ছোট পোশাকের কারনেই কি ধর্ষন?
বিদেশি পর্যটকদের পোশাক নিয়ে পর্যটন মন্ত্রীর মাথাব্যথা
নারী পর্যটকদের স্কার্ট বা আঁটোসাঁটো পোশাক পরা নিয়ে পর্যটন মন্ত্রীর নির্দেশিকাকে ঘিরে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক৷ এতে বলা হয়, বিদেশিনিদের পোশাক-পরিচ্ছদ যেন ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই হয়, বিশেষ করে মন্দির বা ধর্মস্থানে৷
মিনি স্কার্ট
‘বিদেশি মহিলা পর্যটকদের ভারত ভ্রমণকালে ছোট স্কার্ট বা আঁটোসাঁটো পোশাক না পরাই উচিত৷ কারণ সেটা ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থি৷’ হ্যাঁ, মোদী সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের স্বাগতিক ‘গিফট প্যাক’-এ এমনই এক নির্দেশিকা তুলে দেয়া হচ্ছে ভারতে আগত টুরিস্ট বা পর্যটকদের৷ বলা বাহুল্য, বিষয়টি নিয়ে দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক৷
কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রী মহেশ শর্মা আগ্রাতে গিয়েও বলেছেন যে, মহিলাদের আঁটোসাঁটো ড্রেস বা স্কার্ট পরে রাতবিরেতে একা একা নির্জন জায়গায় যাওয়াটা নিরাপদ নয়৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় এই মন্তব্য নিয়ে সোরগোল উঠলে সরকারের তরফে সাফাই দিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রী বলেন, ‘‘এটা ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়, নেহাতই পরামর্শ৷”
শুধু তাই নয়, তিনি এ কথাও বলেন যে, ইচ্ছামত ‘ড্রেস’ পরাটা অপরাধ৷ হিন্দু সংবেদনশীলতার কথা মাথায় রেখে এবং মহিলা বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই নাকি এটা বলা৷ আর সেটাই লেখা হয়েছে ঐ নির্দেশিকায়৷ মন্ত্রীর কথায়, মথুরা, বৃন্দাবন বা বিখ্যাত হিন্দু তীর্থস্থানের মন্দিরগুলিতে কিছু অনুশাসন বিধি মেনে চলাই বাঞ্ছনীয়৷ এখনও গ্রামেগঞ্জে সনাতন ‘ড্রেস কোড’ মানা হয়৷ যেমন কোনো কোনো মন্দির বা ধর্মস্থানে ঢুকতে গেলে মাথা ঢাকতে হয়৷ কোথাও বা খালি পায়ে ঢুকতে হয়৷ এটা আদেশ নয় বা নৈতিক পুলিশিয়ানা নয়৷ তাই এর পেছনে অসহিষ্ণুতার অর্থ খোঁজাও অনুচিত৷ বিদেশি নারীদের সতর্ক করে দেওয়া মাত্র৷
নতুন দিল্লিতে বিদেশি নারী পর্যটক
বিপক্ষবাদীদের পাল্টা যুক্তি, ভারতীয় সংস্কৃতিতে দেশি-বিদেশি মহিলা পর্যটক কোথায় কী পোশাক পরবেন, সেবিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি নেই৷ সেদিক থেকে মহিলাদের স্কার্ট পরাটা অ-ভারতীয় এমনটা বলা যায় না৷ তাঁদের কথায়, ভারতীয় সংস্কৃতির জিগির তুলে নিজেদের মত ব্যক্ত করাটা যেন হিন্দুত্ববাদীদের একটা ফ্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
প্রসঙ্গত, কিছুদিন আগে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন পুলিশ প্রধান মন্তব্য করেছিলেন ‘টাইট’ বা খোলামেলা পোশাক ধর্ষকদের প্রলুব্ধ করে৷ সমাজের বড় একটা অংশ মনে করে, এই ধরনের নির্দেশিকায় বিশ্বের কাছে ভারত সম্পর্কে ভুল বার্তা যাবে৷ ভারত ভ্রমণের আগে বিদেশি মহিলা পর্যটকদের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে না যে, ভারতে মহিলাদের নিরাপত্তা বিপন্ন? তাতে আখেরে ক্ষতি হবে দেশের৷ ভারতের পর্যটন ব্যবসা মার খাবে৷ বিশ্ব ট্রাভেল অ্যান্ড টুরিজম কাউন্সিলের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে নানা সমস্যা সত্ত্বেও পর্যটন শিল্প ব্যবসা করেছে আট লাখ কোটি টাকা৷ নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এসে জোর গলায় বলেছিলেন, পর্যটন শিল্পের প্রসার সরকারের লক্ষ্য৷ কারণ এতে বেশি উপকৃত হয় গরিবরা৷
মোদী সরকারের পর্যটন নির্দেশিকা নিয়ে রাজনৈতিক মহলও সরগরম৷ কংগ্রেস মনে করে মোদী সরকার কি চান নারী পর্যটকরা বোরকা পরে ঘুরুক? সিপিআই-এম নেত্রী বৃন্দা কারাতের সোজাসাপ্টা মন্তব্য, কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রী মহেশ শর্মা একজন ‘সিরিয়াল দোষী’৷ দিল্লি মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন বলেন, আঁটোসাঁটো পোশাক পরলেই যদি ধর্ষিতা হোতে হয়, তাহলে পুলিশ প্রশাসনের থাকার দরকারটা কি? দিল্লির আম আদমি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিয়ালের কটাক্ষ, মোদী জমানার চেয়ে বৈদিক যুগে নারীদের পছন্দমত পোশাক পরার স্বাধীনতা ছিল অনেক বেশি৷ খাজরাহোর মন্দির গাত্রের মিথুন ভাস্কর্য তো প্রাচীন ভারতেরই৷ সেটা কি ভারতীয় সংস্কৃতির বাইরে?
যুগের সাথে পোশাক
যুগে যুগে পোশাকের ধরনে পরিবর্তন এসেছে৷ আদিমকালে ছিল পশুর চামড়া, গাছের ছাল আর এখন রয়েছে নানা ধরনের পোশাক৷ বর্তমানে দেশ, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, কাজের ধরন, অনুষ্ঠান, পছন্দ ও ফ্যাশানের ভিত্তিতে বহু ধরনের পোশাক পরে থাকেন ।
শরীর প্রদর্শন মানেই কি ধর্ষককে আমন্ত্রণ?
ভারতে বেশিরভাগ ধর্ষণ মামলায় দেখা গেছে, ধর্ষিতা সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরেছিলেন৷ অর্থাৎ যাকে বলা হয় ভারতীয় নারীর আদর্শ পোশাক, সে ধরনের পোশাকই তাঁরা পরেছিলেন৷ অর্থাৎ এ জরিপ থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, শরীর প্রদর্শন না করে বা তথাকথিত ‘আধুনিক’ পোশাক না পরেও শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন।
২০১৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে যে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন পুরুষ জীবনে অন্তত একবার কোনো নারীকে ধর্ষণ করেছে৷ এর মধ্যে বেশিরভাগ পুরুষকেই কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়নি৷
ধর্ষণ যখন বিনোদনের মাধ্যম
ভারতের উত্তর প্রদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ এর কারণ হিসেবে পুলিশ নারীদের উপর পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, মেয়েদের মোবাইল ব্যবহার ও ছোট পোশাক পরিধানকে উল্লেখ করেছে৷ নারীদের নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ পুলিশ বলেছে, সেখানকার পুরুষরা তাদের বিনোদনের অভাব পূরণ করছে ধর্ষণের মাধ্যমে৷
নারীদের দাবিয়ে রাখার হাতিয়ার
রাস্তা, অফিস বা যে কোনো পাবলিক প্লেসে পুরুষের যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷ বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ায় নারীদের দাবিয়ে রাখতে পুরুষরা ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে৷
পরিচিতদের দ্বারাই বেশি ধর্ষণ
২০১৩ সালে ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, সে বছর ১০০ জন ধর্ষণের শিকার নারীর মধ্যে ৯৮ জন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন, যারা তাঁদের পরিচিত৷ আদালতে যেসব মামলা ওঠে, বা গণমাধ্যমে যেসব ঘটনা প্রকাশ পায় সেগুলো বেশিরভাগই বাইরের লোকের হাতে৷ ফলে পরিচিত ব্যক্তি দ্বারা ধর্ষণের ব্যাপারটি ধামাচাপা পড়ে।
যৌন নিগ্রহ সর্বত্র
ভারতে জন্মের আগে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ বেআইনি হলেও, খুব সাধারণ ঘটনা৷ ফলে পৃথিবীর আলো দেখতে পাওয়া মেয়েদের সংখ্যা এত কম যে, সমাজে নারী-পুরুষের অনুপাতে হেরফের হয়৷ এছাড়া বাল্যবিবাহ, কম বয়সে মা হওয়া, সন্তান জন্ম দিতে গিয়েও মৃত্যুবরণ করছেন নারীরা৷ পরিবারের ভেতরেও চলে যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণ৷ এরপরও কি আপনারা ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করবেন?
মহিলা ও শিশু সুরক্ষা সংক্রান্ত এক এনজিও কর্মী মহম্মদ তাজমুল হক ডয়চে ভেলেকে বললেন, কে কী পরবে তা সরকার বেঁধে দিতে পারেন না৷ তবে হ্যাঁ, মন্দির, মসজিদ বা গুরদোয়ারার মতো ধর্মীয় স্থানের নিজস্ব কিছু নিয়মবিধি থাকলে তা অমান্য করা অনুচিত৷ যেমন মন্দির, মসজিদ, গুরদোয়ারায় জুতো পায়ে ঢোকা নিষেধ, মাথায় ঢাকা দেওয়া বা স্কাল ক্যাপ পরার প্রথা ইত্যাদি৷ খোলামেলা পোশাক ধর্ষকদের প্রলুব্ধ করে এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মহিলারা স্কার্ট বা আঁটোসাঁটো পোশাক পরলে যদি ধর্ষণের শিকার হোতে হয়, তাহলে নাবালিকারা ধর্ষণের শিকার হয় কি করে? এই তো, কয়েকদিন আগে কলকাতায় অ্যাপ-নির্ভর এক ট্যাক্সিচালক এবং তাঁর বন্ধু একজন নাবালিকাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ট্যাক্সির ভেতরেই ধর্ষণ এবং হত্যা করার পর খালের জলে ফেলে দেয়৷ ঐ নাবালিকা তো উগ্র পোশাক পরেছিল না, তাহলে? আসলে ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থা মূলত একটা মানসিক স্খলন, বলেন সমাজ কর্মী তাজমুল হক৷
চোখে পড়ার জন্যই যার জন্ম
মিনিস্কার্ট এমনই এক বস্তু, যা ৫০ বছর আগেও মানুষের নজর কেড়েছে এবং আজও কাড়ে৷ নন্দনতত্ত্বে নারীদেহের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা আর যৌন আবেদনের মধ্যে যতোটুকু ফারাক, মিনির ক্ষেত্রেও ঠিক ততটা৷ দেহ একই থাকছে, বাড়ছে কমছে শুধু হেমলাইন৷
‘উদ্ধৃতি চিহ্ন’
মিনির মজাই হলো, তা যা অবারিত রাখে, অর্থাৎ সুন্দর, সুডৌল পদযুগল৷ আবার তা অবলীলাক্রমে এমন একটা নান্দনিক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, সমালোচনা করার মতো আর কিছু থাকে না – নাকি থাকে?
‘টুইগি’
খড়কুটোর মতো পাতলা হাত-পা-ওয়ালা এই মডেলটিকে আজও লন্ডনের সুইঙ্গিং সিক্সটিজ-এর প্রতীক বলে মনে করা হয়৷ আসল নাম লেসলি হর্নবি৷ পরবর্তী জীবনে অভিনয়ও করেছেন৷ আজও তাঁর ছবি দেখলে মনে হয়, টুইগি রক্তমাংসের মানুষ নন, তিনি একটি ফ্যাশন স্টেটমেন্টের থেকেও বড় – তিনি জীবন সম্পর্কে একটি মন্তব্য৷
মেরি কোয়ান্ট
লন্ডনের চেলসিতে ‘বাজার’ নামধারী একটি ফ্যাশন বিপণী চালাতেন মেরি কোয়ান্ট৷ পঞ্চাশের দশকের শেষেই আরো ছোট স্কার্ট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন, যা পর্যবসিত হয় ১৯৬৪ সালে তাঁর যুগান্তকারী সৃষ্টিতে: মিনিস্কার্ট৷ এই কাহিনির প্রামাণ্যতা নিয়ে হালে দ্বিধা দেখা দিয়েছে৷ কিংবদন্তী বলে, মেরি নাকি তাঁর প্রিয় মোটরগাড়ি, অস্টিন মিনির নামে খাটো স্কার্টটির নামকরণ করেন৷ এখানে মডেলদের সঙ্গে মেরি কোয়ান্ট (ডানদিকে)৷
হাই আর্ট
মিনিস্কার্ট ছিল স্ট্রিট ফ্যাশন, ষাটের দশকে লন্ডনের মেয়েরা খাটো স্কার্ট পরতে শুরু করে: মেরি কোয়ান্ট নিজেই এ কথা বলেছেন৷ কয়েক বছরের মধ্যেই সেই রাস্তার ফ্যাশন ‘ওৎ কুতুর’, অর্থাৎ হাই ফ্যাশনে পৌঁছে যায়৷ শুধু তাই নয়, স্বয়ং ফ্যাশন গুরু ইভ স্যাঁ লরাঁ তাঁর সুবিখ্যাত মন্ড্রিয়ান ড্রেসটিকে মিনি ড্রেস-ই করেছেন৷ পিয়েট মন্ড্রিয়ান ছিলেন বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের এক ওলন্দাজ।
গ্লোরিয়া স্টাইনেম
নারীবাদের প্রথম পর্বে যাঁরা নারীদের হয়ে কলম ধরেছিলেন এবং সোচ্চার হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে পড়েন জার্মেইন গ্রিয়ার এবং গ্লোরিয়া স্টাইনেম৷ এঁরা কিন্তু ষাটের দশকে মিনিস্কার্টকে নারীমুক্তির প্রতীক হিসেবে গণ্য করতেন এবং উভয়ে মিনিস্কার্টও পরেছেন৷
মিনিস্কার্টের ৫০ বছর
শাকিরা
কলম্বিয়ার এই গায়িকা বিশ্বজয় করেছেন গান গেয়ে৷ মঞ্চে তিনি যখন তাঁর শো দেন, তখন পঞ্চাশ বছরের পুরনো ফ্যাশান স্টেটমেন্ট মিনিস্কার্টকে বাদ দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না৷
নারী পর্যটকদের স্কার্ট বা আঁটোসাঁটো পোশাক পরা নিয়ে পর্যটন মন্ত্রীর নির্দেশিকাকে ঘিরে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক৷ এতে বলা হয়, বিদেশিনিদের পোশাক-পরিচ্ছদ যেন ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই হয়, বিশেষ করে মন্দির বা ধর্মস্থানে৷
মিনি স্কার্ট
‘বিদেশি মহিলা পর্যটকদের ভারত ভ্রমণকালে ছোট স্কার্ট বা আঁটোসাঁটো পোশাক না পরাই উচিত৷ কারণ সেটা ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থি৷’ হ্যাঁ, মোদী সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের স্বাগতিক ‘গিফট প্যাক’-এ এমনই এক নির্দেশিকা তুলে দেয়া হচ্ছে ভারতে আগত টুরিস্ট বা পর্যটকদের৷ বলা বাহুল্য, বিষয়টি নিয়ে দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক৷
কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রী মহেশ শর্মা আগ্রাতে গিয়েও বলেছেন যে, মহিলাদের আঁটোসাঁটো ড্রেস বা স্কার্ট পরে রাতবিরেতে একা একা নির্জন জায়গায় যাওয়াটা নিরাপদ নয়৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় এই মন্তব্য নিয়ে সোরগোল উঠলে সরকারের তরফে সাফাই দিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রী বলেন, ‘‘এটা ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়, নেহাতই পরামর্শ৷”
শুধু তাই নয়, তিনি এ কথাও বলেন যে, ইচ্ছামত ‘ড্রেস’ পরাটা অপরাধ৷ হিন্দু সংবেদনশীলতার কথা মাথায় রেখে এবং মহিলা বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই নাকি এটা বলা৷ আর সেটাই লেখা হয়েছে ঐ নির্দেশিকায়৷ মন্ত্রীর কথায়, মথুরা, বৃন্দাবন বা বিখ্যাত হিন্দু তীর্থস্থানের মন্দিরগুলিতে কিছু অনুশাসন বিধি মেনে চলাই বাঞ্ছনীয়৷ এখনও গ্রামেগঞ্জে সনাতন ‘ড্রেস কোড’ মানা হয়৷ যেমন কোনো কোনো মন্দির বা ধর্মস্থানে ঢুকতে গেলে মাথা ঢাকতে হয়৷ কোথাও বা খালি পায়ে ঢুকতে হয়৷ এটা আদেশ নয় বা নৈতিক পুলিশিয়ানা নয়৷ তাই এর পেছনে অসহিষ্ণুতার অর্থ খোঁজাও অনুচিত৷ বিদেশি নারীদের সতর্ক করে দেওয়া মাত্র৷
নতুন দিল্লিতে বিদেশি নারী পর্যটক
বিপক্ষবাদীদের পাল্টা যুক্তি, ভারতীয় সংস্কৃতিতে দেশি-বিদেশি মহিলা পর্যটক কোথায় কী পোশাক পরবেন, সেবিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি নেই৷ সেদিক থেকে মহিলাদের স্কার্ট পরাটা অ-ভারতীয় এমনটা বলা যায় না৷ তাঁদের কথায়, ভারতীয় সংস্কৃতির জিগির তুলে নিজেদের মত ব্যক্ত করাটা যেন হিন্দুত্ববাদীদের একটা ফ্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
প্রসঙ্গত, কিছুদিন আগে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন পুলিশ প্রধান মন্তব্য করেছিলেন ‘টাইট’ বা খোলামেলা পোশাক ধর্ষকদের প্রলুব্ধ করে৷ সমাজের বড় একটা অংশ মনে করে, এই ধরনের নির্দেশিকায় বিশ্বের কাছে ভারত সম্পর্কে ভুল বার্তা যাবে৷ ভারত ভ্রমণের আগে বিদেশি মহিলা পর্যটকদের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে না যে, ভারতে মহিলাদের নিরাপত্তা বিপন্ন? তাতে আখেরে ক্ষতি হবে দেশের৷ ভারতের পর্যটন ব্যবসা মার খাবে৷ বিশ্ব ট্রাভেল অ্যান্ড টুরিজম কাউন্সিলের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে নানা সমস্যা সত্ত্বেও পর্যটন শিল্প ব্যবসা করেছে আট লাখ কোটি টাকা৷ নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এসে জোর গলায় বলেছিলেন, পর্যটন শিল্পের প্রসার সরকারের লক্ষ্য৷ কারণ এতে বেশি উপকৃত হয় গরিবরা৷
মোদী সরকারের পর্যটন নির্দেশিকা নিয়ে রাজনৈতিক মহলও সরগরম৷ কংগ্রেস মনে করে মোদী সরকার কি চান নারী পর্যটকরা বোরকা পরে ঘুরুক? সিপিআই-এম নেত্রী বৃন্দা কারাতের সোজাসাপ্টা মন্তব্য, কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রী মহেশ শর্মা একজন ‘সিরিয়াল দোষী’৷ দিল্লি মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন বলেন, আঁটোসাঁটো পোশাক পরলেই যদি ধর্ষিতা হোতে হয়, তাহলে পুলিশ প্রশাসনের থাকার দরকারটা কি? দিল্লির আম আদমি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিয়ালের কটাক্ষ, মোদী জমানার চেয়ে বৈদিক যুগে নারীদের পছন্দমত পোশাক পরার স্বাধীনতা ছিল অনেক বেশি৷ খাজরাহোর মন্দির গাত্রের মিথুন ভাস্কর্য তো প্রাচীন ভারতেরই৷ সেটা কি ভারতীয় সংস্কৃতির বাইরে?
যুগের সাথে পোশাক
যুগে যুগে পোশাকের ধরনে পরিবর্তন এসেছে৷ আদিমকালে ছিল পশুর চামড়া, গাছের ছাল আর এখন রয়েছে নানা ধরনের পোশাক৷ বর্তমানে দেশ, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, কাজের ধরন, অনুষ্ঠান, পছন্দ ও ফ্যাশানের ভিত্তিতে বহু ধরনের পোশাক পরে থাকেন ।
শরীর প্রদর্শন মানেই কি ধর্ষককে আমন্ত্রণ?
ভারতে বেশিরভাগ ধর্ষণ মামলায় দেখা গেছে, ধর্ষিতা সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরেছিলেন৷ অর্থাৎ যাকে বলা হয় ভারতীয় নারীর আদর্শ পোশাক, সে ধরনের পোশাকই তাঁরা পরেছিলেন৷ অর্থাৎ এ জরিপ থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, শরীর প্রদর্শন না করে বা তথাকথিত ‘আধুনিক’ পোশাক না পরেও শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন।
২০১৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে যে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন পুরুষ জীবনে অন্তত একবার কোনো নারীকে ধর্ষণ করেছে৷ এর মধ্যে বেশিরভাগ পুরুষকেই কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়নি৷
ধর্ষণ যখন বিনোদনের মাধ্যম
ভারতের উত্তর প্রদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ এর কারণ হিসেবে পুলিশ নারীদের উপর পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, মেয়েদের মোবাইল ব্যবহার ও ছোট পোশাক পরিধানকে উল্লেখ করেছে৷ নারীদের নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ পুলিশ বলেছে, সেখানকার পুরুষরা তাদের বিনোদনের অভাব পূরণ করছে ধর্ষণের মাধ্যমে৷
নারীদের দাবিয়ে রাখার হাতিয়ার
রাস্তা, অফিস বা যে কোনো পাবলিক প্লেসে পুরুষের যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷ বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ায় নারীদের দাবিয়ে রাখতে পুরুষরা ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে৷
পরিচিতদের দ্বারাই বেশি ধর্ষণ
২০১৩ সালে ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, সে বছর ১০০ জন ধর্ষণের শিকার নারীর মধ্যে ৯৮ জন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন, যারা তাঁদের পরিচিত৷ আদালতে যেসব মামলা ওঠে, বা গণমাধ্যমে যেসব ঘটনা প্রকাশ পায় সেগুলো বেশিরভাগই বাইরের লোকের হাতে৷ ফলে পরিচিত ব্যক্তি দ্বারা ধর্ষণের ব্যাপারটি ধামাচাপা পড়ে।
যৌন নিগ্রহ সর্বত্র
ভারতে জন্মের আগে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ বেআইনি হলেও, খুব সাধারণ ঘটনা৷ ফলে পৃথিবীর আলো দেখতে পাওয়া মেয়েদের সংখ্যা এত কম যে, সমাজে নারী-পুরুষের অনুপাতে হেরফের হয়৷ এছাড়া বাল্যবিবাহ, কম বয়সে মা হওয়া, সন্তান জন্ম দিতে গিয়েও মৃত্যুবরণ করছেন নারীরা৷ পরিবারের ভেতরেও চলে যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণ৷ এরপরও কি আপনারা ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করবেন?
মহিলা ও শিশু সুরক্ষা সংক্রান্ত এক এনজিও কর্মী মহম্মদ তাজমুল হক ডয়চে ভেলেকে বললেন, কে কী পরবে তা সরকার বেঁধে দিতে পারেন না৷ তবে হ্যাঁ, মন্দির, মসজিদ বা গুরদোয়ারার মতো ধর্মীয় স্থানের নিজস্ব কিছু নিয়মবিধি থাকলে তা অমান্য করা অনুচিত৷ যেমন মন্দির, মসজিদ, গুরদোয়ারায় জুতো পায়ে ঢোকা নিষেধ, মাথায় ঢাকা দেওয়া বা স্কাল ক্যাপ পরার প্রথা ইত্যাদি৷ খোলামেলা পোশাক ধর্ষকদের প্রলুব্ধ করে এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মহিলারা স্কার্ট বা আঁটোসাঁটো পোশাক পরলে যদি ধর্ষণের শিকার হোতে হয়, তাহলে নাবালিকারা ধর্ষণের শিকার হয় কি করে? এই তো, কয়েকদিন আগে কলকাতায় অ্যাপ-নির্ভর এক ট্যাক্সিচালক এবং তাঁর বন্ধু একজন নাবালিকাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ট্যাক্সির ভেতরেই ধর্ষণ এবং হত্যা করার পর খালের জলে ফেলে দেয়৷ ঐ নাবালিকা তো উগ্র পোশাক পরেছিল না, তাহলে? আসলে ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থা মূলত একটা মানসিক স্খলন, বলেন সমাজ কর্মী তাজমুল হক৷
চোখে পড়ার জন্যই যার জন্ম
মিনিস্কার্ট এমনই এক বস্তু, যা ৫০ বছর আগেও মানুষের নজর কেড়েছে এবং আজও কাড়ে৷ নন্দনতত্ত্বে নারীদেহের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা আর যৌন আবেদনের মধ্যে যতোটুকু ফারাক, মিনির ক্ষেত্রেও ঠিক ততটা৷ দেহ একই থাকছে, বাড়ছে কমছে শুধু হেমলাইন৷
‘উদ্ধৃতি চিহ্ন’
মিনির মজাই হলো, তা যা অবারিত রাখে, অর্থাৎ সুন্দর, সুডৌল পদযুগল৷ আবার তা অবলীলাক্রমে এমন একটা নান্দনিক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, সমালোচনা করার মতো আর কিছু থাকে না – নাকি থাকে?
‘টুইগি’
খড়কুটোর মতো পাতলা হাত-পা-ওয়ালা এই মডেলটিকে আজও লন্ডনের সুইঙ্গিং সিক্সটিজ-এর প্রতীক বলে মনে করা হয়৷ আসল নাম লেসলি হর্নবি৷ পরবর্তী জীবনে অভিনয়ও করেছেন৷ আজও তাঁর ছবি দেখলে মনে হয়, টুইগি রক্তমাংসের মানুষ নন, তিনি একটি ফ্যাশন স্টেটমেন্টের থেকেও বড় – তিনি জীবন সম্পর্কে একটি মন্তব্য৷
মেরি কোয়ান্ট
লন্ডনের চেলসিতে ‘বাজার’ নামধারী একটি ফ্যাশন বিপণী চালাতেন মেরি কোয়ান্ট৷ পঞ্চাশের দশকের শেষেই আরো ছোট স্কার্ট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন, যা পর্যবসিত হয় ১৯৬৪ সালে তাঁর যুগান্তকারী সৃষ্টিতে: মিনিস্কার্ট৷ এই কাহিনির প্রামাণ্যতা নিয়ে হালে দ্বিধা দেখা দিয়েছে৷ কিংবদন্তী বলে, মেরি নাকি তাঁর প্রিয় মোটরগাড়ি, অস্টিন মিনির নামে খাটো স্কার্টটির নামকরণ করেন৷ এখানে মডেলদের সঙ্গে মেরি কোয়ান্ট (ডানদিকে)৷
হাই আর্ট
মিনিস্কার্ট ছিল স্ট্রিট ফ্যাশন, ষাটের দশকে লন্ডনের মেয়েরা খাটো স্কার্ট পরতে শুরু করে: মেরি কোয়ান্ট নিজেই এ কথা বলেছেন৷ কয়েক বছরের মধ্যেই সেই রাস্তার ফ্যাশন ‘ওৎ কুতুর’, অর্থাৎ হাই ফ্যাশনে পৌঁছে যায়৷ শুধু তাই নয়, স্বয়ং ফ্যাশন গুরু ইভ স্যাঁ লরাঁ তাঁর সুবিখ্যাত মন্ড্রিয়ান ড্রেসটিকে মিনি ড্রেস-ই করেছেন৷ পিয়েট মন্ড্রিয়ান ছিলেন বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের এক ওলন্দাজ।
গ্লোরিয়া স্টাইনেম
নারীবাদের প্রথম পর্বে যাঁরা নারীদের হয়ে কলম ধরেছিলেন এবং সোচ্চার হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে পড়েন জার্মেইন গ্রিয়ার এবং গ্লোরিয়া স্টাইনেম৷ এঁরা কিন্তু ষাটের দশকে মিনিস্কার্টকে নারীমুক্তির প্রতীক হিসেবে গণ্য করতেন এবং উভয়ে মিনিস্কার্টও পরেছেন৷
মিনিস্কার্টের ৫০ বছর
শাকিরা
কলম্বিয়ার এই গায়িকা বিশ্বজয় করেছেন গান গেয়ে৷ মঞ্চে তিনি যখন তাঁর শো দেন, তখন পঞ্চাশ বছরের পুরনো ফ্যাশান স্টেটমেন্ট মিনিস্কার্টকে বাদ দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না৷
No comments