমকে টঙ্গী থেকে গ্রেফতার করে নরসিংদী ডিবি পুলিশ। তার দেওয়া তথ্যমতে পুলিশ ১৩ নভেম্বর গোপালগঞ্জের গোপীনাথপুর গ্রামের শরিফপাড়া থেকে গ্রেফতার করে পেশাদার কিলার টিপ্পনকে।
প্রতিবাদ সভা : মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের ১৭ দিন পরও প্রতিবাদ ও হত্যাকারীদের বিচার দাবি অব্যাহত রয়েছে। জনপ্রিয় এ মেয়রের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে গতকাল নরসিংদী ও ঢাকা-সিলেট সড়কের ভেলানগর বাসস্ট্যান্ডে প্রতিবাদ এবং শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়।
ভেলানগর বাজার কমিটির সভাপতি আবদুল আউয়ালের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সাংসদ লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হীরু বীরপ্রতীক বলেন, লোকমান হোসেনের মতো জনপ্রিয় মেয়রকে যারা হত্যা করেছে তাদের অবশ্যই গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া, জিএম তালেব হোসেন, আতাউর রহমান পিয়ার, লোকমান হোসেনের ভাই কামরুজ্জামান কামরুল ও শামীম নেওয়াজ।
এদিকে নরসিংদীর এলজিইডি ভবনে একটি ব্রিজ নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে লোকমান হোসেন স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.