ঘুরে আসুন ছেড়াদ্বীপ by ডা. মোস্তফা আব্দুর রহিম
কান পাতলেই যেন শুনি, চোখ বুজলেই যেন দেখতে পাই হৃদয়ের কত গভীরে নাম লেখা আছে এর। ছেড়াদ্বীপ- অঞ্চলবাসীদের উচ্চারণে ‘ছেড়াদিয়া’ বাংলাদেশের সীমানার দক্ষিণে সেন্ট মার্টিন্স থেকে ছুটে যাওয়া দুটো দ্বীপাংশ নিয়ে ছেড়াদ্বীপ।
পাথরের বুকচিরে দ্বীপের নিউক্লিয়াসে কেয়াগাছের ঝোপ, পৌষের হিমভাঙ্গা ভাপাপিঠার মতো কেয়াফল, আর নারকেল গাছগুলো তার ডালগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশে। পাথরের থরে থরে সাজানো স্তূপগুলো মৃত প্রবালের স্মৃতি ধরে আছে। কোথাও ধারালো পাথর, কোথাও মসৃণ। মনে হয় অসীম শক্তিধর কোন ঠিকাদার অসংখ্য লেবার লাগিয়ে পাথরগুলো সাজিয়েছে।“না ভাসিলাম জলে আমি না ডুবিলাম জলে”
ডিম্বাকার টাইপের দ্বীপটাতে নিয়তই আছড়ে পড়ছে। ঢেউ। ঢেউ ভাঙ্গা বুদবুদ ওঠে, বুদবুদ ফাটে, আর কানের পর্দা কাঁপায় শোঁ শোঁ গর্জন, কানের সুখ, আর চোখে তৃপ্তি ঢুকে যায় মনের গহীনে।
নগর জীবনে ব্যস্ততার দীঘল ছায়া। চোখের তারায় যখন ফুটেকি ফুটে না একফোঁটা দূরাগত সুখ, ঘরের মহাকর্ষ ছাড়িয়ে তখনই যাওয়া হলো নীল জলের টানে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার। ক্যাপ্টেন হিরান বক্সের বাজার ছাড়িয়ে নাফ নদীর তীরঘেঁষা টেকনাফ। টেকনাফ থেকে সীট্রাকে সেন্ট মার্টিন্স। সেন্ট মার্টিন্স থেকে ট্রলার বা স্পীডবোটে ছেড়াদ্বীপ। ট্রলার বা স্পীডবোট থেমে যায় দ্বীপ থেকে খানিক দূরে সেখান থেকে ছোট নৌকায় ঢেউয়ের সাথে ধস্তাধস্তি করে নামতে হয় ছেড়াদ্বীপে।
নামছে দ্বীপে ছেলেমেয়েরা, আনুমানিক শ’দুই হবে। এরা আমার স্বজন এরা আমার বিজন। এই পরিচিত অপরিচিত চেহারা দেখতে দেখতে নিথর প্রকৃতির মাঝে আসে এক অসীম উপলব্ধি। কেয়াবনের সীমানায় একটা ছাপড়া ঘর। দাদন মিয়া ডাব কেটে কুলোচ্ছে না। অসম্ভব মিষ্টি পানির দোকানি থাকে, তাদের আবাস পার্শ্ববর্তী সেন্টমার্টিন্স এ। রাতে এই দ্বীপে জোয়ার ভাটা হয়। পূর্ণিমা তিথিতে বিশালকায় চাঁদ ওঠে, ঐ চাঁদটা হয়ত দোকানিরা দেখে। সাগর গর্জনে জড়ো সড়ো হয়ে কিভাবে তারা রাত কাটায় কে জানে। আমি সাগর জলে পা ভিজালাম। জলতলে চোখ রাখলাম, দেখলাম অগুনতি প্রবালের কারুময়তা। জল কেটে হাঁটলাম বহুদূর। কোথায় সাগর গভীর হয়েছে বুঝা যায় না। আছড়ে পড়া ঢেউ সাদা রং ধরে আবার নীল, কেয়া আর নারকেল গাছগুলো সলিল সুখে দিন যায় রাত কাটে ধারানো প্রবাল পড়ে আছে এখানে সেখানে। আবার ঢেউ আছড়ে পড়ছে প্রবালগাথা তীরে। কিছু ছেলেমেয়ে ভেজার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, যেই ঢেউ এসে ধাক্কা দিচ্ছে ওরা আনন্দে চিৎকার করে উঠছে আর পড়ে যাচ্ছে। বেশ মজার দৃশ্য। নুড়ি, পাথর, শামুক, ঝিনুক, কড়ি যে যেমন পারলাম কুড়ালাম। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছিল। আনন্দে মনে হচ্ছিল আমি বিভিন্ন দিক থেকে পাগল হয়ে যাব। কণ্ঠার কাছে সমস্ত শক্তি জড়ো করে আবৃত্তি করলাম মৌসুমী ভৌমিকের গাওয়া গানের দুটো লাইন।
‘আমি শুনেছি সেদিন তোমরা নাকি সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীলজল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো’ একটু থাকলাম। পাশ থেকে একটা মেয়ে গেয়ে উঠল
“আমি কখনও যাইনি জলে, ভাসিনি নীলে রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাংচিল”
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম মেয়েটির দিকে। মেয়েটির কণ্ঠ থমকে দিল পুরো প্রকৃতি। কজন জটলা করে শুনল গান, আমরা শিহরিত হলাম। মনে তখন ফিটকিরি দেয়া জলের মতো আনন্দের থিরি কাঁপন। কে এই মেয়েটি? নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করা হলো না, আমরা আবার পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। পাথরের গা চুঁইয়ে পানি গড়াচ্ছে। পায়ের গোড়ালি অব্দি কোথাও হাঁটুর নিচে পানি, অজানা ছোট মাছদের নড়াচড়া সন্ন্যাসীর মতো বসে থাকা কাঁকড়া কোথাও দু’একটা জীবন্ত প্রবাল কীট, শামুক, ঝিনুক আর রয়েছে অসম্ভব সাহসী ব্যবসায়ী আর নৌকা ট্রলারের চালক। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়,
“দইজ্যার কূলত বসত করি
সিনাদি ঠেকাই ঝড় তুফান
আঁরা চাটগাইয়া নওজোয়ান
আঁরা চাটগাইয়া নওজোয়ান”
দ্বীপটার এক জায়গায় ভিজে বালুতে সালাম ভাই তর্জনি দিয়ে লিখলেন,
“কমল পেয়েছে কড়ি, শিশির পেয়েছে শংখ আর নীরা যা চেয়েছে তাই”
কে এই নীরা?
যখন আমরা ফিরতি পথে সেন্টমার্টিন্সে ফিরলাম তখন সময়ের হিসেবে বিকেল না হলেও আলোয় টান পড়েছে, আকাশে মেঘের আনাগোনা বাতাস বইছে জোরে, ঢেউ উঠছে উত্তাল। স্পীড বোটে পনেরো মিনিটের ফিরতি জার্নি। কিন্তু ঢেউয়ের ধাক্কায় আমি সালাম আর জাহাঙ্গীর ফকিরের কোমর ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হয়েছিল। অথচ গাইড নুরুল আলম আর বোটচালক নির্বিকার স্বাভাবিক বসে ছিল।
ছেড়াদ্বীপের জ্যেষ্ঠব্রাতা সেন্টমার্টিন্স : এখন বিকেল। জেটির ব্রিজ পার হয়ে সেন্টমার্টিন্সের মুখে আমরা। অনেক দোকানপাট বার্মিজ পোশাক সেন্ডেল, আচার আর সামুদ্রিক মাছ ভাজার একটা পোড়া পোড়া গন্ধ। রিক্সাভ্যান দিয়ে অবলীলায় যাওয়া যায় হুমায়ূন আহমেদের সমুদ্রবিলাসে। বাড়িটা এখন বেশ অযতেœ আছে। শুনেছি কারা নাকি লিজ নিয়েছে বাড়িটা। সেন্টমার্টিন্সে দু’টো জিনিস লক্ষ্য করলাম। এখানে নেশা সন্ত্রাস বা সমজাতীয় জিনিসগুলো একেবারেই নেই। এতে ট্যুরিস্ট আকর্ষিত হচ্ছে। প্রতিদিন হাজার দশেক পর্যটক সেন্টমার্টিন্সে আসা যাওয়া করছে। আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে জেটিতে গিয়েছিলাম ভোরের সাগর দেখব বলে দোকানির হাঁক শুনলাম
“পাঁচটা বাজি গেইয়্যে
আইজও গুমত্তুন নো উডর”
ছেড়াদ্বীপ নিয়ে লিখতে গিয়ে একটুখানি সেন্টমার্টিন্সের গাজন গাইলাম ধান বানার অজুহাতে।
শেষকথা : ছেড়াদ্বীপ কোন পলিমাটির দ্বীপ নয়। বাংলাদেশে একমাত্র ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চতুর্থ প্রবাল দ্বীপ। নাফনদীর মোহনা ছাড়িয়ে সীট্রাক যখন বঙ্গোপসাগরে পড়ে আমরা তর্জনি উঁচিয়ে দেখাই ঐ যে দেখা যায় ওটা মিয়ানমার। সীমান্তে পাহারা দিচ্ছে নাসাকা বাহিনী। আবার মিয়ানমারের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে অধিবাসীরা আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখায়, ঐ যে সরীসৃপের মতো দেখা যায় বঙ্গোপসাগরের বুকে বাংলাদেশের শেষ সীমানা সেন্ট মার্টিন্স ও ছেড়াদ্বীপ। ছেড়াদ্বীপের মনুষ্যহীন নীরবতায় কিভাবে রাত আসে, সাগরের বুক থেকে কেমন করে উঠে আসে সোনালী সূর্য, গ্রীষ্ম থেকে বসন্ত কিভাবে কাটায় এই দ্বীপ?
বিশ্বে নিয়তই কতনা পরিবর্তন হচ্ছে। জলতলে আমাদের অজানায় অসংখ্য বার ভূমি কাঁপছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার তোড়ে ডুবে গেছে তালট্ট, বিলহ্যাম ও ভূমিকম্প বিশারদগণ বলছেন, “হিমালয়ের পাদদেশে ও বঙ্গোপসাগর বিধৌত এলাকায় সাত রিকটার স্কেলের বেশি মাত্রার একাধিক ভূমিকম্প পাওনা হয়ে গেছে।” আরেকটা বড়মাপের পরিবর্তনের আগে ঘুরে আসুন ছেড়াদ্বীপ ও তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সেন্টমার্টিন্স নারিকেল জিঞ্জিরা, দারুচিনি দ্বীপ গত ৩০০ বছর ধরে সেন্টমার্টিন্স জনবসতি ধরে রেখেছে আর ছেড়াদ্বীপ বাড়াচ্ছে তার কলেবর।
কবির কথা দিয়ে শেষ করছি।
“বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি,
দেশে দেশে কতনা নগর রাজধানী,
মানুষের কত কীর্তি কত গিরি সিন্ধু মরু,
কতনা অজানা জীব, কতনা অপরিচিত তরু
No comments