কুজ্ঝটিকার চার বছর by এ কে এম শাহনাওয়াজ
বিগত বিএনপি সরকার নানাভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছিল। দলীয় সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টির অর্থ হচ্ছে, দলটির সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব তৈরি হওয়া। বিএনপি নামের দলটি সৌভাগ্যক্রমে এবং বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছিল।
অবশ্য এই জনপ্রিয়তা অর্জনের পেছনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দলান্ধ আচরণ, স্বজনপ্রীতি ও অন্যকে হেয় করে দেখার প্রবণতা অনেকটা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিএনপির সমস্যা হচ্ছে, এই দলের নেতৃস্থানীয় অনেকেই মনেপ্রাণে বিএনপি নন। নানা ঘাট থেকে আসা সুবিধাবাদী মানুষের ক্লাব যেন। যাঁদের দাপটে জিয়াউর রহমানের অনুসারী খাঁটি বিএনপিদের অবস্থান নড়বড়ে। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে অনেকটা মোড় ঘুরে যায়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের আদর্শে আগের চেয়ে অনেক বেশি পাকিস্তানপ্রীতি ছিল। নানা কারণ হয়তো এর পেছনে কাজ করেছে। এ পর্বে বিএনপির ভেতরের সুযোগসন্ধানীদের দাপট বৃদ্ধি পায়। পরিবারকেন্দ্রিকতার লোভ এরাই হয়তো খালেদা জিয়াকে ধরিয়ে দেন। তাই দুই পুত্রকেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি খালেদা জিয়া। ফলে বিএনপির শেষ শাসনকালে খালেদা জিয়ার দৃঢ় নেতৃত্ব বজায় থাকেনি। প্যারালাল সরকার হিসেবে হাওয়া ভবন সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারেক রহমান সরকারের ভেতর সরকার গড়ে তোলেন। দুর্নীতিবাজ নেতা-মন্ত্রীরা এ পর্বে হয়ে ওঠেন দুর্বিনীত। এ কারণে দুর্নীতি প্রলম্বিত করা ও আত্মরক্ষার প্রয়োজনে পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়া বিএনপি নেতৃত্বের জন্য অবধারিত ছিল। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নানা লুকোচুরি এবং আজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন ও ভুয়া ভোটার তালিকার কলঙ্ক বিএনপিকে ধারণ করতে হয়। বিএনপির নির্বাচনী দুরভিসন্ধি আতঙ্কিত করে আওয়ামী লীগকে। তাই আওয়ামী নেতৃত্ব নিজ দলীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই প্রতিরোধযুদ্ধে নামে। ফলে এক চরম বিশৃঙ্খলায় নিপতিত হয় দেশ। এর অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ায় ফখরুদ্দীন আহমদের বিশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় চলে আসে। আর এই পরিবর্তিত অবস্থায় বিএনপি নেতা-নেত্রীদের দুর্নীতির খতিয়ান সাধারণ্যে উন্মোচিত হয়।
সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিএনপির সবচেয়ে বেশি দূরত্ব তৈরি হয় এ সময়। পরিস্থিতির আনুকূল্য পেয়ে যায় আওয়ামী লীগ। মহাজোট গঠন করে নির্বাচনী যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। গণতন্ত্রপ্রিয় এ দেশের সাধারণ মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই এবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখে। মানুষ বিশ্বাস করেছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং এ সময়ের দুদকের সাঁড়াশি আক্রমণে দুর্নীতিবাজদের ত্রাহী অবস্থা ও পরিণতি দেখে রাজনীতিকদের শিক্ষা হবে। আগামীর রাজনীতি দুর্বৃত্তায়নের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পাবে। নির্বাচনী ইশতেহারে মহাজোট আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার ঘোষণা ছিল ইশতেহারে। ছিল সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করা হয়েছিল। ফলে সাধারণ মানুষ একবুক প্রত্যাশার স্বপ্ন নিয়ে মহাজোটকে বিপুল সমর্থন দেয়।
দীর্ঘ তিক্ত অভিজ্ঞতায় নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে সাধারণ মানুষ সাধারণত আস্থা রাখে না। একাংশ ভোট দেয় দলীয় বৃত্তির প্রভাবে। আর অন্য অংশ দেয় মন্দের ভালোকে। এবার অবশ্য পীড়িত বিপন্ন মানুষ অনেক বেশি সময় উপযোগী স্মার্ট নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা রাখতে চেয়েছিল। এর প্রধান কারণ সম্ভবত ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দলীয় প্রভাবযুক্ত সরকার না হওয়ায় এবং দুর্নীতি দেখে সাধারণ মানুষের মতো বিরক্ত এই সরকার যেভাবে অন্যায়ের চিত্র উন্মোচন করে, তাতে জামায়াত-বিএনপির দিক থেকে মুখ ঘুরিয়েছিল কঠিন দলন্তপ্রাণ ছাড়া সব মানুষ। বিকল্প হিসেবে তাদের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মহাজোটের দিকে তাকাতে হয়। ঠিক এ সময় লাগসই ইশতেহার উপস্থিত করে মহাজোট। বিগত একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে বিএনপি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের উদ্যোগ নেয়নি। বরং জিয়াউর রহমান এই বিচার বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। খুনিদের পুরস্কার দিয়েছিলেন। অন্যদিকে জামায়াতের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকায় বিএনপি যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে না, তা সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট ছিল। এবারই প্রথম নির্বাচনী ইশতেহারে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার কথা বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী দেশবাসী এবং প্রগতিবাদী দেশপ্রেমিক নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করে। তরুণদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার আধুনিক প্রতিশ্রুতি। সাধারণ মানুষ নিষ্কৃতি পেতে চায় সন্ত্রাস আর দুর্নীতি থেকে। সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ পেতে চায় বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রিত থাকা। এসব বাস্তবায়িত হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে দেশে। বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি ছিল মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্য দিয়ে মরচে পড়া সুবিধাবাদী রাজনীতিতে যে ঝাঁকি এসেছিল, তাতে মানুষ দিনবদলের স্লোগানকে বিশ্বাস করতে চেয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট এ কারণে বিপুল জনসমর্থন পায়। এখন বড় প্রশ্ন- এই চার বছরে ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগের কাণ্ডারিরা এই সমর্থনের মূল্য কতটা দিতে পেরেছেন বা অন্তত কতটা দিতে আন্তরিক ছিলেন!
আওয়ামী লীগ শাসনের চার বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা জনমত জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। তাতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। এমনিতেই আমাদের মতো বিপন্ন গণতন্ত্রের দেশে সরকার পরিচালক দল মেয়াদের শেষদিকে এসে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। তার মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের কঠিন দলীয়করণ চর্চা, মন্ত্রিপরিষদ ও উপদেষ্টাদের অনেকের অদক্ষতা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরকার পরিচালনায় ঠিক ছন্দ খুঁজে না পাওয়া, দলীয় সন্ত্রাস দমন করায় ব্যর্থতা, নির্বিচারে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার, অনৈতিকভাবে দলীয় অপরাধীদের মার্জনার মধ্য দিয়ে আইনের শাসনকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে না দেওয়া, শেয়ারবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এবং শেয়ারবাজার কারসাজিতে জড়িত দলীয় ক্রীড়নকদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন- ইত্যাদি সাধারণ মানুষকে চরমভাবে আহত করে।
আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় কার্যকর করে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে মানুষকে স্বস্তি দিলেও যাপিত জীবনে মানুষের কষ্ট তেমনভাবে লাঘব করতে পারেনি। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া দিকগুলোতে সরকারের সাফল্য খুবই কম। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে অনেকটা সাফল্য পেলেও এর পেছনে কুইক রেন্টালের মতো কিছু বিতর্কিত ব্যবস্থা গ্রহণ সরকারকে সমালোচিত করেছে এবং এসবের কুপ্রভাবে সাশ্রয়ী জ্বালানির প্রতিশ্রুতি পূরণ করা সম্ভব হয়নি। বরং জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের ঘন ঘন মূল্যবৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস উঠছে জনগণের। দ্রব্যমূল্য মানুষের নাগালে রাখার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি সরকার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের বদলে দুর্নীতি আওয়ামী শাসনের এই পর্বে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। গণতন্ত্র চর্চার অভাব ও অতি দলীয়করণ এবং অদক্ষতার কারণে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি অনেকটা অধরা থেকে গেছে। নানা রাগ-বিরাগ ও ক্ষুব্ধতার বশবর্তী হয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতাদের অবমূল্যায়ন করে এবং দূরে সরিয়ে দিয়ে দলীয় সংহতিকেও বিপন্ন করে তুলেছেন।
সম্ভবত আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নিজেদের শাসন ব্যর্থতা ও আসন্ন সংকটের সত্য অনুভব করতে পেরেছেন। এতে একটি অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছে সচেতন মানুষ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় ২০০৮-এ একটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়ায় এবং এই সরকারের অধীনে অনেকগুলো স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন স্বচ্ছ ও মুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ায় যেভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছিল সাধারণ মানুষ, তা ক্রমে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো সমঝোতা বৈঠক হচ্ছে না। দেখে মনে হচ্ছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য আওয়ামী লীগ মরিয়া। এর মধ্যে ডিসিদের রিটার্নিং অফিসার করার ব্যবস্থা গ্রহণ বিএনপি আমলের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এসব আচরণ গণতান্ত্রিক ধারাকে আবার বিপর্যস্ত করবে বলে মানুষের আশঙ্কা হচ্ছে।
আমরা মনে করি, সরকারের শেষ বছরে আওয়ামী লীগ ও সরকারের উচিত হবে কুজ্ঝটিকাপূর্ণ চার বছরের পথচলার পর নির্বাচনী বছরে বিভ্রান্ত না হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা। আর এভাবে স্বচ্ছ নতুন পথ রচনা করা। এত কিছুর পরও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের এই বিশ্বাস থাকা উচিত, বিএনপি নিজ কৃতকর্মের জন্য খুব সবল প্রতিপক্ষ নয়। জামায়াতের সঙ্গে বন্ধুত্ব ত্যাগ না করা পর্যন্ত নতুন প্রজন্মের বড় অংশের কাছে বিএনপি পরিত্যাজ্য হবে। দেশপ্রেমিক মানুষ অন্ধকারে ফিরে যেতে চায় না। অন্ধকারে ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছেন আওয়ামী লীগ এবং সরকারের পরিচালকরা। তাঁরা গণসমর্থনের মূল্য না দিয়ে দলীয়বৃত্তে বন্দি থেকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছেন। তাই নিজ গ্লানি মুছে ফেলার চেষ্টাটিই এখন আওয়ামী নেতৃত্বে প্রধান করণীয় হবে। অনন্যোপায় মানুষ যাতে ক্ষমা করতে পারে এবং নতুন আশাবাদ নিয়ে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া কর্তব্য। মনে রাখতে হবে, মানুষ এখন অনেক সতর্ক। মিডিয়া অনেক বেশি সবল। ইচ্ছেমতো নির্বাচন করার দিন অনেকটাই ফুরিয়ে এসেছে। তাই বিগত চার বছরের সব কুজ্ঝটিকার ধোঁয়াশামুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগ যদি গণতন্ত্রমুখী হয় এবং জনকল্যাণমুখী হওয়ার চেষ্টা করে, তবে সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাবে। নির্বাচনী বছরে এই স্বস্তিটি আওয়ামী লীগের জন্য বিশেষ জরুরি।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিএনপির সবচেয়ে বেশি দূরত্ব তৈরি হয় এ সময়। পরিস্থিতির আনুকূল্য পেয়ে যায় আওয়ামী লীগ। মহাজোট গঠন করে নির্বাচনী যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। গণতন্ত্রপ্রিয় এ দেশের সাধারণ মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই এবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখে। মানুষ বিশ্বাস করেছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং এ সময়ের দুদকের সাঁড়াশি আক্রমণে দুর্নীতিবাজদের ত্রাহী অবস্থা ও পরিণতি দেখে রাজনীতিকদের শিক্ষা হবে। আগামীর রাজনীতি দুর্বৃত্তায়নের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পাবে। নির্বাচনী ইশতেহারে মহাজোট আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার ঘোষণা ছিল ইশতেহারে। ছিল সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করা হয়েছিল। ফলে সাধারণ মানুষ একবুক প্রত্যাশার স্বপ্ন নিয়ে মহাজোটকে বিপুল সমর্থন দেয়।
দীর্ঘ তিক্ত অভিজ্ঞতায় নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে সাধারণ মানুষ সাধারণত আস্থা রাখে না। একাংশ ভোট দেয় দলীয় বৃত্তির প্রভাবে। আর অন্য অংশ দেয় মন্দের ভালোকে। এবার অবশ্য পীড়িত বিপন্ন মানুষ অনেক বেশি সময় উপযোগী স্মার্ট নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা রাখতে চেয়েছিল। এর প্রধান কারণ সম্ভবত ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দলীয় প্রভাবযুক্ত সরকার না হওয়ায় এবং দুর্নীতি দেখে সাধারণ মানুষের মতো বিরক্ত এই সরকার যেভাবে অন্যায়ের চিত্র উন্মোচন করে, তাতে জামায়াত-বিএনপির দিক থেকে মুখ ঘুরিয়েছিল কঠিন দলন্তপ্রাণ ছাড়া সব মানুষ। বিকল্প হিসেবে তাদের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মহাজোটের দিকে তাকাতে হয়। ঠিক এ সময় লাগসই ইশতেহার উপস্থিত করে মহাজোট। বিগত একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে বিএনপি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের উদ্যোগ নেয়নি। বরং জিয়াউর রহমান এই বিচার বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। খুনিদের পুরস্কার দিয়েছিলেন। অন্যদিকে জামায়াতের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকায় বিএনপি যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে না, তা সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট ছিল। এবারই প্রথম নির্বাচনী ইশতেহারে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার কথা বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী দেশবাসী এবং প্রগতিবাদী দেশপ্রেমিক নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করে। তরুণদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার আধুনিক প্রতিশ্রুতি। সাধারণ মানুষ নিষ্কৃতি পেতে চায় সন্ত্রাস আর দুর্নীতি থেকে। সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ পেতে চায় বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রিত থাকা। এসব বাস্তবায়িত হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে দেশে। বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি ছিল মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্য দিয়ে মরচে পড়া সুবিধাবাদী রাজনীতিতে যে ঝাঁকি এসেছিল, তাতে মানুষ দিনবদলের স্লোগানকে বিশ্বাস করতে চেয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট এ কারণে বিপুল জনসমর্থন পায়। এখন বড় প্রশ্ন- এই চার বছরে ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগের কাণ্ডারিরা এই সমর্থনের মূল্য কতটা দিতে পেরেছেন বা অন্তত কতটা দিতে আন্তরিক ছিলেন!
আওয়ামী লীগ শাসনের চার বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা জনমত জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। তাতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। এমনিতেই আমাদের মতো বিপন্ন গণতন্ত্রের দেশে সরকার পরিচালক দল মেয়াদের শেষদিকে এসে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। তার মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের কঠিন দলীয়করণ চর্চা, মন্ত্রিপরিষদ ও উপদেষ্টাদের অনেকের অদক্ষতা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরকার পরিচালনায় ঠিক ছন্দ খুঁজে না পাওয়া, দলীয় সন্ত্রাস দমন করায় ব্যর্থতা, নির্বিচারে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার, অনৈতিকভাবে দলীয় অপরাধীদের মার্জনার মধ্য দিয়ে আইনের শাসনকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে না দেওয়া, শেয়ারবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা এবং শেয়ারবাজার কারসাজিতে জড়িত দলীয় ক্রীড়নকদের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন- ইত্যাদি সাধারণ মানুষকে চরমভাবে আহত করে।
আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় কার্যকর করে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে মানুষকে স্বস্তি দিলেও যাপিত জীবনে মানুষের কষ্ট তেমনভাবে লাঘব করতে পারেনি। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া দিকগুলোতে সরকারের সাফল্য খুবই কম। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে অনেকটা সাফল্য পেলেও এর পেছনে কুইক রেন্টালের মতো কিছু বিতর্কিত ব্যবস্থা গ্রহণ সরকারকে সমালোচিত করেছে এবং এসবের কুপ্রভাবে সাশ্রয়ী জ্বালানির প্রতিশ্রুতি পূরণ করা সম্ভব হয়নি। বরং জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের ঘন ঘন মূল্যবৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস উঠছে জনগণের। দ্রব্যমূল্য মানুষের নাগালে রাখার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি সরকার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের বদলে দুর্নীতি আওয়ামী শাসনের এই পর্বে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। গণতন্ত্র চর্চার অভাব ও অতি দলীয়করণ এবং অদক্ষতার কারণে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি অনেকটা অধরা থেকে গেছে। নানা রাগ-বিরাগ ও ক্ষুব্ধতার বশবর্তী হয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতাদের অবমূল্যায়ন করে এবং দূরে সরিয়ে দিয়ে দলীয় সংহতিকেও বিপন্ন করে তুলেছেন।
সম্ভবত আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নিজেদের শাসন ব্যর্থতা ও আসন্ন সংকটের সত্য অনুভব করতে পেরেছেন। এতে একটি অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছে সচেতন মানুষ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় ২০০৮-এ একটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়ায় এবং এই সরকারের অধীনে অনেকগুলো স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন স্বচ্ছ ও মুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ায় যেভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছিল সাধারণ মানুষ, তা ক্রমে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো সমঝোতা বৈঠক হচ্ছে না। দেখে মনে হচ্ছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য আওয়ামী লীগ মরিয়া। এর মধ্যে ডিসিদের রিটার্নিং অফিসার করার ব্যবস্থা গ্রহণ বিএনপি আমলের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এসব আচরণ গণতান্ত্রিক ধারাকে আবার বিপর্যস্ত করবে বলে মানুষের আশঙ্কা হচ্ছে।
আমরা মনে করি, সরকারের শেষ বছরে আওয়ামী লীগ ও সরকারের উচিত হবে কুজ্ঝটিকাপূর্ণ চার বছরের পথচলার পর নির্বাচনী বছরে বিভ্রান্ত না হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা। আর এভাবে স্বচ্ছ নতুন পথ রচনা করা। এত কিছুর পরও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের এই বিশ্বাস থাকা উচিত, বিএনপি নিজ কৃতকর্মের জন্য খুব সবল প্রতিপক্ষ নয়। জামায়াতের সঙ্গে বন্ধুত্ব ত্যাগ না করা পর্যন্ত নতুন প্রজন্মের বড় অংশের কাছে বিএনপি পরিত্যাজ্য হবে। দেশপ্রেমিক মানুষ অন্ধকারে ফিরে যেতে চায় না। অন্ধকারে ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছেন আওয়ামী লীগ এবং সরকারের পরিচালকরা। তাঁরা গণসমর্থনের মূল্য না দিয়ে দলীয়বৃত্তে বন্দি থেকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছেন। তাই নিজ গ্লানি মুছে ফেলার চেষ্টাটিই এখন আওয়ামী নেতৃত্বে প্রধান করণীয় হবে। অনন্যোপায় মানুষ যাতে ক্ষমা করতে পারে এবং নতুন আশাবাদ নিয়ে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া কর্তব্য। মনে রাখতে হবে, মানুষ এখন অনেক সতর্ক। মিডিয়া অনেক বেশি সবল। ইচ্ছেমতো নির্বাচন করার দিন অনেকটাই ফুরিয়ে এসেছে। তাই বিগত চার বছরের সব কুজ্ঝটিকার ধোঁয়াশামুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগ যদি গণতন্ত্রমুখী হয় এবং জনকল্যাণমুখী হওয়ার চেষ্টা করে, তবে সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাবে। নির্বাচনী বছরে এই স্বস্তিটি আওয়ামী লীগের জন্য বিশেষ জরুরি।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments