কোন এক সন্ধিক্ষণে by আল মাহমুদ
মৃত্যু আমার কাছে কোনো ভয়ঙ্কর কিছু নয় বলে মনে হয়। একটা কথা আছে_ 'জন্মিলে মরিতে হবে/অমর সে কোথা কবে'। মৃত্যুর আগ মুহূর্তের সংকটাপন্ন মুমূর্ষু অবস্থার কথা বলার জন্যই এই লেখার অবতারণা। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তা মাথায় এলে আমি নিরুত্তর হয়ে পড়ি। কেননা আমরা সবাই মৃত্যুর অধীন এবং এর পর কী আছে সে সম্পর্কের কিছুই জানি না। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মরণের ভেতর কী আছে তা জানতে আগ্রহী।
এ মুহূর্তে আমার নিজের লেখা কবিতার কয়েকটি লাইন মনে পড়ছে_
'অনিচ্ছায় কতকাল মেলে রাখি দৃশ্যপায়ী তৃষ্ণার লোচন
ক্লান্ত হয়ে আসে সব, নিসর্গও ঝরে যায় বহু দূর অতল আঁধারে
আর কী থাকলো তবে হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন
আমার কাফন আমি চাদরের মতো পরে কতদিন আন্দোলিত হবো
কতকাল কত যুগ ধরে'
কালে কালে অনেক সময়ই তো বয়ে গেল। সহ্য-অসহ্য বহু কিছু দেখতে দেখতে এই পর্যন্ত এসেছি। আমি অতীত নিয়ে ভাবি না। কিন্তু লিখতে গেলে মাঝে মধ্যে অতীতকে ঘুরিয়ে ধরতে হয়। কী কী ফেলে রেখে চলে এসেছি তা ভাবলে অনেক সময় চিত্ত বিমর্ষ হয়ে পড়ে। আর সেটাই হয় অন্তর্জ্বালার কারণ। মানুষ তো আর ফিরে যায় না। না অতীতে, না ভবিষ্যতে। কারণ ভবিষ্যৎ হলো অজ্ঞাত রহস্যের আধার। সব যোগ-বিয়োগ হয়ে মানুষের হাতে থাকে কেবল বর্তমান। আর বর্তমানকে ঘিরে রাখে স্মৃতি। সেই স্মৃতি দুঃখের কিংবা সুখের।
লিখতে বসেছি মুমূর্ষুর বিছনার কিনারে এই শিরোনামে। মুমূর্ষুর কথা মনে করলে মৃত্যু অবধারিতভাবে চলে আসে। অনেক আত্মীয়-স্বজন, আপনজনের শেষ অবস্থা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা কমবেশি আমার আছে। আমি দেখেছি তারা মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছেন। নিরুপায় আমি পাশে বসে এ দৃশ্য দেখে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছি। মৃত্যুর সামনে আমরা আর কথা বলতে পারি না। নির্বাক নীরব থেকে কেবল মৃত্যুর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করাই যেন মানুষের নিয়তি। কিছু রহস্য আছে, যা কোনোদিন উদঘাটিত হয় না। মৃত্যুও তেমনি একটি ব্যাপার।
বয়স আর শারীরিক অসুস্থতার কারণে এখন অনেক কিছুই মনে নেই আমার। স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে পাই অতল অন্ধকার, শূন্যতা। শিশুর আধো আধো বুলির মতো আমিও ভাঙা ভাঙা স্মৃতির সহযোগিতায় কিছু কথা বলব। আমার স্ত্রী সৈয়দা নাদিরা মাহমুদ। তার জীবনাবসানের শেষ সময় আমি পাশে ছিলাম। অনেক কাছ থেকে দেখেছি এই মুহূর্তগুলো। তার মৃত্যু আমাকে সবচেয়ে বেশি আকুল করে। কেননা তিনি আমার সংসারকে নিজের চেয়ে আপন করে আগলে রেখেছিলেন। কোনো প্রকার সাংসারিক ঝামেলা আমাকে অনুভব করতে হয়নি। সাহিত্যের মধ্যে নিমজ্জনে কোনো বেগ পেতে হয়নি আমাকে। নিজের মধ্যেই নিজের অবস্থান ছিল। তার মৃত্যুতে সে ঘোরটি ভেঙে যায় আমার। নাদিরার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। শ্বাস নিতে এবং খাদ্য গ্রহণে মারাত্মক সমস্যা হতো। তার কষ্টের কথা মনে পড়লে আমি এখনও অসহায় বোধ করি। যে মানুষ জেনে যায় তার মৃত্যু নিশ্চিত, তাকে সাহস আর ভরসা দেওয়া অমূলক। কারণ বিদায় ঘণ্টা যে তিনি শুনতে পান নিজ কানে। আমার স্ত্রীর অসুস্থতার সময় আমি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছি। চাইলেও তা পারতাম না। কারণ সত্য-মিথ্যার ভেদ মুছে গিয়ে মৃত্যুই যে একমাত্র পরিণতি_ এ কথা দু'পক্ষেরই জানা। আমার যদ্দুর মনে পড়ে, নাদিরা মৃত্যুর ঠিক আগে কী যেন একটা খাচ্ছিলেন। এ সময় হঠাৎ তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে এবং শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছিল জানিয়ে সহসাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তারপর অনেক কিছু করেও তার বুজে যাওয়া চোখ খোলা যায়নি। আমি এ অবস্থা দেখে এতই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, তারপর বেশ কিছুদিন আর কথা বলতে পারিনি। মাঝে মধ্যে মনে হয় না ফেরার দেশে চলে যাওয়া বোধ হয় সহজ কিন্তু আশপাশের সবার সে দৃশ্য ও অবস্থা হজম করা অনেক বেশি কঠিন। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল।
মৃত্যু সর্বদাই এক গোলক ধাঁধা। এই আছে, এই নাই অবস্থা। যে মানুষটি জীবিত এখন, পরমুহূর্তেই তিনি নিথর, প্রাণহীন। পৃথিবীর আলো-বাতাস শোষণ করে যে বেঁচে ছিল এতকাল, কখনও সে আর পারবে না এই রস আস্বাদন করতে। ভাবতেই অবাক হয়ে যাই। আমার সমবয়সী অনেক কবিবন্ধু, সাহিত্যিক, বন্ধুবান্ধব গত হয়ে গেছেন। যাদের সঙ্গে এক সময় তুমুল আড্ডা আর কবিতার উন্মাদনায় বুঁদ হয়ে থেকে ছিলাম। ভাবতে অবাক লাগে, আজ আমি বেঁচে আছি কিন্তু তারা অনেকেই নেই। যারা আছেন তারাও আমার মতো শেষ ডাকের অপেক্ষায়।
আমার মায়ের মৃত্যুর সময় আমি পাশে থাকতে পারিনি। তিনি গত হয়েছেন প্রায় এক যুগ আগে। তার শেষ অবস্থার আগে আমি ছিলাম ঢাকায়। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। খবর শুনে আমি ছুটে গিয়েছিলাম। মায়ের স্থির, নির্বাক মুখ দেখে আমি তখন কিছুই ভাবতে পারিনি। অনেক স্মৃতি আর ব্যথা-বেদনা মনের মাঝে হানা দিয়েছে চোরা স্রোতের মতো।
মুমূর্ষু অবস্থায় কিংবা মৃত্যুর আগে মানুষ কী ভাবে? আমি ভেবে পাই না। আমি যখন অসুস্থ থাকি স্মৃতি রোমন্থনের চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। অনেক পরিচিত মুখ পানকৌড়ির মতো হঠাৎ ডুব দিয়ে হারিয়ে যায়। দুঃখ হয় পেছনের কথা স্মরণ করে। স্মৃতির প্রতারণায় আমি প্রায় কাবু। অনেক কিছুই মনে নেই। অস্পষ্ট, ঘোলা লাগে সব কিছু। তাই কিছু লিখতে গেলে এলোমেলো হয়ে যাই। প্রিয় মানুষ মৃত্যুকষ্টে ছটফট করছে, প্রাণ তার ওষ্ঠাগত_ এ দুঃসহ দৃশ্য ইচ্ছা করেই ভুলে যেতে চাই। কারণ এই পথ ধরে আমাদের সবাইকেই একদিন হেঁটে যেতে হবে। হয়তো সেখানে অপেক্ষায় আছে অনন্তকাল কিংবা আরেক জগৎ।
মুমূর্ষুর কথা বলতে গেলে আমার স্ত্রীর কথাই মনে পড়ে বারবার। মৃত্যুর কিছু দিন আগে তাকে দেখেছি তিনি কিছু ভাবছেন এবং মৃদু মৃদু হাসছেন। আমি জিজ্ঞেস করলে বলতেন_ 'তোমার কী গতি হবে সেটা ভেবে মাঝেমধ্যে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু আবার ভাবি, তুমি পুরুষ মানুষ, একাকী থাকতে ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে এবং আমার ধারণা ভালোই থাকবে।' তার ভবিষ্যদ্বাণীটা মিথ্যেও হয়নি। আমি আছি, ভালোই আছি। এর মধ্যে দৃষ্টিশক্তির অধঃপতন হয়েছে আরও। চোখে দেখেও চেহারা চিনতে পারি না। হাত দিয়ে স্পর্শ করলে খানিকটা বুঝতে পারি। কিন্তু একটি ঘর্মাক্ত হাত ছাড়া আর কিছুই আবিষ্কার করতে পারি না। শুধু মনে হয় আমি একা। অনন্তকাল একাই ছিলাম। ভবিষ্যতও একাকী অনুভূতির মায়াজাল বিস্তার করে রেখেছে। আমার এখন যে বয়স ও সময়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি, এ সময়ে মানুষ আপনজন খোঁজে। আমিও খুঁজি। কিন্তু কেবলই মনে হয় আমার কোনো আপনজন ছিল না। পরও ছিল না, অপরও ছিল না। তবে ঘর্মাক্ত একটি হাতের ছোঁয়া আজও পাই। সে হাত আমার স্ত্রীর হাত। যখনই ভাবি অদৃশ্য থেকে তার হাসির শব্দ শুনতে পাই। 'কেমন আছ?' জিজ্ঞেস করলে আমি জবাব দিই না। কারণ সবার সঙ্গে মিথ্যা বলতে পারলেও তার সঙ্গে মিথ্যা বলে পার পাওয়া যায় না। তাই আমি নির্বাক থাকি। স্মৃতির গভীর থেকে তার ডাক শুনেও না শোনার ভান করি। কিন্তু আমি নিশ্চিত, খুব সহসাই হয়তো সমস্ত অনিশ্চিয়তার প্রশ্ন-উত্তর খুঁজে নিতে আমাকে তার ডাকে সাড়া দিতে হবে। আমি যেভাবে বসেছি আপন মুমূর্ষুজনের বিছানার পাশে, আমার বিছানার পাশেও এসে বসবে কেউ কেউ। তারাও হয়তো বোঝার চেষ্টা করবে আমার মনে কী চলছে। আমি কী ভাবছি। আমি জানি না অদৃষ্টে কী লেখা আছে। মৃত্যুর কথা তাই প্রতিনিয়ত ভাবি। একদিন অকস্মাৎ মৃত্যুর সম্মুখীন হবো। জানি না, কী ঘটবে তখন। কী পরিস্থিতিতে কোথায় কখন আমার মৃত্যু হবে তা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। া
'অনিচ্ছায় কতকাল মেলে রাখি দৃশ্যপায়ী তৃষ্ণার লোচন
ক্লান্ত হয়ে আসে সব, নিসর্গও ঝরে যায় বহু দূর অতল আঁধারে
আর কী থাকলো তবে হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন
আমার কাফন আমি চাদরের মতো পরে কতদিন আন্দোলিত হবো
কতকাল কত যুগ ধরে'
কালে কালে অনেক সময়ই তো বয়ে গেল। সহ্য-অসহ্য বহু কিছু দেখতে দেখতে এই পর্যন্ত এসেছি। আমি অতীত নিয়ে ভাবি না। কিন্তু লিখতে গেলে মাঝে মধ্যে অতীতকে ঘুরিয়ে ধরতে হয়। কী কী ফেলে রেখে চলে এসেছি তা ভাবলে অনেক সময় চিত্ত বিমর্ষ হয়ে পড়ে। আর সেটাই হয় অন্তর্জ্বালার কারণ। মানুষ তো আর ফিরে যায় না। না অতীতে, না ভবিষ্যতে। কারণ ভবিষ্যৎ হলো অজ্ঞাত রহস্যের আধার। সব যোগ-বিয়োগ হয়ে মানুষের হাতে থাকে কেবল বর্তমান। আর বর্তমানকে ঘিরে রাখে স্মৃতি। সেই স্মৃতি দুঃখের কিংবা সুখের।
লিখতে বসেছি মুমূর্ষুর বিছনার কিনারে এই শিরোনামে। মুমূর্ষুর কথা মনে করলে মৃত্যু অবধারিতভাবে চলে আসে। অনেক আত্মীয়-স্বজন, আপনজনের শেষ অবস্থা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা কমবেশি আমার আছে। আমি দেখেছি তারা মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছেন। নিরুপায় আমি পাশে বসে এ দৃশ্য দেখে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছি। মৃত্যুর সামনে আমরা আর কথা বলতে পারি না। নির্বাক নীরব থেকে কেবল মৃত্যুর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করাই যেন মানুষের নিয়তি। কিছু রহস্য আছে, যা কোনোদিন উদঘাটিত হয় না। মৃত্যুও তেমনি একটি ব্যাপার।
বয়স আর শারীরিক অসুস্থতার কারণে এখন অনেক কিছুই মনে নেই আমার। স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে পাই অতল অন্ধকার, শূন্যতা। শিশুর আধো আধো বুলির মতো আমিও ভাঙা ভাঙা স্মৃতির সহযোগিতায় কিছু কথা বলব। আমার স্ত্রী সৈয়দা নাদিরা মাহমুদ। তার জীবনাবসানের শেষ সময় আমি পাশে ছিলাম। অনেক কাছ থেকে দেখেছি এই মুহূর্তগুলো। তার মৃত্যু আমাকে সবচেয়ে বেশি আকুল করে। কেননা তিনি আমার সংসারকে নিজের চেয়ে আপন করে আগলে রেখেছিলেন। কোনো প্রকার সাংসারিক ঝামেলা আমাকে অনুভব করতে হয়নি। সাহিত্যের মধ্যে নিমজ্জনে কোনো বেগ পেতে হয়নি আমাকে। নিজের মধ্যেই নিজের অবস্থান ছিল। তার মৃত্যুতে সে ঘোরটি ভেঙে যায় আমার। নাদিরার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। শ্বাস নিতে এবং খাদ্য গ্রহণে মারাত্মক সমস্যা হতো। তার কষ্টের কথা মনে পড়লে আমি এখনও অসহায় বোধ করি। যে মানুষ জেনে যায় তার মৃত্যু নিশ্চিত, তাকে সাহস আর ভরসা দেওয়া অমূলক। কারণ বিদায় ঘণ্টা যে তিনি শুনতে পান নিজ কানে। আমার স্ত্রীর অসুস্থতার সময় আমি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছি। চাইলেও তা পারতাম না। কারণ সত্য-মিথ্যার ভেদ মুছে গিয়ে মৃত্যুই যে একমাত্র পরিণতি_ এ কথা দু'পক্ষেরই জানা। আমার যদ্দুর মনে পড়ে, নাদিরা মৃত্যুর ঠিক আগে কী যেন একটা খাচ্ছিলেন। এ সময় হঠাৎ তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে এবং শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছিল জানিয়ে সহসাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তারপর অনেক কিছু করেও তার বুজে যাওয়া চোখ খোলা যায়নি। আমি এ অবস্থা দেখে এতই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, তারপর বেশ কিছুদিন আর কথা বলতে পারিনি। মাঝে মধ্যে মনে হয় না ফেরার দেশে চলে যাওয়া বোধ হয় সহজ কিন্তু আশপাশের সবার সে দৃশ্য ও অবস্থা হজম করা অনেক বেশি কঠিন। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল।
মৃত্যু সর্বদাই এক গোলক ধাঁধা। এই আছে, এই নাই অবস্থা। যে মানুষটি জীবিত এখন, পরমুহূর্তেই তিনি নিথর, প্রাণহীন। পৃথিবীর আলো-বাতাস শোষণ করে যে বেঁচে ছিল এতকাল, কখনও সে আর পারবে না এই রস আস্বাদন করতে। ভাবতেই অবাক হয়ে যাই। আমার সমবয়সী অনেক কবিবন্ধু, সাহিত্যিক, বন্ধুবান্ধব গত হয়ে গেছেন। যাদের সঙ্গে এক সময় তুমুল আড্ডা আর কবিতার উন্মাদনায় বুঁদ হয়ে থেকে ছিলাম। ভাবতে অবাক লাগে, আজ আমি বেঁচে আছি কিন্তু তারা অনেকেই নেই। যারা আছেন তারাও আমার মতো শেষ ডাকের অপেক্ষায়।
আমার মায়ের মৃত্যুর সময় আমি পাশে থাকতে পারিনি। তিনি গত হয়েছেন প্রায় এক যুগ আগে। তার শেষ অবস্থার আগে আমি ছিলাম ঢাকায়। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। খবর শুনে আমি ছুটে গিয়েছিলাম। মায়ের স্থির, নির্বাক মুখ দেখে আমি তখন কিছুই ভাবতে পারিনি। অনেক স্মৃতি আর ব্যথা-বেদনা মনের মাঝে হানা দিয়েছে চোরা স্রোতের মতো।
মুমূর্ষু অবস্থায় কিংবা মৃত্যুর আগে মানুষ কী ভাবে? আমি ভেবে পাই না। আমি যখন অসুস্থ থাকি স্মৃতি রোমন্থনের চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। অনেক পরিচিত মুখ পানকৌড়ির মতো হঠাৎ ডুব দিয়ে হারিয়ে যায়। দুঃখ হয় পেছনের কথা স্মরণ করে। স্মৃতির প্রতারণায় আমি প্রায় কাবু। অনেক কিছুই মনে নেই। অস্পষ্ট, ঘোলা লাগে সব কিছু। তাই কিছু লিখতে গেলে এলোমেলো হয়ে যাই। প্রিয় মানুষ মৃত্যুকষ্টে ছটফট করছে, প্রাণ তার ওষ্ঠাগত_ এ দুঃসহ দৃশ্য ইচ্ছা করেই ভুলে যেতে চাই। কারণ এই পথ ধরে আমাদের সবাইকেই একদিন হেঁটে যেতে হবে। হয়তো সেখানে অপেক্ষায় আছে অনন্তকাল কিংবা আরেক জগৎ।
মুমূর্ষুর কথা বলতে গেলে আমার স্ত্রীর কথাই মনে পড়ে বারবার। মৃত্যুর কিছু দিন আগে তাকে দেখেছি তিনি কিছু ভাবছেন এবং মৃদু মৃদু হাসছেন। আমি জিজ্ঞেস করলে বলতেন_ 'তোমার কী গতি হবে সেটা ভেবে মাঝেমধ্যে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু আবার ভাবি, তুমি পুরুষ মানুষ, একাকী থাকতে ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে এবং আমার ধারণা ভালোই থাকবে।' তার ভবিষ্যদ্বাণীটা মিথ্যেও হয়নি। আমি আছি, ভালোই আছি। এর মধ্যে দৃষ্টিশক্তির অধঃপতন হয়েছে আরও। চোখে দেখেও চেহারা চিনতে পারি না। হাত দিয়ে স্পর্শ করলে খানিকটা বুঝতে পারি। কিন্তু একটি ঘর্মাক্ত হাত ছাড়া আর কিছুই আবিষ্কার করতে পারি না। শুধু মনে হয় আমি একা। অনন্তকাল একাই ছিলাম। ভবিষ্যতও একাকী অনুভূতির মায়াজাল বিস্তার করে রেখেছে। আমার এখন যে বয়স ও সময়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি, এ সময়ে মানুষ আপনজন খোঁজে। আমিও খুঁজি। কিন্তু কেবলই মনে হয় আমার কোনো আপনজন ছিল না। পরও ছিল না, অপরও ছিল না। তবে ঘর্মাক্ত একটি হাতের ছোঁয়া আজও পাই। সে হাত আমার স্ত্রীর হাত। যখনই ভাবি অদৃশ্য থেকে তার হাসির শব্দ শুনতে পাই। 'কেমন আছ?' জিজ্ঞেস করলে আমি জবাব দিই না। কারণ সবার সঙ্গে মিথ্যা বলতে পারলেও তার সঙ্গে মিথ্যা বলে পার পাওয়া যায় না। তাই আমি নির্বাক থাকি। স্মৃতির গভীর থেকে তার ডাক শুনেও না শোনার ভান করি। কিন্তু আমি নিশ্চিত, খুব সহসাই হয়তো সমস্ত অনিশ্চিয়তার প্রশ্ন-উত্তর খুঁজে নিতে আমাকে তার ডাকে সাড়া দিতে হবে। আমি যেভাবে বসেছি আপন মুমূর্ষুজনের বিছানার পাশে, আমার বিছানার পাশেও এসে বসবে কেউ কেউ। তারাও হয়তো বোঝার চেষ্টা করবে আমার মনে কী চলছে। আমি কী ভাবছি। আমি জানি না অদৃষ্টে কী লেখা আছে। মৃত্যুর কথা তাই প্রতিনিয়ত ভাবি। একদিন অকস্মাৎ মৃত্যুর সম্মুখীন হবো। জানি না, কী ঘটবে তখন। কী পরিস্থিতিতে কোথায় কখন আমার মৃত্যু হবে তা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। া
No comments