শেকড়ের ডাক-জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনীতি ও ঢাকা ঘোষণা by ফরহাদ মাহমুদ
গুগলের স্কলার তালিকায় লর্ড এ্যান্টনি গিডেন্স্ এখনো দুনিয়াব্যাপী সবচেয়ে আলোচিত সমাজবিজ্ঞানী। তাঁর লেখা একটি বইয়ের শিরোনাম হচ্ছে 'দ্য পলিটিঙ্ অব ক্লাইমেট চেঞ্জ'। বইটি নিয়ে বিশদ আলোচনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আগ্রহী পাঠকরা বইটি পড়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করতে পারেন। তবে গিডেন্স্ মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব এখন যেসব সমস্যা মোকাবিলা করছে এবং করতে যাচ্ছে, সেগুলোর সমাধানে বিশ্ব রাজনীতি সঠিকভাবে
কাজ করছে না। রাজনীতিতে এখনো গোঁড়ামি প্রাধান্য পাচ্ছে, নানা রকম শূন্যতা বা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সেগুলো দূর করতে তিনি তাঁর বইয়ে কতগুলো ধারণা ব্যক্ত ও কিছু প্রস্তাব পাস করেছেন এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও শক্তি বা এনার্জি নিরাপত্তার মধ্যে যে সংযোগ রয়েছে তাকে খুব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ মোকাবিলায় বিশ্ব উদ্যোগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও আমরা দেখব, এ ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন প্রায় শূন্য। প্রথম পরিবেশ সম্মেলনের প্রায় দুই দশক পরে ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আর্থ সামিট বা ধরিত্রী সম্মেলন। পরিবেশকে মানুষের বসবাসযোগ্য রাখতে সেই শীর্ষ সম্মেলন থেকে দূষণ কমাতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের পাশাপাশি দেশীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণের তথা জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পাশাপাশি দেশগুলোর সরকারকে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। সেখানে নির্ধারিত লক্ষ্যসমূহের মধ্যে ছিল বিষাক্ত দ্রব্যাদি ও বিষাক্ত বর্জ্যের উৎপাদন নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, পরিবেশসম্মত জ্বালানি বা শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনা, যানবাহন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে বায়ুদূষণের পরিমাণ কমানো, পানীয়জলের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করা ও বিকল্প উদ্যোগ বাড়ানো। ১৯৯৭ সালে জাপানের কিওটোতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে কিওটো প্রটোকল প্রণীত হয়। এতে ৩৭টি উন্নত দেশ ও ইউরোপীয় গোষ্ঠীর ওপর গ্রিনহাউস গ্যাস (জিএইচজি) নির্গমন কমানোর লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, ১৯৯০ সালের পরিমাণ অনুযায়ী, দেশগুলো ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে প্রতিবছর ৫ শতাংশ করে জিএইচজি নির্গমন কমিয়ে আনবে। ২০১০ সালে কানকুন সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে উপনীত হওয়ার চেষ্টা চলে। কিন্তু গত বছর কোপেনহেগেন সম্মেলনেও কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে কোনো চুক্তিতে উপনীত হওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফলে প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে জিএইচজি নির্গমন হ্রাস অথবা কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে বাস্তব কোনো অগ্রগতি হয়নি। উল্টো গত বছর অর্থাৎ ২০১০ সালে কার্বন নিঃসরণ ছিল রেকর্ড পরিমাণে বেশি। ফলে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমার বদলে ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আর এর জন্য দায়ী মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলো। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো, যাদের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অতি নগণ্য। অথচ এসব দেশের পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করা প্রায় অসম্ভব। সে কারণে খুব সংগতভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত বিশ্বের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে আসছে। এ অবস্থায় চলতি সপ্তাহেই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) দুদিনব্যাপী সম্মেলন। সম্মেলনে ২০টি দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে 'ঢাকা ঘোষণা' নামে একটি ১৪ দফা ঘোষণা গ্রহণ করা হয়েছে। এই ঘোষণায় যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তা হলো, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, কথা বলতে হবে এক সুরে। উন্নত দেশগুলো যেমন ধরিত্রী সম্মেলন, কিওটো প্রটোকল, কানকুনের সিদ্ধান্ত_কিছুই তোয়াক্কা না করে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে, তেমনি তারা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণের দাবিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে না।
জাতিসংঘ ও কয়েকটি জার্মান ত্রাণ সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে গত বছর জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয় যে গবেষণা চালায়, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে তুলে ধরা হয়েছে। এর আগে জার্মানওয়াচ-এর গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেঙ্ ২০১০-এ সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এক নম্বরে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশকে। গত মাসে জলবায়ুর ঝুঁকি বিশ্লেষণে অভিজ্ঞ লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান 'ম্যাপলক্রাফট' ২০১১ সালের যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতেও বিশ্বে যে ৩০টি দেশকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ তাদের শীর্ষে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ২০১০ সালের তালিকায়ও বাংলাদেশ এক নম্বরে ছিল। আর শুধু বিদেশের রিপোর্টই বা কেন? আমাদের চোখ যদি অন্ধ না হয়ে থাকে, তাহলে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি না,_গত মার্চে কোনো সতর্কতা সংকেতও ছিল না, হঠাৎ করেই ভোলার বিস্তীর্ণ এলাকা জোয়ারে প্লাবিত হয়েছিল? কয়েকবার করে প্লাবিত হয়েছে কঙ্বাজার থেকে শুরু করে সাতক্ষীরা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল। বাগেরহাট, পটুয়াখালী, কঙ্বাজার, চট্টগ্রামসহ অনেক উপকূলীয় শহরেই এখন জোয়ারের পানি প্রবেশ করে। ফলে অচিরেই বাংলাদেশের অনেক উপকূলীয় শহর-গ্রাম বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। লাখ লাখ একর জমি আবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। বেড়িবাঁধ আরো উঁচু করে এবং আরো শক্তভাবে নির্মাণের প্রয়োজন থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে,_২০০৭ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সিডরের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধও এখনো পুরোপুরি মেরামত করা যায়নি। ২০০৯ সালের আইলাবিধ্বস্ত এলাকায়ও বাঁধ মেরামত না হওয়ায় এখনো সেখানকার মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে না। বরং অতিরিক্ত জোয়ারের চাপে বিশাল উপকূলীয় বেড়িবাঁধের নতুন নতুন অংশ ভেঙে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে কেবল যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বা সাগরের আগ্রাসী আচরণ রয়েছে, তা নয়। অতিরিক্ত খরা, ভয়াবহ বন্যা, মহামারি আকারে রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়াসহ আরো অনেক কিছুই এই ঝুঁকির অন্তর্ভুক্ত। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে এই লক্ষণগুলো যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকায় ইতিমধ্যেই মরুকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। অনেক এলাকায় গভীর নলকূপ দিয়েও পানি উঠছে না। চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। নদীগুলোর নাব্যতা না থাকায় সারা দেশই মৌসুমি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেঙ্ ২০১০ অনুযায়ী, ১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরে বাংলাদেশে কেবল সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। কয়েক লাখ মানুষ হতাহত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলার দাবি করেছিল। অনেক আন্তর্জাতিক ফোরামে সে দাবি তুলেও ধরা হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত সহায়তা চুক্তি সই হয়েছে মাত্র ১২৫ মিলিয়ন ডলারের। সেই অর্থ কবে পাওয়া যাবে কিংবা আদৌ পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কাজেই উন্নত বিশ্বের এই উদাসীনতার প্রতি অসহায়ের মতো তাকিয়ে না থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে এবং কার্যকর উপায়ে সেই দাবি জানাতে হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের পক্ষে দুনিয়াব্যাপী মানবতাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য, অতীতে সে কাজটি আমরা ভালোভাবে করতে পারিনি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নেওয়া তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধিদের সম্পর্কে কিছুটা ব্যঙ্গ করেই একজন বিদেশি সাংবাদিক বলেছেন, এঁদের তৎপরতা দেখলে মনেই হয় না, এঁরা একটি দরিদ্র দেশের দুর্দশা নিয়ে কথা বলতে এসেছেন। বরং নাচ-গান-আড্ডা-বিলাসিতাতেই এঁদের বেশি আগ্রহ দেখা যায়। আর এঁরা যখন কথা বলেন, নিতান্তই না বললে নয়, এমনভাবে প্রস্তুতিহীন, এলোমেলো কিছু কথা বলেন। এটি জলবায়ু বা বিশ্ববাণিজ্য_সর্বত্রই সত্য। অথচ উল্টোটা দেখা যায় উন্নত বিশ্বে। তাদের প্রতিনিধিরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাদের যুক্তিগুলো তুলে ধরে। আবার কোপেনহেগেন সম্মেলনের সময় বিশ্ব মানবতার পক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে ডেনমার্কে বেশ কিছু তরুণকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ মোকাবিলায় বিশ্ব উদ্যোগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও আমরা দেখব, এ ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন প্রায় শূন্য। প্রথম পরিবেশ সম্মেলনের প্রায় দুই দশক পরে ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আর্থ সামিট বা ধরিত্রী সম্মেলন। পরিবেশকে মানুষের বসবাসযোগ্য রাখতে সেই শীর্ষ সম্মেলন থেকে দূষণ কমাতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের পাশাপাশি দেশীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণের তথা জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পাশাপাশি দেশগুলোর সরকারকে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। সেখানে নির্ধারিত লক্ষ্যসমূহের মধ্যে ছিল বিষাক্ত দ্রব্যাদি ও বিষাক্ত বর্জ্যের উৎপাদন নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, পরিবেশসম্মত জ্বালানি বা শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনা, যানবাহন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে বায়ুদূষণের পরিমাণ কমানো, পানীয়জলের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করা ও বিকল্প উদ্যোগ বাড়ানো। ১৯৯৭ সালে জাপানের কিওটোতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে কিওটো প্রটোকল প্রণীত হয়। এতে ৩৭টি উন্নত দেশ ও ইউরোপীয় গোষ্ঠীর ওপর গ্রিনহাউস গ্যাস (জিএইচজি) নির্গমন কমানোর লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, ১৯৯০ সালের পরিমাণ অনুযায়ী, দেশগুলো ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে প্রতিবছর ৫ শতাংশ করে জিএইচজি নির্গমন কমিয়ে আনবে। ২০১০ সালে কানকুন সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে উপনীত হওয়ার চেষ্টা চলে। কিন্তু গত বছর কোপেনহেগেন সম্মেলনেও কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে কোনো চুক্তিতে উপনীত হওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফলে প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে জিএইচজি নির্গমন হ্রাস অথবা কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে বাস্তব কোনো অগ্রগতি হয়নি। উল্টো গত বছর অর্থাৎ ২০১০ সালে কার্বন নিঃসরণ ছিল রেকর্ড পরিমাণে বেশি। ফলে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমার বদলে ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আর এর জন্য দায়ী মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলো। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো, যাদের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অতি নগণ্য। অথচ এসব দেশের পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করা প্রায় অসম্ভব। সে কারণে খুব সংগতভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত বিশ্বের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করে আসছে। এ অবস্থায় চলতি সপ্তাহেই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) দুদিনব্যাপী সম্মেলন। সম্মেলনে ২০টি দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে 'ঢাকা ঘোষণা' নামে একটি ১৪ দফা ঘোষণা গ্রহণ করা হয়েছে। এই ঘোষণায় যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তা হলো, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, কথা বলতে হবে এক সুরে। উন্নত দেশগুলো যেমন ধরিত্রী সম্মেলন, কিওটো প্রটোকল, কানকুনের সিদ্ধান্ত_কিছুই তোয়াক্কা না করে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে, তেমনি তারা ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষতিপূরণের দাবিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে না।
জাতিসংঘ ও কয়েকটি জার্মান ত্রাণ সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে গত বছর জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয় যে গবেষণা চালায়, তাতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে তুলে ধরা হয়েছে। এর আগে জার্মানওয়াচ-এর গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেঙ্ ২০১০-এ সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এক নম্বরে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশকে। গত মাসে জলবায়ুর ঝুঁকি বিশ্লেষণে অভিজ্ঞ লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান 'ম্যাপলক্রাফট' ২০১১ সালের যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতেও বিশ্বে যে ৩০টি দেশকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ তাদের শীর্ষে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ২০১০ সালের তালিকায়ও বাংলাদেশ এক নম্বরে ছিল। আর শুধু বিদেশের রিপোর্টই বা কেন? আমাদের চোখ যদি অন্ধ না হয়ে থাকে, তাহলে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি না,_গত মার্চে কোনো সতর্কতা সংকেতও ছিল না, হঠাৎ করেই ভোলার বিস্তীর্ণ এলাকা জোয়ারে প্লাবিত হয়েছিল? কয়েকবার করে প্লাবিত হয়েছে কঙ্বাজার থেকে শুরু করে সাতক্ষীরা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল। বাগেরহাট, পটুয়াখালী, কঙ্বাজার, চট্টগ্রামসহ অনেক উপকূলীয় শহরেই এখন জোয়ারের পানি প্রবেশ করে। ফলে অচিরেই বাংলাদেশের অনেক উপকূলীয় শহর-গ্রাম বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। লাখ লাখ একর জমি আবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। বেড়িবাঁধ আরো উঁচু করে এবং আরো শক্তভাবে নির্মাণের প্রয়োজন থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে,_২০০৭ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সিডরের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধও এখনো পুরোপুরি মেরামত করা যায়নি। ২০০৯ সালের আইলাবিধ্বস্ত এলাকায়ও বাঁধ মেরামত না হওয়ায় এখনো সেখানকার মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে না। বরং অতিরিক্ত জোয়ারের চাপে বিশাল উপকূলীয় বেড়িবাঁধের নতুন নতুন অংশ ভেঙে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে কেবল যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বা সাগরের আগ্রাসী আচরণ রয়েছে, তা নয়। অতিরিক্ত খরা, ভয়াবহ বন্যা, মহামারি আকারে রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়াসহ আরো অনেক কিছুই এই ঝুঁকির অন্তর্ভুক্ত। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে এই লক্ষণগুলো যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বরেন্দ্র অঞ্চলসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকায় ইতিমধ্যেই মরুকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। অনেক এলাকায় গভীর নলকূপ দিয়েও পানি উঠছে না। চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। নদীগুলোর নাব্যতা না থাকায় সারা দেশই মৌসুমি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেঙ্ ২০১০ অনুযায়ী, ১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরে বাংলাদেশে কেবল সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। কয়েক লাখ মানুষ হতাহত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলার দাবি করেছিল। অনেক আন্তর্জাতিক ফোরামে সে দাবি তুলেও ধরা হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত সহায়তা চুক্তি সই হয়েছে মাত্র ১২৫ মিলিয়ন ডলারের। সেই অর্থ কবে পাওয়া যাবে কিংবা আদৌ পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কাজেই উন্নত বিশ্বের এই উদাসীনতার প্রতি অসহায়ের মতো তাকিয়ে না থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে এবং কার্যকর উপায়ে সেই দাবি জানাতে হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের পক্ষে দুনিয়াব্যাপী মানবতাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য, অতীতে সে কাজটি আমরা ভালোভাবে করতে পারিনি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নেওয়া তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধিদের সম্পর্কে কিছুটা ব্যঙ্গ করেই একজন বিদেশি সাংবাদিক বলেছেন, এঁদের তৎপরতা দেখলে মনেই হয় না, এঁরা একটি দরিদ্র দেশের দুর্দশা নিয়ে কথা বলতে এসেছেন। বরং নাচ-গান-আড্ডা-বিলাসিতাতেই এঁদের বেশি আগ্রহ দেখা যায়। আর এঁরা যখন কথা বলেন, নিতান্তই না বললে নয়, এমনভাবে প্রস্তুতিহীন, এলোমেলো কিছু কথা বলেন। এটি জলবায়ু বা বিশ্ববাণিজ্য_সর্বত্রই সত্য। অথচ উল্টোটা দেখা যায় উন্নত বিশ্বে। তাদের প্রতিনিধিরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাদের যুক্তিগুলো তুলে ধরে। আবার কোপেনহেগেন সম্মেলনের সময় বিশ্ব মানবতার পক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে ডেনমার্কে বেশ কিছু তরুণকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল।
কিন্তু বিদেশি সহায়তা পাওয়া না গেলে আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব_তা হয় না। আমাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেই ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। বর্তমান সরকার এ লক্ষ্যে একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। এখন অগ্রাধিকার নির্ণয় করে সেই তহবিল ব্যবহার করতে হবে। জানা যায়, তহবিলের গন্ধ পেয়ে রাতারাতি অনেক এনজিও গজিয়ে উঠেছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কিছু কর্মকর্তার জিভ হয়তো পানিতে টলমল করছে। সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। উপকূলীয় মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন, তথা দেশের অস্তিত্ব যার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল, সেই উদ্যোগে সর্বোচ্চ সততা ও জবাবদিহিতা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, অর্থাভাবের কথা বলে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করা হলে তা হবে আত্মঘাতী। বরং যেটুকু অর্থ আছে, তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। তা না হলে এ দেশে দারিদ্র্য নিরসন কেবল কথার কথাই থেকে যাবে। কারণ এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রধান শিকারই হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী। কাজেই ঢাকা ঘোষণায় যে ১৪ দফা দাবি তোলা হয়েছে, সেগুলোর পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকেই উদ্যোগী হতে হবে এবং অভিন্ন অবস্থানে থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নেওয়া আমাদের প্রতিনিধিদের আলোচনার কলাকৌশল বদলাতে ও আরো যুক্তিপূর্ণ করতে হবে এবং দরকষাকষির সক্ষমতা বাড়াতে হবে। উপযুক্ত লোককে সেসব ফোরামে পাঠাতে হবে। কেবল তখনই আমরা আসন্ন ডারবান সম্মেলন থেকে কিছু ফলপ্রসূ পদক্ষেপের প্রত্যাশা করতে পারব। ঢাকা ঘোষণা সার্থকতা পাবে।
No comments