সরকারী কার্যক্রমে গতিশীলতা by এ এম এম শওকত আলী
সরকারী কার্যক্রমে গতিশীলতা একাধিকবার উচ্চারণ করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। এ কথার মাধ্যমে জনমনে সরকারী কার্যসম্পাদনে শ্লথ গতি সম্পর্কে যে ধারণা রয়েছে সে বিষয়টিই পুনরায় প্রমাণ করলেন।
ইতোপূর্বে আর কোন প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের কথা বলেছেন কিনা জানা নেই। তবে বললেও এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, একাধিকবার এ ধরনের বক্তব্য কোন প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে প্রদান করেননি। প্রধানমন্ত্রী গতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সর্বপ্রথম সচিবদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন গতিশীলতা আনার বিষয়ে মূল প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা হয়েছিল সনাতনী আমলের আইন ও বিধিকে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল প্রয়োজনে আইন ও বিধির সংশোধনের। এ বিষয়ে প্রশাসনিকযন্ত্র কতটুকু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা কারও জানা নেই। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, আইন ও বিধিই নয়। প্রশাসনের অধিকাংশ সিদ্ধান্তের জন্য আইন ও বিধির প্রয়োজন নেই, যদিও কিছু েেত্র এ বিষয়গুলো অনুসরণ করতেই হবে। অন্যথায় বিপদ।প্রশাসনে গতিশীলতা বা দতা নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাজ্যে প্রশাসনিক সংস্কার সম্পর্কিত প্রতিবেদনে (ফুলটন-এর রিপোর্ট) কিছু সুপারিশ রয়েছে যা বাংলাদেশসহ যে কোন দেশের জন্য প্রযোজ্য। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতিশীলতা বা দতা নিশ্চিত করতে হলে যে কোন বড় সংস্থা বা সরকারী বিভাগের প্রয়োজন এমন একটি কাঠামো যার বিভিন্ন শাখা/প্রশাখায় কর্মরত ব্যক্তিদের জন্য সুস্পষ্ট মতা নির্ধারিত থাকবে। দায়িত্বের পরিধিও থাকবে যার মাধ্যমে জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব।
২০০৯ সালের পূর্বেও প্রশাসনে গতিশীলতা বা দতার বিষয়টি সকল ধরনের সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। সবাই এ বিষয়ে সময় সময় উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে। সরকারের বাইরেও এ উৎকণ্ঠা ছিল বিদেশী দাতা সংস্থাসহ মিডিয়া এবং চিন্তাবিদদের মধ্যে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭৩ পরবর্তী সময় থেকে কিছু দেশীয় ও কিছু বিদেশী অর্থায়নে একাধিক প্রতিবেদন প্রণীত হলেও এ উৎকণ্ঠার সমাধান করা সম্ভব হয়নি।
বড় সংস্থাসহ সরকারী বিভাগে যে জবাবদিহিতামূলক প্রশাসনিক কাঠামোর রূপরেখা ফুলটন প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সে কাঠামো কি বাংলাদেশে নেই। এর জন্য বিদ্যমান ব্যবস্থাপনায় প্রাসঙ্গিক সরকারী নিয়ম/পদ্ধতি দু'টি পুস্তিকায় বর্ণিত হয়েছে। এক, সরকারী কার্য সম্পাদন বিধিসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের কার্য বন্টন। দুই, সচিবালয় নির্দেশিকা। প্রথমোক্ত বিধিমালায় মন্ত্রণালয়/বিভাগের দায়িত্বের পরিধি ও মূল কর্মকাণ্ডসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আরও রয়েছে মন্ত্রী ও সচিবের পারস্পরিক মতা। ১৯৯৬ সালে এক সংশোধনীর মাধ্যমে এ বিধিমালায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী সংযুক্ত করা হয়। এর বলে সচিবকে মন্ত্রীর সাধারণ বা বিশেষ নির্দেশে মন্ত্রণালয়ের সকল কার্যাবলীর নি্#৬৩৭৪৩;ত্তি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ সংশোধনীর পূর্বে সংশ্লিষ্ট বিধানটি ছিল সচিব মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মন্ত্রীকে অবহিত রাখবে। অন্য একটি বিধান ছিল জরুরী কোন বিষয়ে মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে সচিব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পরবর্তীতে মন্ত্রীকে অবহিত করবে। সংশোধনীর ফলে এ সমস্ত বিধান অকার্যকর হওয়ায় গতিশীলতা ব্যাহত হচ্ছে।
তবে ১৯৯৬-২০০১ সালে এ ধরনের সংশোধনী সত্ত্বেও গতিশীলতার ধারা এত প্রকট ছিল না। এ কারণে হয়ত বলা যায় যে, মূল বিষয়টি হলো প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের দতা হ্রাস। কেন এটা হয়েছে? কারণ একাধিক। বিগত বছরগুলোতে প্রশাসনের অব্যাহত রাজনীতিকায়নের জন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই প্রশাসনিক কালচারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সিদ্ধান্তের জন্য নথি উপরে পাঠিয়ে দেন, যাতে করে তারা নিরাপদ থাকতে পারেন। কোন্ ধরনের সিদ্ধান্ত কোন্ পর্যায়ে কত দিনের মধ্যে গ্রহণ করতে হবে তার সুস্পষ্ট বিধান কার্য সম্পাদন বিধিমালায় এবং আরও বিশদভাবে সচিবালয় নির্দেশিকায় স্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছ্ কে;িন্তু কার্যত কোন মন্ত্রণালয়/বিভাগ এ বিধানগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করে না। এ প্রশ্নটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানও একাধিকবার ব্যক্তিগতভাবে কিছু সচিবকে বলেছিলেন। কোন লাভ হয়নি। প্রশাসনিক ও আর্থিক েেত্র অনুসরণীয় সকল বিধান পালন নিশ্চিত করার দায়িত্ব সচিবের।
সচিব একা বিষয়টি নিশ্চিত করতে সম হবেন না যদি না তাঁর অধস্তন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে তাকে সক্রিয় সহায়তা প্রদান করেন। এ ছাড়া আরেকটি বিষয়ও প্রাসঙ্গিক। তাহলো যেহেতু সচিবালয় নির্দেশিকার কোন পর্যায়ে কতদিনের মধ্যে কি বিষয়ে বিভিন্ন েেত্র কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতাবান সে বিষয়টি নিশ্চিত করার ল্যে দুটি পদপে জরুরী। এক, অনি্#৬৩৭৪৩;ত্তিকৃত বিষয়গুলোর প্রচলিত পরিবীণ যন্ত্রকে অধিকতর শক্তিশালী ও কার্যকর করা। দুই, সচিব তো বটেই মন্ত্রীকেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্বাধীন ও বিনাদ্বিধায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে এবং এটা একটি অভ্যন্তরীণ দাফতরিক আদেশের মাধ্যমে সবাইকে অবহিত করতে হবে। এর বিকল্প হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং লিখিত নির্দেশ এ বিষয়ে জারি করতে পারেন। কারণ গতিহীনতার জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে সরকারপ্রধান হিসেবে উৎকণ্ঠিত। একই সঙ্গে নিবিড় পরিবীণের মাধ্যমে এ ধরনের নির্দেশ সত্ত্বেও যে সমস্ত কর্মকর্তা নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হবেন তাঁদের বিরুদ্ধে প্রচলিত বিধি অনুযায়ী অদতাসহ অবাধ্যতার অভিযোগ এনে বিভাগীয় কার্যক্রম শুরু করে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় গতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব হবে না। প্রশাসনে বিভাগীয় শাস্তি প্রদান সংক্রান্ত পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, অদতা বা অনুসরণীয় নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হওয়ার জন্য কোন কর্মকর্তা শান্তিভোগ করেননি। এর ফলে কর্মকর্তারা মতা প্রয়োগের েেত্র অনুসরণীয় বিধি/নির্দেশ পালনের কোন তোয়াক্কাই করেন না। ফলশ্রুতিতে আইন বা বিধি মেনে চলাই ব্যতিক্রম এবং এ পরিবেশ সকল েেত্রই দৃশ্যমান। যেমন যানবাহন ব্যবহারের েেত্র তেমনই রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনার েেত্র বা ব্যবসা পরিচালনার েেত্র। এ ধরনের অব্যাহত পরিবেশ রাষ্ট্র গঠনের েেত্র যে তিকর তার বিশদ বিশ্লেষণের অপো রাখে না।
পত্রিকান্তরে দেখা যায় যে, প্রশাসনে গতিহীনতার বিষয় নিয়ে কিছু মন্ত্রণালয়/বিভাগে ত্রিমুখী নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিমুখী নেতৃত্বের মূল নায়করা হচ্ছেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপদেষ্টারা। এ ধরনের ট্রইকা (করমধপট) নেতৃত্বের বিকাশ বর্তমান সরকারে সীমিত হলেও অনেকটা স্থায়িত্ব লাভ করেছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের মতে, একই মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করলে গতিশীলতার অভাব প্রকট হতে বাধ্য। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে দ্বন্দ্ব নিরসনের পদ্ধতি নির্ধারণ করলে ভাল হয়। এ বিষয়ে কিছু জনপ্রশাসন বিশ্লেষক সঙ্কীর্ণ সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে এ ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন, যা মোটেই বস্তুনিষ্ঠ নয়। কারণ উপদেষ্টা নিয়োগের প্রথা বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও বিদ্যমান। এছাড়া স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৯৬-২০০১ সালে প্রজাতন্ত্রের একজন অভিজ্ঞ সাবেক কর্মকর্তাকে একটি অথবা দুটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছিল। তখন সমালোচনা করা তো দূরের কথা, গতিহীনতার কোন প্রশ্নই উত্থাপিত হয়নি। এর জন্য একটি প্রধান কারণ ছিল নিয়োজিত উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বিচণতা ও দায়িত্ববোধ। বর্তমানে যে এ দুটি উপাদানের দারুণ অভাব সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য-প্রমাণ নেই। একই সঙ্গে বলা যায় যে, পরস্পরবিরোধী অবস্থান শুধু মন্ত্রী ও উপদেষ্টার মধ্যে সীমিত নয়। মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর মধ্যেও এ বিষয়টি রয়েছে। তার কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রতিবেদক সার্থকভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
সরকারী কার্য সম্পাদন বিধিমালায় মন্ত্রণালয়ের প্রত্য ও পরো দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি হচ্ছেন সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রী। এ কথাও সত্য যে, যে কোন মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীসহ উপমন্ত্রী নিয়োগের বিধান রয়েছে। তবে তাঁরা মন্ত্রীকে উপো করতে পারেন না। কারণ সংসদে প্রতভাবে জবাবদিহি করতে হয় মন্ত্রীর। এর ব্যতিক্রম হচ্ছে কোন মন্ত্রণালয়ে বা বিভাগে প্রতিমন্ত্রী নিয়োগের বিধানও রয়েছে যেখানে প্রতিমন্ত্রীই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তবে কার্য সম্পাদন বিধিমালা অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের/বিভাগের সার্বিক দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর। প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবেদক অধিকাংশ েেত্র মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেছেন। কয়েকটি েেত্র তাঁর প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী উপদেষ্টার প্রসঙ্গও রয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রীর মতার পরিধি সুস্পষ্টভাবে সরকারী কার্য সম্পাদন বিধিমালায় বর্ণিত রয়েছে। প্রচলিত প্রথা ও বিধান অনুযায়ী যে সমস্ত মন্ত্রণালয় মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী কর্মরত রয়েছে, সে েেত্র প্রতিমন্ত্রীর অধিেেত্রর প্রস্তাব মন্ত্রীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে মন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ীই হয়েছে। এর ব্যতিক্রম যদি কোন প্রতিমন্ত্রী করে তাহলে নিশ্চয়ই এটা কাম্য নয় এবং এর জন্য প্রতিমন্ত্রীকেই জবাবদিহি করতে হবে। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী উপযুক্ত ও যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্তও বিধি অনুযায়ী গ্রহণ করতে হবে। অপ্রিয় হলেও তা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত বক্তব্যে মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীদের এ বিষয়ে হুঁশিয়ারি বাক্য উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, শিার সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রকারান্তরে মূল বাণী হলো রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনতেই হবে। তাহলে তিনি মন্ত্রিসভার রদবদলের কথা ভাবছেন। এ সিদ্ধান্ত সরকারপ্রধান হিসেবে তাঁর এ কথা বলার অপো রাখে না।
পরিশেষে একটি বিষয় উত্থাপন না করলেই নয়। সচিবালয়ের গতিশীলতায়ই সার্বিক প্রশাসনিক গতিশীলতা নয়। একইভাবে মনোযোগী হতে হবে মাঠ প্রশাসনের গতিশীলতা বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয় পদেেপ। আশার বিষয় হচ্ছে, সচিবালয়সহ মাঠ প্রশাসনের গতিশীলতা বৃদ্ধির ল্যে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইতোমধ্যেই পদপে গ্রহণের প্রক্রিয়া চালু করেছেন। বিষয়টি নিঃসন্দেহে জটিল তবে অভীষ্ট ল্য অর্জন রাজনৈতিক সদিচ্ছা সাপে েঅবশ্যই সম্ভব। আগামী এক বছরের মধ্যে এ বিষয়টি দৃশ্যমান হোক এটাই সবার কাম্য।
No comments