মিল মালিক-পাইকার সখ্য, অপকৌশলে মূল্যবৃদ্ধি!- নেপথ্য কাহিনী by মিজান চৌধুরী
পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও চালের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির নেপথ্যে রয়েছে মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের মজুদদারি ও ইচ্ছেমতো মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা। সম্প্রতি সরকারের একটি সংস্থার তদনত্মে এই অপকৌশল ধরা পড়েছে।
আনত্মর্জাতিক বাজারে চালের ঘাটতির কারণে অভ্যনত্মরীণ বাজারে অধিক মূল্যের আশায় এই মজুদদারি শুরম্ন হয়েছে। বেশি মুনাফার আশায় মিল মালিকরা সরবরাহ চ্যানেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ফলে বাজারে চালের মূল্য বাড়ছে।এছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ঘাটতি থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিপুল পরিমাণ ধান ও চাল পাচারের আশঙ্কা করেছে ওই সংস্থা।
বর্তমান সরকার মতায় আসার এক মাসের মধ্যে মোটা চালের মূল্য হ্রাস পেয়ে ১৬ থেকে ১৮ টাকায় নেমে আসে। সরম্ন চালের মূল্য নিচে নেমে দাঁড়ায় ৪০ থেকে ৪২ টাকা ও মাঝারি চালের দাম নেমে আসে ৩৪ থেকে ৩৬ টাকা। কিন্তু ১৮ জানুয়ারির হিসাবে সরম্ন চালের মূল্য উঠেছে ৪৪ টাকা, মাঝারি চাল ৩৬ থেকে ৪২ টাকা ও মোটা চালের মূল্য দাঁড়ায় ২৬ থেকে ২৮ টাকায়। গত এক মাসের ব্যবধানে সরম্ন চালের মূল্য বেড়েছে ৪ দশমিক ১১ শতাংশ, মাঝারি চালের মূল্য ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ ও মোটা চালের মূল্য ১০ দশমিক ২০ শতাংশ।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারের হাতে বর্তমান ১১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন চাল মজুদ রয়েছে। পর্যাপ্ত মজুদ থাকায় চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর এই ছয় মাসে আনত্মর্জাতিক বাজার থেকে কোন চাল আমদানি করা হয়নি। এছাড়া বর্তমান চালের মৌসুম। এরপরও চালের দাম হ্রাস না পেয়ে বৃদ্ধির প্রবণতা সহনশীলতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সম্প্রতি ভারত থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্য বিষয় আলোচনার পর মোটা চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দেন।
চালের মূল্য বৃদ্ধির নেপথ্যে তদনত্মকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, চাল ব্যবসায়ীরা মূল্য বৃদ্ধির আশায় মজুদ শুরম্ন করেছে। বিশেষ করে ভারতসহ পৃথিবীর অন্যান্য চাল উৎপাদনকারী দেশে এ বছর চাল উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঘাটতি মেটাতে ভারত ৩০ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির ঘোষণা দিয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা মূল্য বৃদ্ধির আশায় মজুদদারিসহ চালের মূল্য বাড়িয়েছে। পাশাপাশি মিল মালিকরা নিজের খেয়াল খুশি মতো ধানের মজুদ গড়ে তুলছে এবং ইচ্ছেমতো চালের মূল্য বৃদ্ধি করছে। সূত্র মতে, কুষ্টিয়া, নাটোর, দিনাজপুর, নওগাঁ, দুপচাচিয়া, বগুড়া, শেরপুর, জামালপুর, রাজশাহী ও যশোর এলাকায় অসংখ্য চালকল রয়েছে। এছাড়া সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চালকল। প্রতিদিন একটি চাল কলে সর্বনিম্ন ১০ মেট্রিক টন থেকে সর্বোচ্চ এক শ' মেট্রিক টন পর্যনত্ম ধানের প্রয়োজন হয়। এই কল টিকিয়ে রাখতে মিল মালিকরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ধান ক্রয় করে মজুদ করছে। আর এই প্রতিযোগিতায় ধানের মূল্য বাড়ছে। বর্তমানে প্রতিমণ ধানের মূল্য হচ্ছে ৭২০ টাকা। এই ধানের মূল্য বৃদ্ধির কারণে চালের দামও বাড়ছে।
সংস্থার তদনত্মে জানা গেছে, চাল মিল মালিকদের ধান মজুদ করতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। কারণ ধান ক্রয়ের জন্য স্থানীয় সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন ব্যাংক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দিচ্ছে। ফলে চাল কল মালিকদের কোন আর্থিক অসুবিধা হচ্ছে না। ব্যাংক থেকে ১৩ শতাংশ হার সুদে ঋণ নিয়ে ধান ও চাল কিনে মজুদ করছে। এভাবে মজুদ করে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ হার পর্যনত্ম ধান ও চাল বিক্রি করে মিল মালিকরা মুনাফা করছে। ফলে ব্যাংক ঋণের সুদ ১৩ শতাংশ বাদেও ২০ শতাংশ পর্যনত্ম মুনাফা হচ্ছে চাল কল মালিকদের। এছাড়া ধান ও চালের মূল্য উর্ধমুখী থাকার কারণে আরও মূল্য বৃদ্ধির আশায় কৃষকপর্যায়ে ধান ও চাল কম বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে সরবরাহ চ্যানেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে বাজারে মূল্য বেড়ে যাচ্ছে।
সর্বশেষ চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসাবে শৈত্যপ্রবাহকে অনেকটা দায়ী করা হয়েছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছরে শৈতপ্রবাহ বেশি বিরাজ করছে। সূর্যের আলোর অপ্রতুলতার কারণে চালকল মালিকরা ধান শুকাতে পারছে না। এতে বাজারে সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, এ বছর বিশ্বব্যাপী ৩ শতাংশ চাল উৎপাদন কম হবে। ইএসডিএ রাইস আউটলুকের মতে, বিশ্ব্যব্যাপী পরিমাণের দিক থেকে ৪৩ কোটি মেট্রিক টন চাল উৎপাদন কম হবে। ভারতে দেড় কোটি মেট্রিক টন চাল উৎপাদন কম হবে।
No comments