উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক সত্তার সর্বশেষ স্তম্ভটি ধসে পড়ল by আবদুল লতিফ সিদ্দিকী
দুধসাদা ধুতিপাঞ্জাবির আস্তরণে মোড়া তামাটে ত্বকের দু্যতিমান কিংবদন্তি মর্ত্যজীবন পাড়ি দিয়ে অবশেষে চলে গেলেন রহস্যময় দূরমহাদেশে; সশরীর অনুসন্ধানে কিংবা প্রযুক্তির বোতামে আঙুল ঠুকে তাঁকে আর কোনদিন ফিরিয়ে আনা যাবে না আয়ুরেখার ছককাটা সীমিত জীবনে।
মর্ত্যজীবন পেরিয়ে কালনিরপে স্তব্ধতার অজ্ঞাত কোটরবাসে কোথায় তিনি চলে গেলেন_কে আর বলতে পারে চেতনা-বধির করা সেই প্রস্থানের প্রকৃত বৃত্তান্ত। ইহজাগতিক ঘড়ির কাঁটা যথারীতি বাজাবে তার অভ্যস্ত কোরাস, তবে তিনি মহাকালের বরফাস্তীর্ণ সুদূরলোকের মৌন ঘড়িতে হৃৎপিণ্ডের টিকটিক শব্দে ইহজগতের ইতিহাসে অনির্দিষ্টকাল সরব থাকবেন এমনটি আশা করা অমূলক হবে না। মহাজাগতিক জ্যোতির রেখায় জ্বলে ওঠে বহুদিন তিনি বিকিরণশীল থাকবেন; পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বষর্ীয়ান কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর অন্তরের জ্যোতি নিভবে না, চোখের জ্যোতি নিভে গেলে তাতে কীই-বা এসে যায়।ভারত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে জ্যোতি বসুর কীর্তিমান আবির্ভাব যে একটি পৃথক তাৎপর্য বহন করে তা স্পষ্ট হয় যখন আমরা তাঁর চরিত্রের নিরাসক্ত, নির্মোহ বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টিপাত করি; ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব এলে ব্যক্তি-ইচ্ছার নিরঙ্কুশ প্রতিফলন না ঘটিয়ে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির পলিটবু্যরোর সিদ্ধান্তের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রদর্শনের মাধ্যমে মূলত এটাই প্রমাণ করেন, সংগঠনের মতামত-নির্ভর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল। মনোগঠনের এ বিশিষ্টতা তিনি অর্জন করেন জীবন-অভিজ্ঞতার নানামাত্রিক পালাবদলের অভিঘাতে; দূরশৈশবে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল এ্যান্ড কলেজে পাঠ, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং ইংল্যান্ডের লন্ডন মিডল টেম্পলের মতো প্রতিষ্ঠানে শিাগ্রহণ ও সাংস্কৃতিক চিন্তাবিনিময়, কমিউনিস্ট পার্টি অব ব্রিটেনের স্বনামখ্যাত ব্যক্তিত্ব হ্যারি পলিট, রজনী পাম দত্ত; ব্রেন ব্রাডলি প্রমুখের সংস্পর্শ, ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস এবং লন্ডন মজলিশের মতো সংগঠনের সক্রিয় প্রভাবে।
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই এদেশের সর্বস্তরের জনগণ উৎকণ্ঠিত চিত্তে তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিতে থাকেন। বর্ণগোত্র নির্বিশেষে বাংলাদেশের আপামর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে জ্যোতি বসুর যে যোগাযোগ সেটাকে এক অর্থে 'আত্মিক' বলা চলে; কলকাতার হ্যারিসন রোড বা বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোডের একটি বাড়িতে জন্ম হলেও বাবা ডাক্তার নিশিকান্ত বাবু ও মা হেমলতা বসু দু'জনেরই পৈত্রিক বসতি তৎকালীন ঢাকা জেলার বৈদ্যেরবাজারস্থ বারদিতে, যেটা বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও থানার অন্তভর্ুক্ত। তবে তাঁর বাবা নিশিকান্ত বাবু বারদিতে থাকতেন না; তিনি বেড়ে ওঠেন তাঁর বাবা জ্যোতি বসুর ঠাকুরদার কর্মস্থান আসামের ধুবড়িতে; সেখানকার 'বেবি হোয়াইট মেডিক্যাল স্কুল' থেকে ডাক্তারী পাস করে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চশিা গ্রহণের আগে কিছুদিন ঢাকা শহরে ডাক্তারী পেশায় যুক্ত ছিলেন। সেই সূত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে জ্যোতি বসু বরাবরই নাড়ির টান অনুভব করেছেন; এদেশের মানুষও জীবন্ত কিংবদন্তি জ্যোতি বসুর গুণগ্রাহী হিসেবে তাঁর ব্যাপারে গোড়া থেকেই তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেছেন। তাঁর আকস্মিক অসুস্থতায় ও মৃতু্যবার্তা ঘোষণায় এদেশের মানুষ যে উৎকণ্ঠা দেখিয়েছেন তা-ও তাঁর প্রতি তাদের নিঃশর্ত অনুরাগ ও শ্রদ্ধার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ছাড়া কিছু নয়।
২ জানুয়ারি শনিবার হাসপাতালে শয্যাগ্রহণ, উন্নতি-অবনতির নাটকীয় চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ভেন্টিলেশনের লাইফ সাপোর্ট দেয়া নিবিড় পর্যবেণে মৃতু্যর সঙ্গে লড়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন বামরাজনীতির স্বর্ণপুরুষ বর্ষীয়ান এই জননেতা। পঁচানব্বই বছরের দীর্ঘজীবনে বার্ধক্য-বৈরিতার সঙ্গে নিউমোনিয়াজনিত জটিলতা যুক্ত হয়ে স্তব্ধ করে দেয় তাঁর জীবনছন্দ; কলকাতার এএমআরআই সল্টলেক হাসপাতালে ঘটে ছন্দপতনের এই বিয়োগান্তক ঘটনা।
জ্যোতি বসুর জীবনকালে ঘটনার পরিক্রমা তাঁর জীবনকে সাজিয়েছে বর্ণাঢ্য বৈচিত্র্যের পসরায়। ব্যক্তিজীবনে যখন কিংবদন্তির ছায়াপাত কিংবা মিথের আলো-অাঁধারি মিথস্ক্রিয়া ঘটে তখন ব্যক্তিস্বরূপের যথার্থ নিরূপণ হয়ে দাঁড়ায় কঠিনতর রহস্যের আস্তরণ, আপাতবিরোধী বৈশিষ্ট্যর সমন্বয় ও বিবর্তনশীল রাজনীতির অভিঘাতে নিজ আদর্শের নবায়িত সংস্করণে তাঁর ব্যক্তিসত্তার অন্তমর্ুখী স্বভাবটিকে অাঁচ করাও সহজসাধ্য ব্যাপার নয়, অন্তত জ্যোতি বসুর বেলায় এ কথাটি আরও বেশি মাত্রায় প্রযোজ্য।
বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মতাকাঠামোর ছকের ভেতরে বিরোধী আদর্শের পরিচর্যা নিঃসন্দেহে একটি ঝুঁকিপূর্ণ সংস্কৃতি এবং এেেত্র জ্ঞানের চেয়ে ভারসাম্যবোধ যে অধিক জরুরী সে সত্যটি সম্ভবত তিনি উপলব্ধি করেই অগ্রসর হয়েছেন। মহাদেশতুল্য রাষ্ট্রিক ভূখণ্ডের একটি অঙ্গরাজ্যে ছাবি্বশ বছর মুখ্যমন্ত্রিত্বের স্বাদ গ্রহণে অ-কমিউনিস্ট আদর্শচিন্তা যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি, তার মূলে ক্রিয়াশীল ছিল নীতিগত মূল্যবিভাজনের সূক্ষ্ম মাত্রাজ্ঞান ও পরিমিতিবোধ। যে বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিরোধী কণ্ঠ হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করেন তার মধ্যে আশ্রিত থেকেও পরিবর্তনশীল বিশ্বপরিস্থিতির প্রোপটে সমাজতন্ত্রের কৌশলগত প্রয়োগ কী হতে পারে তার শ্রেষ্ঠতম নির্ণায়ক হিসেবে জ্যোতি বসুকে চিহ্নিত করা যায়। গণতান্ত্রিক নির্বাচনবিধির আওতায় সমাজতন্ত্রের অভিজ্ঞতা তিনি গ্রহণ করেছেন পরিস্থিতির মুখে, যাতে তার ব্যবহারিক দিকটি লুপ্ত হয়ে গণবিচ্ছিন্নতার অপঘাত সইতে না হয়। মার্কসের কেন্দ্রসত্যের সঙ্গে এটা যে খুব বেশি সাংঘর্ষিক তা-ও বলা যাবে না; কারণ পুঁজিকে পুঁজির বিরুদ্ধে খাটানোর কূটকৌশল মার্কসবাদী মারণাস্ত্র হিসেবে অনেকটা স্বীকৃতও বটে।
নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়মুখী অভিজ্ঞতার কবলে উপমহাদেশে বাম রাজনৈতিক আদর্শিক যে ছন্দপতন ঘটতে শুরু করে সেটাকে সামাল দিতে তাঁর আদর্শচু্যতির বড় একটা প্রয়োজন পড়েনি, যদিও এ নিয়ে বিরোধী মহলে তর্কের অবকাশ থাকা অস্বাভাবিক নয়। সাম্যবাদের শাস্ত্রীয় গতিশীলতার নিরিখে এর নানা উপসংস্করণ-মাওবাদ, স্টালিনবাদ, লেনিনবাদ যেমন আছে, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের প্রোপটে জ্যোতি বসুর জন্য একটা সীমিত নতুন ভার্সনের তাগিদ অনুভূত হতেই পারে বলে আমাদের বিশ্বাস। রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে 'তারকা হয়েও মাটি ছুঁয়ে থাকতে' চেয়েছেন বলে উপর-নিচ দ্বিতল জনসমষ্টির নিকটই তার এক ব্যতিক্রমী জনগ্রাহ্যতা তৈরি হতে থাকে। স্বদেশের ভূগোল পেরিয়ে বাংলাদেশের জনসাংস্কৃতিক সমতলেও তার কর্মকীর্তির স্বীকার্য অনুষঙ্গগুলো পটবিস্তার করতে থাকে, যেমন করে তিনি ভারতের বহুত্ববাদী যৌগসংস্কৃতির আবহে নিজেকে আলাদা বর্ণছটায় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। অমেরুদণ্ডী রাজনীতির স্বার্থপরতা দু'হাতে ঠেলে তিনি তার স্থির আদর্শকে ব্যবহারিকতার আলোতে ঝালিয়ে নিতে সচেষ্ট ছিলেন পুরোটা জীবন। বিগত শতাব্দীকালের রাজনৈতিক অগ্রযাত্রায় উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক সত্তার শেষ স্তম্ভ ছিলেন তিনি, বিশাল বিস্তৃত জীবন পরিসরে ভাবনার বর্ণাঢ্যে, চিন্তার জৌলুসে এবং দর্শনের স্বাতন্ত্র্যে তিনি অলোকসামান্য আলোকস্তম্ভে পরিণত। ভারত-ভূগোলের রাজনৈতিক ঐশ্বর্যের একটি বহুপল্লবিত, ফলবান শাখা যেন ভেঙ্গে পড়ল তাঁর মৃতু্যতে; মানবতাবাদী ও কল্যাণমুখী উপমহাদেশীয় রাজনীতির অঙ্গনে যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও আদর্শিক শূন্যতা সৃষ্টি হলো তা পুষিয়ে উঠতে এ অঞ্চলের উত্তর প্রজন্মকে কতকাল অপো করতে হবে, বলা মুশকিল।
No comments