আমার সৌভাগ্য আমি আর পাকিস্তানি নই by ওয়াহিদ নবি
ভারতের যে অঞ্চলগুলোতে মুসলিম সংখ্যাধিক্য ছিল, সেই অঞ্চলগুলো নিয়ে মুসলমানদের জন্য পৃথক বাসভূমি গঠনের দাবি জানায় মুসলিম লীগ। কিন্তু বলতে যত সহজ, বাস্তবে বিষয়টি তার চেয়ে অনেক জটিল।
একদল মুসলমান নেতা ভারত বিভক্তির বিরুদ্ধে মত দিলেন। মোল্লা আবুল কালাম আজাদ, সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফফার খান প্রমুখ ছিলেন এই দলে। দেখা গেল, ভারতের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান রয়ে গেল বা থাকতে বাধ্য হলো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ভারতের সঙ্গে। বাকি দুই-তৃতীয়াংশের ৫৬ শতাংশ রইল পূর্ব ভাগে, যে অংশটির নামকরণ হলো 'পূর্ব পাকিস্তান'। বাকি ৪৪ শতাংশের আবাসভূমি হলো পশিম পাকিস্তান। পাকিস্তান সৃষ্টির আরেকটি ফল হলো এই যে পাঞ্জাব ও বাংলা এই দুটি বড় প্রদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। লাখ লাখ মানুষ ছিন্নমূল হয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তান সংখ্যালঘিষ্ঠ হলেও দেশটির রাজধানী হলো সেখানে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পঁচানব্বই শতাংশের জন্মভূমি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর সদর দপ্তরও করা হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল চারটি প্রদেশ। এগুলোর ছিল ভিন্ন ভিন্ন ভাষা। ছিল ভিন্ন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও উত্তরাধিকার। এই জাতিগত পার্থক্যের জন্য সৃষ্ট সমস্যাগুলোর দিকে পাকিস্তান সরকার ভ্রূক্ষেপ করল না। 'পাকিস্তান : বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি' বইটির লেখক হোসেন হক্কানি লিখেছেন যে সরকার আসল সমস্যাগুলোর প্রকৃত সমাধান খোঁজার চেষ্টা না করে সব সমস্যার সমাধানের উপায় হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করল। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল, কাজেই সব সমস্যার সমাধান হবে ধর্মের ভিত্তিতে- এই ছিল পাকিস্তানি শাসকদের মনোভাব।
ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে এলো আরো কয়েকটি নীতি বা কৌশল। সংখ্যালঘুদের সমস্যার সমাধান হিসেবে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার উপহার দেওয়া হলো। বৃহত্তম প্রদেশের অধিবাসী পাঞ্জাবিরা হলো সব রকমের সুযোগ-সুবিধার অধিকারী। কিন্তু রাজনৈতিক প্রাধান্য রইল ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রদেশ থেকে আসা মোহাজের নেতাদের হাতে। পাকিস্তানের জন্মের আগেই অবিভক্ত ভারতের মুসলিম লীগ নেতৃত্বে এই
মনোভাব দেখে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন, যে প্রদেশগুলোতে নির্বাচনে জয়লাভ করে মুসলমানরা মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল, মুসলিম লীগের নেতৃত্বে সেসব প্রদেশের প্রতিনিধিরা স্থান পাননি। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে বহাল তবিয়তে ছিলেন মুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রদেশগুলোর নেতারা।
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হলো উর্দুকে। সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানুষের মাতৃভাষাকে তো অগ্রাহ্য করা হলোই, অগ্রাহ্য করা হলো দেশের ৫৬ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা।
ভারত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই ভারতবিরোধী প্রচার চালানো হলো অবিরাম। এই শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করবে কে? কে আবার? একমাত্র সেনাবাহিনী তা করতে পারে। কাজেই শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করতে হবে। অর্থ সেদিকেই প্রবাহিত হতে থাকল। এই যে ব্যবস্থাগুলো- অর্থাৎ ইসলাম, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার, উর্দু ভাষা ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী; এর বাইরে কিছু বললেই তা দেশদ্রোহ। যে বলবে সে ভারতের এজেন্ট।
আরেক সমস্যার মুখোমুখি হলেন পাকিস্তানের নেতারা, আর সেটা হলো আফগানিস্তান। আফগানরা মুসলমান। কাজেই ভারতের ব্যাপারে যে কৌশল কাজ করেছিল, আফগানিস্তানে তা কাজে লাগানো যায় না। একটা বড় সমস্যা হচ্ছে জাতিগত। পশতুনরা পাকিস্তান ও আফগানিস্তান দুই দেশেই রয়েছে। তারা খুশি হতো নিজেদের জন্য স্বাধীন পাখতুনিস্তান পেলে। পাকিস্তান এটা পছন্দ করে না। তারা আফগানিস্তানকে সন্দেহ করে পশতুনদের উস্কিয়ে দেওয়ার জন্য। আবার আফগানিস্তান অপেক্ষাকৃত ছোট দেশ হওয়ায় মাতব্বরি করার একটা ইচ্ছা তো আছেই পাকিস্তানিদের। আফগানিস্তানের নিজের কিছু সমস্যা রয়েছে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন জাতি রয়েছে, যাদের মধ্যে সব সময় সদ্ভাব থাকে না। রাজনৈতিক সমস্যা হচ্ছিল। রাজা ছিলেন সেখানে, অবশ্য এখন আর নেই। কমিউনিস্টরা সেখানে বেশ শক্তিশালী ছিল। আবার রয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। এসবের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশের জন্য একটা বড় সমস্যা ডেকে এনেছিল। আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারের সাহায্যে সোভিয়েত রাশিয়া এগিয়ে এলে মুসলমানরা আন্তর্জাতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সঙ্গে যোগ দেয় আমেরিকা। এ সময় পাকিস্তান একটা বড় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সোভিয়েতরা চলে গেলে আফগানিস্তানের ব্যাপারে আমেরিকার আগ্রহ কমে যায়। অর্থ সাহায্য কমে যাওয়ায় পাকিস্তানের আফগান ট্রেনিংকেন্দ্রগুলো অসুবিধায় পড়ে। রব্বানি, হেকমতিয়ার, মাসুদ এবং তাদের লোকজন পাকিস্তানেই প্রশিক্ষণ লাভ করে। এদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। মাসুদের দল আফগানিস্তান দখল করে ও শাসন করে। পরে পাকিস্তানের সরাসরি সাহায্যে তালেবানরা মাসুদদের হটিয়ে আফগানিস্তান দখল করে। কিন্তু টুইন টাওয়ার ভাঙার পর আমেরিকার সঙ্গে তালেবানদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। আমেরিকা আফগানিস্তান আক্রমণ করলে পাকিস্তান দৃশ্যত তালেবানদের পরিত্যাগ করে। কারণ হিসেবে পাকিস্তানের সেনা রাষ্ট্রপতি পারভেজ মোশাররফ বলেন যে পাকিস্তানের বড় দুটি স্বার্থ আণবিক বোমা ও কাশ্মীরের জন্য আমেরিকার সাহায্য দরকার হবে বলেই এক সময়ের মিত্র তালেবানদের পরিত্যাগ করা হয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক আরেকটা পিচ্ছিল বিষয়, যেটা পরে আলোচনা করা হবে।
কাশ্মীরের বিষয়টি একটি জটিল সমস্যা। পাকিস্তান কাশ্মীরের গেরিলাদের ট্রেনিং দেয়। অস্ত্র দেয়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কাশ্মীরি ইনসার্জেন্টদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাও পাঠায় ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে। '৪৮-এর যুদ্ধ এভাবে শুরু হয়েছিল। '৬৫-এর যুদ্ধ এভাবেই শুরু হয়েছিল। কারগিলের বৃহৎ সমস্যার কারণও কাশ্মীর। এ সমস্যা চলছেই।
আসলে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য যখন মুসলিম লীগের নেতারা ইসলামকে ব্যবহার করছিলেন, তখন তাঁরা চিন্তা করেননি যে পাকিস্তান সৃষ্টির পর দেশের সব সমস্যার সমাধান ধর্মের দ্বারা করা সম্ভব হবে না। আয়েশা জামাল তাঁর 'দ্য স্টেট অব মার্শাল রুল' বইয়ে এই জটিল সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। মনে হয়, পাকিস্তানের জন্মের পর জিন্নাহ সাহেবের মনে হয়তো বিষয়টি এসেছিল, তাই তিনি গণপরিষদে বক্তৃতা দেওয়ার সময় বলেছিলেন যে 'সবার ধর্ম আলাদা আলাদা হলেও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সবাই পাকিস্তানি।' কিন্তু তিনি বেশি দিন জীবিত ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের তিনটি নীতির ঘোষণা দেন- (ক) দেশের অখণ্ডতা, (খ) ইসলাম ধর্ম, (গ) অর্থনৈতিক অগ্রগতি।
কিন্তু টাকা আসবে কোথা থেকে? মার্কিনরা অর্থ নিয়ে এগিয়ে এলো। মার্গারেট বুর্ক-হোয়াইট তাঁর 'হাফ ওয়ে টু ফ্রিডম' বইয়ে বলেছিলেন, 'পাকিস্তান সরকারের প্রবণতা হচ্ছে, অন্যের দুর্বলতা নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা।' এই সময়টিতে চলছিল ঠাণ্ডাযুদ্ধ। আমেরিকা ও সোভিয়েতের মধ্যে তখন চলছিল ভীষণ প্রতিযোগিতা। সোভিয়েতের দক্ষিণ দিকে পাকিস্তান ও আরো কয়েটি দেশ। পাকিস্তানের অবস্থান আমেরিকার জন্য অনুকূল সোভিয়েতকে মোকাবিলা করার জন্য। এসব কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার একটা অদ্ভুত ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্কটিকে 'পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট' বলে বর্ণনা করা যায় না। পরস্পরকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার অভিপ্রায় ছিল পুরো মাত্রায়। আইয়ুব খান আমেরিকা সরকারকে বলেছিলেন, 'আমাদের সেনাবাহিনী আপনাদেরই সেনাবাহিনী।' এই সম্পর্কের ফলে পাকিস্তানের জনগণ কতটা উপকৃত হয়েছিল জানি না। তবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এতে করে লাভবান হয়েছিল। পাকিস্তানিদের একটা অনুযোগ ছিল যে আফগানিস্তানের বিরোধে পাকিস্তান অনেক সাহায্য করেছে আমেরিকাকে। কিন্তু কাশ্মীর যুদ্ধে আমেরিকা পাকিস্তানকে একটুও সাহায্য করেনি। পাকিস্তানের আণবিক বোমা তৈরির সময় পাকিস্তান আমেরিকাকে সব সময় সত্য বলেনি- এই ছিল আমেরিকার অভিযোগ। আণবিক বোমা তৈরি হয়ে গেলে আমেরিকা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে; কিন্তু কিছু পরেই তা তুলে নেয়। ডেনিস কুক্স তাঁর 'দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অ্যান্ড পাকিস্তান : ডিসএন্চ্যানটেড এলাইজ?' বইতে লিখেছেন যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আমেরিকা বারবার বলেছে; কিন্তু শিগগিরই ব্যবস্থা না নেওয়ার অজুহাত বের করেছে।' প্রেসিডেন্ট রিগান বলেছিলেন যে পাকিস্তানের আণবিক বোমা বানানোর ব্যাপারে তাঁর আপত্তি নেই, বোমাটির বিস্ফোরণ না ঘটালেই হলো। মার্কিন বন্ধুদের সমর্থনেই ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রক্ষার জন্য ৩০ লাখ বাঙালি হত্যা করেছে, হাজার হাজার বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করেছে পাকিস্তানিরা।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যকলাপ, সেনাবাহিনীর ভূমিকা ও ইসলামী দলগুলোর কর্মকাণ্ড লক্ষ করলে এই উপসংহারে পৌঁছাতে দেরি হয় না যে আমার দেশ যেন এ অবস্থায় না পড়ে। আইয়ুব খান, জিয়াউল হক ও পারভেজ মোশাররফ ৩২ বছর সেনা শাসন চালান। জে. বেগ বেসামরিক সরকারগুলোকে চালান। তিনি সুপ্রিমকোর্টের বিচারকের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, 'তিনি কোর্টের প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নন।' গোয়েন্দাবাহিনী রাজনীতিতে নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছে। নির্বাচিত সরকারকে বারবার অপসারিত করা হয়েছে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে। প্রতিবার সেনাবাহিনী সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে; কিন্তু সরকার অপসারণের কারণ ছিল অন্য। ধর্মীয় দলগুলো বিশেষ করে জামায়াত সেনাবাহিনীর ইঙ্গিতে দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে আর তার জের ধরে নির্বাচিত সরকারকে অপসারণ করেছে। প্রধান দুটি দল মুসলিম লীগ ও পিপিপি সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারেনি এবং উভয় দলের সরকার অপসারিত হয়েছে সেনাবাহিনী দ্বারা।
আজ নতুন বছরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছে- কারণ আমি আর পাকিস্তানি নই। কিন্তু এটা আমার নিজের ভাগ্যের জন্য হয়নি। ৩০ লাখ শহীদের জন্য, অসংখ্য আহতের জন্য, অসংখ্য নারীর সম্ভ্রম হারানোর জন্য, অসংখ্য মানুষের সর্বস্ব হারানোর জন্য আমি ভাগ্যবান হয়েছি। তাঁদের সবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। আর যারা আমার দেশটিকে পাকিস্তানের মতো করতে চাইছে, তাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে সাবধান হওয়া প্রয়োজন রয়েছে আমাদের।
লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের ফেলো
ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে এলো আরো কয়েকটি নীতি বা কৌশল। সংখ্যালঘুদের সমস্যার সমাধান হিসেবে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার উপহার দেওয়া হলো। বৃহত্তম প্রদেশের অধিবাসী পাঞ্জাবিরা হলো সব রকমের সুযোগ-সুবিধার অধিকারী। কিন্তু রাজনৈতিক প্রাধান্য রইল ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রদেশ থেকে আসা মোহাজের নেতাদের হাতে। পাকিস্তানের জন্মের আগেই অবিভক্ত ভারতের মুসলিম লীগ নেতৃত্বে এই
মনোভাব দেখে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন, যে প্রদেশগুলোতে নির্বাচনে জয়লাভ করে মুসলমানরা মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল, মুসলিম লীগের নেতৃত্বে সেসব প্রদেশের প্রতিনিধিরা স্থান পাননি। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে বহাল তবিয়তে ছিলেন মুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রদেশগুলোর নেতারা।
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হলো উর্দুকে। সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানুষের মাতৃভাষাকে তো অগ্রাহ্য করা হলোই, অগ্রাহ্য করা হলো দেশের ৫৬ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা।
ভারত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই ভারতবিরোধী প্রচার চালানো হলো অবিরাম। এই শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করবে কে? কে আবার? একমাত্র সেনাবাহিনী তা করতে পারে। কাজেই শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করতে হবে। অর্থ সেদিকেই প্রবাহিত হতে থাকল। এই যে ব্যবস্থাগুলো- অর্থাৎ ইসলাম, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার, উর্দু ভাষা ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী; এর বাইরে কিছু বললেই তা দেশদ্রোহ। যে বলবে সে ভারতের এজেন্ট।
আরেক সমস্যার মুখোমুখি হলেন পাকিস্তানের নেতারা, আর সেটা হলো আফগানিস্তান। আফগানরা মুসলমান। কাজেই ভারতের ব্যাপারে যে কৌশল কাজ করেছিল, আফগানিস্তানে তা কাজে লাগানো যায় না। একটা বড় সমস্যা হচ্ছে জাতিগত। পশতুনরা পাকিস্তান ও আফগানিস্তান দুই দেশেই রয়েছে। তারা খুশি হতো নিজেদের জন্য স্বাধীন পাখতুনিস্তান পেলে। পাকিস্তান এটা পছন্দ করে না। তারা আফগানিস্তানকে সন্দেহ করে পশতুনদের উস্কিয়ে দেওয়ার জন্য। আবার আফগানিস্তান অপেক্ষাকৃত ছোট দেশ হওয়ায় মাতব্বরি করার একটা ইচ্ছা তো আছেই পাকিস্তানিদের। আফগানিস্তানের নিজের কিছু সমস্যা রয়েছে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন জাতি রয়েছে, যাদের মধ্যে সব সময় সদ্ভাব থাকে না। রাজনৈতিক সমস্যা হচ্ছিল। রাজা ছিলেন সেখানে, অবশ্য এখন আর নেই। কমিউনিস্টরা সেখানে বেশ শক্তিশালী ছিল। আবার রয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। এসবের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশের জন্য একটা বড় সমস্যা ডেকে এনেছিল। আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারের সাহায্যে সোভিয়েত রাশিয়া এগিয়ে এলে মুসলমানরা আন্তর্জাতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সঙ্গে যোগ দেয় আমেরিকা। এ সময় পাকিস্তান একটা বড় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সোভিয়েতরা চলে গেলে আফগানিস্তানের ব্যাপারে আমেরিকার আগ্রহ কমে যায়। অর্থ সাহায্য কমে যাওয়ায় পাকিস্তানের আফগান ট্রেনিংকেন্দ্রগুলো অসুবিধায় পড়ে। রব্বানি, হেকমতিয়ার, মাসুদ এবং তাদের লোকজন পাকিস্তানেই প্রশিক্ষণ লাভ করে। এদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। মাসুদের দল আফগানিস্তান দখল করে ও শাসন করে। পরে পাকিস্তানের সরাসরি সাহায্যে তালেবানরা মাসুদদের হটিয়ে আফগানিস্তান দখল করে। কিন্তু টুইন টাওয়ার ভাঙার পর আমেরিকার সঙ্গে তালেবানদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। আমেরিকা আফগানিস্তান আক্রমণ করলে পাকিস্তান দৃশ্যত তালেবানদের পরিত্যাগ করে। কারণ হিসেবে পাকিস্তানের সেনা রাষ্ট্রপতি পারভেজ মোশাররফ বলেন যে পাকিস্তানের বড় দুটি স্বার্থ আণবিক বোমা ও কাশ্মীরের জন্য আমেরিকার সাহায্য দরকার হবে বলেই এক সময়ের মিত্র তালেবানদের পরিত্যাগ করা হয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক আরেকটা পিচ্ছিল বিষয়, যেটা পরে আলোচনা করা হবে।
কাশ্মীরের বিষয়টি একটি জটিল সমস্যা। পাকিস্তান কাশ্মীরের গেরিলাদের ট্রেনিং দেয়। অস্ত্র দেয়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কাশ্মীরি ইনসার্জেন্টদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাও পাঠায় ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে। '৪৮-এর যুদ্ধ এভাবে শুরু হয়েছিল। '৬৫-এর যুদ্ধ এভাবেই শুরু হয়েছিল। কারগিলের বৃহৎ সমস্যার কারণও কাশ্মীর। এ সমস্যা চলছেই।
আসলে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য যখন মুসলিম লীগের নেতারা ইসলামকে ব্যবহার করছিলেন, তখন তাঁরা চিন্তা করেননি যে পাকিস্তান সৃষ্টির পর দেশের সব সমস্যার সমাধান ধর্মের দ্বারা করা সম্ভব হবে না। আয়েশা জামাল তাঁর 'দ্য স্টেট অব মার্শাল রুল' বইয়ে এই জটিল সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। মনে হয়, পাকিস্তানের জন্মের পর জিন্নাহ সাহেবের মনে হয়তো বিষয়টি এসেছিল, তাই তিনি গণপরিষদে বক্তৃতা দেওয়ার সময় বলেছিলেন যে 'সবার ধর্ম আলাদা আলাদা হলেও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সবাই পাকিস্তানি।' কিন্তু তিনি বেশি দিন জীবিত ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের তিনটি নীতির ঘোষণা দেন- (ক) দেশের অখণ্ডতা, (খ) ইসলাম ধর্ম, (গ) অর্থনৈতিক অগ্রগতি।
কিন্তু টাকা আসবে কোথা থেকে? মার্কিনরা অর্থ নিয়ে এগিয়ে এলো। মার্গারেট বুর্ক-হোয়াইট তাঁর 'হাফ ওয়ে টু ফ্রিডম' বইয়ে বলেছিলেন, 'পাকিস্তান সরকারের প্রবণতা হচ্ছে, অন্যের দুর্বলতা নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা।' এই সময়টিতে চলছিল ঠাণ্ডাযুদ্ধ। আমেরিকা ও সোভিয়েতের মধ্যে তখন চলছিল ভীষণ প্রতিযোগিতা। সোভিয়েতের দক্ষিণ দিকে পাকিস্তান ও আরো কয়েটি দেশ। পাকিস্তানের অবস্থান আমেরিকার জন্য অনুকূল সোভিয়েতকে মোকাবিলা করার জন্য। এসব কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার একটা অদ্ভুত ধরনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্কটিকে 'পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট' বলে বর্ণনা করা যায় না। পরস্পরকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার অভিপ্রায় ছিল পুরো মাত্রায়। আইয়ুব খান আমেরিকা সরকারকে বলেছিলেন, 'আমাদের সেনাবাহিনী আপনাদেরই সেনাবাহিনী।' এই সম্পর্কের ফলে পাকিস্তানের জনগণ কতটা উপকৃত হয়েছিল জানি না। তবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এতে করে লাভবান হয়েছিল। পাকিস্তানিদের একটা অনুযোগ ছিল যে আফগানিস্তানের বিরোধে পাকিস্তান অনেক সাহায্য করেছে আমেরিকাকে। কিন্তু কাশ্মীর যুদ্ধে আমেরিকা পাকিস্তানকে একটুও সাহায্য করেনি। পাকিস্তানের আণবিক বোমা তৈরির সময় পাকিস্তান আমেরিকাকে সব সময় সত্য বলেনি- এই ছিল আমেরিকার অভিযোগ। আণবিক বোমা তৈরি হয়ে গেলে আমেরিকা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে; কিন্তু কিছু পরেই তা তুলে নেয়। ডেনিস কুক্স তাঁর 'দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অ্যান্ড পাকিস্তান : ডিসএন্চ্যানটেড এলাইজ?' বইতে লিখেছেন যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আমেরিকা বারবার বলেছে; কিন্তু শিগগিরই ব্যবস্থা না নেওয়ার অজুহাত বের করেছে।' প্রেসিডেন্ট রিগান বলেছিলেন যে পাকিস্তানের আণবিক বোমা বানানোর ব্যাপারে তাঁর আপত্তি নেই, বোমাটির বিস্ফোরণ না ঘটালেই হলো। মার্কিন বন্ধুদের সমর্থনেই ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রক্ষার জন্য ৩০ লাখ বাঙালি হত্যা করেছে, হাজার হাজার বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করেছে পাকিস্তানিরা।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যকলাপ, সেনাবাহিনীর ভূমিকা ও ইসলামী দলগুলোর কর্মকাণ্ড লক্ষ করলে এই উপসংহারে পৌঁছাতে দেরি হয় না যে আমার দেশ যেন এ অবস্থায় না পড়ে। আইয়ুব খান, জিয়াউল হক ও পারভেজ মোশাররফ ৩২ বছর সেনা শাসন চালান। জে. বেগ বেসামরিক সরকারগুলোকে চালান। তিনি সুপ্রিমকোর্টের বিচারকের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, 'তিনি কোর্টের প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নন।' গোয়েন্দাবাহিনী রাজনীতিতে নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছে। নির্বাচিত সরকারকে বারবার অপসারিত করা হয়েছে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে। প্রতিবার সেনাবাহিনী সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে; কিন্তু সরকার অপসারণের কারণ ছিল অন্য। ধর্মীয় দলগুলো বিশেষ করে জামায়াত সেনাবাহিনীর ইঙ্গিতে দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে আর তার জের ধরে নির্বাচিত সরকারকে অপসারণ করেছে। প্রধান দুটি দল মুসলিম লীগ ও পিপিপি সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারেনি এবং উভয় দলের সরকার অপসারিত হয়েছে সেনাবাহিনী দ্বারা।
আজ নতুন বছরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছে- কারণ আমি আর পাকিস্তানি নই। কিন্তু এটা আমার নিজের ভাগ্যের জন্য হয়নি। ৩০ লাখ শহীদের জন্য, অসংখ্য আহতের জন্য, অসংখ্য নারীর সম্ভ্রম হারানোর জন্য, অসংখ্য মানুষের সর্বস্ব হারানোর জন্য আমি ভাগ্যবান হয়েছি। তাঁদের সবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। আর যারা আমার দেশটিকে পাকিস্তানের মতো করতে চাইছে, তাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে সাবধান হওয়া প্রয়োজন রয়েছে আমাদের।
লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের ফেলো
No comments