পবিত্র হজ-ঐক্যের স্থান আরাফাতের ময়দান
হজের মাসে তিনটি ফরজ রয়েছে, যেমন_ইহরাম বাঁধা, আরাফাতের ময়দানে ৯ জিলহজ অবস্থান করা ও তাওয়াফে জিয়ারত করা। এ তিনটি ফরজের মধ্যে বড় ফরজ ৯ জিলহজ সারা দিন আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। পবিত্র কাবাঘরকে কেন্দ্র করে হজ হয়। কাবাঘর আল্লাহপাক নির্মাণই করেছিলেন দুনিয়ার হজ পালনকারীদের দেখার সুযোগ-সুবিধার জন্য, হজের মূল কেন্দ্রই কাবাঘর। অথচ কাবা শরিফে তাওয়াফ করা সবচেয়ে বড় ফরজ ধার্য করা হয়নি।
হজের সবচেয়ে বড় ফরজ ধার্য করা হয়েছে কাবাঘর থেকে প্রায় ৯ মাইল দূরে, আরাফাতের ময়দানে জিলহজ মাসের ৯ তারিখ সারা দিন অবস্থান করাকে। মুফাসসিরিনে কেরাম লিখেছেন, এর একটি বিশেষ রহস্য হলো_আল্লাহপাক মানুষ সৃষ্টি করার পর মানুষকে দুনিয়ায় পাঠানোর আগেই আল্লাহর কুদরতি হাতে আদম (আ.)-এর পিঠ বুলিয়ে দিয়ে সব মানুষকে ছোট আকারে বের করে একটি ময়দানে দাঁড় করিয়ে প্রশ্নোত্তর আকারে একটি সবক পড়িয়েছিলেন, আর সবকটি ছিল_'আলাস্তু বিরাবি্বকুম'_আমি কি তোমাদের রব নই অর্থাৎ তোমাদের সব চাহিদা পূরণের মালিক কি আমি আল্লাহ নই? তখন আদম (আ.)-এর সব সন্তান বলেছিল, হ্যাঁ, আপনিই আমাদের সব চাহিদা পূরণের একমাত্র মালিক। সুতরাং যে ময়দানে দাঁড় করিয়ে আল্লাহপাক এই সবক পড়িয়েছিলেন, সেই ময়দানটার নামই আরাফাতের ময়দান। আরেক রহস্য হলো, এই অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের প্রয়োজনে, মুসলিম জাতির হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের তাগিদে, ইসলাম ও মুসলিম জাতির শান-শওকত ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য মুসলিম বিশ্বের ঐক্য পূর্বশর্ত। মুসলিম বিশ্বে ঐক্য স্থাপনের জন্য গোটা মুসলিম বিশ্বের একটি বিশ্বসম্মেলনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য সত্য। তবে এই বিশ্বসম্মেলন হতে হবে এমন এক স্থানে, যেখানে শুধু এক আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী, প্রিয় নবী (সা.)-এর অনুসারী, এক কোরআনের অনুগামী মুসলিম চিন্তাবিদরাই থাকবেন। কী আশ্চর্য! এই কাজও আল্লাহপাক সহজ করে দিয়েছেন হজের মাধ্যমে। হজের মৌসুমে সারা পৃথিবীর প্রতিনিধিরা ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে সমবেত হয়ে থাকেন। উল্লেখ্য, এখানেই জান্নাত থেকে বিচ্ছেদের পর সৃষ্টির প্রথম মানুষ হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.)-এর পুনর্মিলন হয়েছিল, তাঁরা একে অন্যের পরিচয় পেয়েছিলেন এখানেই, এ জন্যই এর নামকরণ করা হয়েছে আরাফাত। দিগন্তব্যাপী মরুভূমির এই ময়দান আরাফাতে যেন সারা বিশ্বের সব মুসলিম সমবেত হলেও আরাফাতের বক্ষে অভাব হবে না স্থানের। আল্লাহপাক কর্তৃক অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক পন্থায় আহূত এই বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনের মাধ্যমে মুসলিম জাতির ঐক্য স্থাপন করা সম্ভব হতে পারে। মুসলিম বিশ্বের যাবতীয় বিবাদ-বিসংবাদ দূরীভূত করে এক-চতুর্থাংশ যখন মুসলমানদের করতলগত ছিল, হজরত ওমর (রা.)-এর মতো মহামনীষীরা যখন মুসলিম জাতির নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তখন এই আরাফাতের ময়দানেই মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান করা হতো। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! মুসলিম জাতির ভাগ্যের বিপর্যয় ঘটেছে। তারা আল্লাহপাক ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর মহান শিক্ষা বিস্মৃত হয়েছে, আত্মবিস্মৃত হয়েছে, সুদিনের স্থলে তাই দুর্দিন এসেছে। আজও আরাফাতের ময়দানে সারা দুনিয়ার মুসলমান একত্রিত হয়; কিন্তু একে অন্যের সঙ্গে মনের কপাট খুলে মেশে না, তদুপরি যাঁরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান পেশ করতে পারেন, তাঁরা বড় বেশি এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে উপস্থিত হন না। ফলে বিশ্বমুসলিমের ঐক্য স্থাপিত হয় না বলে হজের একটা বিরাট উদ্দেশ্যই এভাবে ব্যাহত হয়। আল্লাহপাক মুসলিম বিশ্বের ইসলামী চিন্তাবিদদের সজাগ ও জাগ্রত হওয়ার তাওফিক দান করে আমাদেরও শরিক হওয়ার সামর্থ্য দান করুন। আমীন।
মুফতী আইনুল ইসলাম কান্ধলবী
মুফতী আইনুল ইসলাম কান্ধলবী
No comments