পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর তাপর্য অধ্যাপক by হাসান আবদুল কাইয়ূম
আল্লাহ জাল্লা শানুহুর প্রথম সৃষ্টি নূরে মুহম্মদীর মানব সুরতে পৃথিবীতে তশরীফ আনয়নের দিনটি বিশ্ব মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন। এই নূরে মুহম্মদীই হচ্ছেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নূর মুবারক।
এই নূর মুবারক থেকে বিশ্ব জগতের সবকিছু বিকশিত হয়েছে। এই নূর মুবারক সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা বিশ্ব জগত সৃষ্টির সূচনা করেন এবং তাঁকে নবুওয়ত ও রিসালতে অভিষিক্ত করে নবুওয়ত ও রিসালতেরও সূচনা করেন। প্রিয়নবী (সা) বলেছেন : আমি রসূলগণের ভূমিকা এবং নবীদের উপসংহার।কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : স্মরণ কর, সেই সময়কার কথা যখন আল্লাহ নবীদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তোমাদেরকে আমি যে কিতাব ও হিকমত দেব শপথ, আর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থকরূপে একজন রসূল আসবেন তখন নিশ্চয়ই তোমরা তাঁকে বিশ্বাস করবে এবং তাকে সাহায্য করবে। তিনি (আল্লাহ) বলেন, তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এতদসংক্রান্ত অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তারা বললো, আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন : তবে তোমরা সাক্ষী থাকো এবং আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষী থাকলাম। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত ৮১)।
এই আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হযরত আলী রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ‘আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু বলেছেন যে, আল্লাহ সব নবীর কাছ থেকে হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের সম্পর্কে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তাঁরা যদি তাঁর আমল পান তাহলে তাঁর উপর ঈমান এনে তাঁকে সাহায্য করবেন আর যদি না পান তাহলে পরবর্তীদের কাছে এ খবর পৌঁছে দেবার জন্য অনুসারীদের বলে যাবেন।
নানা পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন, বিয়োজন ও ভাষান্তর হওয়া সত্ত্বেও আমরা লক্ষ্য করি, ইয়াহুদী ও খ্রীস্টানদের ধর্মগ্রন্থে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর নবুওয়তের এবং তাঁর পৃথিবীতে আগমনের আগাম খবর বিধৃত হয়েছে। তওরাতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর নাম মুবারক ‘আহমদ’ দৃষ্ট হয় ‘হিমদা’ উচ্চারণে। জেরুজালেমে সোলায়মানের ইবাদত- গাহে আগুন লেগে পুড়ে গেলে এবং ইয়াহুদীদের দীর্ঘকাল বন্দিত্বের যন্ত্রণার মধ্যে দিন গুজরানকালে তাদের একজন মহানবীর (স) আগমনের আগাম খবর দেয়া এইভাবে : ও রিষষ ংযধশব ধষষ হধঃরড়হং, ধহফ ঃযব ঐরসফধ ড়ভ ধষষ হধঃরড়হং রিষষ পড়সব ধহফ ও রিষষ ভরষষ ঃযরং যড়ঁংব রিঃয মষড়ৎু, ংধুং ঃযব ষড়ৎফ ড়ভ যড়ংঃং.
মহাপ্রভু বলেন : আমি প্রকম্পিত করে দেবো সব জাতিকে, অতঃপর সব জাতির হিমদা আসবে এবং আমি পূর্ণ করবো এই গৃহকে গৌরব দ্বারা। (ঐধমমধর, ১১, ৭-৯)। এখানে উল্লেখ্য যে, হিব্রু হিমদা ও আরবী আহমদ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ একই।
অন্যত্র বলা হয়েছে যে, মহাপ্রভু বলেন : ইবযড়ষফ, ও রিষষ ংবহফ সু গধংংবহমবৎ, ঝঁফফবহষু যব রিষষ পধসব ঃড় ঃযরং ঃবসঢ়ষব. ঐব রং ঃযব ধফড়হধর যিড়স ুড়ঁ ফবংরৎব ধহফ ঃযব সধংংবহমবৎ ড়ভ ঃযব পড়াবহধহঃ রিঃয যিড়স ুড়ঁ ধৎব ঢ়ষবধংবফ ষড়, যব রং পড়সরহম.
দেখো, আমি আমার রসূল প্রেরণ করবো, সহসা তিনি আসবেন এই ইবাদত-গৃহে তিনি সেই আদোনেই (প্রভু) যাঁকে তোমরা চাও এবং তিনিই সেই প্রতিশ্রুত নবী যিনি এলে তোমরা খুশি হবে। দেখো, দেখো, তিনি আসছেন (গধষধশযর ওওও.ও)। এখানে লক্ষণীয় যে, প্রিয়নবী (সা.)-এর নবুওয়তের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে আত্মার জগতে নবী-রসূলদের যে মীসাক ঈড়াবহধহঃ গ্রহণ করা হয়েছিল তার উল্লেখ রয়েছে এই উক্তিতে এবং তিনি যে জেরুজালেমে মসজিদুল আকসায় তশরীফ আনবেন তারও উল্লেখ রয়েছে। এটা সকলেরই জানা, মিরাজ গমনকালে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম প্রথম মসজিদুল আকসায় তশরীফ এনেছিলেন এবং এখানে নবী-রসূলগণের জামাআতে ইমামতি করেছিলেন। এটাও সকলের জানা যে, তিনি উর্ধ গমনকালে যে পাথরখানির ওপর কদম মুবারক রেখেছিলেন সেই পাথরটি হযরত সুলায়মান (আ.)-এর ইবাদতগাহের স্মৃতি বহন করে। জেরুজালেমে যে সোনালী গম্বুজবিশিষ্ট অষ্টকোণাকৃতির প্রাসাদ বা উড়সব ড়ভ ঃযব জড়পশ বিদ্যমান তা সেই পাথরটিকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয়।
বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট অর্থাৎ নতুন নিয়মে সুসমাচারে দেখা যায়, প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর আগমনের আগাম খবর বিধৃত আছে। যোহন বলেছেন : ঞযবৎব রং ড়হব ঃযধঃ পড়সবং ধভঃবৎ সব যিড় রং ংঃৎড়হমবৎ ঃযধহ ও, ঃযব ষধপব ড়ভ যিড়ংব ংযড়বং ও ধস হড়ঃ ড়িৎঃযু ঃড় ঁহঃরব, যব রিষষ নধঢ়ঃরংব ুড়ঁ রিঃয ঃযব ংঢ়রৎরঃ ধহফ রিঃয ভরৎব.
আমার পরে এমন একজন আসছেন যিনি আমার চেয়ে অধিক বলবান, তাঁর জুতোর ফিতে খুলে দেবার যোগ্যও আমি নই, তিনি তোমাদেরকে বাপ্তাইজ করবেন মনন ও দ্যুতি দ্বারা (ঔড়যহ, ১.২৬-২৭)
আমরা আরও দেখতে পাই বাইবেলে পেরিক্লাইটস, প্যারাক্লেট, প্যারাক্যালন, কম্ফোরটার ইত্যাদি নাম উচ্চারণ করে একজন শেষ নবীর আগমনের আগাম খবর বিধৃত হয়েছে। যীশু বলেন : ও রিষষ ঢ়ৎধু ঃযব ভধঃযবৎ, ঐব ংযধষষ মরাব ুড়ঁ ধহড়ঃযবৎ পড়সভড়ৎঃবৎ (ঢ়বৎরয়ষুঃধং) ঃযধঃ যব সধু ধনরফব রিঃয ুড়ঁ ভড়ৎ বাবৎ.
Ñআমি আমার স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করব এবং তিনি তোমাদেরকে আরেকজন সান্ত¡নাদাতা দেবেন, যেন তিনি তোমাদের সঙ্গে চিরকাল থাকেন। (ঔড়যহ, ীরা.১৬) এখানে লক্ষণীয় যে, ঐব সধু ধনরফব রিঃয ুড়ঁ ভড়ৎ বাবৎ দ্বারা কিয়ামত পর্যন্ত যে মহানবীর (স) নবুওয়ত অব্যাহত থাকবে সেই মহানবী হযরত মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের কথাই বলা হয়েছে। তিনি খাতামুননাবীয়ীন, তিনি শেষ নবী। তাঁর পর আর কোন নবী আসবেন না। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, বাইবেলের যে প্যারাক্লেট, পেরিক্লাইটস প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোর অর্থও যা, আরবী আহমদ শব্দের অর্থও তা-ই।
আমরা দেখতে পাই, যীশু বলেন, ঐড়নিবরঃ ঃযব ংঢ়রৎরঃ ড়ভ ঃৎঁঃয রং পড়সব, যব রিষষ মঁরফব ুড়ঁ রহ ঃড় ধষষ ঃৎঁঃয, ভড়ৎ যব ংযধষষ হড়ঃ ংঢ়বধশ ড়ভ যরসংবষভ, নঁঃ যিধঃংড়বাবৎ যব ংযধষষ যবধৎ, ঃযধঃ ংযধষষ যব ংঢ়বধশ.
যা হোক, যখন সেই সত্য আত্মা আসবেন, তিনি তোমাদেরকে তাবত সত্যের দিকে পরিচালিত করবেন। কেননা তিনি নিজের থেকে কিছু বলবেন না, তিনি যা শুনবেন কেবল সেটাই বলবেন। (ঔড়যহ, ীার,১৩)
কুরআন মজীদে স্পষ্ট ভাষায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : তিনি নিজের থেকে কিছু বলেন না, এটা তো ওহী যা তাঁর কাছে প্রত্যাদেশ করা হয়। (সূরা নজম : আয়াত ৩-৪)।
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহ ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের পৃথিবীতে আগমনের আগাম খবর এবং তাঁর নবুওয়তের যেসব তথ্য রয়েছে সেগুলো পর্যালোচনা করলে নবুওয়তে মুহম্মদীর সর্বজনীনতা প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।
আমরা জানি পৃথিবীতে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার, মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রসূল তশরীফ এনেছেন। তাঁরা কেউ এসেছেন একটি নির্দিষ্ট কওমকে হিদায়াত দান করবার জন্য, কেউ এসেছেন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষকে সত্য পথে আহ্বান করবার জন্য। কিন্তু একমাত্র প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীতে তশরীফ এনেছেন সমগ্র মানব জাতিকে হিদায়াতের আলোয় উদ্ভাসিত করার জন্য। আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁর প্রিয় হাবীবকে উদ্দেশ করে ইরশাদ করেন : আপনি বলুন, হে মানুষ, আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর রসূল। (সূরা আ’রাফ : আয়াত ১৮৫)।
আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : (হে রসুল), আমি আপনার খ্যাতিকে বুলন্দ (উচ্চ মর্যাদা দান) করেছি।
(সূরা ইনশিরাহ : আয়াত ৪)।
আমরা কুরআন মজীদে লক্ষ্য করি, তাতে বহু নবী-রসূলের জন্ম বৃত্তান্ত রয়েছে; এমনকি হযরত ইয়াহিয়া আলায়হিস সালামের জন্মদিনে তাঁর প্রতি সালাম জানানো হয়েছে, সালামুন ‘আলায়হি ইয়াওমা বুলিদা। (সূরা মরিয়াম : আয়াত ৫)
যাঁর নূর মুবারক সৃষ্টি করে আল্লাহ তা’আলা বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন, যাকে তিনি সর্বপ্রথম নবুওয়ত ও রিসালাত দান করেছেন, পৃথিবীতে নবী রসূল আগমনের ধারাবাহিকতায় যাঁর পৃথিবীতে সবার শেষে আগমন ঘটেছে এবং নবী-রসূল আগমনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে, ইসলামের পূর্ণতা এসেছেÑ সেই প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের পৃথিবীতে আগমনের সেই দিনটি সবচেয়ে বেশি আনন্দের দিন, সবচেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ দিন।
আল্লাহ আমাদের জন্য বহু আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন তার মধ্যে এমন একটি নির্দেশ দিয়েছেন যা তিনি নিজে করেন, তাঁর ফেরেশতারা করেন। কুরান মজীদে ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ পেশ করেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ পেশ করো এবং তাঁকে যথাযথ তাজীমের সঙ্গে সালাম জানাও। (সূরা আহযাব :আয়াত ৫৬)। আল্লাহর নির্দেশের বাস্তবায়ন ঘটে ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের মাধ্যমে, মিলাদ মাহফিল ও মিলাদে কিয়াম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। হাদীস শরীফ থেকে জানা যায়, আল্লাহর নিকট দু’আ কবুলের প্রধান শর্তই হচ্ছেÑ তাতে অবশ্যই দরূদ শরীফ থাকতে হবে। যে কারণে বছরব্যাপী মিলাদ ও কিয়ামের আয়োজন করে দু’আ করবার ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্ন ভাষায় প্রচুর মিলাদ ও কিয়াম সাহিত্য গড়ে উঠেছে। বহু কাসিদা রচিত হয়েছে। ঈদে মিলাদুন্নবীর মর্মবাণী উপলব্ধি করা আমাদের সকলের কর্তব্য, কারণ নবীপ্রেম ছাড়া আল্লাহর ভালবাসা পাওয়া যাবে না।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম কবর মঞ্জিলে অবস্থান করছেন, দুনিয়ায় অবস্থানের মতোই। হাদীসে কুদসীতে আছে যে, আল্লাহ বলেন : (হে রসূল) লাওলাক লামা খালাক তাল ইফলাকÑআমি যদি আপনাকে সৃষ্টি না করতাম তাহলে আমি বিশ্বজাহান সৃষ্টি করতাম না। এতেই ঈদে মিলাদুন্নবীর তাৎপর্য নিহিত রয়েছে।
লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
No comments