বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-জাতীয় সংসদে গরহাজির মন্ত্রীদের নিয়ে কথা by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

৭ অক্টোবর, ২০১১ জাতীয় সংসদ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল কিছু সংগত কারণেই। সংসদে সরকারি দলের সদস্যদের এই উত্তপ্ততা কুলক্ষণ নয়, অবশ্যই সুলক্ষণ বটে। এ জন্য সুলক্ষণ, এর মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হলো, সংসদে বিরোধী দলের সদস্যদের অনুপস্থিতির পরও জাতীয় সংসদ রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত হয়নি। সংসদ উত্তপ্ত হয়ে ওঠার বিষয়টি বিরোধী দলের কাছে নেতিবাচক রাজনীতির 'খোরাক' হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সচেতন মানুষদের তা আশান্বিত


করেছে। আশান্বিত করেছে এ কারণে, বিরোধী দল সংসদে অনুপস্থিত থাকলেও সরকারি দলের শুধু সদস্য নন, মন্ত্রীদেরও যা-তা করে পার পেয়ে যাওয়ার উপায় নেই_এটাই পরিষ্কার বোঝা গেল। গণতান্ত্রিক কিংবা সংসদীয় রাজনীতির এই পরিপুষ্টতা গণতন্ত্রের জন্য সুবার্তাও বটে। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সদস্যরা ঘোষণা দিয়েই অনুপস্থিত রয়েছেন, যদি সদস্যপদ রক্ষার বাধ্যবাধকতা না থাকত, তাহলে তাঁরা মাঝেমধ্যেও হয়তো জাতীয় সংসদে ফিরে যেতেন না। যদিও তাঁরা সংসদে অনুপস্থিত আছেন, কিন্তু সব রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগে তাঁদের কোনো অনীহা নেই এবং দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর অর্থ তাঁরা পকেটে পুরছেন দ্বিধা-সংকোচহীনভাবেই। এ ক্ষেত্রে তাঁদের দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা, রুচিবোধ ইত্যাদি সব কিছু নিয়েই প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক।
বিরোধী দলের সদস্যরা সংসদে যাচ্ছেন না কিংবা গেলেও সদস্যপদ রক্ষার জন্য যাচ্ছেন বা যাবেন_এ সবই জানা কথা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি দলের সদস্য বিশেষ করে মন্ত্রীদের সংসদে গরহাজির থাকার হেতুটা কী? প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, সরকারি দলের কোনো কোনো জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী সংসদে অনুপস্থিত থাকলেই তাঁরাও অনুপস্থিত থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁরা কি শুধু প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি পাওয়ার জন্যই সংসদে হাজির থাকেন, যাঁরা তাঁদের জনপ্রতিনিধি বানিয়ে সেখানে পাঠিয়েছেন তাঁদের অবজ্ঞা করে? এ প্রশ্নটি হালকাভাবে নেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। এমনটি অবশ্যই জবাবদিহিতার পাট চুকিয়ে ফেলার কুদৃষ্টান্ত। যাঁরা মন্ত্রীপদ অলংকৃত করে আছেন, তাঁদের অনেকেরই কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই। একটি গণতান্ত্রিক সরকারের একজন মন্ত্রীর দায়বদ্ধতা কতটুকু, এ সম্পর্কেও তাঁদের অনেককেই যথেষ্ট ওয়াকিবহাল বলে মনে হয় না। একজন মন্ত্রী অবশ্যই জাতীয় সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। কিন্তু সংসদে অনুপস্থিত থাকলে জবাবদিহিতার পাটটি তো এমনিতেই চুকে যায়। প্রশ্ন আছে উপদেষ্টাদের ভূমিকা নিয়েও। যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে আছেন, তাঁরা রাজনীতির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ না হলেও নিশ্চয়ই এটুকু বোঝার মতো মেধা ও প্রজ্ঞা তাঁদের রয়েছে, কতদূর পর্যন্ত তাঁরা হাত বাড়াতে কিংবা নাক গলাতে পারেন। তাঁরা মন্ত্রণালয়সহ নানা কাজে প্রায়শই হস্তক্ষেপ করেন, সীমানা ডিঙিয়ে নিজেরাই কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে নেন_এমন অভিযোগ খুব স্পষ্ট। কিন্তু তাঁরা নিশ্চয়ই এটুকুও বোঝেন, মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতার দাপট বিপদ ডেকে আনে এবং ক্ষমতা ক্ষমতার শত্রু-মিত্র দুই-ই হতে পারে। ২৭ অক্টোবর, ২০১১ যাঁরা সংসদে নানা কারণে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, তাঁরা ক্ষমতাসীন মহলের পোড় খাওয়া রাজনীতিক এবং জ্যেষ্ঠ সদস্য। তাঁদের যুক্তিসংগত ক্ষোভ আমলে না নিলে ক্ষতিটা কার হবে সে বিষয়টি নিশ্চয়ই দলের নীতিনির্ধারকরা ধারণা করতে পারেন।
যেসব সমস্যা নিয়ে ২৭ অক্টোবর, ২০১১ জাতীয় সংসদ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল, সে সমস্যাগুলো যে নতুন তাও নয়। আগেও এসব বিষয় নিয়ে টুকটাক আলোচনা হয়েছে এবং তা উপেক্ষিতই থেকে গেছে। এর ফল যে শুভ হয়নি, ২৭ অক্টোবর, ২০১১ সংসদ অধিবেশনে এরই পুনর্বার প্রমাণ মিলেছে। সেদিন প্যানেল স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরুও জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্যদের ক্ষোভের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তিনিও কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। বছরের পর বছর জাতীয় সংসদে জবাবদিহিতার জন্য মন্ত্রীদের অনেকেই সময়মতো হাজির থাকেন না। এমন নানা রকম পরিস্থিতি জিইয়ে রেখেই এই রক্তস্নাত বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি দীর্ঘকাল ধরে আমরা শুনে আসছি। স্ববিরোধী রাজনীতির এই বৃত্ত থেকে কেউই বেরিয়ে আসতে পারছেন না। সুশাসন নিশ্চিত করা এত সহজ কোনো বিষয় নয়। অস্বীকার করার উপায় নেই, সংসদের বাইরেও মন্ত্রীদের অনেক কাজ থাকে, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে সংসদকে উপেক্ষা করতে হবে। জাতীয় সংসদের অধিবেশন যখন চলে, তখন কী করে বাইরের কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে হয়, তা একজন মন্ত্রীর তো না বোঝার কথা নয়। সংসদের অধিবেশন তো সারা বছর চলে না; এমনকি সারা দিনও চলে না। জাতীয় সংসদকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার সদিচ্ছা যদি থাকে, তাহলে অধিবেশন চলাকালে সেখানে হাজির থেকেও অন্য কাজ সম্পাদন করা সম্ভব। কিন্তু কোনো কোনো মন্ত্রী যদি মনে করেন যে সংসদ, জনগণ_এসব পরের ব্যাপার, অন্য বিষয়গুলো আগে, তাহলে এটাই বুঝতে হবে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা করার জন্য তিনি বা তাঁরা মোটেই পরিপক্ব নন এবং সরকারের জন্য তাঁরা একপর্যায়ে বোঝা হয়ে উঠবেন, জনগণ দ্বারা পরিত্যাজ্য হবেন। সংসদীয় রাজনীতিতে মন্ত্রী এবং উপদেষ্টা উভয় ক্ষেত্রেই নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর। সংসদ কিংবা জনগণের কাছে উপদেষ্টাদের জবাবদিহিতার প্রয়োজন পড়ে না, কিন্তু মন্ত্রীদের বেলায় তা অপরিহার্য। জাতীয় সংসদে নিজ দলের সদস্য বা সরকারের সমালোচনা যেসব সদস্য করেছেন, সরকারকে তাঁরা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছেন_এমন ভাবনা অনেকেই ভাবতে পারেন। হয়তো তাঁরা এ দেশের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরণ করেছেন, কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য তাঁরা কল্যাণকর সেতু নির্মাণ করেছেন তা অস্বীকার করা কঠিন। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন বিদেশের বিভিন্ন মিশনে কর্মরত কূটনীতিকদের দায়িত্বহীন আচরণ এবং কর্তব্য পালনে উদাসীনতা নিয়েও। তাঁদের উত্থাপিত অভিযোগগুলোর মধ্যে যথেষ্ট সারবত্তা রয়েছে। জাতীয় সংসদকে জাতীয় উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র যদি বলা হয়, তাহলে সে প্রাণকেন্দ্রটিকে প্রাণবন্ত রাখার দায় তাঁদেরই, যাঁরা সেখানে বসার জন্য জনরায় পান।
লক্ষ করা যাচ্ছে, উপদেষ্টারা মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে উপস্থিত থাকেন। সংসদীয় রাজনীতিতে তা কোনোভাবেই বিধিসম্মত নয়। এটা রুলস অব বিজিনেসের পরিপন্থী। দেখা যাচ্ছে, দেশে এখন মন্ত্রী বনাম উপদেষ্টা_এই দ্বন্দ্বটি প্রকট হয়ে উঠছে, যা মোটেও শুভলক্ষণ নয়। আরো লক্ষ করা যাচ্ছে, মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাবে বিদ্ধ হচ্ছেন দেশের সাধারণ মানুষ। শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটেছে। দৃষ্টান্ত আরো দেওয়া যাবে। এ ছাড়া মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টাদের অতিকথনও উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে যদি পুষ্ট করা যেত, তাহলে নেতিবাচক এ সব কিছুরই অবসান ঘটত। অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর যোগ্যতা-দক্ষতা নিয়েও অহরহই প্রশ্ন উঠছে। অনেক ক্ষেত্রেই এও লক্ষ করা যাচ্ছে, সব কিছুই আসলে প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। একজন প্রধানমন্ত্রী তো দশভুজা নন যে তিনিই সব কিছু করবেন, দেখবেন। যদি তা-ই হয়, তাহলে এত সব মন্ত্রণালয় কিংবা মন্ত্রীরই দরকার কী? মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা কিংবা সংসদ সদস্য_যাঁরাই নেতিবাচক কর্মকাণ্ড চালাবেন, তাঁদের সমালোচনা করা মানে সরকারকে বিব্রত করা নয়; বরং গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এটিই স্বাভাবিক। দলের ভেতরে যদি সে সমালোচনা হয়, তবে তা দলের জন্যই মঙ্গলজনক এবং গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্র তাতে বিস্তৃত হয়। যাঁরা সমালোচনা করবেন, দোষত্রুটি ধরিয়ে দেবেন_উল্টো যদি তাঁদের ঘাড়ে দোষ চাপে, তাহলে তা খুব দুঃখজনক। এমন ঘটনা অতীতে ঘটেছে। সরকারকে সব সময় মনে রাখা দরকার, 'আমার সমালোচক আমার বন্ধু'। গঠনমূলক সমালোচনা আত্মশুদ্ধির পথ প্রশস্ত করে, এর মধ্য দিয়ে নিজেকে শুধরে নেওয়ার উপায় খুঁজে পাওয়া যায়। সহনশীলতা গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত, রাজনীতিকরা নিশ্চয়ই তা অস্বীকার করবেন না।
যার যত দায়িত্ব, তার দায়ও তত বেশি। দেশের মানুষের খুব সংগত প্রত্যাশা যে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নিয়মিত সংসদে হাজির থাকবেন, জনকল্যাণে শক্তিশালী কিংবা কার্যকর ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন, সমস্যা-সংকট চিহ্নিত করে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেবেন। মহাজোট সরকার ইতিমধ্যে পৌনে তিন বছর সময় অতিক্রান্ত করেছে। সরকার কী কী করতে পেরেছে আর কী কী করতে পারেনি এবং কেন পারেনি এর খোলামেলা ব্যাখ্যা দরকার। আগামী সোয়া দুই বছর তারা কী করতে চায় সেই পরিকল্পনাও জনগণকে জানানো জরুরি। সব সময় শুধু বিগত সরকারের ছিদ্র অন্বেষণ করে কথা বলতে থাকলে তা মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। মহাজোট সরকারের মনে রাখা উচিত, অন্য রকম প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ তাদের ভোট দিয়েছিল এবং এর সুফল তারা অবশ্যই চাইবে, হিসাব মেলাবে। বিরোধী দল যেসব অজুহাতে সংসদ বর্জন করে চলেছে, সেসব ষোল আনাই গ্রহণযোগ্য_এটাও মনে করার কোনো কারণ নেই। সংসদে উপস্থিত থেকে দায়িত্ব পালন করাটা তাঁদেরও দায়। সংসদে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না_তা বলে তো লাভ নেই, কারণ সচেতন মানুষ মাত্রই সব কিছু জানেন, বোঝেন এবং টেলিভিশনের মাধ্যমে দেখেনও। সবার মনে রাখা উচিত, দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর কষ্টার্জিত অর্থে জাতীয় সংসদ চলে। তাই জনগণই সব কিছুর বিচার করবে। বর্জনের মাধ্যমে নিজেদের অর্জন কতটা কী হবে আমরা জানি না, তবে এটুকু জানি_এতে জনগণের কোনো কল্যাণ নিশ্চিত হবে না। সবার বেলায়ই কথাটি প্রযোজ্য।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.