ফলাফল উদ্বেগজনক by করুণাময় গোস্বামী
কয়েক দিন আগে আমাদের জাতীয় পত্রিকাগুলোতে একটি জরিপের ফল প্রকাশিত হয়েছে। জরিপটি ছিল শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারগুলো নিয়ে। এই জরিপ চালানো হয় সমগ্র বাংলাদেশের স্কুলগামী শিশুদের ওপর।
জরিপে দেখা যায়, আমাদের পাঠ্যসূচির যে ভার, পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য মা-বাবা ও শিক্ষকদের যে প্রবল চাপ এবং শিশুদের আনন্দ ও শরীরচর্চার পরিবেশের একান্ত অভাব_সেসব তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য দুটো বিষয়কেই ক্রমে ক্রমে পঙ্গু করে দিচ্ছে। শিশুদের মধ্যে এই স্বাস্থ্যহানির পরিমাণ ঢাকায়ই সর্বোচ্চ। এটি অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। আমাদের শিশুদের পড়াশোনা করানো দরকার। নিশ্চয়ই দরকার। কিন্তু পড়াশোনা করাতে গিয়ে যদি তাদের শরীর ও মন নানাভাবে আক্রান্ত হয়, তাহলে এদের ভবিষ্যৎ কী? পড়াশোনা শিখবে এবং শিখে শিশুরা তো মনেপ্রাণে সজীব হয়ে উঠবে, তার বিপরীতে তারা যদি নির্জীব হয়ে পড়ে, তাহলে এদের নিয়ে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? এ ব্যাপারটি অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে এবং অবিলম্বে এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। কাজটি একেবারেই কালবিলম্ব না করে শুরু করা দরকার। প্রয়োজনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে ব্যাপকতর এবং কার্যকরতর জরিপ চালাতে পারে, এ ব্যাপারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খ্যাতিসম্পন্ন শিশু মনস্তত্ত্ববিদদের সাহায্য নিতে পারে। তাই আর দেরি না করে এ কাজে হাত দেওয়া প্রয়োজন।
জাতীয় দৈনিকগুলোতে জরিপের যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে তাতে এই বিপর্যয়ের জন্য কয়েকটি কারণ শনাক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, শিশুরা পাঠ্যসূচির ভারে জর্জরিত। সাক্ষাৎকার থেকে যে সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হচ্ছে, শিশুরা কোনোক্রমেই এ ভার সামলে উঠতে পারছে না। আরো দেখা যাচ্ছে, ফল ভালো করার জন্য কী মা-বাবার পক্ষ থেকে, কী স্কুলের পক্ষ থেকে শিশুদের ওপর এত চাপ যে, দিনরাত তারা শুধু পড়া পড়া লেখা লেখা করছে, এর বাইরে আর যেতে পারছে না। ফলে পুরো ব্যাপারটা এমন ক্লান্তিকর ও একঘেয়ে হয়ে উঠছে যে শিশুরা একেবারে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ছে। তারা না পারছে গল্পের বই পড়তে, না পারছে ছড়া-কবিতার বই পড়তে, না পারছে সায়েন্স ফিকশন পড়তে বা অন্য কোনো পছন্দের বই পড়তে। ফলে পাঠ্যপুস্তকের যে ক্লান্তিকর সীমা, এর বাইরে কোনোক্রমেই শিশুরা যেতে পারছে না। জরিপে দেখা যাচ্ছে, শিশুদের সৃজনীশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। পরিস্থিতি যদি এমনই হয়, তাহলে সৃজনীশক্তি তো ক্ষয় হওয়ারই কথা। কেননা শিশুদের জন্য ক্লাসের পড়ার বাইরে প্রচুর সময় দরকার যে তারা পছন্দের বই পড়বে, এমন সব বই পড়বে যা দিয়ে সৃজনীশক্তি ও চিন্তাশক্তির একটা ভিত্তি গড়ে উঠবে। শিশুদের জন্য খেলাধুলার সময় থাকা দরকার। কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি হচ্ছে যে শিশুরা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বা বিকেল পর্যন্ত স্কুলে পড়ছে, পর পরই প্রাইভেট টিউটরদের কাছে ঘাড় নুইয়ে খাতা-কলমে মনোনিবেশ করতে হচ্ছে। যেটুকু সময় খেলার জন্য থাকা দরকার, সেটুকু তারা মোটেই পাচ্ছে না। ফলে শারীরিক দিক থেকেও তারা বিকশিত হতে পারছে না।
এই যদি পরিস্থিতি হয়, না ঘটছে মানসিক বিকাশ, না ঘটছে শারীরিক বিকাশ_তাহলে এই পর্যুদস্ত শিশুদের নিয়ে আমরা কী করব। ঢাকা শহরে এই পরিস্থিতি দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় অনেক বেশি প্রকট। তেমনই হওয়ার কথা। এখানে দিয়াশলাইয়ের বাঙ্রে মতো কিছু দালান, তাতে ছোট ছোট কোঠা, তার মধ্যে ক্লাসরুম। সকাল ৮টায় এসে বেঞ্চে বা চেয়ারে শিশুটি যে বসল, দুপুর ২টা বা ৩টা পর্যন্ত পা গুটিয়ে বসেই থাকল। মাঝখানে ১৫-২০ মিনিটের জন্য ব্রেক পেলেও সে সময়টুকুও খেলাধুলা করে কাটানোর কোনো উপায় নেই। কেননা স্কুলগুলোতে এখন আর কোনো মাঠ নেই, গাছ নেই, ফুল নেই, পাখি থাকার তো প্রশ্নই আসে না। এভাবে খোলামেলা থাকার যাবতীয় সুযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু হাত-পা গুটিয়ে বাচ্চাকাচ্চারা পড়েই যাচ্ছে, লিখেই যাচ্ছে, মুখস্থ করেই যাচ্ছে। এতে বিকাশ বলে যে বস্তুটি আছে তা ক্রমেই ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। সারা দেশের প্রতিযোগিতা এসে জমাট বেঁধেছে রাজধানীতে, সুযোগ-সুবিধাহীন স্কুল গণ্ডায় গণ্ডায় রাজধানীতে গড়ে উঠছে, চূড়ান্ত পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য শিশুদের ওপর ক্রমেই চাপ বাড়ছে। সেই চাপের ফলে শিশুমন একেবারেই চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে, শিশুর শরীর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আমরা ক্রমেই সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির দিকে যাত্রা করছি। শিশুদের মধ্যে সৃজনশীলতা যদি ক্ষয় হতে থাকে, জরিপে যেমনটা দেখা যাচ্ছে, তাহলে তারা সৃজনশীল পদ্ধতির দিকে এগোবে কী শক্তিতে! আগে তো তার সৃজনশীল শক্তি বাড়াই, তারপর তো সৃজনশীল পথে এগোতে বলি। ঢাকাকেন্দ্রিক শিক্ষায় ঘটনাটা ঘটছে তার উল্টো। সৃজনশীল ধারণা যত ব্যাপক হচ্ছে, অন্তত পরীক্ষা গ্রাহকদের স্তরে বা পাঠ্যপুস্তক রচিতদের স্তরে, শিশুদের মধ্যে সৃজনশীল শক্তি ততই ক্ষয় হয়ে আসছে।
আমরা সুস্থ শিশু চাই দেহে ও মনে। এই স্লোগানটি মানুষের ইতিহাসের একটি অতি প্রাচীন স্লোগান। আমরা যেন ক্রমে এই স্লোগান থেকে সরে এসে একটা জবুথবু সমাজ গড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং বিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা, অভিভাবক-শিক্ষকদের চাপ যেন সেই জবুথবু হওয়াটাকেই অনিবার্য করে তুলছে। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি যাঁরা বাস্তবায়ন করবেন, তাঁরা যেন ভেবে দেখেন শিশুদের কিভাবে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করা যায়। আমাদের যে ভৌত সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান, তাতে হয়তো কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব হবে না। তবে কিছুটা পরিবর্তন আনতেই হবে। আমাদের পাঠ্যসূচিকে এবং প্রতিযোগিতাকে একটা সহনীয় স্তরে রাখতেই হবে। শিক্ষার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের ভেতরকার শক্তিকে জাগিয়ে তোলা। শিক্ষার তোড়ে যদি সে শক্তি জেগে না উঠে ঘুমিয়ে পড়তে চায়, তাহলে তো আর কোনো একটা জায়গায় গিয়ে পেঁৗছানো গেল না। এ ব্যাপারটি নিয়ে নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভাববেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
জাতীয় দৈনিকগুলোতে জরিপের যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে তাতে এই বিপর্যয়ের জন্য কয়েকটি কারণ শনাক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, শিশুরা পাঠ্যসূচির ভারে জর্জরিত। সাক্ষাৎকার থেকে যে সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হচ্ছে, শিশুরা কোনোক্রমেই এ ভার সামলে উঠতে পারছে না। আরো দেখা যাচ্ছে, ফল ভালো করার জন্য কী মা-বাবার পক্ষ থেকে, কী স্কুলের পক্ষ থেকে শিশুদের ওপর এত চাপ যে, দিনরাত তারা শুধু পড়া পড়া লেখা লেখা করছে, এর বাইরে আর যেতে পারছে না। ফলে পুরো ব্যাপারটা এমন ক্লান্তিকর ও একঘেয়ে হয়ে উঠছে যে শিশুরা একেবারে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ছে। তারা না পারছে গল্পের বই পড়তে, না পারছে ছড়া-কবিতার বই পড়তে, না পারছে সায়েন্স ফিকশন পড়তে বা অন্য কোনো পছন্দের বই পড়তে। ফলে পাঠ্যপুস্তকের যে ক্লান্তিকর সীমা, এর বাইরে কোনোক্রমেই শিশুরা যেতে পারছে না। জরিপে দেখা যাচ্ছে, শিশুদের সৃজনীশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। পরিস্থিতি যদি এমনই হয়, তাহলে সৃজনীশক্তি তো ক্ষয় হওয়ারই কথা। কেননা শিশুদের জন্য ক্লাসের পড়ার বাইরে প্রচুর সময় দরকার যে তারা পছন্দের বই পড়বে, এমন সব বই পড়বে যা দিয়ে সৃজনীশক্তি ও চিন্তাশক্তির একটা ভিত্তি গড়ে উঠবে। শিশুদের জন্য খেলাধুলার সময় থাকা দরকার। কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি হচ্ছে যে শিশুরা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বা বিকেল পর্যন্ত স্কুলে পড়ছে, পর পরই প্রাইভেট টিউটরদের কাছে ঘাড় নুইয়ে খাতা-কলমে মনোনিবেশ করতে হচ্ছে। যেটুকু সময় খেলার জন্য থাকা দরকার, সেটুকু তারা মোটেই পাচ্ছে না। ফলে শারীরিক দিক থেকেও তারা বিকশিত হতে পারছে না।
এই যদি পরিস্থিতি হয়, না ঘটছে মানসিক বিকাশ, না ঘটছে শারীরিক বিকাশ_তাহলে এই পর্যুদস্ত শিশুদের নিয়ে আমরা কী করব। ঢাকা শহরে এই পরিস্থিতি দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় অনেক বেশি প্রকট। তেমনই হওয়ার কথা। এখানে দিয়াশলাইয়ের বাঙ্রে মতো কিছু দালান, তাতে ছোট ছোট কোঠা, তার মধ্যে ক্লাসরুম। সকাল ৮টায় এসে বেঞ্চে বা চেয়ারে শিশুটি যে বসল, দুপুর ২টা বা ৩টা পর্যন্ত পা গুটিয়ে বসেই থাকল। মাঝখানে ১৫-২০ মিনিটের জন্য ব্রেক পেলেও সে সময়টুকুও খেলাধুলা করে কাটানোর কোনো উপায় নেই। কেননা স্কুলগুলোতে এখন আর কোনো মাঠ নেই, গাছ নেই, ফুল নেই, পাখি থাকার তো প্রশ্নই আসে না। এভাবে খোলামেলা থাকার যাবতীয় সুযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধু হাত-পা গুটিয়ে বাচ্চাকাচ্চারা পড়েই যাচ্ছে, লিখেই যাচ্ছে, মুখস্থ করেই যাচ্ছে। এতে বিকাশ বলে যে বস্তুটি আছে তা ক্রমেই ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। সারা দেশের প্রতিযোগিতা এসে জমাট বেঁধেছে রাজধানীতে, সুযোগ-সুবিধাহীন স্কুল গণ্ডায় গণ্ডায় রাজধানীতে গড়ে উঠছে, চূড়ান্ত পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য শিশুদের ওপর ক্রমেই চাপ বাড়ছে। সেই চাপের ফলে শিশুমন একেবারেই চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে, শিশুর শরীর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আমরা ক্রমেই সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির দিকে যাত্রা করছি। শিশুদের মধ্যে সৃজনশীলতা যদি ক্ষয় হতে থাকে, জরিপে যেমনটা দেখা যাচ্ছে, তাহলে তারা সৃজনশীল পদ্ধতির দিকে এগোবে কী শক্তিতে! আগে তো তার সৃজনশীল শক্তি বাড়াই, তারপর তো সৃজনশীল পথে এগোতে বলি। ঢাকাকেন্দ্রিক শিক্ষায় ঘটনাটা ঘটছে তার উল্টো। সৃজনশীল ধারণা যত ব্যাপক হচ্ছে, অন্তত পরীক্ষা গ্রাহকদের স্তরে বা পাঠ্যপুস্তক রচিতদের স্তরে, শিশুদের মধ্যে সৃজনশীল শক্তি ততই ক্ষয় হয়ে আসছে।
আমরা সুস্থ শিশু চাই দেহে ও মনে। এই স্লোগানটি মানুষের ইতিহাসের একটি অতি প্রাচীন স্লোগান। আমরা যেন ক্রমে এই স্লোগান থেকে সরে এসে একটা জবুথবু সমাজ গড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং বিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা, অভিভাবক-শিক্ষকদের চাপ যেন সেই জবুথবু হওয়াটাকেই অনিবার্য করে তুলছে। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি যাঁরা বাস্তবায়ন করবেন, তাঁরা যেন ভেবে দেখেন শিশুদের কিভাবে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করা যায়। আমাদের যে ভৌত সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান, তাতে হয়তো কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব হবে না। তবে কিছুটা পরিবর্তন আনতেই হবে। আমাদের পাঠ্যসূচিকে এবং প্রতিযোগিতাকে একটা সহনীয় স্তরে রাখতেই হবে। শিক্ষার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের ভেতরকার শক্তিকে জাগিয়ে তোলা। শিক্ষার তোড়ে যদি সে শক্তি জেগে না উঠে ঘুমিয়ে পড়তে চায়, তাহলে তো আর কোনো একটা জায়গায় গিয়ে পেঁৗছানো গেল না। এ ব্যাপারটি নিয়ে নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভাববেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
No comments