একুশ শতক- নতুন প্রজন্মের জন্য অমর একুশে by মোস্তাফা জব্বার
গত উনিশ ফেব্রুয়ারি ২০১০ রাতে ইন্টারনেটের দুটি সামাজিক নেটওয়ার্ক গুগল বাজ এবং ফেসবুকে আমি আমার নিজের স্ট্যাটাসে লিখলাম, 'একুশ জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশকে।
একুশের স্বপ্ন ডিজিটাল বাংলাদেশ। আসুন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ি।' আমি স্ট্যাটাসটি লিখে পলক না ফেলতেই সাইফ হাসান নামের আমার বাজ ও ফেসবুকের এক বন্ধু প্রশ্ন করল, 'কেমন করে।' অর্থাৎ কেমন করে একুশ বাংলাদেশকে জন্ম দিয়েছে? আমাদের প্রজন্মের কোন শিৰিত মানুষ সাইফের এই প্রশ্নটি করবে না। কারণ সে একুশের অংশগ্রহণকারী না হলেও একুশের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রত্যৰদর্শী সাৰী। তার কাছে পাকিসত্মান ভাঙ্গার ইতিহাসটি পরিষ্কার। কেমন করে বায়ান্নতে আমরা ভাষা আন্দোলন করি, কেমন করে ৬৬-তে আমরা ছয় দফা আন্দোলন করি, কেমন করে আমরা ঊনসত্তরের আন্দোলন করি এবং সবশেষে সত্তরের নির্বাচনের পর কেমন করে আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধ করি সেটি আমাদের প্রজন্মের মানুষদের জানা। কিন্তু সাইফদের কাছে সেটি স্পষ্ট নয়। আমি সাইফকে চিনি। ও ঢাকা শহরের একটি স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। কম্পিউটার নিয়ে প্রচুর নাড়াচাড়া করে। বলা যায়, দিনের বেশির ভাগ সময় ফেসবুকেই কাটায়। ইন্টারনেট থাকার ফলে তার জন্য তথ্য পাওয়া কোন কঠিন বিষয় নয়। কিন্তু অবাক হবার বিষয় নয় কি যে, সে বুঝতেই পারেনি কেমন করে একুশে ফেব্রম্নয়ারি বা ভাষা আন্দোলন থেকে আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যনত্ম গেলাম।দেশের নতুন প্রজন্ম যদি এই ইতিহাসটিকে সঠিকভাবে না জানে তবে প্রতিদিন মৌলবাদীরা তাদের শেখাবে যে পাকিসত্মান আসলে ঝগড়া করে ভেঙ্গেছে এবং দুটিই ইসলামী রাষ্ট্র। বরং বলা যায় যে, জামায়াত-শিবির ও বিএনপির রাজনীতিটাই এটি। ওরা বাংলাদেশকে পাকিসত্মানী জাতীয়তার ফসল হিসেবে দেখে। একে তারা ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রচার করে এবং এই রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেৰ চরিত্রটা বহাল রাখতে চায় না। সাইফের প্রশ্ন থেকে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, আমরা আমাদের সনত্মানদের এটি জানাতে ব্যর্থ হচ্ছি যে, পাকিসত্মান একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হলেও আমরা বাংলাদেশকে একটি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছি। বহুদিন আগে ইউরোপে যে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার উদ্ভব ঘটে বাংলাদেশ একাত্তরে তাকেই এই অঞ্চলে বাসত্মবে রূপ দিয়েছে। আমাদের এই কথাটিও বলা দরকার যে, এই উপমহাদেশের অন্য দুটি দেশ এভাবে ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র নয়। এসব ইতিহাসের বিষয় এবং দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের সনত্মানদের কাছে সেই ইতিহাস নেই।
এদের ইতিহাস শেখানোর জন্যই 'মোদের গরব মোদের আশা' নামে আমার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে অনেক আগে। কাজী হাসান হাবিবের ছবি আর আমার লেখা মিলে বইটি। শিশু-কিশোরদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানানোর জন্য সচিত্র সেই বইটি চাররঙে ছাপা হয়ে প্রকাশিত হয়। যদিও এখন বইটির আর কোন সংস্করণ বাজারে নেই, তবুও ঐতিহাসিক কারণেই আমি বইটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আমাদের নতুন প্রজন্মের মানুষদের। এই একুশেই বইটির একটি ইন্টারনেট সংস্করণ প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে। ফলে যে কেউ ইন্টারনেট থেকে (িি.িনরলড়রুবশংঁযব.হবঃ) বইটি বিনামূল্যে ডাউনলোড করে নিতে পারবেন। কারণ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস না জানলে এর প্রকৃত কারণ বা আন্দোলনের চরিত্র বোঝা যাবে না। এই না বোঝার জন্যই আমরা একুশে ফেব্রম্নয়ারিকে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, আনুষ্ঠানিকতা এবং উৎসবের গ-িতে সীমিত করে ফেলেছি। কিন্তু একুশ যে আমাদের জাতিসত্তার ভিত্তি সেই কথাটি বলছি না।
আমরা আমাদের প্রজন্মের সবাই অনত্মত এটি জানি যে, একুশের সঙ্গে একেবারে সরাসরি যার সম্পর্ক আছে সেটি হচ্ছে আমাদের বাংলা ভাষার। পাকিসত্মানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাঙালীর মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিসত্মানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতেই ভাষা আন্দোলন শুরম্ন করি। এরই মাঝে একুশে আনত্মর্জাতিক পরিম-লে মাতৃভাষার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সেজন্যই আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, আমরা বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ (কিছুসংখ্যক উপজাতি ব্যতীত যারাও এখন বাংলা ভাষাভাষীতে পরিণত হয়েছে) বাংলা ভাষাভাষী এবং এই রাষ্ট্রটি সেই বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেই জন্ম নিয়েছে। আমি বহুজনকে দেখেছি যে, তারা এখনও পর্যনত্ম পাকিসত্মান ও বাংলাদেশের মাঝে ধর্মের একটি সমিলতা পান এবং এটি বলার চেষ্টা করেন যে, আসলে যদি অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক বঞ্চনা না থাকত তবে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। প্রধানত একাত্তরে পাকিসত্মানকে যারা সমর্থন করেছে তারা এভাবে কথা বলে। জামায়াত-শিবির এমনটি বলার চেষ্টা করে যে, দুই ভাইয়ে ঝগড়া হয়েছে এবং পাকিসত্মানী শাসকরা খারাপ বলে দেশটা টুকরো হয়ে গেছে। কেউ কেউ তো এতটা বলেন যে, সত্তরের নির্বাচনের পরে শেখ মুজিবের হাতে পাকিসত্মানের ৰমতা ছেড়ে দিলেই পাকিসত্মানটা টিকে যেত। তারা মনে করেন যে, আমরা কেবলমাত্র প্রতিবাদ করতে গিয়েই পাকিসত্মান ভেঙ্গেছি। তাদের এই ভাবনায় ঐতিহাসিক ভুল আছে। কারণ, আমরা দুই পাকিসত্মানে গৃহযুদ্ধ করিনি। বরং আমরা একটি স্বাধীন জাতিসত্তার বিকাশ ঘটিয়েছি। একাত্তরে বারবার শেখ মুজিবকে সামনে নিয়ে দুই পাকিসত্মানকে দুই প্রানত্মে রেখে একটি কনফেডারেশন গড়ে তোলার চেষ্টা কম করা হয়নি যা জাতির জনক নিজে গ্রহণ করেননি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনকার একুশে ফেব্রম্নয়ারি উদযাপনের সর্বাঙ্গের কোথাও আমাদের জাতিসত্তার বিকাশের ইতিহাসটি প্রতিফলিত হয় না। আজকাল একুশে ফেব্রম্নয়ারি মানে একটি আনুষ্ঠানিকতা বা ফর্মালিটিতে পরিণত হয়েছে। রাত ১২টা এক মিনিটে ৰমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী, প্রধান উপদেষ্টা বা সামরিক শাসক শহীদ মিনারে ফুল দেবেন এবং তারপর শহীদ মিনারে জনতার ঢল নামবে এটাই রীতি। প্রধানত সকালে বিরোধী দল ও অপেৰাকৃত দুর্বল দলগুলো এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ফুল দিতে আসে। এই কাজটি সুচারম্নরূপে সম্পন্ন করার জন্য ফুল দেবার রম্নট তৈরি করা থেকে ধোয়া মোছাও কম করা হয় না।
গত ১৯ ফেব্রম্নয়ারি ২০১০ রাতে যখন শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখনই টের পেলাম যে, একুশে সামনে এসে গেছে। শহীদ মিনারজুড়ে বাঁশের বেড়া, ফাড লাইটের আলোর লহরি, রঙের বাহার সবই আছে এখনকার শহীদ মিনারে। অনত্মত একুশে ফেব্রম্নয়ারি দুপুর পর্যনত্ম এই অবস্থাটি বহমান থাকবে। দেখলাম, রাসত্মায় সাদা রঙ দেয়া হচ্ছে মেশিনে। বাংলা সাহিত্যের কবি-সাহিত্যিকদের ছবিও দেখলাম। আমি নিশ্চিত যে, শহীদ মিনারের উল্টো দিকের দেয়ালে দেখতে পাবো চমৎকার সব বাণী উৎকীর্ণ থাকবে। লাখে লাখে মানুষ এসব দেখবে। কিন্তু আমরা কি আমাদের সঙ্গে থাকা শিশু-কিশোর বা তরম্নণকে এই কথাটি বলব যে, এই শহীদ মিনার হলো আমাদের স্বাধীনতার প্রথম সত্মম্ভ? আমরা কি তাদের বলব যে বরকত-সালামের আত্মদানই হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য রক্তদানের সূচনা?
একুশের প্রভাতে অত্যনত্ম মনোরম কিছু দৃশ্য দেখা যায় যে, ছোট ছোট শিশুরা চমৎকারভাবে পায়জামা-পাঞ্জাবি ও কালো ব্যাজ ধারণ করে নগ্ন পায়ে প্রভাতফেরিতে অংশ গ্রহণ করে এবং তাদের কচি হাতে একটি দুটি ফুল শহীদ বেদিতে অর্পণ করে। যেসব মা-বাবা এমন চমৎকার কাজটি করেন তাদের ধন্যবাদ। আমরা যদি আমাদের নতুন প্রজন্মকে এভাবে স্বহসত্মে আমাদের জাতীয় ইতিহাস, ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে না পারি তবে সেটি মোটেই শুভ ফলদায়ক হবে না। কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণ করার বিষয় হচ্ছে আমরা কি এদের ঈদের জামাতে নামাজ পড়ার জন্য যেভাবে নিয়ে যাওয়া হয় সেভাবেই নিয়ে যাই, না তাদের এই দিনটি, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত ইতিহাস, এর তাৎপর্য, গুরম্নত্ব এবং নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথাও বলি? আমরা কি কেবল তাদের ভাষা আন্দোলনের গল্প বলি, না স্বাধীনতার সঙ্গে এর যে সম্পর্ক সেটিও বলি?
আমরা আরও লৰ্য করেছি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরাও শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে বা আজিমপুর গোরস্থানে যায়। এই কর্মযজ্ঞের পাশাপাশি যদি আমরা আমাদের এই প্রজন্মকে একুশের ইতিহাস এবং তাৎপর্য তুলে ধরতে পারি তবে ওরাই নতুন করে জাতিসত্তার ভিত্তিটাকে আরও মজবুত করবে। এজন্য প্রভাতফেরির পর সংশিস্নষ্ট প্রতিষ্ঠানে আলোচনাসভা বা সেমিনারের আয়োজন করা যেতে পারে। এমনকি কোন ভাষা সৈনিককে নিয়ে গিয়ে তাদের কাছ থেকে গল্পও শোনা যেতে পারে। এর ওপর ডকুমেন্টারি দেখানো যেতে পারে বা বই বিতরণ করা যেতে পারে।
আপনারা লৰ্য করেছেন কিনা জানি না, আমরা বছরের পর বছর ধরে আলবদর-রাজাকার, আল শামস বা স্বাধীনতাবিরোধীদের কথা বলেছি বলেই আজকের নতুন প্রজন্ম এদের ঘৃণা করে। বস্তুত বিগত কয়েক বছরে এটি একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। এখন যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয় তবে তারা নুতন করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানবে এবং আমরা অনত্মত স্বাধীনতার বিপৰ শক্তির আস্ফালন থেকে মুক্তি পাব।
নতুন প্রজন্মের কাছে আরও একটি বিষয় তুলে ধরা প্রয়োজন বলে মনে করি। আমাদের দেশের জ্ঞানী-গুণী, রাজনীতিক, শিৰাবিদেরা যে অহরহ আমাদের নতুন প্রজন্মকে এই কথাটি বলে বেড়াচ্ছেন যে, ইংরেজী না জানলে দুনিয়াতে টিকে থাকা যাবে না_সেই কথাটির একটি সংশোধনীও দেয়া প্রয়োজন। বস্তুত তাদের বলতে হবে যে, মাতৃভাষা সবার আগে-সবার ওপরে। যিনি নিজের মাতৃভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন না তিনি অন্য ভাষাতেও পারদর্শী হতে পারেন না। মানুষ যে তার নিজের মাতৃভাষাতেই তার সব চিনত্মা-ভাবনা করে এবং অন্য ভাষা যে কেবল দোভাষীর কাজ করে সেটিও বলা দরকার। আমাদের সনত্মানদের তাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ভালবাসতে শেখাতে হবে। তাদের জন্য এটি বলতে হবে যে, মা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমির কোন বিকল্প কোথাও নেই। এর পাশাপাশি বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের মানুষদের কাছে তুলে ধরার জন্যও আমাদের বিশেষ কর্মসূচী গ্রহণ করা দরকার। আমরা যদি কাগুজে আর আনুষ্ঠানিকতার কারাগার থেকে একুশেকে বের করতে না পারি তবে আমাদের সনত্মানেরা আমাদের গৌরবকে তাদের মতো করে চিনতে পারবে না।
ঢাকা,১৯ ফেব্রম্নয়ারি ২০১০ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এর জনক এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর প্রবক্তা ॥ ই-মেইল ঃ সঁংঃধভধলধননধৎ@মসধরষ.পড়স, ওয়েবপেজ: িি.িনরলড়ুবশঁংযব.হবঃ
No comments