ঘন ঘন ট্রেন দুর্ঘটনা ॥ রাজধানীর অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং দায়ী!- গত ৬ মাসে ছোটবড় ৬৯ দুর্ঘটনা
ঘন ঘন ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য দায়ী রেলওয়ের সিগন্যাল বিভাগ ও চালকদের অদৰতা। বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে ভুল সিগন্যালের কারণে। অরৰিত রেল ক্রসিং পেয়ে অন্য যানবাহন চালকদের দ্রম্নত ক্রসিং পার হয়ে যাওয়ার প্রবণতা, সর্বোপরি মানুষের অসচেতনতার কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা।
রেললাইনগুলোর নিয়মিত সংস্কারের অভাবেও ট্রেন দুর্ঘটনা হচ্ছে। ট্রেন দুর্ঘটনার পর গঠিত তদনত্ম কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ হয় না। রিপোর্ট প্রকাশ হলেও দায়ীদের বিরম্নদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়াও ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। এসব কারণেই ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে। শুক্রবার রাতে মহাখালীতে ট্রেন দুর্ঘটনাও এসব কারণেই ঘটেছে। আধুনিক রেলওয়ে ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা না হলে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। বাংলাদেশ রেলওয়ের ডিজি বেলায়েত হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, রেল দুর্ঘটনার মূলকারণ আনঅথোরাইজড লেভেল ক্রসিং। এসব ক্রসিংয়ে কোন গেটম্যান নেই। যদিও এসব লেভেল ক্রসিংয়ে রেলওয়ের পৰ থেকে লিখে দেয়া হয়েছে 'নিজ দায়িত্বে পথচারী পারাপারের সাইনবোর্ড'। তবে ঢাকায় অনুমোদিত লেভেল ক্রসিংগুলোতে গেটম্যান বা বার ফেলার জন্য লোক রয়েছে। মহাখালীতে গেটম্যান বার ফেলার পরও মাইক্রোবাস চালক বার মাড়িয়ে পার হতে গিয়েই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এখানে রেলওয়ের কোন গাফিলতি ছিল না। ট্রেন তো একটা নির্দিষ্ট লাইনে চলে। যেখানেই লেভেল ক্রসিং রয়েছে সব ক্রসিংয়ে হর্ন বাজানো হয়। এরপর মানুষের ধৈর্য চু্যতির কারণে ক্রসিং পার হতে গিয়েই দুর্ঘটনার শিকার হয়। রাজধানীর লেভেল ক্রসিংগুলোর ওপর দিয়ে ওভারপাস ও ফাইওভার নির্মাণ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। স্টাফ রোড ক্রসিংয়ের ওভারপাস নির্মাণ করবে সেনা বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর, এফডিসি ও প্রগতি সরণির ওভারপাস নির্মাণ করবে রাজউক, মগবাজার, মালিবাগ, জুরাইন ও যাত্রাবাড়ীতে ফাইওবার নির্মাণ করা হবে জাইকার অর্থে।রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, অরৰিত লেভেল ক্রসিংগুলোয় জরম্নরী ভিত্তিতে লোক নিয়োগ করবে রেলওয়ে। রেলওয়ের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে ভাল কোন লোকমোটিভ (ইঞ্জিন) নেই। ১৩৮টি লোকমোটিভ রয়েছে, সেগুলোর কোন কোনটির বয়স ৫০ থেকে ৬০ বছর হয়ে গেছে। এসব লোকমোটিভের গতিও অনেক কম। এগুলো কোন রকমে মেরামত করে চালানো হচ্ছে। এই মুহূর্তে দশটি নতুন লোকমোটিভ ও অনত্মত ২৫টি কোচ না হলেই নয়। এছাড়া রেল দুর্ঘটনা এড়াতে স্থানীয় জন প্রতিনিধিরা যদি এগিয়ে আসে তাহলে অরৰিত লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার অনেকাংশে কমে যাবে। এর আগে প্রতিটি জেলায় ডিসিদের মন্ত্রণালয় থেকে রেল দুর্ঘটনা রোধে পদৰেপ নেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে। দুর্ঘটনার জন্য ট্রেন চালক ও সিগন্যাল বিভাগের অদৰতার বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে ওই সূত্র বলেছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ঈশ্বরদী ও পার্বতীপুরে রেলওয়ের উন্নতমানের ৪টি প্রশিৰণ কেন্দ্র রয়েছে। এসব প্রশিৰণ কেন্দ্রে চালক ও সিগন্যালম্যানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ধারাবাহিকভাবে প্রশিৰণ দেয়া হয়।
সূত্র জানিয়েছে, গত মাসে কম করে হলেও ১০ বড় ধরনের ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী রেলওয়ে সিগন্যাল বিভাগ। প্রতিটি দুর্ঘটনার ৰেত্রে দেখা গেছে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে। সিগন্যাল বিভাগের দায়িত্বহীন সিগন্যাল দেয়ায় দু'টি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। এখানে অন্য কোন কারণ নেই। তাছাড়া চালকদের অদৰতাও অনেক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। রেলওয়ের তিনটি নিরাপত্তা সত্মর ঠিক না থাকলে ট্রেন চলাচলে বিপত্তি ঘটবেই। এগুলো হচ্ছে ট্রেন চলাচলের লাইন যথাযথ থাকতে হবে, সিগন্যাল ব্যবস্থা সর্বৰণিক কার্যকর রাখতে হবে, এ ছাড়া সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তাদের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই তিনটি ব্যবস্থার যে কোন একটি কাজ না করলে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটবেই। রেলওয়ের কিছু কর্মকর্তা দৰতার সঙ্গে কাজ করতে চাইলেও অদৰদের কাছে তাদের জিম্মি হয়ে থাকতে হচ্ছে। একটি ট্রেন যখন স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় সেৰেত্রে কেবিন স্টেশন মাস্টার এবং পস্নাটফর্ম মাস্টারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার সময় এসব কর্মকর্তা লাইনম্যান দিয়ে ট্রেন ছাড়ার কাজটি করিয়ে থাকেন বলে অভিয়োগ রয়েছে। এদের দায়িত্ব অবহেলার জন্যও ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে।
সারাদেশে রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী সাড়ে ১২ শ' রেলক্রসিং রয়েছে। কিন্তু বাসত্মবে এই সংখ্যা ২ হাজার ৩৯২। রেলওয়ে বলছে তাদের অনুমোদিত রেলক্রসিং গেটম্যান রয়েছে। তারা ট্রেন আসা-যাওয়ার সময় ঠিকমতো ক্রসিং বার ফেলে। নিয়মানুযায়ী স্পর্শকাতর রেল ক্রসিংগুলোতে ছয়জন করে নিরাপত্তা প্রহরীকে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়। এরচেয়ে কম গুরম্নত্বপূর্ণ ক্রসিংয়ে ৩ জন করে নিরাপত্তা পহরী এবং ছোট ক্রসিংগুলোতে একজন বা দু'জন প্রহরী দায়িত্ব পালন করার কথা। কিন্তু লোকবলের অভাবে অনেক ক্রসিংয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক জনবল দেয়া সম্ভব হয়নি। আনঅথোরাইজড রেলক্রসিং রয়েছে এক হাজার ১৪২। এগুলোতে গেটম্যান দেয়নি রেলওয়ে। কারণ এগুলো মানুষ তাদের প্রয়োজনে নিজেরাই তৈরি করেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে এই রেলক্রসিং গড়ে তোলা হয়েছে। এসব ক্রসিংয়ে গেটম্যান দিতে হলে রেলওয়ের বিপুল সংখ্যক লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। গত ৬ মাসে ছোট বড় ৬৯ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৩৫ জন, আহত হয়েছে কয়েক শ' যাত্রী। নিহত আহত কাউকেও কোন ৰতিপূরণ দেয়া হয়নি।
রাজধানী ঢাকায় রেলক্রসিং রয়েছে ৩০। এসব ক্রসিংয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন গনত্মব্যে ৭২ ট্রেন ছেড়ে যায়। ট্রেনগুলোকে ৩০ ক্রসিং পার হতে হয়। এতে প্রতিটি ক্রসিংয়ে ৮ থেকে ১০ মিনিট সময় বন্ধ রাখা হয়। এতটা সময় অন্যান্য যানবাহন চালকরা বসে থাকতে চায় না। তারা ক্রসিং পার হতে গিয়েই ঘটে দুর্ঘটনা। এ ছাড়া প্রতিটি রেলক্রসিংয়ে স্বয়ংক্রিয় ঘণ্টা ও সিগন্যাল বাতি অকেজো থাকার কারণে অন্য পরিবহন চালকরা বেপরোয়া ট্রেন লাইনের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেয়।
অন্যদিকে, রেলক্রসিংগুলো নিরাপদ করতে ট্রাফিক সিস্টেমকে না বদলালে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। দেশে এখন পর্যনত্ম রেল যোগাযোগের তেমন উন্নতি হয়নি। এরপরও দেশের মানুষ রেলওয়ের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। কেননা মালামাল পরিবহন কন্টেনার সার্ভিস চালু করা, নতুন নতুন যাত্রীবাহী ট্রেন চালু করা হয়েছে। এতে ট্রেনের প্রতি মানুষের মনোযোগ বেড়েছে। কিন্তু কোনকালেই ট্রেনের উন্নতির জন্য কর্তৃপৰ কোন পদৰেপ নেয়নি। এর ফলে ঘন ঘন ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে। ঐতিহ্যবাহী এই পরিবহনটি অবহেলার মধ্য দিয়েই চলে আসছে। দুর্ঘটনা ঘটলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে কর্তৃপৰ ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং পৃথক তদনত্ম কমিটি গঠন করে দেয়া ছাড়া আর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। যত ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে তার যত তদনত্ম কমিটি গঠিত হয়েছে কোনটির তদনত্ম প্রতিবেদন প্রকাশ ও দায়ীদের বিরম্নদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দায়সারা তদনত্ম এবং নিহত আহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো ছাড়া কর্তৃপৰ আর কিছু করতে পারেনি। দেশ ও নিজেদের স্বার্থেই রেলওয়েকে সময়োপযোগী করতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে অবকাঠামোতে, বাড়াতে হবে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। রেল কর্তৃপৰকেই রেল ভ্রমণ ও মালামাল পরিবহনকে ঝুঁকিমুক্ত এবং নিরাপদ করতে হবে বলে মত দিয়েছেন।
No comments