মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে যুক্তরাষ্ট্রে কঠোর আইন
সম্প্রতি মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে ম্যাগনেটস্কি এ্যাক্ট পাস হয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট ওবামা তাতে স্বাক্ষর দিয়েছেন। কংগ্রেস ও মিডিয়ায় এই আইনটি মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে অভিনন্দিত হয়েছে।
আইনটির উদ্দেশ্য হচ্ছে ২০০৯ সালে মস্কোর একটি কারাগারে রুশ আইনজীবী সার্গেই ম্যাগনেটস্কির মৃত্যুর জন্য যেসব রুশ কর্মকর্তা দায়ী বলে সন্দেহ করা হয় তাদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ এবং এর ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। তবে বাস্তবে আইনটির পরিধি অনেক বিস্তৃত। এই আইনের সঙ্গে এখন যেসব রুশ নাগরিকের বিরুদ্ধে মানবাধিকার গুরুতর লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে তাদেরকেও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা যাবে।সমালোচকদের মতে ম্যাগনেটস্কি আইনটির দ্বারা আইনের শাসন লঙ্ঘিত হয়েছে। এটা মার্কিন মূল্যবোধের পরিপন্থী। বিশ্বের সর্বত্রই অপরাধী ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সাজা হওয়া উচিত। তবে এই আইনের যে ভাষা তাতে মার্কিন বিচারব্যবস্থার মূল শিক্ষাকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, আইনে এই ব্যবস্থা রাখা আছে যে, নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নামে যে তালিকা তৈরি হবে সেটা আইনের যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নয়, বরং এনজিও এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর বা লোকদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে করা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে এবং রাশিয়াতেও এই নতুন কালোতালিকা সম্প্রসারিত করার রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ কল্পনা করা কঠিন কিছু নয়। এর দ্বারা নির্দোষিতার পূর্বানুমান ও যথাযথ প্রক্রিয়ার মৌল নীতিমালাগুলো লঙ্ঘিতই শুধু হয়নি উপরন্তু প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য রনপলের ভাষায়, এটা সোভিয়েত যুগের গণআদালতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। গণআদালতের ক্ষেত্রে কোন সাক্ষ্যপ্রমাণের দরকার নেই বলে মনে করা হতো। পল বলেন, কংগ্রেস যদি সত্যি সত্যিই বন্দীদের মানবাধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন বোধ করে থাকে তাহলে তারা মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রাইভেট ব্রাডলি ম্যানিংয়ের ভয়াবহ আচরণ বিবেচনা করে দেখতে পারে, যে আচরণ এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভাষায় ছিল অমানবিক।
এই বিল সম্পর্কিত সিনেটের মূল সংস্করণে শুধু রাশিয়ার নয়, বরং সারা বিশ্বের সন্দেহভাজন মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের টার্গেট করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। এতে রুশবিরোধী লবিস্টরা বেশ আহতবোধ করে। তাদের প্রবল চাপে সিনেট এই বিলের প্রতিনিধি পরিষদের সংস্করণের পক্ষে ভোট দেয়। শুরু থেকে এ সংস্করণের লক্ষ্যটি এককভাবে ছিল রাশিয়া। এটাতেও আইনের শাসনের নীতিমালা লঙ্ঘিত হয়েছে। কারণ এতে সার্বজনীন ন্যায়বিচারের পরিবর্তে বাছাই করা ক্ষেত্রে ন্যায় বিচারের পরোক্ষ আহ্বান জানানো হয়েছে। স্পষ্টতই বিলের উদ্যোক্তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নীতিনিষ্ঠ ভাবনা থেকে নয়, বরং রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সরকারের প্রতি বৈরিতা দ্বারাই এই বিল পাসের ব্যাপারে অধিক চালিত হয়েছিলেন। উপরন্তু অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের যুক্তাষ্ট্রে ঢুকতে না দেয়ার এবং তাদের বেআইনীভাবে অর্জিত অর্থ সম্পদ আটক করার জন্য প্রয়োজনীয় বিধিব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাহী শাখার আগে থেকেই আছে।
বস্তুত পক্ষে মার্কিন নাগরিকরা প্রশ্ন তুলতে পারেন, এই বিলের প্রধান লবিয়িস্ট লন্ডনভিত্তিক হার্মিটেজ হেজ ফান্ডের প্রধান উইলিয়াম ব্রাউডার এখন আর মার্কিন নাগরিক নন এবং কর ফাঁকি দেয়ার সন্দেহে তাঁর নিজের বিরুদ্ধেই এখন রাশিয়ায় তদন্ত চলছে। উল্লেখ্য, হার্মিটেজ একদা অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী মস্কোভিত্তিক কোম্পানি ছিল এবং ম্যাগনেটস্কি সেই কোম্পানির কর-উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন। আমেরিকায় যেসব বিধিব্যবস্থা ও রেওয়াজ অনুসৃত হয় তাতে নিশ্চয়ই এমন কথা বলা আছে যে, কোন ব্যক্তি আইনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলে তাঁর কোন বৈষয়িক বা অন্য কোন স্বার্থ থাকা চলবে না। এক্ষেত্রে সেই শর্তটি যে অনুসৃত হয়েছে সে ব্যাপারে কি মার্কিন কংগ্রেস একান্তই নিশ্চিত ছিল?
কংগ্রেস আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও পরমাণু অস্ত্রবিস্তার রোধ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে রুশ-মার্কিন সহযোগিতা অকারণে ও হঠকারিতার সঙ্গে নস্যাত করে দিয়েছে। ম্যাগনেটস্কি বিল-এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাশিয়ার জবাবটা যদি নিত্যান্তই নির্বিষ ও লোক দেখানো মাত্র হয় তারপরও তা এই দুটি দেশকে স্নায়ুুযুদ্ধের আরও কাছাকাছি অবস্থায় নিয়ে যাবে। সে অবস্থা নিশ্চয়ই কারোর কাম্য হতে পারে না।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি আমেরিকার দৃঢ় অঙ্গীকার বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। এই অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ মূল্যবোধগুলোর স্বাক্ষর আছে। কিন্তু ম্যাগনেটস্কি বিলের ক্ষেত্রে সে ব্যাপারটা ঘটেনি। তাই সেটাকে কালো আইন বললে অত্যুক্তি হবে না।
চলমান ডেস্ক
No comments