নারী ও শিশু ধর্ষণ এর শেষ কোথায়?
দেশে নারী, শিশু ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী এসব প্রতিরোধে কিছুই করতে পারছে না বলা যায়। অধিকাংশ ঘটনায় থানায় মামলা হলেও গ্রেফতার হয় না অপরাধী।
আবার গ্রেফতার হলেও মামলা বেশিদূর এগোয় না। প্রভাবশালী বা আর্থিক আধিপত্যের ফলে মামলার তেমন অগ্রগতি হয় না। কখনওবা প্রভাবশালী-ক্ষমতাসীনদের মধ্যস্থতায় মীমাংসা করতে বাধ্য হয় নির্যাতিতরা। এ সকল কারণে ক্রমেই শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ ও হত্যার মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। ইভটিজিং নামে যৌন হয়রানি ও নারী এবং শিশু নির্যাতন-নিপীড়ন দেখার কেউ নেই। লজ্জা ও অপমানের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেন নিরূপায় নারী। কিন্তু এটাই কি সমাধান?সরকারী ও বেসরকারী হিসেব অনুযায়ী গত চার বছরে নারী নির্যাতন বেড়ে চলেছে আশঙ্কাজনক হারে। দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা যে উদ্বেগজনক তা কেবলমাত্র গত এক বছরের চিত্র থেকেই অনুধাবণ করা যায়। পুলিশ প্রশাসনের হিসেবেই গত বছর নারী নির্যাতনের ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটে ওঠে। পুলিশ সদর দফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে ২০১২ সালে সারাদেশে লিপিবদ্ধ মোট মামলার বিবেচনায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নারী নির্যাতন মামলা। গড়ে প্রতিদিন ৯.৩৩ নারী ধর্ষিত হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৯.৪৩ নারী। মানবাধিকার সংগঠনের হিসেবে এ সংখ্যা অনেক বেশি। মানবাধিকার সংগঠনের অধিকারের তথ্যমতে, ২০১২ সালের ১১ মাসে ৭৭১ নারী যৌতুকের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ২৫৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্নভাবে অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার ৪৮৫জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের পর ১০৬ নারীকে হত্যা করা হয়েছে। গণধর্ষণের শিকার ১৭৫ জন। নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন সাড়ে ৪শ’। ইভটিজিংয়ের শিকার সাড়ে ৬শ’ নারী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটে বা তাদের পরিবারের সদস্যদের আক্রমণে যথাক্রমে নিহত হয়েছেন ছয় পুরুষ এবং ৪৫ আহত ও ৩৫ লাঞ্ছিত। ৯ নারী আহত এবং ৪ লাঞ্ছিত হয়েছেন। এ সময় ৬৫১ নারী ও মেয়ে শিশু বাইরে। যাথাযথ আইন থাকলেও প্রয়োগ ক্ষেত্রে নানা ত্রুটি ও জটিলতার কারণে ধর্ষিত বিচার পান না। অনেক সময় আইন বিভাগের দীর্ঘসূত্রতার ফলেও এসব মামলার দ্রুত কোন সুরাহা হয় না। এসবের কারণে নির্যাতিত ও তার পরিবার অনেক সময় মামলা পরিচালনায় আগ্রহও হারিয়ে ফেলেন। আবার নির্যাতিত ও তার পরিবারের ঘটনা লুকানোর প্রবণতার কারণেও ধর্ষকের কোন শাস্তি হয় না। এসব কারণে ধর্ষণ ও নিপীড়ন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ধর্ষণের ঘটনা নির্মূলে ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিচারের জন্য কঠোর আইন রয়েছে। ১৯৯৬ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিশেষ বিধান আইন করা হয়। পরবর্তীতে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০০৩ সালে হলে এবং ধর্ষণের ফলে মৃত্যু ঘটলে কিংবা আহত হলে ধর্ষকদের প্রত্যেকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- এমনকি মৃত্যুদ-ও হতে পারে। পাশাপাশি অর্থদ-ও হবে। ৯ এর উপধারা ৪ অনুযায়ী নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করা হলে তার শাস্তির বিধান রয়েছে। এক্ষেত্রে ধর্ষকের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ- প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অর্থদ-েরও বিধান রয়েছে। পুলিশ হেফাজতে থাককালীন কোন নারী ধর্ষিত হলে তার জন্যও কঠিন শাস্তির উল্লেখ রয়েছে ৯-এর উপধারা ৫-এ।
আমাদের দেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ- দেয়ার বিধান রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও আইনের এমন কঠোর শাস্তির বিধান নেই। তবুও দেশে ধর্ষণ ও নিপীড়ন কোনভাবেই কমানো যাচ্ছে না বরং তা বাড়ছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে আইন প্রয়োগের অভাবকেই দায়ী করা যায়। মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুযায়ী অধিকাংশ ধর্ষণ মামলার চিত্র একই রকম। মামলা লিপিবদ্ধ হবার পর আসামি গ্রেফতার হলেও খুব সহজেই ছাড়াও পেয়ে যায়। অনেক সময় সাক্ষী ও প্রমাণের অভাবে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। আবার ঘটনার পর অপরাধী গ্রেফতার হলেও টাকা-পয়সার বিনিময়ে উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতা করতেও দেখা যায়। আসামি পক্ষ নির্যাতিতকে সামান্য ক্ষতিপূরণ দিয়েই মারাত্মক এ ধরনের অপরাধ ও শাস্তি থেকে সহজেই নিষ্কৃতি লাভ করে। বিপরীত পক্ষও আবার হয়রানি ও লোকলজ্জার কথা বিবেচনায় সমঝোতা করে নেয়। এসকল কারণে অপরাধীরা শাস্তির তো পায়-ই না, বরং এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধমূলক কাজে উৎসাহিত হয়। ফলশ্রুতিতে সমাজে বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতন ও নিপীড়ন।
দেশে কঠোর আইন থাকলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে মামলার বিচার কার্য সম্পন্ন হয় না। আইনে ৯০ দিনের মধ্যে মামলার তদন্ত সম্পন্ন করার নির্দেশ রয়েছে। ১২০ দিনের মধ্যে বিচার কাজ সম্পন্ন করার বিধান রয়েছে। কিন্তুর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়িত হয় না। আইন বিভাগের দীর্ঘসূত্রতা, আইন প্রয়োগের বিভিন্ন বাধা, জটিলতা ও প্রশাসনের অসহযোগিতা প্রভৃতি কারণ এক্ষেত্রে দায়ী বলা যায়।
আমাদের সমাজে ঘৃণ্য অপরাধে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির তেমন কোন উদাহরণ নেই। তাই অপরাধী শাস্তির ভয়ে ভীত হয় না। এ অবস্থা বেশিদিন চলতে দেয়া যায় না। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে আইনের যথাযথ কঠোর প্রয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আইনী জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দিতে হবে। তা হলেই হয়ত সমাজে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির তৈরি করা সম্ভব হবে; যা আমাদের কাছে আজ সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাবিনা ইয়াসমিন
No comments