শোষকের ভীতি ভাষা আর সংস্কৃতি, আবহমান বাংলার কড়চা by ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ
হাজার বছরের বাংলার দিকে যদি দৃষ্টি ফেরানো যায়, তবে একটি সত্য স্পষ্ট হবে_ তা হচ্ছে যখনই বিদেশী শক্তি শোষণের মানসিকতায় রাজ সিংহাসনে বসেছে তখনই তারা আঘাত করেছে বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতিকে।
কারণ এদের কাছে সাংস্কৃতিক শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল। তারা জানে সবল সংস্কৃতির ধারক বাংলার মানুষের স্বাজাত্যবোধ প্রবল। প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করে তুলবে তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সাহিত্যের বাহন ভাষা। বাঙালীর সবল মাতৃভাষায় রচিত সাহিত্য তার ঐতিহ্যকে ধারণ করে। পেঁৗছে দেয় পরবতর্ী প্রজন্মের কাছে। ফলে আধিপত্যবাদী শোষকগোষ্ঠী প্রজন্মকে ঐতিহ্য বিচ্ছিন্ন রাখতে চায়। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ফমর্ুলায়। হাজার বছর ধরে বাংলার মানুষ নিজেকে মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত রেখেছে। সেই দু'হাজার খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের দিকেই বাংলার আদি বসতকারী অস্ট্রিক নিষাদ গোষ্ঠীর মানুষ আর্য আক্রমণকে ঠেকিয়ে দিয়েছিল প্রবল বীরত্বে। এদেরই উত্তরসূরি সাঁওতালরা এখনও এ মাটিতে বাস করছে। তাই পরাজয়ের কষ্টকে আড়াল করে আর্যরা তাদের গ্রন্থ বেদে নিন্দা গেয়েছে বাংলার মানুষের। বলেছে এরা বর্বর নীচুজাত। পীর ভাষায় কিচির মিচির করে কথা বলে। তাই বাংলায় প্রবেশ করেনি নীল রক্তের ধারক আর্যরা। এসব বলেও বাংলার মানুষের বীরত্বকে আড়াল করা যায়নি। কারণ এরও অনেক পরে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার ভারতের একাংশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেনাপতি সেলুকাসকে পাঠিয়েছিলেন পূর্বভারত জয়ে। সেলুকাসের কাছে অজেয় থেকে যায় বাংলা। গঙ্গারিডি রাজ্যের কথা তিনি বর্ণনা করেছেন গৌরবের সাথে। বাংলার এই রাজ্যের শৌর্য-বীর্যের কথা লিখেছেন গ্রিক ইতিহাসবিদরা। আর্যরা নিজেদের পরাজয়ের কথা আড়াল করলেও বাংলার উর্বর ভূমির লোভ ত্যাগ করতে পারেনি। তাই ৩০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে মৌর্য সম্রাটরা উত্তর বাংলা দখল করার পর সেই সূত্রে আর্যরাও বাংলায় ঢুকে পড়েছিল।বাংলা ভাষার জন্ম হয়নি তখনও, বা বলা যায় মানুষের মুখের ভাষা সাহিত্যের রূপ পায়নি। যে কাজটির সূচনা ঘটে বৌদ্ধ পালদের যুগে আট শতকে। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা বাংলা সাহিত্যের সূচনা ঘটান চর্যাপদ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। পাল রাজারা ছিলেন বাংলার মাটির ছেলে। শোষক না হয়ে তারা ছিলেন প্রজা সাধারণের প্রতিপালক। তাই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তার অবয়ব তৈরি করতে থাকে। কিন্তু ছেদ পড়ে এগারো শতকে। বাংলার শাসন মতা ছিনতাই হয়ে যায় দণি ভারতের কর্নাটকের ব্রাহ্মণ সেনা শাসকদের হাতে। পালদের সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সুবাদে সেনা অভু্যত্থান ঘটিয়ে দখল করে নেয় বাংলার সিংহাসন। এভাবে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় সেন রাজত্ব। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর প্রথম আঘাত আসে এই পর্বে। বাঙালীর সাংস্কৃতিক শক্তিজাত স্বাজাত্যবোধের প্রোপট হয়ত সেন রাজাদের অজানা ছিল না। তাই নিজেদের অন্যায় মতা দখল নিয়ে হয়ত নিজেরাই ভীত ছিল। আশঙ্কা করেছে প্রতিবাদী বাঙালীর কাছ থেকে প্রতিরোধের। এ কারণে নতুন প্রজন্মের বাঙালীকে ঐতিহ্য বিচ্ছিন্ন রাখতে চেয়েছে। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার ওপর আঘাত আসে। দেশীয় ভাষাচর্চা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। পাল আমলে চর্যাপদের মধ্যদিয়ে বাংলা সাহিত্যের যে শুভ যাত্রা হয়েছিল তা থমকে গেল সেনযুগে। শোষক চরিত্র থাকায় সেন রাজারা সবচেয়ে ভয় পেল বাঙালীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে। তাই শক্তভাবে এদেশে বর্ণপ্রথা প্রতিষ্ঠা করল। বাংলার আমজনতাকে শূদ্র অভিধায় অভিহিত করে সব ধরনের অধিকার বঞ্চিত করল। দেশীয় ভাষায় ধর্মগ্রন্থ অনুবাদও নিষিদ্ধ হলো। ব্রাহ্মণ শাসকরা ধর্মের দোহাই দিয়ে ভাগ্য বিধাতা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তারা জানে ধর্ম কখনও অমানবিক প্রথা চাপিয়ে দেয় না। তাই শাসকরা সচেষ্ট থেকেছে শূদ্র বাঙালী যাতে ধর্মগ্রন্থ পড়তে না পারে। এ কারণে বাংলায় ধর্মগ্রন্থ অনুবাদের ওপর ছিল নিষেধাজ্ঞা। অন্যদিকে সতর্ক শাসকরা সামাজিক অনুশাসন চাপিয়ে দিয়ে ঘোষণা করল সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ শূদ্র পড়লে তার স্থান হবে রৌরব নরকে।
ভাষার ওপর এই আঘাত কাটিয়ে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল বাঙালীর। রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধে সাহিত্য সৃষ্টি না করতে পেরে গুমরে মরেছে বাঙালী কবি। এসব কারণে অত্যাচারিত বাঙালী সেন শাসনের অবসান প্রার্থনা করেছে। ফলে তেরো শতকের শুরম্নতে বিদেশী আক্রমণকারী মুসলমানকে স্বাগত জানিয়েছিল বাঙালী। বাংলার মতাসীন মুসলমান সুলতানদের মধ্যে কোন ঔপনিবেশিক চরিত্র প্রকাশ পায়নি। তারা কেউ পিতৃভূমিতে ফিরে যাননি। দিলস্নীর সুলতানদের গবর্নর হয়ে বাংলায় এসেছেন। পরে স্বাধীনতা ঘোষণা করে স্বাধীন সুলতানী রাজ্য গড়েছেন। টানা দু'শ' বছর অব্যাহত থাকে এই স্বাধীনতা। বাংলার যাবতীয় উন্নয়নে শ্রম ও মেধা ব্যয় করেন সুলতানরা। সেন যুগের দেশীয় ভাষা ও সাহিত্যচর্চার বিধিনিষেধ উঠে যায় এ সময়। ফলে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো হিন্দু কবিরা সাহিত্য সৃষ্টি করতে থাকেন। মানিক চন্দ্র রাজার গান নামের এক কাব্যে লেখা আছে মুসলিম শাসন যুগের শুরম্নতেই অনুকূল অবস্থা পেয়ে শূদ্র শ্রেণীর বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ কাব্যচর্চা করে খ্যাতিমান হয়েছিলেন। এরপর শুরম্ন হয় মঙ্গল কাব্যের যুগ। বাংলা সাহিত্য তার বিকাশের ঠিকানা পেয়ে যায়। বহিরাগত মুসলমান সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু ধমর্ীয় কাব্য অনূদিত হতে থাকে। সুফিবাদের জনপ্রিয়তায় সুফিসাহিত্য আরেকটি মাত্রা যোগ করে। বাংলার সমাজ ধর্ম ও সংস্কৃতির ভূমিতে নতুন আলোড়ন নিয়ে আসেন শ্রীচৈতন্য তাঁর নব্য বৈষ্ণব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। চৈতন্য প্রভাবে রচিত হতে থাকে নানা পদাবলী আর চৈতন্যোত্তর যুগে চৈতন্য চরিত গ্রন্থ। হিন্দু কবিদের পাশাপাশি মুসলমান কবিরাও এগিয়ে আসেন। তাঁদের হাতে পুঁথি সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়। লেখা হতে থাকে প্রণয়োপাখ্যান, জীবনী সাহিত্য। বাংলা সাহিত্য বিকাশের ধারা মোগল যুগেও অব্যাহত থাকে। শিয়াদের আগমনের সূত্রে বাংলা সাহিত্যের ভা-ারে যুক্ত হতে থাকে মর্সিয়া সাহিত্য। সুফি ও বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রভাবে বিকাশ ঘটতে থাকে বাউল সাহিত্যের। রাষ্ট্র মতার বিধায়করা শোষক চরিত্রে আবিভর্ূত না হওয়ায় মধ্যযুগ এভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে মর্যাদার আসনে নিয়ে আসে।
ঔপনিবেশিক শাসক ইংরেজরা মেধাবী ও দূরদশর্ী ছিল। বিচিত্র ভাষা ও সংস্কৃতির দেশ ভারতের জনমানসকে অনুধাবন না করে রাষ্ট্রীয় নীতি বিন্যাস করতে চায়নি তারা। মানুষকে আস্থায় রেখে তারা শাসন শোষণ দুটোই করেছে। মধ্যযুগব্যাপী রাষ্ট্রভাষা ছিল ফারসি। ১৭৫৭ সালের পর ধীরে ধীরে ইংরেজদের হাতে মতা চলে এলেও তারা ফারসিকে হটিয়ে মানুষকে ুব্ধ করতে চায়নি। অপো করেছে ১৮৩৫ সাল পর্যনত্ম। সাধারণ মানুষের মধ্যে জনমত তৈরি হওয়ার পর ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করেছে। ঔপনিবেশিক যুগের ইংরেজরা উচ্চমাগর্ীয় শোষক হওয়ায় এদেশের ভাষা সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করেনি। তার চেয়েও বড় কথা ইংরেজ শাসকরা ধর্ম দিয়ে মানুষকে প্রতারিত করতে চায়নি। তবে শেষ পর্বে এসে ইংরেজবিরোধী সম্মিলিত ভারতীয় শক্তিকে দ্বিধাবিভক্ত করার জন্য তারা হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধমর্ীয় দ্বন্দ্ব তৈরি করতে কসুর করেনি।
পাকিসত্মানী শাসকদের মনসত্মাত্তি্বক সঙ্কট সেন শাসকদের মতোই ছিল। নিজেদের মধ্যে শোষক মানসিকতা থাকায় একই ধর্ম অনুসারী হলেও সাধারণ বাঙালী ভীতি কাটেনি। ফলে বিভাজনের রাজনীতি করেছে। ভয় পেয়েছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে। পাকিসত্মানী শাসকদের দশা একই। ধমর্ীয় আবহে পাকিসত্মান নামের দেশটির সৃষ্টি হয়েছে। পূর্ববাংলার মানুষও অনত্মর দিয়ে পাকিসত্মান চেয়েছে। তারাও সেস্নাগান তুলেছে 'হাত মে বিড়ি মুখ মে পান/লড়কে লেঙ্গে পাকিসত্মান।' তারপরেই স্বপ্নভঙ্গ ঘটে।
রাষ্ট্রমতার অধিকর্তা পশ্চিম পাকিসত্মানী শাসকরা বাঙালীকে আপন ভাবেনি শুরম্ন থেকেই। সেনদের মতো ধর্মের দোহাই দিয়ে শোষণ করতে চেয়েছে। আর এই শোষণকে প্রতিবাদহীন করার জন্য চেয়েছে পূর্ব পাকিসত্মানের পরবতর্ী প্রজন্মকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিচ্ছিন্ন করতে। এই উদ্দেশ্যেই শাসকচক্রের প্রথম কাজ ছিল বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানা। ভাষা বিচ্ছিন্ন হলে প্রজন্ম সাহিত্য বিচ্ছিন্ন হবে। এভাবে তাকে করা যাবে ঐতিহ্য বিচ্ছিন্ন। প্রতিবাদী হওয়ার প্রণোদনা খুঁজে পাবে না। এভাবে বাঙালীকে ঐতিহ্যের অহঙ্কার ভুলিয়ে দিয়ে একানত্ম অনুগত করতে চেয়েছে।
কিন্তু সেন শাসকদের মতো অশুভ ইচ্ছে থাকলেও ইংরেজ শোষকদের মতো মেধাবী ছিল না পশ্চিম পাকিসত্মানী শাসকরা। ফলে বুঝতে পারেনি হাজার বছর ধরে লালিত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মূল অনেক গভীরে প্রথিত। অন্যদিকে পাকিসত্মানের সিংহভাগ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা হওয়ার পর এই ঐতিহ্যপ্রেমী বাঙালী রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উদর্ুকে চাপিয়ে দিলে কেন মেনে নেবে! শোষণের ইচ্ছে প্রবল থাকায় পাকিসত্মানীরা স্থূল মেধায় বাঙালীর ঐতিহ্যের পরম্পরা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। এ কারণেই ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় পথ বেয়ে বাঙালী পেরেছিল তার অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে।
সামপ্রতিক সময়ও কি আধিপত্যবাদীরা ভাষা ও সংস্কৃতির শক্তিকে আঘাত হানছে না? এ সময় আধিপত্যবাদ রাষ্ট্রীয় গ-ি ছাড়িয়ে আনত্মর্জাতিক রূপ পেয়েছে। অর্থনৈতিক শোষণের মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে চাচ্ছে এই আধিপত্যবাদ। এখানেও শোষকের ভীতি ভাষা ও সংস্কৃতি। কারণ একটি দেশের প্রজন্ম নিজ ভাষা আর সংস্কৃতির পথ বেয়েই ঐতিহ্যগবর্ী হয়ে ওঠে। যতণ এই গর্ব তার মনে দেদীপ্যমান থাকে ততণ আধিপত্যবাদী দাঁত বসাতে পারে না। এ কারণে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর সুকৌশলে আঘাত করে। সহযোগী হিসেবে তারা তৈরি করে তাঁবেদার শ্রেণী। ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলের দাপট, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী মাধ্যমে পাঠদান বাধ্যতামূলক করা। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে বিকৃত বাংলা এবং অদ্ভুত ইংরেজীর মিশেলে খিচুড়ি ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা এ সবই হচ্ছে অশুভ থাবার বহির্প্রকাশ। এভাবে পাশ্চাত্য অনুগত একটি সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি করা হয়। এসব আনত্মর্জাতিক শক্তির ল্য হচ্ছে একটি ঐতিহ্যবাহী দেশের নতুন প্রজন্মকে ঐতিহ্য বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। এই বিভ্রানত্ম প্রজন্ম যখন রাষ্ট্র-প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্বে আসবে তখন প্রভুদের ইচ্ছে পূরণেই নিবেদিত হবে। নিজ গরিমা নিয়ে দেশটির ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে।
এ কারণে এমন চক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের আর কালপেণের সুযোগ নেই। বাংলা ভাষা ও বাঙালী সংস্কৃতিকে আপন মহিমায় ধারণ করার জন্য প্রয়োজন জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন। প্রজন্মের মধ্যে স্বাজাত্যবোধ জাগিয়ে তুলতে না পারলে দেশ ও সমাজের উন্নয়ন দুর্বৃত্ত ঘূর্ণিতে বন্দি হয়ে পড়বে।
ংযধযহধধিুলঁ@ুধযড়ড়.পড়স
No comments