‘কিভাবে যে এতটি বছর পেরিয়ে গেল by সুজা উদ্দিন, জাহানারা বেগম
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম সিকারপুরে জন্ম। তবে গ্রামের আর দশটা মেয়ের মতো নন জাহানারা। নিজেকে চিনিয়েছেন আলাদাভাবে। লেখাপড়ায় উপরে উঠতে পারেননি ঠিক, খেলাধুলায় নিজেকে নিয়ে গেছেন উঁচু আসনে।
গড়েছেন হ্যান্ডবল খেলোয়াড় হিসেবে ২৬ বছরের রেকর্ড। মেয়েদের খেলাধুলায় আসার পথে সমাজে এমনিতেই নানা বাধা, সেখানে সংগ্রাম করে খেলোয়াড়ী জীবন ছাব্বিশ বছর পূর্ণ করা বীরত্বের স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। তাঁর মা-বাবাও পেতে পারেন বীরাঙ্গনার সম্মান।আশ্চার্যের ব্যাপার হলেও মাত্র ১১ বছরে জাহানারা খেলায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন তাঁর অতি আগ্রহ থেকেই, যা একটি অজপাড়া-গাঁয়ের মেয়ের কাছে এতটা প্রত্যাশা করা যায় না। বাবা সাদেক প্রামাণিক ও মা রাহেলা বেগম ছিলেন শৌখিন। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী জাহানারকে বাধা দেননি, বরং উৎসাহ দিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন। তাঁর এতদূর আসার পেছনে যা সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে স্মরণ করেন নাটোরের সিকারপুরের জাহানারা। এজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মা-বাবার প্রতি, ‘আমার পরিবার আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। বিশেষ করে আমার মা রাহেলা বেগম ও বাবা সাদেক প্রামাণিকের অবদানই বেশি। মা-বাবা খুব শৌখিন ছিলেন। তাঁরা খেলাধুলা পছন্দ করতেন। এতদিন খেলার মধ্য থাকার পেছনে মূলত তাঁদের অবদানই বেশি।’ খেলাধুলায় আসার গল্প বলতে গিয়ে অনেকটা আবেগে জড়িয়ে পড়েন তিনি ‘ছোট থেকেই খেলাধুলা পছন্দ করতাম। যখন প্রাইমারী স্কুলে পড়ি বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন খেলায় অংশ নিতাম। ১১ বছর বয়সে আনসারের প্যারেডে যাই। সেখানে মেয়েদের খেলা দেখে এগিয়ে যাই। মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখি ও মাঝে মাঝে বল নিয়ে নাড়াচাড়া করি। বল খেলার প্রতি আমার আগ্রহ দেখে কোচ ইকবাল হোসেন আমাকে আনসারে নিয়ে আসেন। এরপর কিছুদিন প্রশিক্ষণ দেন। সেই থেকে শুরু হলো হ্যান্ডবলের হাতেখড়ি। কিভাবে যে এতটি বছর পেরিয়ে গেল, টেরও পাইনি।’ দীর্ঘ ক্যারিয়ারের জন্য কোচ, ফেডারেশন ও সতীর্থদের অবদানকে অকপটে স্বীকার করেন কীর্তিগড়া জাহানারা, ‘হ্যান্ডবল ফেডারেশনও অনেক সহযোগিতা করেছে। নিয়মিত খেলা চালু রেখেছে। কোচ ইকবাল, কামরুল ইসলাম কিরণ ও নাসিরুল্লাহ লাভলু আমাকে ভাল খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তুলতে শ্রম দিয়েছেন। যে ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারব না। সবার সহযোগিতায় কৃতী খেলোয়াড় হতে পেরেছি। আজ আমাকে ক্রীড়াঙ্গনের বেশিরভাগ লোকই চেনে। মাঝে মাঝে এটা মনে হলে সুখ লাগে।’ আনসারের হয়ে জাতীয় লীগ ও জাতীয় আসরে নিয়মিত অংশ নিয়েছেন। হয়েছেন প্রায় পনেরোবার সেরা খেলোয়াড়। আনসারের প্রতিটি চ্যাম্পিয়ন দলেরই সদস্য ছিলেন। বললেন জাহানারা। ব্যক্তিগত এসব অর্জন ছাড়াও জাতীয় দলের হয়ে বিভিন্ন দেশে গিয়ে খেলেছেন। হংকং, নেপাল, দিল্লী ও মাদ্রাজে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন। দিল্লীতে একটি টুর্নামেন্ট স্মৃতি হয়ে আছে। যেখানে বাংলাদেশ রানার্সআপ হয়েছিল। তবে খেলোয়াড় হিসেবে যথার্থ মূল্যায়ন পাননি বলে কিছুটা অনুযোগও তাঁর, ‘আমাদের দেশে খেলোয়াড়দের ঠিকমতো মূল্যাায়ন করা হয় না। মেয়েদেরও না। বিশেষ করে ভাল করলে যতটা করা দরকার, সুযোগসুবিধা দেয়া দরকার।’ ‘মেয়েদের সুযাগসুবিধা বাড়ালে এ খেলা আরও প্রসার ঘটবে। সারাদেশে হ্যান্ডবল ছড়িয়ে যাবে। যোগ করেন তিনি। লেখাপড়ায় অষ্টম শ্রেণী পার হতে পারেননি। একটাই দুঃখ তাঁর। অবশ্য আনসারে চাকরির সুবাদে ব্যবসায়ী স্বামী আবুল হোসেনের সঙ্গে সুখেই ঘর করছেন। দাম্পত্য জীবনে দুই সন্তান আছে। ১৪ বছরের ছেলে সেলিম হোসেন পড়ে নবম শ্রেণীতে। আর ১২ বছরের মেয়ে শিরিন শিলা সবে পঞ্চম শ্রেণীতে। সবমিলিয়ে ভালই আছেন জানালেন ৩৭ বছরী মহীয়সী নারী। নিজের জীবনে অপ্রাপ্তি বেশি থাকলেও হ্যান্ডবলে মনপ্রাণ দেয়া জাহানারা মনে করেন, বেশি বেশি মেয়েদের খেলায় এনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে দেশের মহিলা হ্যান্ডবলের মান আরও বাড়বে ও প্রসার ঘটবে। হ্যান্ডবল কোচ হিসেবে নতুন জীবন শুরু করার ইচ্ছাও আছে তাঁর। দীর্ঘ ক্যারিয়ারের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করা যে কারও জন্যই বেদনার। জাহানারার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে না এটাই স্বাভাবিক। গত ২ জানুয়ারি জাতীয় মহিলা হ্যান্ডবলের সেমিফাইনাল ম্যাচে আনুষ্ঠানিক অবসর নিয়ে ছাব্বিশ বছরের অভিজ্ঞতাকে বাক্সবন্দী করলেন আনসারের এ বয়স্ক খেলোয়াড়। তবে সহজেই পার করতে পারেননি বিদায় মুহূর্তটি। ম্যাচ শেষে বিদায় বেলায় সতীর্থদের হারানোর কষ্টে ও নানা স্মৃতি মনে করে চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছিল। কণ্ঠ ছিল ভারি। কথা বলতে পারছিলেন না। সতীর্থদের জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজেছেন বুকে।
No comments