সাবেক পৌর চেয়ারম্যান মতিন সরকার গ্রেপ্তার! by পারভেজ খান ও হায়দার আলী
লোকমান হত্যা মামলার দ্বিতীয় আসামি নরসিংদী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মতিন সরকার গ্রেপ্তার হয়েছেন। পুলিশ গত বুধবার রাতে নোয়াখালীর ফেনী সড়ক থেকে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি আবদুল মতিন সরকারকে গ্রেপ্তার করে। তদন্ত ও গ্রেপ্তার অভিযান-সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা এই গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করেননি। তবে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার একাধিক সূত্র থেকে খবরটির সত্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
মতিন সরকার দুইবার নরসিংদী পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। সর্বশেষ পৌর নির্বাচনে লোকমান হোসেনের সঙ্গে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। এই মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তারের সংখ্যা চারজন। তাদের মধ্যে মতিন সরকার এবং তাঁর ছোট ভাই আশরাফ সরকার এজাহারভুক্ত। হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারকৃত অপর আসামি হাজি সেলিমকে গতকাল বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করে চার দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। লোকমানের পরিবারের কয়েকজন সদস্য জানান, সন্ত্রাসীরা পুরান ঢাকার একটি খুনি চক্রকেও একবার ভাড়া করেছিল। জানতে পেরে বিষয়টি লোকমান স্ত্রী ও ভাইদের জানান। এর পর থেকেই লোকমান অধিকাংশ সময় বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরে থাকতেন। তবে ঘটনার দিন তিনি একটি জানাজায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন বলে জ্যাকেটটি পরেননি।
পুলিশ সূত্র মতে, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে একের পর এক যেসব তথ্য মিলছে, তাতে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ছোট ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর সম্পৃক্ততার ইঙ্গিতটাও জোরালো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মন্ত্রীর সরাসরি জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ না মিললেও হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা বা পরামর্শের সঙ্গে তিনি জড়িত বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তদন্তে এসব তথ্যকেও গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মতিন সরকার নরসিংদী শহরের দত্তপাড়া (বেপারীপাড়া) এলাকার বাসিন্দা। লোকমান হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি মতিন সরকার তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য এলাকায় 'বেপরোয়া লীগ' নেতা হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। তিনি লোকমান হোসেনের আগে পর পর দুইবার নরসিংদী পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৪ সালে ও চলতি বছর পৌর নির্বাচনে লোকমানের সঙ্গে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন তিনি। মতিন সরকার পৌর চেয়ারম্যান থাকাকালীন নরসিংদী শহর সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, জমি দখল, খুন, ধর্ষণসহ মাদকের রাজ্যে পরিণত হয়েছিল।
শুধু মতিন সরকারের নিজ এলাকা বেপারিপাড়ায় ছিল ২০টির বেশি মাদকের স্পট। সারা শহরে ছিল দুই শতাধিক মাদকের আস্তানা। ওইসব আস্তানা থেকে মাসে লাখ লাখ টাকা মাসোহারা পেতেন মতিন সরকার ও তাঁর ছোট ভাই আশরাফ সরকার।
নরসিংদীর রাঙ্গামাইট্যা এলাকার পাওয়ারলুম কারখানার ইলেকট্রিশিয়ান সাইদুর রহমান বলেন, '১৯৯৯ সালে মদ খাইয়া একরাতে যেই শহরে শতাধিক লোক প্রাণ হারাতে পারে, সেই শহর সম্পর্কে মানুষকে বেশি কিছু বুঝাতে হবে না। মতিন সরকারের যুগ আইয়ামে জাহিলিয়াতকেও হার মানিয়েছিল। ওই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সাধারণ মানুষ জেলা ছাত্রলীগ নেতা লোকমান হোসেনকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করে।' জাবেদ খন্দকার নামের স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, নির্বাচনে পরাজিত হওয়া এবং মাদকের স্পট বন্ধ, বেপারিপাড়ার ক্ষমতা খর্ব_এসব থেকেই আবদুল মতিন সরকার ও আশরাফ সরকারের সঙ্গে লোকমানের দ্বন্দ্ব ব্যাপক বিস্তার লাভ করেন।
একাধিক সূত্র মতে, মতিন সরকার শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসীদের গডফাদার ছিলেন। দেশে প্রথমবারের মতো রকেট লঞ্চারসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়া দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী রিপন সরকার, পুলিশের তালিকাভুক্ত চিহ্নিত অস্ত্র ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের গডফাদার তৌহিদুল সরকার, পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত সন্ত্রাসী নূরা, প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত সন্ত্রাসী বিপ্লবসহ অনেক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীই একসময় মতিন সরকারের ক্যাডার হিসেবে কাজ করত।
মামলার বাদী কামরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'লোকমান হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আবদুল মতিন সরকার। নির্বাচনে পরাজিত হয়েই সে আমার ভাইকে হত্যার জন্য সন্ত্রাসী ভাড়া করে বিভিন্ন সময় চেষ্টা চালায়। আমার ভাই শহরে জনপ্রিয় হওয়ার কারণে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীরা হত্যার মিশনের কথা ভাইকে আগাম জানিয়ে দিতেন। মতিন সরকারের সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমার ভাই অনেক চেষ্টা করলেও বেঁেচ থাকতে পারেননি।'
লোকমানের স্ত্রী তামান্না নুশরাত বুবলি বেগম বলেন, বেপারিপাড়ার সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট তাঁর স্বামীকে ঘায়েল করতে না পেরে হাত মেলায় লোকমানের বিরোধী গ্রুপ ঘাতকদের অন্যতম মোবারক হোসেন মোবা, কবির সরকার, তারেক আহামেদ, নুরুল ইসলামদের সঙ্গে। লোকমানকে হত্যার জন্য দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করে এই সিন্ডিকেট। অবশেষে হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেই মোবা, কবির ও নুরুল পারি জমায় মালয়েশিয়ায়।
আমাদের নরসিংদী প্রতিনিধি সুমন বর্মণ জানান, মতিন সরকারকে গ্রেপ্তার করার খবরটি গতকাল সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত নিশ্চিত করেননি নরসিংদীর পুলিশ সুপার খ. মুহিদ উদ্দিন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মতিন সরকার গ্রেপ্তার হয়েছে_এমন সংবাদ আমাদের কাছে নেই।' তবে তাঁরাও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তাঁর গ্রেপ্তারের খবর পেয়েছেন বলে জানান।
এদিকে লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার মো. সেলিমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফের চার দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। টানা চার দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর গতকাল বৃহস্পতিবার সেলিমকে আরো পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নরসিংদী গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ মণ্ডল। শুনানি শেষে নরসিংদীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হাকিম নিতাই চন্দ্র সাহা চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
লোকমানের স্ত্রী তামান্না এবং তাঁর ছোট ভাই ও মামলার বাদী কামরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশ বা তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যা-ই বলুক না কেন, তাঁরা নিশ্চিত, এই হত্যাকাণ্ডে মন্ত্রী রাজুর ভাই বাচ্চু ও তাঁর সহযোগী মতিন সরকারসহ এজাহারভুক্ত প্রত্যেক আসামিই জড়িত। এর বাইরে আর কেউ জড়িত থাকলে সেটা পুলিশের তদন্তে বের হয়ে আসবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার কয়েকজন আয়ামী লীগ নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকাশ্যে তাঁদের পক্ষে রাজু ও তাঁর ভাই বাচ্চুর ব্যাপারে কথা বলার সাহস নেই। তবে এটা সত্য যে ঘটনার পর আওয়ামী লীগের যে অংশ মন্ত্রী ও বাচ্চুর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল সেই অংশটাও ক্রমে ছোট হয়ে আসছে।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, ঘটনার সঙ্গে মন্ত্রী ও তাঁর ভাইয়ের নাম চলে আসায় তাঁদেরকে অনেক কিছু বিবেচনা করে এগোতে হচ্ছে। তবে মন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন বাচ্চু, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব মাসুদুর রহমান মুরাদ এবং শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোন্তাজ উদ্দিন ভূঁইয়ার সম্পৃক্ততার বিষয়ে অনেক জোরালো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তাঁদের গ্রেপ্তার করাটা এখন জরুরি। ইতিমধ্যেই তাঁদের গ্রেপ্তারের জন্য একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু তাঁরা গা ঢাকা দিয়েছেন। পুলিশ বলছে, তাঁরা যেদিন উচ্চ আদালতে জামিন আনতে গিয়ে ব্যর্থ হন, সেদিনই গ্রেপ্তারের ব্যাপারে পুলিশের পূর্ণ প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সবুজ সংকেত না পাওয়ার কারণে সেদিন তাঁদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তাঁদের গ্রেপ্তার করা হলে এখন এই জটিল অবস্থার সৃষ্টি হতো না বলেও পুলিশ মনে করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদর দপ্তরে কর্তব্যরত একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, তদন্তে ব্যাপক অগ্রগতি আসায় তাঁরা পুরো বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক শীর্ষ মহলের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। কয়েকজন সংসদ সদস্যসহ ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন সিনিয়র রাজনীতিবিদ এর আগে এই মামলার তদন্তে কিছুটা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু এখন সেই অবস্থা আর আগের মতো জোরালো নেই। শীর্ষ মহল থেকেও পুলিশকে স্বাভাবিক গতিতে এগোতে বলা হয়েছে। তবে সন্দেহের বসে অহেতুক যাতে করে কোনো রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হয়রানি না করা হয়, সে ব্যাপারেও পুলিশকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, ভাড়াটে খুনি দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হলেও এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই ধূর্ত প্রকৃতির। তাঁরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করা ছাড়াও মামলার মেরিট নষ্ট করতে পারেন। ফলে এই হত্যা পরিকল্পনায় কারা কারা ছিল সে ব্যাপারে পাওয়া তথ্য সম্পর্কে অধিকতর নিশ্চিত হতে হচ্ছে পুলিশকে। পাশাপাশি খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে, পরিকল্পনাটি কবে ও কোথায় করা হয়।
এই হত্যা মামলার অন্যতম আসামি শহর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মোবারক হোসেন মোবা, সদর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম এবং শহর যুবলীগ নেতা কবীর সরকার মালয়েশিয়ায় রয়েছে। তারা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার কয়েক দিন আগেই মালয়েশিয়া চলে যায়। তারাও এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। এ ছাড়া অপর আসামি বিএনপির স্থানীয় নেতা তারেক আহমেদও হজ করতে সৌদি আরব গেছেন।
গত ১ নভেম্বর রাতে সন্ত্রাসীর গুলিতে প্রাণ হারান নরসিংদীর মেয়র লোকমান হোসেন। এ ঘটনায় নিহত মেয়রের ছোট ভাই কামরুজ্জামান বাদী হয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ছোট ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে প্রধান আসামি করে ১৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আশরাফ হোসেন সরকার, হাজি সেলিম ও টিপ্পন কাজী নামের দুজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা পুলিশ।
সেলিম মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মোবারক হোসেনের ভাতিজি জামাই। লোকমান হত্যাকাণ্ডে যে মোটরসাইকেলটি ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তা সেলিমের। হত্যাকাণ্ডের ১১ দিন পর গত ১২ নভেম্বর গাজীপুরের টঙ্গী থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত সেলিমসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া গ্রেপ্তারকৃত অপর আসামি টিপ্পন কাজী ও আশরাফ সরকারকেও জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। টিপ্পন কাজী একজন পেশাদার সন্ত্রাসী ও ভাড়াটে খুনি। সে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকারও করেছে।
পুলিশ সূত্র মতে, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে একের পর এক যেসব তথ্য মিলছে, তাতে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ছোট ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুর সম্পৃক্ততার ইঙ্গিতটাও জোরালো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মন্ত্রীর সরাসরি জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ না মিললেও হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা বা পরামর্শের সঙ্গে তিনি জড়িত বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তদন্তে এসব তথ্যকেও গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মতিন সরকার নরসিংদী শহরের দত্তপাড়া (বেপারীপাড়া) এলাকার বাসিন্দা। লোকমান হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি মতিন সরকার তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য এলাকায় 'বেপরোয়া লীগ' নেতা হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। তিনি লোকমান হোসেনের আগে পর পর দুইবার নরসিংদী পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৪ সালে ও চলতি বছর পৌর নির্বাচনে লোকমানের সঙ্গে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন তিনি। মতিন সরকার পৌর চেয়ারম্যান থাকাকালীন নরসিংদী শহর সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, জমি দখল, খুন, ধর্ষণসহ মাদকের রাজ্যে পরিণত হয়েছিল।
শুধু মতিন সরকারের নিজ এলাকা বেপারিপাড়ায় ছিল ২০টির বেশি মাদকের স্পট। সারা শহরে ছিল দুই শতাধিক মাদকের আস্তানা। ওইসব আস্তানা থেকে মাসে লাখ লাখ টাকা মাসোহারা পেতেন মতিন সরকার ও তাঁর ছোট ভাই আশরাফ সরকার।
নরসিংদীর রাঙ্গামাইট্যা এলাকার পাওয়ারলুম কারখানার ইলেকট্রিশিয়ান সাইদুর রহমান বলেন, '১৯৯৯ সালে মদ খাইয়া একরাতে যেই শহরে শতাধিক লোক প্রাণ হারাতে পারে, সেই শহর সম্পর্কে মানুষকে বেশি কিছু বুঝাতে হবে না। মতিন সরকারের যুগ আইয়ামে জাহিলিয়াতকেও হার মানিয়েছিল। ওই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সাধারণ মানুষ জেলা ছাত্রলীগ নেতা লোকমান হোসেনকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করে।' জাবেদ খন্দকার নামের স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, নির্বাচনে পরাজিত হওয়া এবং মাদকের স্পট বন্ধ, বেপারিপাড়ার ক্ষমতা খর্ব_এসব থেকেই আবদুল মতিন সরকার ও আশরাফ সরকারের সঙ্গে লোকমানের দ্বন্দ্ব ব্যাপক বিস্তার লাভ করেন।
একাধিক সূত্র মতে, মতিন সরকার শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসীদের গডফাদার ছিলেন। দেশে প্রথমবারের মতো রকেট লঞ্চারসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়া দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী রিপন সরকার, পুলিশের তালিকাভুক্ত চিহ্নিত অস্ত্র ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের গডফাদার তৌহিদুল সরকার, পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত সন্ত্রাসী নূরা, প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত সন্ত্রাসী বিপ্লবসহ অনেক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীই একসময় মতিন সরকারের ক্যাডার হিসেবে কাজ করত।
মামলার বাদী কামরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'লোকমান হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আবদুল মতিন সরকার। নির্বাচনে পরাজিত হয়েই সে আমার ভাইকে হত্যার জন্য সন্ত্রাসী ভাড়া করে বিভিন্ন সময় চেষ্টা চালায়। আমার ভাই শহরে জনপ্রিয় হওয়ার কারণে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীরা হত্যার মিশনের কথা ভাইকে আগাম জানিয়ে দিতেন। মতিন সরকারের সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমার ভাই অনেক চেষ্টা করলেও বেঁেচ থাকতে পারেননি।'
লোকমানের স্ত্রী তামান্না নুশরাত বুবলি বেগম বলেন, বেপারিপাড়ার সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট তাঁর স্বামীকে ঘায়েল করতে না পেরে হাত মেলায় লোকমানের বিরোধী গ্রুপ ঘাতকদের অন্যতম মোবারক হোসেন মোবা, কবির সরকার, তারেক আহামেদ, নুরুল ইসলামদের সঙ্গে। লোকমানকে হত্যার জন্য দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করে এই সিন্ডিকেট। অবশেষে হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেই মোবা, কবির ও নুরুল পারি জমায় মালয়েশিয়ায়।
আমাদের নরসিংদী প্রতিনিধি সুমন বর্মণ জানান, মতিন সরকারকে গ্রেপ্তার করার খবরটি গতকাল সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত নিশ্চিত করেননি নরসিংদীর পুলিশ সুপার খ. মুহিদ উদ্দিন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মতিন সরকার গ্রেপ্তার হয়েছে_এমন সংবাদ আমাদের কাছে নেই।' তবে তাঁরাও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তাঁর গ্রেপ্তারের খবর পেয়েছেন বলে জানান।
এদিকে লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার মো. সেলিমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফের চার দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। টানা চার দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর গতকাল বৃহস্পতিবার সেলিমকে আরো পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নরসিংদী গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ মণ্ডল। শুনানি শেষে নরসিংদীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হাকিম নিতাই চন্দ্র সাহা চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
লোকমানের স্ত্রী তামান্না এবং তাঁর ছোট ভাই ও মামলার বাদী কামরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশ বা তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যা-ই বলুক না কেন, তাঁরা নিশ্চিত, এই হত্যাকাণ্ডে মন্ত্রী রাজুর ভাই বাচ্চু ও তাঁর সহযোগী মতিন সরকারসহ এজাহারভুক্ত প্রত্যেক আসামিই জড়িত। এর বাইরে আর কেউ জড়িত থাকলে সেটা পুলিশের তদন্তে বের হয়ে আসবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার কয়েকজন আয়ামী লীগ নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকাশ্যে তাঁদের পক্ষে রাজু ও তাঁর ভাই বাচ্চুর ব্যাপারে কথা বলার সাহস নেই। তবে এটা সত্য যে ঘটনার পর আওয়ামী লীগের যে অংশ মন্ত্রী ও বাচ্চুর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল সেই অংশটাও ক্রমে ছোট হয়ে আসছে।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, ঘটনার সঙ্গে মন্ত্রী ও তাঁর ভাইয়ের নাম চলে আসায় তাঁদেরকে অনেক কিছু বিবেচনা করে এগোতে হচ্ছে। তবে মন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন বাচ্চু, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব মাসুদুর রহমান মুরাদ এবং শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোন্তাজ উদ্দিন ভূঁইয়ার সম্পৃক্ততার বিষয়ে অনেক জোরালো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। তাঁদের গ্রেপ্তার করাটা এখন জরুরি। ইতিমধ্যেই তাঁদের গ্রেপ্তারের জন্য একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু তাঁরা গা ঢাকা দিয়েছেন। পুলিশ বলছে, তাঁরা যেদিন উচ্চ আদালতে জামিন আনতে গিয়ে ব্যর্থ হন, সেদিনই গ্রেপ্তারের ব্যাপারে পুলিশের পূর্ণ প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সবুজ সংকেত না পাওয়ার কারণে সেদিন তাঁদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তাঁদের গ্রেপ্তার করা হলে এখন এই জটিল অবস্থার সৃষ্টি হতো না বলেও পুলিশ মনে করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদর দপ্তরে কর্তব্যরত একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, তদন্তে ব্যাপক অগ্রগতি আসায় তাঁরা পুরো বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক শীর্ষ মহলের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। কয়েকজন সংসদ সদস্যসহ ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন সিনিয়র রাজনীতিবিদ এর আগে এই মামলার তদন্তে কিছুটা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু এখন সেই অবস্থা আর আগের মতো জোরালো নেই। শীর্ষ মহল থেকেও পুলিশকে স্বাভাবিক গতিতে এগোতে বলা হয়েছে। তবে সন্দেহের বসে অহেতুক যাতে করে কোনো রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হয়রানি না করা হয়, সে ব্যাপারেও পুলিশকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, ভাড়াটে খুনি দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হলেও এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই ধূর্ত প্রকৃতির। তাঁরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে পুলিশকে বিভ্রান্ত করা ছাড়াও মামলার মেরিট নষ্ট করতে পারেন। ফলে এই হত্যা পরিকল্পনায় কারা কারা ছিল সে ব্যাপারে পাওয়া তথ্য সম্পর্কে অধিকতর নিশ্চিত হতে হচ্ছে পুলিশকে। পাশাপাশি খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে, পরিকল্পনাটি কবে ও কোথায় করা হয়।
এই হত্যা মামলার অন্যতম আসামি শহর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মোবারক হোসেন মোবা, সদর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম এবং শহর যুবলীগ নেতা কবীর সরকার মালয়েশিয়ায় রয়েছে। তারা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার কয়েক দিন আগেই মালয়েশিয়া চলে যায়। তারাও এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। এ ছাড়া অপর আসামি বিএনপির স্থানীয় নেতা তারেক আহমেদও হজ করতে সৌদি আরব গেছেন।
গত ১ নভেম্বর রাতে সন্ত্রাসীর গুলিতে প্রাণ হারান নরসিংদীর মেয়র লোকমান হোসেন। এ ঘটনায় নিহত মেয়রের ছোট ভাই কামরুজ্জামান বাদী হয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ছোট ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে প্রধান আসামি করে ১৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আশরাফ হোসেন সরকার, হাজি সেলিম ও টিপ্পন কাজী নামের দুজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা পুলিশ।
সেলিম মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মোবারক হোসেনের ভাতিজি জামাই। লোকমান হত্যাকাণ্ডে যে মোটরসাইকেলটি ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তা সেলিমের। হত্যাকাণ্ডের ১১ দিন পর গত ১২ নভেম্বর গাজীপুরের টঙ্গী থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত সেলিমসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া গ্রেপ্তারকৃত অপর আসামি টিপ্পন কাজী ও আশরাফ সরকারকেও জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। টিপ্পন কাজী একজন পেশাদার সন্ত্রাসী ও ভাড়াটে খুনি। সে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকারও করেছে।
No comments