জাপান ॥ কেমন হবে শিনজো এ্যাবের নতুন যাত্রা by আহমেদ সুমন
নানা চড়াই-উৎরাই আর উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে জাপানের রাজনীতিতে শিনজো এ্যাবে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। গত এক দশক ধরে জাপানের রাজনীতিতে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি অব জাপান (ডিপিজে) পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করছে।
নাইন ইলেভেন-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা অর্থনৈতিক পরাশক্তি জাপানেও প্রভাব ফেলেছে। জনগণ তাদের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন দেখানোর জন্য এলডিপি এবং ডিপিজেকে অদল-বদল করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে। কার্যত জনগণের প্রত্যাশিত সেই ইচ্ছার প্রতিফলন এলডিপি এবং ডিপিজে কেউই দেখাতে পারছে না বলে এ দু’টি দল ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করছে। এই রকম পরিবেশ-পরিস্থিতিতে এলডিপি আবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এলডিপি নেতা শিনজো এ্যাবে ২৬ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে দেশের ১৭তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এর আগে ২০০৬-২০০৭ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। শিনজো এ্যাবের এলডিপি জাপানের নিম্নকক্ষের নির্বাচনে ৪৮০টি আসনের মধ্যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।বিশ্লেষকগণ এ্যাবের দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর পদে দায়িত্ব গ্রহণকে প্রথমবারের চেয়েও অধিকতর চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী উত্তর ফোনালাপে এ্যাবে আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার মাইলফলক হিসেবে দু’দেশের মধ্যে মৈত্রী সম্পর্ক অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। এ্যাবেকে এশীয় এবং অপরাপর দেশগুলোর উন্নত সম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি নিজে দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা, চীন ও কোরিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে কৌশলী হতে হবে। কোরিয়া এবং চীনের সঙ্গে স্পর্শকাতর সম্পর্ককে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে তাঁর জন্য চ্যালেঞ্জ হবে।
বলাই বাহুল্য যে, এক অস্থির সময়ের মধ্যে এ্যাবে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। ইয়েনের উচ্চমূল্য মানের কারণে রফতানি হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে বিগত প্রায় দুই বছর ধরে অর্থনীতির কয়েকটি ক্ষেত্রে বিপর্যয় নেমে আসে, যা ডিপিজে সরকার পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। এ কারণে ডিপিজের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীগণ ক্রিকেট খেলার ব্যাটিং ব্যর্থতার চিত্রের মতো একের পর এক আসা-যাওয়া করেছেন। বিগত বছরগুলোতে জাপানের রাজনীতিতে ক্ষমতার শীর্ষ পদে দ্রুত পালাবদলের ঘটনায় জাপানের অর্থনীতিকে বেসামাল হওয়ার যে চিত্র আমরা লক্ষ্য করছি, তার সূত্রপাত হয়েছিল এলডিপির সময়ে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পর্যায়ক্রমে শিনজো এ্যাবে, ইয়োশো ফুকুদা, জুনিচিরো কোইজুমি এবং সবশেষে তারো আসো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও ২০০৯ সালের ৩০ আগস্ট অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে দলের ভরাডুবি এড়াতে ব্যর্থ হন। নির্বাচনে বিরোধী দল ডিপিজে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে সরকার গঠন করে। ঐতিহাসিক ওই নির্বাচনে বিজয়ী নেতা ইউকিয়ো হাতোয়ামো ২০০৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেও ক্ষমতার মাত্র আট মাস বাইশ দিনের মাথায় পদত্যাগ করেন।
ডিপিজে সরকার জাপানে বেকারত্ব দূরীকরণ, চাকরিচ্যুতদের পুনঃকর্মস্থান, জনসংখ্যার ক্রম হ্রাস রোধ, স্থিতিশীল সরকার ও প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা, শিক্ষা ব্যয় হ্রাস, শিশুদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ, কৃষকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সরকারী সহযোগিতা, চাকরিজীবীদের জন্য পেনশন বৃদ্ধিসহ জনগণের প্রত্যাশা পূরণের আশ্বাস প্রদান করেছিলেন। ডিপিজে জনগণের পরিবর্তনের তাগিদ অনুভব করেছিল । জনগণের লক্ষ্য পূরণে নতুন ধরনের রাজনীতি চালু করার কথা শুনিয়েছিল। কিন্তু, ক্ষমতার বাইরে থাকলে প্রতিশ্রুতি দেয়া যত সহজ, ক্ষমতায় গিয়ে তা বাস্তবায়ন তত কঠিন। ডিপিজের কাছ থেকে আশাহত হয়ে জনগণ আবার এলডিপির দিকে ঝুঁকেছে।
এবার নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ্যাবেকে খুবই কৌশলী হতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাঁর কার্যসূচী তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও ৯ আগস্ট নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর পর থেকে জাপানের জনগণের মধ্যে মার্কিন-বিরোধী মনোভাব এখনও অটুট রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এখানে স্থাপিত বিমান ঘাঁটিতে ৪৭ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। জাপানের অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি ফুতেনমার মার্কিন বিমান ঘাঁটি প্রত্যাহারের বিষয়টিও এ্যাবে সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
লেখক : গবেষক, সহকারী পরিচালক
জনসংযোগ অফিস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments