চালের বাজারের কারসাজি ভাঙতে হবে রাজনৈতিক ব্যবস্থা দিয়ে- সংবাদ ভাষ্য
চালের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, না চালের দাম নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে; এটা এখন অনেক বড় প্রশ্ন? কারণ, এটা সত্য যে, চালের বাজারে একটা ছোট মাপের অস্থিরতা কেন যেন কাজ করছে।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'দেশে পর্যাপ্ত চাল আছে। চালের দাম নিয়ে একটি মহল যড়যন্ত্র করছে।' প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরে বোঝা যায়, চালের বাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এখন আর সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করছেন না; নিজেই চালের বাজার সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন।চালের বাজার নিয়ে সরকারকে সতর্ক হতেই হবে। তীব্র শীতের কারণে দুই সপ্তাহের মতো সময় পিছিয়ে গেছে বোরো আবাদ। তাছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারতে চাল উৎপাদন বাধাগ্রসত্ম হয়েছে খরার কারণে। প্রথমে তো খবর বের হয়েছিল, ভারত সরকারী পর্যায়ে চাল আমদানি করবে, পরে তারা সে সিদ্ধানত্ম থেকে সরে এসেছে। এমনকি তাদের কৃষিমন্ত্রী শারদ পাওয়ার মনে করেন, চাল আমদানির কোন প্রয়োজন নেই। আর তাদের বেসরকারী পর্যায়ে যা ঘটে সেখানে ব্যবসায়ীদের আমদানি-রফতানি সবটাই থাকে। এক ধরনের চাল তারা হয়ত আমদানি করে, অন্য ধরনের চাল আবার রফতানি করে। দেখা যায়, কিছু উন্নতমানের চাল তারা সব সময়ই আমদানি করে। আবার মোটা চাল সব সময়ই রফতানি করে। ভারত ছাড়া চাল উৎপাদন কম হয়েছে ফিলিপিন্সে। তবে এই দুই দেশে যতটা কম উৎপাদন হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি চাল উৎপাদন করেছে ভিয়েতনাম। এ কারণে কিছুদিন আগেও বাজার গবেষকরা মনে করেছিলেন, চালের দাম এবার খুব বেশি বাড়বে, তেমনটি এখন আর মনে করছেন না।
বিশ্ব বাজারে যে মুহূর্তে চালের দাম বাড়ার শঙ্কা কমে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, দেশে পর্যাপ্ত চাল আছে- এর পরেও চালের বাজার কেন কিছুটা অস্থির? চালের বাজারের অস্থিরতার কারণ, সরকার কতটুকু জেনেছে সেটা অবশ্য সরকার দেশবাসীকে খোলাখুলি বলেনি। খাদ্যমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে সনত্মোষজনক কোন বক্তব্য দেশের মানুষকে জানাতে পারেননি। অর্থমন্ত্রী অবশ্য তার সততার প্রমাণ রেখেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছি না। অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী একই কথা একটু দুইভাবে বলেছেন। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আমরা বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছি না আর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাজার নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীও পরোৰভাবে বললেন বাজারে সিন্ডিকেট আছে। তারা এভাবে চালের বাজার নিয়ে কারসাজি করছে।
এই বাজার সিন্ডিকেট আসলে নানানভাবে কাজ করছে। কোন কোন অর্থনীতিবিদ বলছেন, চালের বাজারে কালো টাকা নামানো হয়েছে। আবার বাসত্মবে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় চাতালে চাল নেই। চাল মজুদদারি হচ্ছে নানান কৌশলে। চালের এই মজুদদারি, চাতাল মালিকদের বিভিন্নভাবে চাল সরিয়ে ফেলা এ সংক্রানত্ম বিষয়গুলো বর্তমান সরকার সঠিকভাবে খোঁজ নিতে পারেনি। যাদের দায়িত্ব ছিল এ কাজে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যাপারে সকল তথ্য সরকারের ভেতর যাদের দায়িত্ব ছিল তারা যদি সংগ্রহ করতে পারত এবং এর বিপরীতে যে অস্ত্র প্রয়োগ করার সেটা করতে পারত; তাহলে বর্তমানের এই অস্থিরতা থাকত না। যেমন দেশের একটি বিশেষ নামের ব্যাংক মৌলবাদী একটি দলের হয়ে চালের বাজার অস্থির করার জন্য পরোৰভাবে কাজ করছে। ব্যাংকটি চালের বাজারে সব থেকে বেশি বিনিয়োগ করে। তারা এখন ওই মৌলবাদী দলটির নির্দেশে তাদের পাওনা আদায়ের নামে, ঋণ খেলাপের নামে দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে চালের গুদাম সিল করে দিয়েছে। যার ফলে চালের বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট হতে সহায়তা হচ্ছে। ওই সব গুদাম থেকে চাল বাজারে আসতে পারছে না। এই একটি রাজনৈতিক দল, একটি বিশেষ ব্যাংকই শুধু এখানে সীমাবদ্ধ নয়। আরও অনেক রাঘব বোয়াল চালের বাজার নিয়ে বসে আছে প্রশাসনের ভেতর। যে কারণে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেশের একটি অতি পুরনো শিল্প ও ব্যবসায়ী হাউস অনেক কম দামে চাল আমদানির ছাড়পত্র যোগাড় করতে পারেনি। তাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ওই সরকার কাজে লাগাতে পারেনি। বরং সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে শেষ অবধি সরকার চাল আমদানি করতে পারেনি। ফলে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চালের দাম আকাশ ছোঁয়।
বাসত্মবে এই সিন্ডিকেট অনেক শক্ত। বিশেষ করে ২০০১ থেকে ২০০৬ অবধি রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় এ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা এতটাই শিকড় ছড়িয়েছে যে, বর্তমান সরকার বিশাল রাজনৈতিক ৰমতা দিয়েও তাদের সব শিকড় টেনে তুলতে পারছে না। তারপরেও এটা ঠিক যে, চালের বাজারের এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে, চালের বাজারের অস্থিরতাকে বন্ধ করতে হলে সরকারকে রাজনৈতিক ৰমতা দিয়েই করতে হবে। এখানে সরকারকে রাজনৈতিক সিদ্ধানত্ম নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে সেই রাজনৈতিক সিদ্ধানত্ম কিছুটা নিতে দেখা যায়। যেমন_ প্রধানমন্ত্রী প্রায় একমাস আগে দেশের হতদরিদ্রদের কম টাকায় মাসে বিশ কেজি চাল দিতে কার্ড দেবার সিদ্ধানত্ম নেন। প্রথম পর্যায়ে জানা যায়, ২৫ লাখ পরিবারকে কার্ড দেয়া হবে। ঢাকা শহরের প্রতি ওয়ার্ডে ১০ হাজার পরিবার এই কার্ড পাবে। কার্ডধারীরা মাসে বিশ কেজি করে চাল ২২ টাকা দামে পাবে। ২৫ লাখ পরিবার এই কার্ড পেলে চালের বাজারের অস্থিরতা সৃষ্টির পথ কিছুটা হলেও যে বন্ধ হতো, সেটা সকলে মনে করেন। সরকারের এই সিদ্ধানত্ম ২১ ফেব্রম্নয়ারি থেকে কার্যকর হবে বলেই জানানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ২১ ফেব্রম্নয়ারি দেশের মানুষ এ কার্ড পাবে। এখন জনকণ্ঠে প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, সরকারের পৰ থেকে যাদের এই কার্ড দেবার দায়িত্ব ছিল তারা ২১ তারিখ থেকে এই কার্ড দিতে পারছে না। কার্ড দিতে না পারার কারণ সরকারের চালের অভাব নয়, সরকারের প্রশাসনিক প্রস্তুতির অভাব। বাসত্মবে যাদের ওপর কার্ড দেবার দায়িত্ব ছিল, তারা যদি কার্ড দেবার ৰেত্রে প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে; তাহলে এ দেরি হবেই। এই ২১ তারিখ তারা কার্ড দিতে পারেনি, আগামী মাসের ২১ তারিখ এমনকি বোরো উঠে গেলেও কোন একুশ তারিখে তারা কার্ড দিতে পারবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, আমাদের প্রশাসনের ইতিহাসে খুব কমই দৃষ্টানত্ম আছে, তারা শীতের আগে বা শীত থাকতে শীত কাপড় পৌঁছাতে পেরেছে। বরং যেটা ইতিহাস তা হলো_ যেদিন তাপমাত্রা সব থেকে নিচে নামে ওই দিন মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন শীত কাপড়ের প্রয়োজনীয়তার ফর্দ পাঠায় উর্ধতনের কাছে। তাই প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে এই কার্ড আদৌ বিতরণ সম্ভব হবে কি-না এটা নিয়ে সংশয় জাগবে সকলের।
সরকারের যদি কার্ড সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে হয় তাহলে তাকে এটা তার রাজনৈতিক ৰমতা দিয়েই করতে হবে। তার জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে এ কার্ড পৌঁছাতে হবে। সরকার যখনই তার দলের মাধ্যমে এই কাজ করতে যাবে, তখনই এক ধরনের মিডিয়া সমালোচনা করবে। নিন্দা করবে সামরিক শাসন সমর্থনকারী তথাকথিত সুশীল সমাজ। কিন্তু এই সমালোচনা ও নিন্দার ভয় কোন রাজনৈতিক সরকারের করা উচিত নয়। বরং তাদের লৰ্য হওয়া উচিত, কত দ্রম্নত তারা এ কার্ড পৌঁছে দিয়ে দরিদ্রের ঘরে চাল পৌঁছে দিতে পারবে। এবং এখানে জনপ্রতিনিধিদেরও প্রকৃত জনপ্রতিনিধি হতে হবে। একজন এমপি তার এলাকার ওয়ার্ডে পাঁচ দিনের ভেতর কার্ড বিতরণ করার জন্য মানুষ চিহ্নিত করতে পারবেন না, এমন যারা বলেন- তারা কিন্তু প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নন, তা যত বড় নেতাই হোন না কেন। প্রকৃত জনপ্রতিনিধি এ কাজ এক ঘণ্টায় করতে পারবেন। তার কর্মীবাহিনী যেমন মানুষ চেনে তিনিও তেমনি এলাকার নাড়ির খবর রাখেন।
বাসত্মবে চালের বাজারের এই অস্থিরতা কাটাতে হলে সরকারের এর কোন বিকল্প নেই। খাদ্য মন্ত্রণালয় যদি এ কাজ না পারে প্রধানমন্ত্রী কয়েক মন্ত্রীকে দিয়ে বিশেষ কমিটি করে অবিলম্বে এ ব্যবস্থা করতে পারেন। সরকার যদি দেশের হতদরিদ্র, দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত চিহ্নিত করে তাদের কাছে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী মূল্যে এই বিকল্প পথে চাল পৌঁছাতে পারে, তাহলে দেখা যাবে, যে রাজনৈতিক শক্তি চালের বাজারের সিন্ডিকেটের পেছনে; তারা সরে আসতে বাধ্য হবে। কারণ, তখন আর চালের বাজার নিয়ে রাজনীতি করা সম্ভব হবে না। কারণ তাদের বাজার থেকে তখন সরে এসেছে দেশের দরিদ্র মানুষ। তারা তখন সরকারের কার্ডে চাল পাচ্ছেন। তাই বাজারের মাধ্যমে চালের দাম বাড়িয়ে যেমন তাদের পকেট কাটা যাবে না, তেমনি দরিদ্র মানুষকে নিয়ে খাদ্যের রাজনীতি করা যাবে না। তাই যখন চাল নিয়ে আর তাদের রাজনীতি থাকবে না তখন তারা সরে আসবেই। আর বাজার সিন্ডিকেটের পৰ থেকে যখনই রাজনৈতিক শক্তি সরে দাঁড়াবে তখনই সিন্ডিকেট ভেঙ্গে পড়বে। কারণ, এই সিন্ডিকেটের প্রাণভোমরা এক ধরনের রাজনৈতিক শক্তি। ২০০১ থেকে ২০০৬-এ রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এটা গড়ে ওঠে।
No comments