নিচে পাটা ওপরে পুতাইল, মাঝখানে... by মোফাজ্জল করিম
শুরুতেই সব পাঠক-পাঠিকাকে জানাই খ্রিস্টীয় নববর্ষের অফুরন্ত শুভেচ্ছা। চারপাশে অহর্নিশ এত অশুভ-অসূয়া, এত অনৈক্য, এত ক্রোধ! আমাদের বাংলাদেশের ছোট পৃথিবীটা সত্যি এখন হিংসায় উন্মত্ত। এখন তাই যা কিছু শুভ তা দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য। মহার্ঘ তো বটেই।
এর ভেতর কেউ শুভেচ্ছা জানালে খুবই ভালো লাগে। ভালো লাগে কাউকে শুভেচ্ছা জানাতেও। সেটা যেকোনো ভাষাতেই হোক। এখন আমরা সব শুভর কাঙাল। ইচ্ছে হয়, বারবার শুনি কেউ বলছে : শুভ নববর্ষ। হ্যাপি নিউ ইয়ার। তার চেয়ে বেশি কামনা করি, আমাদের সবগুলো অশুভর কাঁটা ফুল হয়ে ফুটুক।
কিন্তু শুধু চাইলেই কি সব আশা পূরণ হয়? আমাদের সব দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা-বঞ্চনার অবসান, সব সমস্যার সমাধান কি শুধু আমাদের চাওয়া-চাওয়ির ওপরই নির্ভরশীল? নিশ্চয়ই না। পৃথিবীর কোনো দেশের, কোনো জাতির সমস্যার সমাধান এভাবে হয়নি, হবেও না। ইংরেজি ভাষার সেই মোক্ষম প্রবাদবাক্যটি আমরা সবাই জানি : ইফ উইশেস ওয়্যার হর্সেস, বেগারস্ উড হ্যাভ রিডেন... ইচ্ছাগুলো যদি ঘোড়া হতো, ভিক্ষুকেরাও ঘোড়া দৌড়াত। কিন্তু অমন অলৌকিক কিছু বাস্তবে ঘটে না। বাস্তবে ঘোড়ার মালিক হতে হলে সামর্থ্য অর্জন করতে হয়।
আর যখনই সামর্থ্যের কথা ওঠে, আমার অবাক লাগে। বাংলাদেশের কি সামর্থ্য নেই? বাংলাদেশ সম্বন্ধে স্বাধীনতার পর পরই যে দুর্বাসা মুনি মন্তব্য করেছিল দেশটা একটা তলাহীন ঝুড়ি, সে কি এখন সাহস করে কথাটা আবার উচ্চারণ করতে পারবে? জানি সে একটা সময় ছিল যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশে সবই ছিল বিপর্যস্ত, এলোমেলো, তখন রক্তস্নাত সদ্য স্বাধীন দেশটির ওপর অনেকেরই শ্যেনদৃষ্টি ছিল, এ কথা কে না জানে। তখন বাংলাদেশ সম্বন্ধে উল্টাসিধা যেকোনো মন্তব্য করতে কারো মুখে বাধত না। ওই যে গ্রামদেশে যে বলে, 'গরিবের বউ সকলের ভাবি', সেই অবস্থা আর কি। কিন্তু এখন কোন বাপের বেটা বাংলাদেশকে নিয়ে এ রকম ঠাট্টা-মশকরা করুক তো দেখি।
একাত্তরের এ দেশের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে ডাবলেরও বেশি হয়েছে, সমস্যার পর্বত ছুঁই ছুঁই করছে আকাশ, তবু আর কিছু না হোক, ষোল কোটি মানুষ এখন দুই বেলা খেয়েদেয়ে বেঁচে-বর্তে আছে, এখন তারা আর আদুল গায়ে এবাড়ি-ওবাড়ি যায় না, নগ্নপদে এক জোড়া চটিও জুটেছে তাদের। এগুলো হলো কী করে? নিশ্চয়ই আকাশ ফুঁড়ে আসেনি? কোনো বিগ ব্রাদারের মোসাহেবি করে, দেশটাকে কারো করদ রাজ্য বানিয়ে, কারো দরজায় গিয়ে হাত পেতে মুষ্টিভিক্ষা নিয়ে এসে তো এ দেশ চলছে না, এ দেশ চলছে সেই জাদুমন্ত্রে, যা একদিন এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে একতাবদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে ছিনিয়ে আনতে। বুকের রক্ত দিয়ে যারা স্বাধীনতা এনেছিল, তাদেরই উত্তরসূরীরা এখন মাঠে ফসল ফলাচ্ছে রেকর্ড পরিমাণ, বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা উপার্জন করে নিয়ে এসে মায়ের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে, পূর্ণ করছে বাপের স্বপ্ন। লাখ লাখ তরুণী সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাজ করছে কল-কারখানায়। এ দেশের ছেলেরামেয়েরা ডাবগাছে চড়ে ডাব পাড়ার মতো দুড়দাড় করে উঠে পড়ছে এভারেস্টের চূড়ায়। নোবেল পুরস্কার, ম্যাগসাসাই পুরস্কার আমাদের বাড়িতে এসে দিয়ে যায় বোদ্ধারা। দেশে-বিদেশে যুগান্তকারী সব সাফল্যও অর্জন করছে এ দেশের বর্তমান প্রজন্মের মানুষ। অতএব বাংলাদেশকে এখন সমঝে কথা বলার সময় এসেছে।
আসলে আমরা পরস্পরকে খোঁচাখুঁচি, খামচা-খামচিতে এত ব্যস্ত যে আমাদের অপার সম্ভাবনার দিকগুলোর দিকে একবার ভালো করে তাকিয়েও দেখি না। আর আমাদের নিজেদের টনক না নড়লেও যারা আমাদের 'সোয়া হুয়া রুস্তম' ভাবে, তারা তো তাদের নাতিপুতিদের বলতে শুরু করে দিয়েছে : তোমরা এখন থেকে বাংলাদেশকে সালাম করতে শেখো, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর তোমাদের দিয়ে ওই দেশের মানুষ তাদের পা টেপাবে। সব পাওনা-গণ্ডা সুদে-মূলে আদায় করে নেবে তারা।
আমি বলি, পঞ্চাশ বছর পর কী হবে না হবে জানি না, তবে যারা ৯ মাসে একটি দেশকে একটি দানবীয় শক্তির হাত থেকে মুক্ত করে পৃথিবীকে চমকে দিতে পেরেছে, মাত্র ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি খাঁচার ভেতর তাদেরই উত্তরাধিকারী ১৬ কোটি আদমসন্তান শুধু যে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসই ফেলছে তা নয়, বন্যা-খরা, আইলা-সিডর-সাইক্লোন সামাল দিয়ে নিজেদের অন্ন-বস্ত্রেরও জোগান দিচ্ছে, বিশ্বসভায় প্রতিনিয়ত জানান দিচ্ছে তাদের সগৌরব উপস্থিতির। তারা চাওয়ার মতো চাইলে যে সব কিছু করতে পারে তা বিশ্ববাসী জেনে গেছে। অশিক্ষা-কুশিক্ষা, মারামারি-কাটাকাটি, চুরি-চামারি সত্ত্বেও দেশটা তো এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বজোড়া মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশগত বিপর্যয় ইত্যাদি হাজারটা সমস্যার বেড়াজালে জবুথবু পৃথিবীর হাতেগোনা যে কয়টি দেশের প্রবৃদ্ধির হার এখনো গোঁয়ারের মতো মাথা তুলে এগিয়ে যাচ্ছে, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বাংলাদেশ, আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ, তাদের মধ্যে অন্যতম। আমি নিশ্চিত, উন্নত বিশ্বে হইচই পড়ে গেছে : কেইসটা কী? যে পোলার ফেইলই টেকার কথা না, সে জিপিএ-৫ পায় কেমনে? নিশ্চয়ই নকল-টকল করেছে। আমি বলি, জ্বী না, নকল করে নোবেল পাওয়া যায় না। এই বাঙালি পোলাপান-মাইয়াপান সব পারে। শুধু ঠিক জায়গা মতো বসিয়ে দিলে হলো, এক সিটিংয়ে একটানা ১৫-১৬ ঘণ্টা কাজ করে ইউরোপ-আমেরিকার ফাটাফাটি ব্র্যান্ডের বস্তা বস্তা চোখ ধাঁধানো পোশাক-আশাক নামিয়ে দিতে পারে এই মাত্র সেদিন অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা ক্ষেতমার্কা ছেলেমেয়েরা। এরা কাজ করতে জানে, কাজ করে দুটি কর্মব্যস্ত হাত দিয়ে, তীক্ষ্ন ধীশক্তি দিয়ে, একটি ইস্পাতকঠিন সঙ্কল্প মনের মধ্যে পুষে। এদের ঘুম-নেই চোখে স্বপ্নের বুড়বুড়ি : একদিন টিনের ছাপড়া ঘর ছেড়ে উঠবে গিয়ে একটি পাকা দালানে, মা-বাবাকে গ্রামের পূতিগন্ধময় পরিবেশ থেকে নিয়ে আসবে সেখানে। দু'চোখে তাদের একটা শান্তির নীড় বাঁধার স্বপ্ন। এরা প্রবাসে গিয়ে আরও একশটা দেশের শ্রমিককে পেছনে ফেলে নজর কাড়ে তার নিয়োগকর্তার : কোন দেশ থেকে এসেছ তুমি? সে মাথা উঁচু করে বলে : বাংলাদেশ। 'ও বাংলাদেশ। ইয়েস, আই নো, ইউ পিপল আর ডুয়িং ভেরি ওয়েল।' আর আগে, অর্থাৎ সেই 'তলাহীন ঝুড়ি' খেতাব পাওয়ার দিনগুলোতে বা তার পরে, বাংলাদেশ শুনলেই এই লোকের আব্বাজান আঁতকে উঠত, যেন কলেরা-বসন্ত-এইডস-ক্যান্সারের জীবাণু একসঙ্গে গুলে কেউ তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ মানে তখন ছিল বন্যা-সাইক্লোন-দুর্ভিক্ষ-অপুষ্টির আরেক নাম। সেই অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে শুধু ক্ষেতে-খামারে, কলে-কারখানায় জীবন উৎসর্গ করে দেয়া কোটি কোটি মানুষের ঐকান্তিক চেষ্টা, অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিখাদ সততার কারণে। এই যে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বাড়ছে হু হু করে, এক কুড়ি টাকিমাছ রাখার ঝুড়িতে পাঁচ কুড়ি রাখার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে ঢাকা শহরে গাদাগাদি ঠেলাঠেলি গুঁতোগুঁতি করছে, তবুও তো বাজারে আলহামদুলিল্লাহ চাল-ডাল-মাছ-তরকারির সরবরাহের কমতি নেই। টিভিতে শাইখ সিরাজের কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠানগুলোয় বাংলাদেশের চাষীদের নিষ্ঠা, উদ্যম, পরিশ্রম ও উদ্ভাবনী শক্তি দেখে যে কারোরই তাক লাগে। যে এলাকায় জীবনে কোনদিন কলার চাষ হতো না, সে এলাকা এখন ট্রাক বোঝাই করে কলা রপ্তানি করে ঢাকায়। পেঁপের বাগান, ফুলের বাগান, কাজী পেয়ারার চাষ, উন্নত জাতের ষণ্ডা ষণ্ডা বরইয়ের চাষ- এগুলোতে হাত পাকিয়ে এখন স্ট্রবেরি ফলাচ্ছে আমাদের হাল আমলের চাষী। যে মেয়ের মায়ের হস্তশিল্পের বিদ্যার দৌড় বাচ্চার জন্য কাঁথা সেলাই আর বড়জোর ডালাটা কুলাটা বানানো পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল, সেই মেয়ের দুটি কোমল হাত এখন যন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লন্ডন-প্যারিস-নিউ ইয়র্কের বিশ্ববিখ্যাত চেইন স্টোরগুলোর জন্য তৈরি করে 'হাই ভ্যালুড' পোশাক। ওই চাষি কিংবা ওই গার্মেন্ট মেয়েটির ভাগ্যের চাকাটি বড় একটা ঘোরেনি ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশ তো অবশ্যই 'স্লোলি বাট স্টেডিলি' এগিয়ে যাচ্ছে।
এখানে একটা টীকা যোগ করতে চাই। পাঠক, বাংলাদেশের এই এগিয়ে যাওয়ার দিকে একবার চোখ তুলে তাকান তো। কী দেখতে পাচ্ছেন? নিশ্চয়ই কোটি কোটি একর ক্ষেতি জমি, জমির বুকে শিশুর মুখের হাসির মতো শ্যামল-সবুজ-সোনালি ফসলের হাসি, আর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কাস্তে হাতে লক্ষ-কোটি কৃষক। আর না হয় শুনতে পাচ্ছেন কানে তালা লাগা অসংখ্য সেলাই মেশিনের ঘর্ঘর্ আওয়াজ, আর দেখতে পাচ্ছেন নতমুখী লক্ষ লক্ষ বালিকাকে, যারা তাদের সমস্ত চৈতন্য দিয়ে, সত্তা দিয়ে সচল রেখেছে মেশিনগুলো, যাতে করে বাংলাদেশ নামক স্বপ্নের গাড়িটির চাকা থেমে না যায়। নিরন্ন-নিবস্ত্র অসহায় মা-বাবা, ভাইবোনকে ফেলে যে সংগ্রামী তরুণটি বোটম্যান সেজে টেকনাফ উপকূল থেকে মালয়েশিয়ার সোনার হরিণের উদ্দেশে একদিন পাড়ি জমিয়েছিল, পথে সাগরে বিসর্জন দিয়েছিল কতিপয় হতভাগ্য সাথীকে, মধ্যপ্রাচ্যের ঊষর মরুর ধূসর জীবনে নাস্তানুবাদ হয়ে হয়ে যে যুবক তার আয়ু ক্ষয় করা উপার্জন পাঠাচ্ছে এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের চৌহদ্দিতে তার কথা, তাদের কথাও নিশ্চয়ই আপনার মনে পড়ে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রার মানসাঙ্ক কষতে গিয়ে। কিন্তু নিশ্চয়ই আপনার মনে পড়ে না, যারা এই অগ্রযাত্রা অনুষ্ঠানের শিল্পী নন, সঞ্চালক, যারা কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে, তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে সাফল্যের দাবিদার সাজেন তাঁদের কথা।
সাফল্য তো কেবল তৈরি পোশাক আর বিদেশে শ্রমিক রপ্তানিতেই নয়, আরো অনেক কিছুতেই ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছে তৃতীয় বিশ্বের এই সমস্যাজর্জরিত সাবেক উপনিবেশটি। গড় আয়ু পাকিস্তানি আমলের ৪০ বা তার নিচে থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০-এর বেশি, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে দ্বিগুণ, শিক্ষার হার পাক আমলে যেখানে সেই ২০-এর কোটায় খাবি খাচ্ছিল, এখন তা হয়েছে ৬০ বা তারও বেশি। এমনি আরো অনেক সাফল্য-গাথা আছে। এর জন্য সরকার-বেসরকার (যেমন এনজিও) সিনা ফুলিয়ে কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। করুন। কিন্তু সবার আগে কৃতিত্বটা দেবেন কাকে? নিশ্চয়ই কৃষককে, শ্রমিককে। খেলোয়াড়দের বাদ দিয়ে জয়মাল্য নিশ্চয়ই কোচকে পরাবেন না, যে কোচ আবার বেশির ভাগ সময় সমস্যার সমাধানের চাইতে পুরো টিমের জন্য নানা ধরনের উদ্ভট সব সমস্যা সৃষ্টি করতে ব্যস্ত।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি এইসব কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষ যদি এইসব বাকসর্বস্ব নটবর-নটরাজদের হাত থেকে রক্ষা পেত, তা হলে আমাদের জিডিপি ছয় থেকে এক লাফে নয়ে চলে যেত। দুঃখের বিষয়, এই মেহনতি মানুষদের বিপরীতে মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক লোক নিজেদের আখের গোছানোর জন্য যা করছেন তা দেশের অগ্রযাত্রার পথে, বিভিন্ন সেক্টরে উৎপাদন বৃদ্ধিতে, জাতিকে সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে কোন সহায়ক ভূমিকা পালন তো করছেই না, বরং তাদের বেশির ভাগ কাজকর্ম টোট্যালি কাউন্টার প্রডাক্টিভ। তারা প্রবৃদ্ধির ধারাটিকে ছয় থেকে নয়ে নিয়ে যাওয়া নয়, বরং সবকিছু নয়ছয় না করে যেন ছাড়বেন না। তারা কোন ব্যাপারে একমত হতে পারেন না। একজন যদি বলেন 'বাইরে চমৎকার রোদ,' আরেকজনকে যেন অবশ্যই বলতে হবে, 'সারাদিন মেঘলা থাকার পর এটাকে ঠিক রোদ বলা যায় না, রোদ ওঠার চেষ্টা বলা যেতে পারে।' একজন সূর্য পূর্বদিকে ওঠে বললে অন্যজন সাথে সাথে বলবেনই : না, ঠিক পূর্বদিকে না, উত্তরপূর্ব বা দক্ষিণপূর্ব দিকে ওঠে বলা উচিত। এ যেন সম্প্রতি প্রয়াত পপ গানের প্রখ্যাত শিল্পী আযম খানের গানের সেই 'আলাল যদি ডাইনে যায়, দুলাল যায় বাঁয়ে'-র মত, দু'জন কিছুতেই একদিকে যাবে না। আর তাতেই যত বিপত্তি। তাতেই দেশজুড়ে মারামারি-কাটাকাটি-ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও-অবরোধ-হরতাল। নিচে পাটা, ওপরে পুতাইল। মাঝখানে পড়ে বেচারা জনগণ নামক মরিচ, গার্মেন্টশিল্প, লেখাপড়া, বিদেশী বিনিয়োগ নামক পেঁয়াজ-হলুদ-আদার জান যায়।
ইস, কল্পনা করুন, যদি এই পোড়া দেশটাতে অনৈক্যের বদলে ঐক্য থাকত, অসহিষ্ণুতার পরিবর্তে সহিষ্ণুতা, নিয়ম ভাঙার জায়গায় নিয়মপালন, যদি থাকত দুর্নীতির জায়গায় সামান্য এক চিমটে সুনীতি, সকাল-সন্ধ্যায় সুশাসনের সুবাতাস যদি একবারও বইত, তা হলে কী হতো? তা হলে শুধু ভানুমতীর খেলের দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথার সোনার বাংলা নয়, গিলটি-করা সোনার বাংলাদেশ নয়, সত্যিকারের খাঁটি সোনার বাংলাদেশ হতো আমাদের জন্মভূমি, এ দেশের সোনার মানুষেরা যেটার হকদার। শুধু কথা আর কথা, কথার তোড়ে মনে হয় ভেসে যাবে বাংলাদেশ। আর সেসব কথা যারা বলেন তারা তাদের শ্রোতৃমণ্ডলীকে যে কী রূপ গরু-ছাগল মনে করেন ভাবা যায় না। এর অনেকগুলোই যদি কোন সিনেমার ডায়ালগ হতো তা হলে অশ্লীলতার অভিযোগে সেন্সর বোর্ডে ধরা খেত সেই সিনেমা। এতদিনেও আমরা জানলাম না, শুধু কথায় যদি চিঁড়া ভিজত তা হলে ঠাটারিবাজার-মৌলভীবাজার-শ্যামবাজারের আড়ত বোঝাই চিঁড়ার একটা চিঁড়াও শুকনা থাকত না।
সর্বশেষ যে আত্মঘাতী প্রবণতা আমাদের অনেক কর্ণধারকে পেয়ে বসেছে তা হল, জাতির ভেতর অহেতুক বিভাজন সৃষ্টি করার প্রবণতা। বিভিন্ন বিষয়ে, বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা শাদা, ওরা কাল, আমরা লম্বা, ওরা খাটো, আমরা মটকু ওরা শুটকু- এসব বলে খামাখা ঘোঁট পাকানো হচ্ছে। মানুষ মরছে নিজের জ্বালায়...পেটের ধান্দা, চান্দাবাজের চান্দা, কোনটা সস্তা, নূন না খুন, সেসব হিসাব-নিকাশ নিয়ে চোখে ঘুম নেই তার। আপনারা যেসব উচ্চাঙ্গের কথাবার্তা বলে মাঠ গরম করে বেড়াচ্ছেন এগুলো বাদ দিয়ে কী করে জিনিসপত্রের দাম কমাবেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াবেন, মানুষকে 'বা'জিদের' হাত থেকে বাঁচাবেন (নোয়াখালী-চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাবাজি কথার সংক্ষিপ্ত এবং বহুল উচ্চারিত রূপ 'বা'জি'। এখানে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ইত্যাদিতে বিশেষ নৈপুণ্য প্রদর্শনকারী বাবাজিদের সবিশেষ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বাবাজি বা বা'জি বলা হয়েছে।) সেই চিন্তা করুন। ভুলে যাবেন না, গত কিছুদিন যাবৎ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে এসে টাকা লগি্ন করতে বললেই শুনতে হয় : আগে তোমাদের দেশের বিনিয়োগকারীদের মালপানি ঢালতে বল, তারপর আমরা আসব। আমাদের বা'জি, মাস্তান ও তাদের গুরুদের খবর বিদেশীরা ঠিকই রাখে। তারপর পদ্মা সেতু যা একখানা সনদ উপহার দিল তাতে এই কলঙ্কতিলক মুছতে যে কতদিন লাগে। তাও যদি শেয়ালের হাতের লাঠি কামড়ে না ধরে ঠ্যাংয়ে কামড়টা বসাতেন তাও একটা কথা ছিল। পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি,---এবং বোধ করি, সাগর-রুনিও,---এসব ক্ষেত্রে আসামি নম্বর ১-কে বেকসুর খালাস দিয়ে হুকুমের চাকরদের ফাঁসিতে ঝুলালে এর ফল কিন্তু ভাল হবে না। কসম আল্লাহর, ক্ষমতায় গিয়ে আপনারা পাবলিককে যতটুকু আহাম্মক ঠাওরান, তারা কিন্তু তা না। আসলে গদিতে বসেই আপনারা হয়ে যান উটপাখি, বিপদ দেখলেই মাথা গুঁজেন বালুকারাশিতে, মনে করেন 'কুল্লু খালাস,' আর কোন ভয় নেই, আমাকে কেউ দেখছে না। আবার উটপাখির মত আপনাদের হজমশক্তিও হঠাৎ করে অস্বাভাবিকরকম বৃদ্ধি পায়, সামনে যা পান তাই কড়কড় করে সাবাড় করেন---জমি-জিরাত, খালবিল, দালানকোঠা, টেন্ডার, মানী লোকের মান-ইজ্জত, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। সব।
আর লক্ষ্য থাকে একটাই : ক্ষমতা। যে করে হোক ক্ষমতা চাই। 'বাই মিনস্ ফেয়ার অর ফাউল'। তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার স্থায়ী ক্ষমতা চাই। অতএব, কমরেডস্, ঝাঁপিয়ে পড়। বেটাদের বাঁশ দাও। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ বাঁশ। দেশের শান্তিশৃঙ্খলা? ইকোনমি? হেল উইথ দিজ। আগে ক্ষমতা, পরে ওসব দেখা যাবে। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। আগামী নির্বাচনী ইশতেহারে না হয় ওসব বিষয়ে ভাল করে লিখে দেব।
পরিশেষে দেশের আপামর মরিচ-পেঁয়াজ-আদা-হলুদ ইত্যাদির পক্ষ থেকে তাদেরই মুখের ভাষায় সনির্বন্ধ অনুরোধ : শ্রীচরণেষু! হে শ্রীল শ্রীযুক্ত পরম ক্ষমতাধর মহামহিম পাটা-পুতাইল, ২০১৩ সালটাতে ঘষাঘষির ব্যাপারটিতে, ফর গডস্ সেক, আপনারা একটু ক্ষেমা দেন।
কথাটা শুনে ভিড়ের পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল : ক্ষেমা দিবে না ছাই। জানেন না, মরিচ-হলুদ-পেঁয়াজ এসব দেখলে পাটা-পুতাইলের মুখ দিয়া নাল ঝরতে শুরু করে।
হায়রে কপাল!
লেখক : সাবেক সচিব, কবি ও কলামিস্ট
কিন্তু শুধু চাইলেই কি সব আশা পূরণ হয়? আমাদের সব দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা-বঞ্চনার অবসান, সব সমস্যার সমাধান কি শুধু আমাদের চাওয়া-চাওয়ির ওপরই নির্ভরশীল? নিশ্চয়ই না। পৃথিবীর কোনো দেশের, কোনো জাতির সমস্যার সমাধান এভাবে হয়নি, হবেও না। ইংরেজি ভাষার সেই মোক্ষম প্রবাদবাক্যটি আমরা সবাই জানি : ইফ উইশেস ওয়্যার হর্সেস, বেগারস্ উড হ্যাভ রিডেন... ইচ্ছাগুলো যদি ঘোড়া হতো, ভিক্ষুকেরাও ঘোড়া দৌড়াত। কিন্তু অমন অলৌকিক কিছু বাস্তবে ঘটে না। বাস্তবে ঘোড়ার মালিক হতে হলে সামর্থ্য অর্জন করতে হয়।
আর যখনই সামর্থ্যের কথা ওঠে, আমার অবাক লাগে। বাংলাদেশের কি সামর্থ্য নেই? বাংলাদেশ সম্বন্ধে স্বাধীনতার পর পরই যে দুর্বাসা মুনি মন্তব্য করেছিল দেশটা একটা তলাহীন ঝুড়ি, সে কি এখন সাহস করে কথাটা আবার উচ্চারণ করতে পারবে? জানি সে একটা সময় ছিল যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশে সবই ছিল বিপর্যস্ত, এলোমেলো, তখন রক্তস্নাত সদ্য স্বাধীন দেশটির ওপর অনেকেরই শ্যেনদৃষ্টি ছিল, এ কথা কে না জানে। তখন বাংলাদেশ সম্বন্ধে উল্টাসিধা যেকোনো মন্তব্য করতে কারো মুখে বাধত না। ওই যে গ্রামদেশে যে বলে, 'গরিবের বউ সকলের ভাবি', সেই অবস্থা আর কি। কিন্তু এখন কোন বাপের বেটা বাংলাদেশকে নিয়ে এ রকম ঠাট্টা-মশকরা করুক তো দেখি।
একাত্তরের এ দেশের সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে ডাবলেরও বেশি হয়েছে, সমস্যার পর্বত ছুঁই ছুঁই করছে আকাশ, তবু আর কিছু না হোক, ষোল কোটি মানুষ এখন দুই বেলা খেয়েদেয়ে বেঁচে-বর্তে আছে, এখন তারা আর আদুল গায়ে এবাড়ি-ওবাড়ি যায় না, নগ্নপদে এক জোড়া চটিও জুটেছে তাদের। এগুলো হলো কী করে? নিশ্চয়ই আকাশ ফুঁড়ে আসেনি? কোনো বিগ ব্রাদারের মোসাহেবি করে, দেশটাকে কারো করদ রাজ্য বানিয়ে, কারো দরজায় গিয়ে হাত পেতে মুষ্টিভিক্ষা নিয়ে এসে তো এ দেশ চলছে না, এ দেশ চলছে সেই জাদুমন্ত্রে, যা একদিন এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে একতাবদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে ছিনিয়ে আনতে। বুকের রক্ত দিয়ে যারা স্বাধীনতা এনেছিল, তাদেরই উত্তরসূরীরা এখন মাঠে ফসল ফলাচ্ছে রেকর্ড পরিমাণ, বিদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা উপার্জন করে নিয়ে এসে মায়ের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে, পূর্ণ করছে বাপের স্বপ্ন। লাখ লাখ তরুণী সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাজ করছে কল-কারখানায়। এ দেশের ছেলেরামেয়েরা ডাবগাছে চড়ে ডাব পাড়ার মতো দুড়দাড় করে উঠে পড়ছে এভারেস্টের চূড়ায়। নোবেল পুরস্কার, ম্যাগসাসাই পুরস্কার আমাদের বাড়িতে এসে দিয়ে যায় বোদ্ধারা। দেশে-বিদেশে যুগান্তকারী সব সাফল্যও অর্জন করছে এ দেশের বর্তমান প্রজন্মের মানুষ। অতএব বাংলাদেশকে এখন সমঝে কথা বলার সময় এসেছে।
আসলে আমরা পরস্পরকে খোঁচাখুঁচি, খামচা-খামচিতে এত ব্যস্ত যে আমাদের অপার সম্ভাবনার দিকগুলোর দিকে একবার ভালো করে তাকিয়েও দেখি না। আর আমাদের নিজেদের টনক না নড়লেও যারা আমাদের 'সোয়া হুয়া রুস্তম' ভাবে, তারা তো তাদের নাতিপুতিদের বলতে শুরু করে দিয়েছে : তোমরা এখন থেকে বাংলাদেশকে সালাম করতে শেখো, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর তোমাদের দিয়ে ওই দেশের মানুষ তাদের পা টেপাবে। সব পাওনা-গণ্ডা সুদে-মূলে আদায় করে নেবে তারা।
আমি বলি, পঞ্চাশ বছর পর কী হবে না হবে জানি না, তবে যারা ৯ মাসে একটি দেশকে একটি দানবীয় শক্তির হাত থেকে মুক্ত করে পৃথিবীকে চমকে দিতে পেরেছে, মাত্র ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি খাঁচার ভেতর তাদেরই উত্তরাধিকারী ১৬ কোটি আদমসন্তান শুধু যে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসই ফেলছে তা নয়, বন্যা-খরা, আইলা-সিডর-সাইক্লোন সামাল দিয়ে নিজেদের অন্ন-বস্ত্রেরও জোগান দিচ্ছে, বিশ্বসভায় প্রতিনিয়ত জানান দিচ্ছে তাদের সগৌরব উপস্থিতির। তারা চাওয়ার মতো চাইলে যে সব কিছু করতে পারে তা বিশ্ববাসী জেনে গেছে। অশিক্ষা-কুশিক্ষা, মারামারি-কাটাকাটি, চুরি-চামারি সত্ত্বেও দেশটা তো এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বজোড়া মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশগত বিপর্যয় ইত্যাদি হাজারটা সমস্যার বেড়াজালে জবুথবু পৃথিবীর হাতেগোনা যে কয়টি দেশের প্রবৃদ্ধির হার এখনো গোঁয়ারের মতো মাথা তুলে এগিয়ে যাচ্ছে, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বাংলাদেশ, আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ, তাদের মধ্যে অন্যতম। আমি নিশ্চিত, উন্নত বিশ্বে হইচই পড়ে গেছে : কেইসটা কী? যে পোলার ফেইলই টেকার কথা না, সে জিপিএ-৫ পায় কেমনে? নিশ্চয়ই নকল-টকল করেছে। আমি বলি, জ্বী না, নকল করে নোবেল পাওয়া যায় না। এই বাঙালি পোলাপান-মাইয়াপান সব পারে। শুধু ঠিক জায়গা মতো বসিয়ে দিলে হলো, এক সিটিংয়ে একটানা ১৫-১৬ ঘণ্টা কাজ করে ইউরোপ-আমেরিকার ফাটাফাটি ব্র্যান্ডের বস্তা বস্তা চোখ ধাঁধানো পোশাক-আশাক নামিয়ে দিতে পারে এই মাত্র সেদিন অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা ক্ষেতমার্কা ছেলেমেয়েরা। এরা কাজ করতে জানে, কাজ করে দুটি কর্মব্যস্ত হাত দিয়ে, তীক্ষ্ন ধীশক্তি দিয়ে, একটি ইস্পাতকঠিন সঙ্কল্প মনের মধ্যে পুষে। এদের ঘুম-নেই চোখে স্বপ্নের বুড়বুড়ি : একদিন টিনের ছাপড়া ঘর ছেড়ে উঠবে গিয়ে একটি পাকা দালানে, মা-বাবাকে গ্রামের পূতিগন্ধময় পরিবেশ থেকে নিয়ে আসবে সেখানে। দু'চোখে তাদের একটা শান্তির নীড় বাঁধার স্বপ্ন। এরা প্রবাসে গিয়ে আরও একশটা দেশের শ্রমিককে পেছনে ফেলে নজর কাড়ে তার নিয়োগকর্তার : কোন দেশ থেকে এসেছ তুমি? সে মাথা উঁচু করে বলে : বাংলাদেশ। 'ও বাংলাদেশ। ইয়েস, আই নো, ইউ পিপল আর ডুয়িং ভেরি ওয়েল।' আর আগে, অর্থাৎ সেই 'তলাহীন ঝুড়ি' খেতাব পাওয়ার দিনগুলোতে বা তার পরে, বাংলাদেশ শুনলেই এই লোকের আব্বাজান আঁতকে উঠত, যেন কলেরা-বসন্ত-এইডস-ক্যান্সারের জীবাণু একসঙ্গে গুলে কেউ তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ মানে তখন ছিল বন্যা-সাইক্লোন-দুর্ভিক্ষ-অপুষ্টির আরেক নাম। সেই অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে শুধু ক্ষেতে-খামারে, কলে-কারখানায় জীবন উৎসর্গ করে দেয়া কোটি কোটি মানুষের ঐকান্তিক চেষ্টা, অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিখাদ সততার কারণে। এই যে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বাড়ছে হু হু করে, এক কুড়ি টাকিমাছ রাখার ঝুড়িতে পাঁচ কুড়ি রাখার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে ঢাকা শহরে গাদাগাদি ঠেলাঠেলি গুঁতোগুঁতি করছে, তবুও তো বাজারে আলহামদুলিল্লাহ চাল-ডাল-মাছ-তরকারির সরবরাহের কমতি নেই। টিভিতে শাইখ সিরাজের কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠানগুলোয় বাংলাদেশের চাষীদের নিষ্ঠা, উদ্যম, পরিশ্রম ও উদ্ভাবনী শক্তি দেখে যে কারোরই তাক লাগে। যে এলাকায় জীবনে কোনদিন কলার চাষ হতো না, সে এলাকা এখন ট্রাক বোঝাই করে কলা রপ্তানি করে ঢাকায়। পেঁপের বাগান, ফুলের বাগান, কাজী পেয়ারার চাষ, উন্নত জাতের ষণ্ডা ষণ্ডা বরইয়ের চাষ- এগুলোতে হাত পাকিয়ে এখন স্ট্রবেরি ফলাচ্ছে আমাদের হাল আমলের চাষী। যে মেয়ের মায়ের হস্তশিল্পের বিদ্যার দৌড় বাচ্চার জন্য কাঁথা সেলাই আর বড়জোর ডালাটা কুলাটা বানানো পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল, সেই মেয়ের দুটি কোমল হাত এখন যন্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লন্ডন-প্যারিস-নিউ ইয়র্কের বিশ্ববিখ্যাত চেইন স্টোরগুলোর জন্য তৈরি করে 'হাই ভ্যালুড' পোশাক। ওই চাষি কিংবা ওই গার্মেন্ট মেয়েটির ভাগ্যের চাকাটি বড় একটা ঘোরেনি ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশ তো অবশ্যই 'স্লোলি বাট স্টেডিলি' এগিয়ে যাচ্ছে।
এখানে একটা টীকা যোগ করতে চাই। পাঠক, বাংলাদেশের এই এগিয়ে যাওয়ার দিকে একবার চোখ তুলে তাকান তো। কী দেখতে পাচ্ছেন? নিশ্চয়ই কোটি কোটি একর ক্ষেতি জমি, জমির বুকে শিশুর মুখের হাসির মতো শ্যামল-সবুজ-সোনালি ফসলের হাসি, আর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কাস্তে হাতে লক্ষ-কোটি কৃষক। আর না হয় শুনতে পাচ্ছেন কানে তালা লাগা অসংখ্য সেলাই মেশিনের ঘর্ঘর্ আওয়াজ, আর দেখতে পাচ্ছেন নতমুখী লক্ষ লক্ষ বালিকাকে, যারা তাদের সমস্ত চৈতন্য দিয়ে, সত্তা দিয়ে সচল রেখেছে মেশিনগুলো, যাতে করে বাংলাদেশ নামক স্বপ্নের গাড়িটির চাকা থেমে না যায়। নিরন্ন-নিবস্ত্র অসহায় মা-বাবা, ভাইবোনকে ফেলে যে সংগ্রামী তরুণটি বোটম্যান সেজে টেকনাফ উপকূল থেকে মালয়েশিয়ার সোনার হরিণের উদ্দেশে একদিন পাড়ি জমিয়েছিল, পথে সাগরে বিসর্জন দিয়েছিল কতিপয় হতভাগ্য সাথীকে, মধ্যপ্রাচ্যের ঊষর মরুর ধূসর জীবনে নাস্তানুবাদ হয়ে হয়ে যে যুবক তার আয়ু ক্ষয় করা উপার্জন পাঠাচ্ছে এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের চৌহদ্দিতে তার কথা, তাদের কথাও নিশ্চয়ই আপনার মনে পড়ে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রার মানসাঙ্ক কষতে গিয়ে। কিন্তু নিশ্চয়ই আপনার মনে পড়ে না, যারা এই অগ্রযাত্রা অনুষ্ঠানের শিল্পী নন, সঞ্চালক, যারা কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে, তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে সাফল্যের দাবিদার সাজেন তাঁদের কথা।
সাফল্য তো কেবল তৈরি পোশাক আর বিদেশে শ্রমিক রপ্তানিতেই নয়, আরো অনেক কিছুতেই ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছে তৃতীয় বিশ্বের এই সমস্যাজর্জরিত সাবেক উপনিবেশটি। গড় আয়ু পাকিস্তানি আমলের ৪০ বা তার নিচে থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০-এর বেশি, শিশুমৃত্যুর হার কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে দ্বিগুণ, শিক্ষার হার পাক আমলে যেখানে সেই ২০-এর কোটায় খাবি খাচ্ছিল, এখন তা হয়েছে ৬০ বা তারও বেশি। এমনি আরো অনেক সাফল্য-গাথা আছে। এর জন্য সরকার-বেসরকার (যেমন এনজিও) সিনা ফুলিয়ে কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। করুন। কিন্তু সবার আগে কৃতিত্বটা দেবেন কাকে? নিশ্চয়ই কৃষককে, শ্রমিককে। খেলোয়াড়দের বাদ দিয়ে জয়মাল্য নিশ্চয়ই কোচকে পরাবেন না, যে কোচ আবার বেশির ভাগ সময় সমস্যার সমাধানের চাইতে পুরো টিমের জন্য নানা ধরনের উদ্ভট সব সমস্যা সৃষ্টি করতে ব্যস্ত।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি এইসব কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষ যদি এইসব বাকসর্বস্ব নটবর-নটরাজদের হাত থেকে রক্ষা পেত, তা হলে আমাদের জিডিপি ছয় থেকে এক লাফে নয়ে চলে যেত। দুঃখের বিষয়, এই মেহনতি মানুষদের বিপরীতে মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক লোক নিজেদের আখের গোছানোর জন্য যা করছেন তা দেশের অগ্রযাত্রার পথে, বিভিন্ন সেক্টরে উৎপাদন বৃদ্ধিতে, জাতিকে সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে কোন সহায়ক ভূমিকা পালন তো করছেই না, বরং তাদের বেশির ভাগ কাজকর্ম টোট্যালি কাউন্টার প্রডাক্টিভ। তারা প্রবৃদ্ধির ধারাটিকে ছয় থেকে নয়ে নিয়ে যাওয়া নয়, বরং সবকিছু নয়ছয় না করে যেন ছাড়বেন না। তারা কোন ব্যাপারে একমত হতে পারেন না। একজন যদি বলেন 'বাইরে চমৎকার রোদ,' আরেকজনকে যেন অবশ্যই বলতে হবে, 'সারাদিন মেঘলা থাকার পর এটাকে ঠিক রোদ বলা যায় না, রোদ ওঠার চেষ্টা বলা যেতে পারে।' একজন সূর্য পূর্বদিকে ওঠে বললে অন্যজন সাথে সাথে বলবেনই : না, ঠিক পূর্বদিকে না, উত্তরপূর্ব বা দক্ষিণপূর্ব দিকে ওঠে বলা উচিত। এ যেন সম্প্রতি প্রয়াত পপ গানের প্রখ্যাত শিল্পী আযম খানের গানের সেই 'আলাল যদি ডাইনে যায়, দুলাল যায় বাঁয়ে'-র মত, দু'জন কিছুতেই একদিকে যাবে না। আর তাতেই যত বিপত্তি। তাতেই দেশজুড়ে মারামারি-কাটাকাটি-ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও-অবরোধ-হরতাল। নিচে পাটা, ওপরে পুতাইল। মাঝখানে পড়ে বেচারা জনগণ নামক মরিচ, গার্মেন্টশিল্প, লেখাপড়া, বিদেশী বিনিয়োগ নামক পেঁয়াজ-হলুদ-আদার জান যায়।
ইস, কল্পনা করুন, যদি এই পোড়া দেশটাতে অনৈক্যের বদলে ঐক্য থাকত, অসহিষ্ণুতার পরিবর্তে সহিষ্ণুতা, নিয়ম ভাঙার জায়গায় নিয়মপালন, যদি থাকত দুর্নীতির জায়গায় সামান্য এক চিমটে সুনীতি, সকাল-সন্ধ্যায় সুশাসনের সুবাতাস যদি একবারও বইত, তা হলে কী হতো? তা হলে শুধু ভানুমতীর খেলের দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথার সোনার বাংলা নয়, গিলটি-করা সোনার বাংলাদেশ নয়, সত্যিকারের খাঁটি সোনার বাংলাদেশ হতো আমাদের জন্মভূমি, এ দেশের সোনার মানুষেরা যেটার হকদার। শুধু কথা আর কথা, কথার তোড়ে মনে হয় ভেসে যাবে বাংলাদেশ। আর সেসব কথা যারা বলেন তারা তাদের শ্রোতৃমণ্ডলীকে যে কী রূপ গরু-ছাগল মনে করেন ভাবা যায় না। এর অনেকগুলোই যদি কোন সিনেমার ডায়ালগ হতো তা হলে অশ্লীলতার অভিযোগে সেন্সর বোর্ডে ধরা খেত সেই সিনেমা। এতদিনেও আমরা জানলাম না, শুধু কথায় যদি চিঁড়া ভিজত তা হলে ঠাটারিবাজার-মৌলভীবাজার-শ্যামবাজারের আড়ত বোঝাই চিঁড়ার একটা চিঁড়াও শুকনা থাকত না।
সর্বশেষ যে আত্মঘাতী প্রবণতা আমাদের অনেক কর্ণধারকে পেয়ে বসেছে তা হল, জাতির ভেতর অহেতুক বিভাজন সৃষ্টি করার প্রবণতা। বিভিন্ন বিষয়ে, বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা শাদা, ওরা কাল, আমরা লম্বা, ওরা খাটো, আমরা মটকু ওরা শুটকু- এসব বলে খামাখা ঘোঁট পাকানো হচ্ছে। মানুষ মরছে নিজের জ্বালায়...পেটের ধান্দা, চান্দাবাজের চান্দা, কোনটা সস্তা, নূন না খুন, সেসব হিসাব-নিকাশ নিয়ে চোখে ঘুম নেই তার। আপনারা যেসব উচ্চাঙ্গের কথাবার্তা বলে মাঠ গরম করে বেড়াচ্ছেন এগুলো বাদ দিয়ে কী করে জিনিসপত্রের দাম কমাবেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াবেন, মানুষকে 'বা'জিদের' হাত থেকে বাঁচাবেন (নোয়াখালী-চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাবাজি কথার সংক্ষিপ্ত এবং বহুল উচ্চারিত রূপ 'বা'জি'। এখানে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ইত্যাদিতে বিশেষ নৈপুণ্য প্রদর্শনকারী বাবাজিদের সবিশেষ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বাবাজি বা বা'জি বলা হয়েছে।) সেই চিন্তা করুন। ভুলে যাবেন না, গত কিছুদিন যাবৎ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে এসে টাকা লগি্ন করতে বললেই শুনতে হয় : আগে তোমাদের দেশের বিনিয়োগকারীদের মালপানি ঢালতে বল, তারপর আমরা আসব। আমাদের বা'জি, মাস্তান ও তাদের গুরুদের খবর বিদেশীরা ঠিকই রাখে। তারপর পদ্মা সেতু যা একখানা সনদ উপহার দিল তাতে এই কলঙ্কতিলক মুছতে যে কতদিন লাগে। তাও যদি শেয়ালের হাতের লাঠি কামড়ে না ধরে ঠ্যাংয়ে কামড়টা বসাতেন তাও একটা কথা ছিল। পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি,---এবং বোধ করি, সাগর-রুনিও,---এসব ক্ষেত্রে আসামি নম্বর ১-কে বেকসুর খালাস দিয়ে হুকুমের চাকরদের ফাঁসিতে ঝুলালে এর ফল কিন্তু ভাল হবে না। কসম আল্লাহর, ক্ষমতায় গিয়ে আপনারা পাবলিককে যতটুকু আহাম্মক ঠাওরান, তারা কিন্তু তা না। আসলে গদিতে বসেই আপনারা হয়ে যান উটপাখি, বিপদ দেখলেই মাথা গুঁজেন বালুকারাশিতে, মনে করেন 'কুল্লু খালাস,' আর কোন ভয় নেই, আমাকে কেউ দেখছে না। আবার উটপাখির মত আপনাদের হজমশক্তিও হঠাৎ করে অস্বাভাবিকরকম বৃদ্ধি পায়, সামনে যা পান তাই কড়কড় করে সাবাড় করেন---জমি-জিরাত, খালবিল, দালানকোঠা, টেন্ডার, মানী লোকের মান-ইজ্জত, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। সব।
আর লক্ষ্য থাকে একটাই : ক্ষমতা। যে করে হোক ক্ষমতা চাই। 'বাই মিনস্ ফেয়ার অর ফাউল'। তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার স্থায়ী ক্ষমতা চাই। অতএব, কমরেডস্, ঝাঁপিয়ে পড়। বেটাদের বাঁশ দাও। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ বাঁশ। দেশের শান্তিশৃঙ্খলা? ইকোনমি? হেল উইথ দিজ। আগে ক্ষমতা, পরে ওসব দেখা যাবে। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। আগামী নির্বাচনী ইশতেহারে না হয় ওসব বিষয়ে ভাল করে লিখে দেব।
পরিশেষে দেশের আপামর মরিচ-পেঁয়াজ-আদা-হলুদ ইত্যাদির পক্ষ থেকে তাদেরই মুখের ভাষায় সনির্বন্ধ অনুরোধ : শ্রীচরণেষু! হে শ্রীল শ্রীযুক্ত পরম ক্ষমতাধর মহামহিম পাটা-পুতাইল, ২০১৩ সালটাতে ঘষাঘষির ব্যাপারটিতে, ফর গডস্ সেক, আপনারা একটু ক্ষেমা দেন।
কথাটা শুনে ভিড়ের পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল : ক্ষেমা দিবে না ছাই। জানেন না, মরিচ-হলুদ-পেঁয়াজ এসব দেখলে পাটা-পুতাইলের মুখ দিয়া নাল ঝরতে শুরু করে।
হায়রে কপাল!
লেখক : সাবেক সচিব, কবি ও কলামিস্ট
No comments